যদিও প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী চার্লি চ্যাপলিনের জন্মদিন ১৬ এপ্রিল, তবু কাগজ ঘেঁটে দেখা যায়, তারিখটা আসলে ১৫ এপ্রিল। সে তর্ক থাকুক। এসো পড়ে ফেলে যাক চ্যাপলিনকে নিয়ে কৌশিক মজুমদারের এই চমৎকার গদ্যটি। লেখাটা প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল চির সবুজ লেখা-র ২০১৬ পুজো সংখ্যায়। পরে এটা স্থান পেয়েছে কৌশিকের ‘কুড়িয়ে বাড়িয়ে’ নামক নিবন্ধ সংকলনে। টগবগ-এর অনুরোধে উনি লেখাটা আরও একবার আমাদের প্রকাশ করতে দিয়েছেন। কৌশিককে ধন্যবাদ জানাই।
– টগবগ কর্তৃপক্ষ
১৯২৮ সাল। প্রচলিত সিনেমার সব ধ্যানধারণা এক লহমায় ভেঙেচুরে হলিউডে মুক্তি পেল ‘The Jazz Singer’ ছবিটি। দর্শকরা অবাক হয়ে দেখল শুধু নড়াচড়াই নয়, পর্দার ছবিরা কথাও বলতে পারে। সব্বাইকে চমকে দিয়ে আল জনসন বলে ওঠেন, ‘Wait a minute, wait a minute, I tell yes, you ain’t heard nothing yet.’ চলচ্চিত্রে শুনতে পাওয়া প্রথম সংলাপ। জ্যাজ সিঙ্গারের সাফল্য দেখে গোটা হলিউড যেন পাগলপারা হয়ে গেল। ‘কথা-বলা ছবি’ বা ‘টকি’ বানানোর ধুম লেগে গেল চারদিকে। এমনকী যেসব ছবি নির্বাকেই তোলা হয়েছিল, তাতেও আধখ্যাঁচড়া কিছু সবাক দৃশ্য জুড়ে দেওয়া হল। আর তাদের টক্কর দিতে সম্পূর্ণ সবাক চিত্ররা বিজ্ঞাপন দিত ‘100% Talkie’। সত্যজিতের ‘যখন ছোট ছিলাম’-এও এই টকির আগমনের কথা আছে।
টকি আসাতে আর যে-ই যত খুশি হোক না কেন, ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না ছোটখাটো একটি মানুষ। তাঁর নাম চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন। চারদিক থেকে প্রচণ্ড চাপ আসতে থাকল তাঁর ওপর। ‘অনেক হয়েছে, এবার নির্বাক ছবি তৈরি বন্ধ করো, মানুষ ছুঁড়ে ফেলে দেবে নির্বাক ছবিকে। তারা সবাকের স্বাদ পেয়ে গেছে।’ কিন্তু চ্যাপলিন একগুঁয়ে। কিছুতেই তাঁর বিখ্যাত ‘ট্র্যাম্প’ চরিত্রটিকে দিয়ে কথা বলাবেন না তিনি। ‘যেদিন ও কথা বলে উঠবে, সেদিনই মৃত্যু ঘটবে ওর’— বন্ধু i¨vলফ্ বার্টনকে বারবার বলতেন তিনি। আর এই সমস্ত সবাক ছবির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তিনি ঠিক করলেন একটি ছবি বানাবেন। নির্বাক ছবি। সবার সম্মিলিত প্রতিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লেখক আর্থার জনসনের সঙ্গে মিলে ছয় হপ্তায় ছবির গল্প লিখে ফেললেন চ্যাপলিন। ঠিক করলেন ছবিতে সুরও দেবেন তিনি নিজেই। ছবির নাম ঠিক হল ‘City Lights’। চ্যাপলিন ছবির সঙ্গে কাজ শুরু করতে যাবেন, ঠিক এমন সময় মারা গেলেন তাঁর প্রিয়তম মানুষটি— তাঁর মা হানা চ্যাপলিন। মানসিকভাবে ভেঙেচুরে যাওয়া চ্যাপলিন প্রায় তিন মাস পিছিয়ে দিলেন ছবির কাজ। কাহিনিতেও সামান্য অদলবদল করলেন। নেশাড়ু মানুষটির মধ্যে নিয়ে এলেন তাঁর বাবা চার্লসের আদল আর অন্ধ ফুলওয়ালিকে গড়ে তুললেন সদ্যপ্রয়াত হানার ছায়ায়। কাহিনি একেবারে সরল। অদ্ভুত এক মিষ্টি গল্প। ভবঘুরে চ্যাপলিন শহরে ঘুরতে ঘুরতে এক বিরাট বড়লোককে আত্মহত্যা থেকে বাঁচায়। সে আবার দারুণ নেশাড়ু। নেশার ঘোরে সে চ্যাপলিনকে আপন করে নেয়, কিন্তু পরদিন সকালে নেশা কেটে যেতেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় তাকে। প্রায় প্রতিদিনই এমন ঘটে। এদিকে চ্যাপলিনের সঙ্গে দেখা হয় এক অন্ধ ফুলওয়ালির। মেয়েটি রাস্তার মোড়ে এক কোণে বসে ফুল বেচে। কোনও কারণে সে চ্যাপলিনকে বড়লোক ঠাওরায়। চ্যাপলিনও সে ভুল ভাঙায় না। সে ঠিক করে, ওই বড়লোকের থেকে টাকা এনে মেয়েটির চোখ ভালো করবে। নেশাড়ু মানুষটি চ্যাপলিনকে টাকা দেয়। চ্যাপলিন সে টাকা মেয়েটির চোখ ভালো করতে দেয়। বড়লোকটি সজ্ঞানে ফিরে এলে চ্যাপলিনকে যথারীতি চিনতে পারে না। চ্যাপলিন জেলে যায়। জেল থেকে ফিরে সে দ্যাখে মেয়েটি এখন দেখতে পায়, তার বড় ফুলের দোকান হয়েছে। কিন্তু সে তো চ্যাপলিনকে দেখেনি আগে, ফলে চিনতে পারে না। শেষে এক মোক্ষম মোচড়ে মেয়েটি বুঝতে পারে, এই সেই মানুষ, যে তাকে নতুন জীবন দিয়েছে।
১৯২৮-এর ডিসেম্বর মাস থেকে এ ছবির কাজ শুরু করেন চ্যাপলিন। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৩১ সালের ৩১ জানুয়ারি। প্রায় তিন বছর ধরে চলা এ ছবির শুটিং চ্যাপলিনের জীবনেও এক অনন্য রেকর্ড। এত বেশি দিন ধরে তিনি কোনও ছবির শুটিং করেননি। তবে এক্ষেত্রে এতদিন লাগল কেন? তা নিয়েই আমাদের গল্প। শুনলে অবাক হয়ে যেতে হয়, এই তিন বছরের মধ্যে এক বছরের বেশি সময় ধরে চ্যাপলিন ছবির মাত্র একটি দৃশ্যের শুটিং করেছেন— পর্দায় যার আয়ু এক মিনিটেরও কম। ব্যাপারটা খোলসা করেই বলি। ওই যে রাস্তার ধারে বসে থাকা ফুলওয়ালি মেয়েটি চ্যাপলিনকে বড়লোক ভাববে, সেই দৃশ্যটি কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছিল না চ্যাপলিনের নিজের কাছেই। চ্যাপলিন কোনও লিখিত চিত্রনাট্য ব্যবহার করতেন না। শুটিং স্পটে এসে নানা আইডিয়া গিজগিজ করত তাঁর মাথায়। প্রথমে ভাবলেন মেয়েটি চ্যাপলিনকে একটি ফুল কিনতে অনুরোধ করবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই ভাবলেন, খামোখা তাঁকেই বা কেন? চ্যাপলিনের অদ্ভুত একটা স্বভাব ছিল। যা মাথায় আসত, সঙ্গে সঙ্গে তাকে ক্যামেরাবন্দি করে ফেলতেন। যদিও জানতেন, শেষ পর্যন্ত ছবিতে তা থাকবে না। ফলে রাশ প্রিন্টের পরিমাণ বেড়ে যেত হু হু করে। অন্ধ মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করা ভার্জিনিয়া চেরিল অভিনয় জানতেন না। ‘এক হিসেবে ভালোই হয়েছে। আমি আমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিজের মতো করে অভিনয় শেখাই। ফলে আগে থেকে অভিনয় শিখলে তোমাকে আগে সেটা ভুলতে হত।’ বলতেন চ্যাপলিন। যা-ই হোক, যা বলছিলাম, এই ফুলওয়ালির সঙ্গে চ্যাপলিনের দেখা হওয়ার দৃশ্যটিকে পাখির চোখ করে নিয়েছিলেন তিনি। ‘এ দৃশ্যটি বিশ্বাসযোগ্য না হলে গোটা সিনেমাটাই ভুল হয়ে যাবে।’ বারবার বিড়বিড় করে বলতেন তিনি। প্রথমে ঠিক হয়, চ্যাপলিন রাস্তায় যেতে যেতে মেয়েটিকে দেখবেন, তাঁর থেকে ফুল চাইবেন, কিন্তু মেয়েটি অন্য ফুল ওঠাবে। ফলে চ্যাপলিন বুঝবেন মেয়েটি চোখে দেখতে পায় না। কিন্তু চ্যাপলিনকে মেয়েটি বড়লোক ভাববে কীভাবে? আচ্ছা, এমন যদি হয়, একজন বড়লোক চ্যাপলিনের আগে ফুল কিনলেন… তারপর চ্যাপলিন। ধুস-স্। তাতেও দাঁড়াচ্ছে না গোটা ব্যাপারটা। চ্যাপলিন অস্থির হয়ে উঠলেন। বারবার একই শট নিচ্ছেন আর মাথা ঝাঁকাচ্ছেন। পারফেকশনিস্ট চ্যাপলিন অন্য কোনও দৃশ্যের কথা ভাবতেই পারছেন না। বিরক্ত চ্যাপলিন সবার সঙ্গে রাগারাগি শুরু করলেন। হঠাৎ একটা বুদ্ধি মাথায় এল তাঁর। প্রথমে এক বড়লোক মেয়েটির থেকে ফুল কিনবে। তারপর চ্যাপলিন তার শেষ কপর্দকটি দিয়ে একটা ফুল কিনবে মেয়েটির কাছ থেকে— মেয়েটি ভাববে সেই বড়লোকটিই ফিরে এসেছে। কিন্তু শট তোলার পরই বাতিল করে দিলেন চ্যাপলিন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস শুটিং বন্ধ রইল। চ্যাপলিন আইডিয়া পাচ্ছেন না। ভার্জিনিয়া চেরিল এক সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন, ‘আমরা শুটিং করতে আসতাম। শুটিং হত না। চ্যাপলিন আসতেন না। ফলে সারাদিন বসে বই পড়া বা উল বোনা ছাড়া অন্য কাজ ছিল না।’ অতিরিক্ত চিন্তায় চ্যাপলিনের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথম ৮২ দিন শিডিউলে মাত্র ২১ দিন শুটিং হয়— তাও চ্যাপলিন বাতিল করে দেন। ১ এপ্রিল, ১৯২৯-এ চ্যাপলিন সুস্থ হয়ে আবার সেই ফুল দেবার দৃশ্যে চলে যান। আবার শুরু হয় সেই দৃশ্যের শুটিং। ৩৪১টি টেক নেওয়া হয় সেদিন। কিন্তু তারপরেও আসল ম্যাজিক, চ্যাপলিনকে বড়লোক ভাবা— অধরাই রইল। বিরক্ত চ্যাপলিন স্থির করলেন, সিনেমাটা আর বানাবেনই না। ৫৩৪ দিন শুটিং শিডিউল পেরিয়ে গেছে, কিন্তু কাজ হয়েছে মাত্র ১৬৬ দিন। ৩৬৮ দিন গোটা ইউনিট লোকেশনে এসে বসেছিল— চ্যাপলিন আসেননি।
হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে মাঝরাতে চিৎকার করে উঠে বসলেন চ্যাপলিন— ‘গাড়ির দরজার আওয়াজ! একমাত্র এইভাবেই মেয়েটি বুঝবে চ্যাপলিন বড়লোক।’ অর্থাৎ কিনা রাস্তার কোনায় মেয়েটি বসে। একটি দামি গাড়ি সামনে এসে থামবে। তার দরজা খুলে বেরিয়ে আসবেন এক ধনী ব্যক্তি। তিনি সজোরে দরজা বন্ধ করবেন। মেয়েটি বুঝবে কোনও বড়লোক খরিদ্দার এসেছে। সে তাঁকে ফুল নিতে বলবে। কিন্তু সামনে পাবে চ্যাপলিনকে। তৎক্ষণাৎ সবাইকে ফোন করে লোক পাঠিয়ে বলা হল সকাল সকাল শুটিং স্পটে চলে আসতে। আরও বেশ কয়েকশ টেক নিয়ে অবশেষে চ্যাপলিন যখন ‘ওকে’ বললেন, তখন সবাই বিধ্বস্ত— কিন্তু জন্ম হয়েছে বিশ্ব-সিনেমার অন্যতম সেরা একটি দৃশ্যের।
ভবঘুরে চ্যাপলিন হেঁটে যাচ্ছে সড়ক বেয়ে। ফুটপাথে উঠতে যাবে, এমন সময় একগাদা গাড়ি এসে পথ আটকে দাঁড়াল। এরই মধ্যে একটা খালি গাড়ির এপাশের দরজা খুলে অন্য পাশের দরজা দিয়ে বেরোল চ্যাপলিন। জোরে দরজা বন্ধ করল। সামনেই ফুল নিয়ে মেয়েটি। সে চ্যাপলিনকে বড়লোক ভেবে ফুল কিনতে অনুরোধ করে। চ্যাপলিন অন্য একটি ফুল বাছে। হাতের ধাক্কায় ফুলটি মাটিতে পড়ে যায়। চ্যাপলিন নিচু হয়ে তোলে। মেয়েটি তবু মাটি হাতড়াতে থাকে। চ্যাপলিন বোঝে মেয়েটি অন্ধ। হাত ধরে মেয়েটিকে তোলে সে। মেয়েটি চ্যাপলিনের কোটের বাটনহোলে ফুল গুঁজে দেয়। চ্যাপলিন তার হাতে গুঁজে দেয় নিজের শেষ কপর্দকটি। এমন সময় সে গাড়ির মালিক গাড়িতে চেপে দরজা বন্ধ করে। গাড়ি চলে যায়। মেয়েটি ‘স্যার আপনার চেঞ্জটা…’ বলে সেদিকে ফেরে। এবার ভবঘুরে চ্যাপলিন বুঝতে পারে মেয়েটি তাকে ধনী ঠাউরেছে। সে পা টিপে টিপে স্থান ত্যাগ করে।
হ্যাঁ, এই ছিলেন চ্যাপলিন। পর্দায় মাত্র কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্যকে বিশ্বাসযোগ্য করতে প্রাণপাত করতেন। হয়তো দর্শকরা ততটা মনোযোগ দেবেন না জেনেও। কারণ তিনিই তো একবার বলেছিলেন, ‘Comedy is really a serious business’, আর সেটা তাঁর মতো ভালো আর কে-ই বা জানত!
তথ্যসূত্র:
1. Hollywood— The Pioneer— Kevin Brownlow and John Cobal
2. Parades gone by— Kevin Brownlow
3. Charlie Chaplin— Silent Traces— John Bengston
4. The Silent Clowns— Walter Kerr
5. The Unknown Chaplin (TV Mini Series 1983)— Kevin Bronlow
Leave a Reply