কাসিমনানা তাড়া দিচ্ছেন, “কোথায় রে সব তোরা? জলদি চল রংসাগর পাড়ে। হাতে আর বেশি সময় নাই!”
যদিও আমি যাওয়ার জন্য প্রস্তত সেই সকাল থেকেই। নাকি এখানে আসার পর কাসিমনানার মুখে চাঁদের জন্ম দেখা ব্যাপারটা যখন থেকে শুনেছি, তখন থেকেই! তার ওপর ইদের চাঁদের জন্ম বলে কথা! কাসিমনানার তাড়ার অপেক্ষায় ছিলাম আমি! কাসিমনানা তাড়া দিতেই হই হই করে উঠলাম। কাল ইদ হবে বলে আজ ইদের চাঁদের জন্ম হবে। আর সবার সঙ্গে এখন কাসিমনানা আমাকেও রংসাগর পুকুরপাড়ে নিয়ে যাবেন। চাঁদের জন্ম দেখাবেন। আমার কী মজা! ভাবতেই আনন্দ হয় আমার।
আর সবাই বলতে আমার খালাতো-মামাতো ভাইবোনেরা। আর, কাসিমনানা হলেন আমার নানাবাড়ি ‘মিঞা মঞ্জিল’-এর অন্দরমহলের খাস লোক। মোরব্বি মানুষ। ইদ-বকরিদে রংসাগর পুকুরপাড়ে চাঁদের জন্ম দেখাতে নিয়ে যাওয়াটা নাকি তাঁর বহুদিনের কাজ! সেই তিনি যখন এই বাড়িতে রাখাল হয়ে এসেছিলেন। আমার নানা আব্দুল হাই মিঞা যখন ছিলেন তাঁর সমবয়সি। গোটা মুর্শিদাবাদ জেলার সঙ্গে এই মিঞা পাড়াও যখন আড়াই দিন পাকিস্তান হয়ে ছিল। ‘মিঞা মঞ্জিল’-এর দুয়ারের তেঁতুলগাছটার মগডালে আড়াই দিন পাকিস্তানি পতাকায় আঁকা চাঁদ-তারা আসমানে পতপত করে উড়েছিল! সেই তখন থেকে এই বাড়ির কচিকাঁচা সবাইকে রংসাগরের পাড়ে নিয়ে গিয়ে চাঁদের জন্ম দেখিয়ে আনা কাসিমনানার অন্যতম কাজ। তাছাড়া ইদ-বকরিদে চাঁদের জন্ম দেখা নাকি নেকির কাজ! হাদিসের এই কথাটা কাসিমনানা সেই তখন থেকেই ভালোরকম জানতেন। সঙ্গে তিনি এটাও জানতেন চাঁদের জন্ম একা দেখতে নেই। অন্তত দুজন সঙ্গীর দরকার হয়। সাক্ষী হিসাবে। যেখানে আজকে তাঁর সাক্ষী হিসাবে সঙ্গী আমার দু-গণ্ডা খালাতো-মামাতো ভাইবোন। তার ওপর আমি এসে জুটেছি। আমার খুব আনন্দ! এই প্রথম আমি চাঁদের জন্ম দেখব।
আমাদের নিজেদের বাড়িতে এসবের রেওয়াজ নেই। চাঁদ জন্মাল কি জন্মাল না টিভি মারফত সবাই জানতে পারে। সেই মতো কখন কোথায় কোন জামাত হবে, তাও জানা যায় টিভির খবরে। খবরের কাগজে। সেই মতো আব্বা জায়নামাজ বগল দাবা করে রেড রোড কিংবা নাখোদা মসজিদে গিয়ে ইদ-বকরিদের নামাজ পড়ে আসেন। মা কিচেনে ভালোমন্দ রান্না করেন। আর আমি ড্রয়িং-রুমে বন্দি। ইদ বলে স্কুল ছুটি। ইদ বলে বাড়িতেও পড়াশোনাও বন্ধ। অগত্যা ওই টিভি, ভিডিও গেম কিংবা কমিক্সের বই! ব্যাপারটা আমার মোটেও ভালো লাগে না। তবু ওই জীবন না মেনে উপায়ও নেই কিছু। আমরা যে নগরবাসী! আমার এসব কথা শুনে কাসিমনানা আমাকে বলেছেন, “তোরা ভাই নগরবাসী হবি কেন, তোরা হলি নরকবাসী।”
ভাগ্যিস নানী অসুস্থ হয়েছিলেন! হঠাৎ খবর গেল আমাদের বাড়িতে। নানী নাকি এমনই অসুস্থ, বাঁচবেন কিনা সন্দেহ! নানা মারা গেছেন সেই কবে! আমার ঠিক মনে পড়ে না। তবে নানার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে যা যা ঘটেছিল, মাঝে মাঝে তার বিক্ষিপ্ত কিছু দৃশ্য ভেসে ওঠে আমার মনের পর্দায়। আমি তখন স্কুল বেরোব। স্কুল-বাসের অপেক্ষা করছি। আব্বা অফিসে যাবেন। খাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ আমাদের টেলিফোনটা বেজে ওঠে। মা ফোনের রিসিভার তুলে ধরেন নিজের কানে। তারপর আর কোনও কথা বলতে পারেন না। ওই অবস্থায় মাকে নিয়ে আমি আর আব্বা গাড়ি ভাড়া করে এখানে এসেছিলাম। দেখেছিলাম ‘মিঞা মঞ্জিল’-এর দক্ষিণ বারান্দায় ধবধবে সাদা বিছানায় নানা শুয়ে আছেন। সাদা চাদরে ঢাকা তাঁর শরীর। মুখটা শুধু খোলা। নাকে কানে তুলা গোঁজা। মাথায় টুপি। চোখে চশমা। আমার মা নানার বুকে মাথা গুঁজে হিঁপিয়ে হিঁপিয়ে কাঁদছিলেন। সম্ভবত সেটাই ছিল নানার মৃত্যুর ঘটনা। তারপর আমি আর এই বাড়িতে আসিনি। নানীর অসুস্থতার খবর পেয়ে এই এবার এলাম। মায়ের সঙ্গে। তাও কতদিন পর কে জানে! তবে এসে দেখলাম এখানে আমার অনেক ভাইবোন! অনেক আত্মীয়স্বজন! নিজের নানা না থাকলেও কাসিমনানাকে পেলাম। তিনি বাড়ির আর সবার সঙ্গে আমাকেও চাঁদের জন্ম দেখাতে নিয়ে যাবেন!
এই তো কাসিমনানার সঙ্গ ধরে আমরা বেরিয়ে পড়েছি চাঁদের জন্ম দেখতে। সদর দরজা দিয়ে বেরোলেই সামনে পড়ে একটা ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছ। তার সামনে পানিতে টইটুম্বর একটা পুকুর! নাম নয়নজলি। সেই নয়নজলির উত্তর পাড় ধরে একটা সরু রাস্তা। গিয়ে উঠেছে একটা ডাঙায়। বিশাল ডাঙা। কাঁটা ঝোপ আর বাবলা গাছে ভর্তি। তার মধ্যে দিয়ে মানুষের হাঁটা পথ। সেই পথে আমরা পর পর হেঁটে চলেছি। সবার আগে আগে হাঁটছেন কাসিমনানা। তাঁর পিছু পিছু আমরা। আমি আছি তৃতীয় স্থানে। দ্বিতীয় স্থানে আমার মামাতো ভাই খাইরুল। তার হাতে একটা বেতের লাঠি। লাঠিটা নিয়ে খাইরুলভাই কী করে কে জানে! তবে এখানে আসা ইস্তক দেখছি হাতে লাঠি ছাড়া খাইরুলভাই নেই। কিংবা খাইরুলভায়ের হাত ছাড়া ওই লাঠিটা! যাই হোক, আমরা হাঁটছি পশ্চিমদিকে মুখ করে। যাব রংসাগর পুকুরপাড়ে। কোথায় সেটা, আমি জানি না। তবে রংসাগরের নাম এই ক-দিনে এতবার শুনেছি যে, সেটা যেন আমার পূর্ব পরিচিত! সবার সঙ্গে মহা আনন্দে আমি হাঁটছি সেই পুকুরের উদ্দেশ্যে। আমার পিছনে হাঁটছে খালাতো বোন মীরা। তার পেছনে মুক্তার, জিন্না, সামিমা, ফিরদৌস… ইদের চাঁদের জন্ম দেখতে যাওয়াটাই আমার কাছে এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা! খালাতো-মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে কাসিমনানা আমাকেও চাঁদের জন্ম দেখাতে নিয়ে যাচ্ছেন। আজ সত্যিই আমার খুব আনন্দের দিন! খুশির দিন!
দুই
শেষপর্যন্ত আমরা নির্দিষ্ট স্থানে এসে পৌঁছালাম। কেউ আমাকে বলে দিল না যে এটাই রংসাগর কিংবা রংসাগরের পাড়! আমি ঠিক চিনতে পারলাম। চিনতে পারলাম রংসাগরের পানিতে রঙিন ঢেউ দেখে। সে ভারী সুন্দর দৃশ্য! কিন্তু আমি তো এসব দেখতে আসিনি! আমি এসেছি ইদের চাঁদের জন্ম দেখতে। আর সেটা দেখা যাবে পশ্চিম আকাশে। কাসিমনানার নির্দেশ মতো রংসাগরের পশ্চিম পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা সবাই। আমাদের দৃষ্টি পশ্চিম আকাশে। আমাদের সামনে আদিগন্ত মাঠ। মাঠের পারে মেঘের মতো একটা গ্রাম। সেই গ্রামের কার জোড়া মাথার তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে আকাশ ছুঁয়ে। সেই জোড়া মাথার তালগাছের ওপর আমাদের তাকিয়ে থাকতে বললেন কাসিমনানা। চাঁদের জন্ম হবে নাকি ওখানেই!
আমরা তাকিয়ে আছি। জোড়া মাথার তালগাছের ডান দিক ঘেষে সূর্যটা অস্ত যাবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে। তার আগে সে তার যত রঙ সব ছড়িয়ে দিছে চরাচরে। আমাদের চোখ-মুখেও এসে লাগছে তার আভা। আমার অদ্ভুত লাগছে। বুঝতে পারছি একটু আগে রংসাগরের পানিতে রঙের যে খেলা দেখছিলাম, সেটা ওই সূর্যেরই কেরামতি। আমার আবার রংসাগরের পানির দিকে তাকাতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু তাকাতে পারি না। হঠাৎ কাসিমনানা বলে উঠলেন, “চোখ স্থির রাখিও সব। চোখের পলক যেন না পড়ে! সূর্যটা অস্ত গেলেই চাঁদটা জন্ম নেবে। তারপর সদ্যোজাত চাঁদটা ভেসে থাকবে ঠিক ওই জোড়া মাথার তালগাছের ওপর। খেয়াল থাকে যেন, সেটাও খুব বেশিক্ষণ আসমানে থাকবে না। সূর্যের পিছু পিছু সেও অস্ত যাবে ঘুমের দেশে। শিশু চাঁদ ঘুমাবে সারারাত।”
কাসিমনানার কথায় আমাদের নিজেদের মধ্যে কে প্রথম চাঁদের জন্ম দেখবে কিংবা শিশু চাঁদকে ভেসে উঠতে দেখবে, তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল যেন! আমরা পশ্চিম দিকে মুখ করে আদিগন্ত মাঠ পেরিয়ে মেঘের মতো গ্রামে সেই জোড়া তালগাছের মাথার ওপর দৃষ্টিপাত করে আছি। কাসিমনানার কথা শোনার পর আমরা প্রত্যেকেই যেন এক একটা জড়পাথর! আমাদের চোখ স্থির। আমাদের কারও পলক পড়ছে না। হৃৎপিণ্ড চলছে কিনা তাও বুঝতে পারছি না।
ওভাবে কতক্ষণ ছিলাম, কে জানে! হঠাৎ আমাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন চিৎকার করে উঠল, “ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ! চাঁদ! চাঁদ চাঁদ!”
আমরা তার চিৎকারে চমকে উঠি। যদিও আমাদের কারও মুখ থেকে কোনও কথা বের হয় না। শুধু কাসিমনানা জিজ্ঞেস করলেন, “কই? কোথায় চাঁদ?”
মুক্তার বলে উঠল, “ওই ওই তো! মুক্তার খুব উত্তেজিত। তার মানে তার চোখে পড়েছে।”
দেখাদেখি মীরা বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ। আমিও দেখতে পেয়েছি। ওই ওই তো ইদের চাঁদ!”
সবাই কিছু না কিছু বলছে। অথচ আমার মুখ থেকে কোনও কথা বেরোচ্ছে না। সদ্য জন্মানো চাঁদটাকে একে একে সবাই আবিষ্কার করছে। আনন্দে তাদের মুখ থেকে এক-এক রকমের কথা বেরোচ্ছে। কেউ বলছে, কী সুন্দর! কেউ বলছে, অপূর্ব! বলতে বলতে একজন অন্যজনকে ঘাড় ধরে দেখাচ্ছে। কিন্তু কেন জানি শুধু আমি চাঁদটাকে দেখতে পাচ্ছি না। আমার মুখ থেকে কোনও কথা বেরোচ্ছে না। সে কারণেই হয়তো কেউ আমাকে ঘাড় ধরে দেখাচ্ছেও না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। সেই কষ্টের কথা আমি কাউকে বলতে পারছি না। আমার কান্না পাচ্ছে। তবু আমার দিকে কারও কোনও খেয়াল নেই। সবাই চাঁদকে নিয়ে ব্যস্ত! কাসিমনানার সঙ্গে দোয়া পড়ে সবাই নতুন চাঁদের সঙ্গে ইদের খুশি ভাগ করে নিচ্ছে। আমি ইদের খুশির ভাগ পাচ্ছি না। আমি শুধু তাদের সবাইকে দেখে যাচ্ছি। এছাড়া আমার আর কী-ই বা করার আছে?
তিন
রাত কেটে ভোর হয়। শিশু চাঁদের ঘুম ভাঙে কি না আমি জানি না। তবে আমার ঘুম ভাঙে। আমি বিছানা ছেড়ে উঠি। রংসাগরে গিয়ে সবার সঙ্গে গোসুল করে পাক্পবিত্র হয়ে ফিরে আসি। আমার ভালো লাগে না। নতুন জামাকাপড় পরে ইদগাহে যাই। ইদের নামাজ পড়ে এসেও আমার কিছু ভালো লাগে না। অগত্যা নানীর ঘরে নানীর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ি চুপিসাড়ে। আশ্চর্য কেউ আমার খোঁজ করে না! নানী অসুস্থ ছিলেন। অথচ আজ তিনি সুস্থ! বউ-বিটিদের নিয়ে রান্নাশালে রান্নায় ব্যস্ত। কত কী যে রান্না হচ্ছে! আরও কত কী রান্না হবে! নানী নির্দেশ দিচ্ছেন। ইদ বলে কথা! আজ ‘মিঞা মঞ্জিল’-এ রান্নার শেষ নেই। আত্মীয়-কুটুমের আসা-যাওয়ার শেষ নেই। খাওয়ারও শেষ নেই। খাওয়ানোর শেষ নেই। পাল্লা দিয়ে কাসিমনানারও একটু বিশ্রাম নেই। ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে তাঁর নাজেহাল অবস্থা। বাড়ির কাজের মেয়ে যারা আছে, পটলবুবু কিংবা জামিলাবুবু— তারা সব গোসুল করে পাক্পবিত্র হলেও নতুন কাপড় পরার সময় পর্যন্ত পায়নি! আর, আমার খালাতো-মামাতো ভাইবোনেরা, তারা সব মুক্ত বিহঙ্গ! কিংবা চঞ্চল প্রজাপতি। নতুন সাজগোজে সবাই এ বাড়ি ও বাড়ি করতে করতে গোটা পাড়া উড়ে উড়ে পরিভ্রমণ করছে। ইদের খুশিতে। নানীর ঘরে একা শুয়ে শুয়ে আমি সবকিছু টের পাচ্ছি। তবু আমার কিছু ভালো লাগছে না। সবাই চাঁদ দেখলেও আমি দেখতে পাইনি। কেন দেখতে পাইনি? কেন আমার চোখে ধরা দেয়নি সে? এখানকার সবাই তার আত্মীয়, আর আমি তার কেউ নই বলে? নাকি আমি তাকে কোনোদিন দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করিনি বলে? কী করে ইচ্ছা প্রকাশ করব? আমার যেখানে বসবাস সেখানে পুরো আকাশ দেখা যায় না। জানালা দিয়ে, রেলিং থেকে যেটুকু চোখে পড়ে সেটুকু কেমন ঘোলাটে! ধোঁয়া ধোঁয়া!
চার
কখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল, বিকাল গড়িয়ে প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে আমি টের পাইনি। মনখারাপ অবস্থায় নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পটলবুবু এসে আমার ঘুম ভাঙাল চিৎকার করে, “এই দ্যাখেন কচিফুফু আপনার বেটার কীর্তি! কেমুন মরা-ঘুম ঘুমিন আছে!”
পটলবুবুর চিৎকারে মা শুধু বললেন, “ওকে উঠিয়ে নিয়ে আয় তো আমার কাছে! সারাদিন কিছু খায়ওনি বোধ হয়! বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে নিশ্চয়। কতদিন আসা হয়ে গেল! তার ওপর এখানে টিভি নেই। ভিডিও গেম নেই। কমিক্স নেই। মন খারাপ হবারই কথা। না, আর থাকা যাবে না। কাল চলে যাব। ওর আবার স্কুল কামাই হচ্ছে।”
মায়ের কথায় আমার কান্না পায়। মা আমাকে বুঝতে পারেন না। ইদের চাঁদটা যেমন আমাকে বুঝতে পারেনি! মা-ও তেমনি। আমি যে সারাদিন কিছু খাইনি, মা সেটা এতক্ষণে খেয়াল করছেন! আমার খুব অভিমান হয়। কাল সন্ধ্যায় রংসাগর পাড়ে দাঁড়িয়ে চাঁদটার ওপর যেমন অভিমান হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি অভিমান হয় আমার মায়ের ওপর। দূর ছাই, আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না!
পটলবুবু ডাকে ঘুম থেকে উঠি বটে, তবে তার সঙ্গে আমি মায়ের কাছে যাই না। নয়নজলিতে হাত-মুখ ধোব বলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসি। আশ্চর্য! তেঁতুলতলাটা একেবারে ফাঁকা। নয়নজলির ঘাটেও কেউ নেই। আমার সুবিধা হয়। আমি সবার অগোচরে নয়নজলির উত্তর পাড় ধরে বাবলা বনের ভেতর দিয়ে আনমনে হাঁটতে শুরু করি। আর একসময় পৌঁছে যাই রংসাগরের পশ্চিমপাড়ে।
নিজের অজান্তেই আমার দৃষ্টি চলে যায় পশ্চিম আকাশে। আমি দেখি আদিগন্ত মাঠ পেরিয়ে মেঘের মতো গ্রামে দাঁড়িয়ে থাকা সেই জোড়া মাথার তালগাছটিকে। কী আশ্চর্য! তালগাছটি আমার চোখে পড়লেও, সবকিছু এড়িয়ে চাঁদটা আগ বাড়িয়ে ধরা দেয় আমার চোখে। আমি তাকে দেখতে চাই না। অথচ তাকে না দেখে আমার কোনও উপায়ও থাকে না। অন্ধকার ঘনিয়ে আসে চরাচরে। সবকিছু ঢেকে যায়। শুধু চাঁদটা সুযোগ পেয়ে যায়। সে আমার মান ভাঙানোর চেষ্টা করে। সে আমাকে তার জন্মকথা শোনায়, “জানো, আমি তোমার মতোই। সবে জন্মেছি। আজ আমার বয়স মাত্র দুদিন। কেন জন্মালাম, কিছুই জানি না। আমার কী কাজ, তাও আমার অজানা। শুধু তোমার পৃথিবীটাকে আমি প্রদক্ষিণ করে যাব। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। এভাবেই আঠাশ দিন আমি বেঁচে থাকব। তারপর একদিন আমার মৃত্যু হবে। সেখানেই শেষ নয়, আমি আবার জন্মাব। ওই একই কাজের জন্য। তবে এক-একবার এক-একরকম নাম হবে আমার। যেমন এবার আমার নাম হয়েছে ইদের চাঁদ। অর্থাৎ খুশির চাঁদ। কিন্তু কোথায় খুশি? আমি নিশ্চিত সারা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে কোথাও খুশির লেশ মাত্র পাব না।”
আমি শুনি চাঁদের জন্মকথা, নাকি আমারই জন্মকথা বলে যায় চাঁদ, আমি শুনি…
অলংকরণ – সুমিত রায়
Leave a Reply