“দেখেছিস বিল্টু, আকাশটা কেমন করে এসেছে, ঠিক বৃষ্টি হবে।”

 

গম্ভীর মুখ করে ভবিষ্যদ্‌বাণী করেই মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বৃষ্টি যদি সত্যি হয়, তাহলে বিল্টুর যে কত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে, তাতে কি আর মা-র কিছু যায় আসে? পাড়ার ক্রিকেট টুর্নামেন্টে বিল্টুর সেঞ্চুরি তিন রানের জন্য আটকে থাকবে। গলির মুখে লালু কুকুরকে রোজ বিকেলে গুনে গুনে পাঁচটা বিস্কুট খাওয়ায় বিল্টু, লালুর ভাগ্যে সেটা জুটবে না। বাবাকে লুকিয়ে দাদু রোজ দশ টাকা দেয় বিল্টুর হাতে, সন্দেশ কিনে আনার জন্য। তার থেকে স্বাভাবিকভাবেই বিল্টুরও ভাগ জোটে, সেটাও আজ বাদের খাতায়। কিন্তু এগুলো নেহাতই ছুটকো ব্যাপার। আসল কথা হচ্ছে যুগি সর্দার।

যুগি সর্দারের ব্যাপারটা কাউকে বলা যাবে না। বললে তার সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা তো জলে যাবেই যাবে, বিল্টুর পা দুখানাও আস্ত থাকবে কি না সন্দেহ। কত বয়স হবে যুগির, ১৮-১৯ মেরেকেটে। ফরসা রং রোদে পুড়ে তামাটে, লম্বা, রোগা টিকটিকে চেহারা। সে চেহারা যেমনই হোক, গায়ে জোর আছে বটে যুগির। শুধু কি জোর! ছেলেটার গুণও কিছু কম নেই। এই যে বিল্টুরা খেলবে বলে, চাটুজ্জেদের পড়ে থাকা ফাঁকা জমিটাকে ক্রিকেটের যোগ্য করল কে শুনি? ঘাস কেটে, রোলার চালিয়ে, চুন দিয়ে রং করে, পেয়ারা গাছের তিনটে ডাল সরু করে চেঁছে উইকেট বানিয়ে, সে অনেক কাজ। মনটাও বড় ভালো যুগির। গেল বছর পাড়ার কাকিমারা ঠাকুর বরণ করবে, এমন সময় মণ্ডপের এককোনা মচাৎ করে ভেঙে পড়ল। একেই দশমীর দিন সবার মনকেমন, তার মাঝে এই অঘটন। ঠিক স্কুলবাড়ির একটা পুরনো বেঞ্চ জোগাড় করে, মাপ মতো লাগিয়ে দিয়ে, কাকিমাদের তাতে সাবধানে তুলে দিয়ে, তবেই যুগি প্রসাদ খেতে গেল।

 

দড়াম করে পড়ার টেবিলের সামনে জানলার পাল্লাটা আছড়ে পড়ল। ঝড় এল। নাহ, খেলা আজকে হবে না। যুগির সঙ্গেও দেখা হবে না। যদিও যুগি বিল্টুর বাকি বন্ধুদের সঙ্গে খেলে না, মেশে না, কথাও বলে না। যুগি তো আসলে পকেটমার। ওর সঙ্গে আবার কীসের কথা? নেহাত সেই কবে বিল্টু আর পটলাকে পাগলা কুকুরের থেকে বাঁচিয়েছিল বলে পাড়ার কাকুরা যুগিকে রাস্তার মোড়ে থাকতে দিয়েছে। সেদিন খুব ভয় পাওয়া বিল্টুকে দাদু বুঝিয়েছিল, খারাপ কাজ করে মানেই যে লোক খারাপ, তা না। বড় অফিসে উঁচু পোস্টে যারা চাকরি করে, তারাও কেউ কেউ ঘুষ নেয়। যুগি চুরি করে ঠিকই, কিন্তু চাকরি পায়নি বলেই করে। কত বেকার ছেলেপিলে পেটের দায়ে কত কী করে। যাকগে সেসব। অনেকবার চেষ্টা করেছে বিল্টু দাদু, বাবার পকেট থেকে মানিব্যাগ সরাতে, মা-র পার্সের থেকে চুইংগাম নিতে, ঠিক ধরা পড়ে গেছে। যুগির মতো আর্টিস্ট সে হতে পারবে না কোনোদিন। অনেক বছর পেরিয়ে গেছে, স্কুলের ‘এসে’তে যাই লিখুক না কেন, বিল্টু জানে যুগি হল গিয়ে তার আসল বেস্টফ্রেন্ড।

 

এইসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে বিল্টু ছাদে উঠে এল। ছাদে এলেই বিল্টুর মন ভালো হয়ে যায়। বাড়ির গা বেয়ে যে নারকেল গাছটা উঠে গেছে, সেটার বয়স আর বিল্টুর বাবার বয়স এক। নারকেল গাছের কোনা দিয়ে গলির মুখে যুগির ছোট্ট ঘরটা দেখা যায়। লাল পরদা হাওয়ায় উড়ছে দেখলেই বিল্টু বোঝে, যুগি মেঝেতে শুয়ে কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনছে। যুগির জানলা এখনও খোলা। যা ঝড় আসছে, বেশিক্ষণ আর খোলা থাকবে না। যাকগে যাক, কালকেই না হয় দেখা হবে যুগির সঙ্গে।

 

 

কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। সকালে উঠে বিল্টু দেখল, বারান্দা অব্দি জল উঠে এসেছে। বালতি করে করে সেই জল তুলে তুলে ফেলছে বাবা। বাড়ির সামনে চাতালভর্তি ঝরা পাতা। বিন্তি মাসি সেসব বেজার মুখ করে ঝাঁট দিচ্ছে। মা নাকি বাথরুমে ব্যাঙের আওয়াজ পেয়েছে। নেহাত আজ রবিবার, নাহলে বিল্টুদের ঠিক রেনি ডে হত। স্কুল না থেকে যদিও কোনোই লাভ নেই; গুচ্ছের হোমওয়ার্ক শেষ করতে হবে। কী-ই আর করা, বিল্টু চেয়ার টেনে বসতে বসতে ভাবল, বিকেলে তো যুগির সঙ্গে দেখা হবেই। এ বাবা! এক মিনিট। যুগির বাড়ি নিশ্চয়ই জলে ভর্তি। এক ছুটে নারকেল গাছের কোনায় গেল বিল্টু। নাহ, জানলা খোলা। মনে হয় ঠিকঠাকই আছে সবকিছু।

 

দুপুরে খিচুড়ি ডিমের ওমলেট খেয়ে বিল্টু যখন শোবে শোবে করছে, তখন শুনতে পেল খবরে বলছে বৃষ্টি নিম্নচাপের আকার নেবে। বঙ্গোপসাগর থেকে ওড়িশা হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং খোদ কলকাতাতেই ঘর করবে বেশ কিছুদিন, অন্তত এক সপ্তাহ। ওমলেট খেয়ে মনের ভেতর বেশ একটা বেলুন-বেলুন ভাব এসেছিল, পুট করে চুপসে গেল। ভাল্লাগে না। এক সপ্তাহ ধরে ঝড়বাদল চলবে আকাশে, কিন্তু আসল ঝড় তো বিল্টুকেই পোয়াতে হবে। স্কুল নেই, স্কুল বাসে চিৎকার করে হিন্দি সিনেমার গান গাওয়া নেই, ফেরার পথে হজমি খাওয়া নেই, মা ঘুমিয়ে পড়লেই দৌড়ে খেলার মাঠে নেমে পড়া নেই, লুকিয়ে যুগির সঙ্গে আডডা দেওয়া নেই। ফুচকা নেই, লালুর সঙ্গে খুনসুটি নেই, দাদুর সঙ্গে ফুল তোলা নেই। কিস্‌সু নেই।

 

টুক করে দৌড়ে যুগির সঙ্গে দেখা করে আসা যায় না? খাট থেকে এক লাফে দরজা, দরজা থেকে বারান্দায় নেমেই থমকে গেল বিল্টু। জল তো এখনও থইথই করছে। এর মধ্যে দিয়ে তো যাওয়া যাবে না। চট করে স্কুলের ডায়েরির পেছনে লেখা যুগির নাম্বার দেখে ডায়াল করল বিল্টু।

‘দেখা হ্যয় পেহলি বার, সাজন কে অ্যাঁখো মে প্যার, দেখা হ্যয় পেহলি বার, সাজন কে অ্যাঁখো মে প্যার।’ চমকে গেল বিল্টু। ফোনের নামে খোঁজ নেই, এদিকে কলারটিউন লাগিয়েছে দেখ। দুবার বাজল, তিনবার বাজল, ফোন আর তোলে না। কী ব্যাপার? ছাদে একবার ঢুঁ মারবে? বাবা যদি দেখে এই বাদলা দিনে বিল্টু সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠছে, কপালে দুঃখ আছে। দেখা যাক, একটু পরে না হয় আবার চেষ্টা করবে। ধুস, মেজাজটাই চটকে গেল।

 

 

দুদিন হয়ে গেল, যুগির কোনও খবর পাওয়া যায়নি। ফোন তো ধরলই না, ছাদ থেকে বিল্টু দেখেছে যুগির জানলা বন্ধ। গতকাল বিকেলে বৃষ্টি একটু ধরেছিল, তখন হজমলা কিনতে যাওয়ার নাম করে টুক করে অপুর দোকান ঘুরে এসেছে বিল্টু। উলটোদিকেই যুগির ঘর। এত করে কড়া নাড়ল, অনেক সাহস করে জোরে জোরে ডাকল, কিন্তু সাড়া পেল না।

 

“নেই নেই, পালিয়েছে। চোর কি চুরি করে বসে থাকে? কিন্তু তুমি এখানে কী করছ বিল্টু?”

পেছন ফিরে দেখল ভুবন ডাক্তারকাকুর সেক্রেটারি প্রণবের সঙ্গে মিস্ত্রি গোছের একটা লোক। “চোর মানে?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল বিল্টু।

“চোর না তো কি, এই তো কালকে ডাক্তারবাবুর বারান্দার রেলিং সারাইতেসিলাম, দেখি করমচা গাছের নিচে উবু হয়ে লুইক্যা বইসা আসে। যেই আমি বাতি ধরাইয়া কে কে কইরা উইঠলাম, সাথে সাথে পাইলে গেল।”

“ডাক্তারবাবু তোমাদের বাড়িতেই আছেন মনে হয়। যুগির ব্যাপারে তোমার দাদুর সাথে আলোচনা করবেন। তুমি এখানে কী করছিলে বললে না তো…”

কোনোমতে প্রণবদা আর মিস্ত্রিকে কাটিয়ে বাড়ি পৌঁছল বিল্টু। বাবা, মা, দাদুর কথা শুনে বুঝল ডাক্তারকাকু এসে যা বলার বলে চলে গেছেন। ইশ, আর একটু হলেই পুরো ঘটনাটা শুনে ফেলা যেত।

 

“এইসব ছেলেছোকরাদের এই তো কাজ অণিমা, একটুও দায়িত্বজ্ঞান নেই, একটুও কৃতজ্ঞতা নেই। ডাক্তারবাবু ঠিকই বলছেন, এটা যুগিরই কাজ। আগে শুধু পকেট মারত, এখন জ্ঞান আরও বেড়েছে আর কী। ওই বকু মিস্ত্রি না দেখে ফেললে কত কী চুরি যেত কে জানে। আমার তো মনে হয় এই ক-দিন আগে যে পাশের বাড়ির ফিল্টার চুরি হল, সেটাও এরই কাজ। যাকগে, এখন থেকে ছাদের দরজাটা রাতে একবার চেক করে নেব বুঝলে তো, যা শুরু হয়েছে।”

বাবার কথায় মুখ নিচু করে নিল বিল্টু। যুগি কেন গেছিল ডাক্তারকাকুদের বাড়ি? সত্যি কি যুগি চোর? কিন্তু সে যে দুদিন ধরে তার টিকির দেখা পায়নি? নাকি ভুল শুনেছে বাবা? হয়তো চুরি-টুরি সব মিথ্যে, হয়তো গল্প পুরোই অন্য। আগের সপ্তাহে পায়ে দারুণ চোট লেগেছে যুগির। বিল্টুই মা-র ফার্স্ট এইড বক্স থেকে ব্যান্ডেজ দিল ওকে। সেই পা নিয়ে চলাই মুশকিল, পাঁচিল ডিঙিয়ে চুরি করবে কী করে? এতগুলো কথা মাথায় একসাথে ঝিঁঝি পোকার মতো ঘুরতে লাগল, কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলা যাবে না। ও যুগির সঙ্গে কথা বলে, সেটা জানলে বাবার কী অবস্থা হবে ভেবেই বিল্টুর পেট চুপসে গেল ভয়ে।

চুপচাপ উঠে গেল বিল্টু। কোনোমতে মুখহাত ধুয়ে ধপ করে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল বিল্টু।

 

“বিল্টু বাবু কি যুগি সর্দারের কথা চিন্তা করছেন?”

সর্বনাশ! মুখ তুলে দেখে এক মুখ পাকা দাড়ি আর এক গাল হাসি নিয়ে দাদু দাঁড়িয়ে।

“কী ব্যাপার, যুগির কথা ভাবছ বুঝি?” খাটে বসতে বসতে দাদু বলল, “সে আর এমন কী, বন্ধুদের কথা মাঝে মাঝেই লোকে ভাবে। এই দেখো না, আমি যেমন আমার মর্নিংওয়াকের বন্ধুদের কথা ভাবছি। কবে এই বৃষ্টিবাদল শেষ হবে, তবে আবার দেখা হবে। কখনও আবার বাংলাদেশের পুরনো বন্ধুদের কথা খুব মনে পড়ে। তাদের সাথে তো ধরো দেখাই হবে না আর কোনোদিন। তা তুমি এত মনমরা কেন দাদু?

 

কী বলছে দাদু! বিল্টু একেবারে হাঁ। দাদু যুগির কথা জানে? কে বলল দাদুকে? কই, দাদু তো রেগে নেই। তাহলে নিশ্চয়ই যুগির নতুন কাণ্ডর কথা জানে না এখনও। ও বাবা, ফাঁদ নয় তো। বিল্টু সব বলে দিল, তারপর ঠেসে কানমলা খেল।

“এতে এত ভাবার তো কিছু নেই দাদুভাই। আমি যে এককালে পুলিশ এ চাকরি করতাম, সেটা মনে রাখলেই এত ভাবতে হত না। তোমার বাবারই কি কম কাণ্ড ধরেছি আমি! সে যাকগে। এই যে তুমি রোজ করমচা খেতে খেতে স্কুল থেকে ফেরো, করমচা কোথায় পাও? এ পাড়ায় একমাত্র করমচা গাছ ডাক্তারবাবুর বাড়িতে। যার পাশেই যুগি থাকে। সেদিন চামড়ার ব্যাগটা কাটব বলে ব্লেড চাইলাম, কেউ দিতে পারল না। তুমি চট করে কোত্থেকে এক পাতলা ছুরি নিয়ে এলে, মাখনের মতো কেটে গেল। ব্যাগ কাটার ওর’ম অস্ত্র ক-টা লোকের কাছে থাকে? আচ্ছা, তুমি তো চুইংগাম খাও না, তাহলে তার সাথে ফ্রি স্টিকারগুলো পাও কোথায়? এদিকে যুগিকে দেখি সর্বক্ষণ জাবর কাটছে। দুয়ে দুয়ে চার, তিনে তিনে ছয়।”

দাদুর মুখে এখনও আবছা প্রসন্নতা দেখে স্বস্তি পেল বিল্টু।

“তুমি বাবাকে বলবে না তো দাদু?”

“তুমি না চাইলে বলব না। কিন্তু বাবার থেকে লুকোনো তো ভালো কথা না। তাছাড়া, যুগি যে চোর, তা তো এখনও প্রমাণ হয়নি।”

“কিন্তু দাদু, যুগি যে চোর না, সেটাই বা জানব কী করে? সে তো বাড়িতেই নেই। দুদিন ধরে খোঁজ নেই, বাড়িতে গেলাম, দরজা খুলল না।”

“ও নিয়ে তুমি চিন্তা কোরোনা, আছে কোথাও না কোথাও। আবহাওয়া ঠান্ডা হলে ঠিক চলে আসবে।”

 

 

“ওঠ ওঠ বাবু, তাড়াতাড়ি কর, পাড়ায় চোর এসেছে।” মাঝরাতে হন্তদন্ত হয়ে মশারির বাইরে মায়ের হন্তদন্ত চেহারা দেখে ঘাবড়ে গেল বিল্টু।

বারান্দায় এসে দেখে হইহই কাণ্ড। বৃষ্টির মধ্যেই পাড়ার সবাই নিজেদের বাড়ির গেট খুলে, গলিতেই জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে, একদৃষ্টিতে ডাক্তারকাকুদের বাড়ির ছাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সেখান দিয়েই নাকি চোর ঢুকে, রিম্পিদির বিয়ের গয়না গায়েব করে, ওই একই রাস্তা দিয়ে টা-টা বাই-বাই করে চলে গেছে।

 

“আজকে বিকেল থেকেই দেখেছি একটা ছেলে সানগ্লাস পরে ঘুরছে। মনে মনে ভাবলাম বাব্বাহ এই জেনারেশন মেঘলা দিনেও চশমা পরে! এতটা হবে কী করে বুঝব।”

“আরে আমি তো উঠেছি বাথরুম যাব বলে, ডাইবেটিসে ভুগি তো। দেখি ভুবনের ছাদে কারা যেন টর্চ জ্বালিয়েছে। যেই আমি আলো ফেললাম, অমনি দেখি টর্চ বন্ধ। খুটখাট আওয়াজ। কে রে কে রে করে উঠতেই ঝপ করে লাফ মারল। দুজন মিনিমাম ছিল বুঝলে।”

“ঝপ করে একটা আওয়াজ তো আমিও পেলাম, ভাবলাম ডাব পড়ল বুঝি।”

“না না, ভুবনদার আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল। দুদিন আগেই যখন একটা ঘটনা হল এরকম, এই ডাকাতিটা স্রেফ ডাক্তারবাবুর বোকামো ছাড়া কিছু না।”

“হ্যাঁ রে বিল্টু, আসার সময় মেন গেটটা বন্ধ করেছিলাম তো রে?” মা-র প্রশ্নে আশপাশের কাকু-কাকিমাদের থেকে মন ফেরাল বিল্টু। মেন গেট? সে কি আর তখন মেন গেট খেয়াল করেছে?

“দাদু তো আছেই বাড়িতে।”

“তা হোক, চল আমরা ফিরে যাই।” পাশে দাঁড়ানো বাবাকে বলল, “এই যে, আমরা যাচ্ছি। তুমি বেশি দেরি কোরো না। ঝড়-জলে দাঁড়িয়ে গল্প করলেই তো আর চোর এসে ধরা দেবে না।”

 

শত অনিচ্ছাসত্ত্বেও গুটিগুটি বাড়ি ফিরল বিল্টু। দেখল সদর দরজা ঠিকঠাক বন্ধ। র‍্যাকে চটি খুলে রাখতে যাবে, মাথায় টপ করে জল পড়ল। মা-র দিকে তাকাল, মা কিছুই টের পায়নি। একটু ইচ্ছে করেই দেরি করল বিল্টু। ঠিক একই জাগায় আবার জল পড়ল। খুব ঠান্ডা মাথায় ওপরে তাকাল সে। তাকের এককোনায় খুব তাড়াহুড়ো করে গুঁজে রাখা একটা পুরনো ছাতা। সদ্য জলে ভিজে এসেছে তাই এখনও জল পড়ছে। ছাতাটা এ বাড়ির কারুর না।

ছাতাটা বিল্টুর খুব চেনা।

 

 

“মা, আজকে একটা রুটি বেশি খাব। কালকে চোরদের কথা ভেবে ভেবে রাতে ঘুম হয়নি। খুব খিদে পেয়েছে। এটা কি নরমাল ব্যাপার দাদু?”

“এক্কেবারে নরমাল। এই তো আমিও আজকে দুটো রুটি বেশি খেলাম। কোনও গন্ডগোল নেই।”

“না বাবা, গন্ডগোল তো একটা আছেই। চোর যে ঘরে ঢুকেছিল, সে তো ঘরের অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। কিছু না নিয়েই চলে গেল? তারা অনেকক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজি করেছে, সারা ঘরে পায়ের ছাপ, একটা আধখাওয়া সিগারেট অব্দি পাওয়া গেছে। এতক্ষণ ধরে নিশ্চয়ই ডাকাতরা বসে লুডো খেলছিল না?”

বাবার কথায় সায় দিয়ে মা-ও মাথা নাড়ল।

“সে তারা কী করছিল আমি কী জানি। ভুবন যখন বলছে কিছু চুরি যায়নি, নিশ্চয় মিথ্যে বলবে না। আজ সকালেই তো ভুবন ফোন করল যে, না, সব অক্ষত। তার যত দামি জিনিস, সবই নাকি একতলায় তার চেম্বারের লকারে থাকে। চোর নিশ্চয়ই চেম্বারে যাওয়ার কথা ভাবেনি। ভালোই তো।”

“কিন্তু চোর যে যুগি, তাই নিয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই?”

“কী করে বলি বলো? আমি তো চোরকেও দেখিনি, যুগিকেও দেখিনি। কে চোর কে পুলিশ, তারা নিজেরাই বুঝে নিক। তুমি বরং বিল্টুকে আর একটা রুটি দাও।”

বাবা-মা-দাদুর কথা চলতে লাগল। বিল্টু চুপিচুপি তিন নম্বর রুটিতে জ্যাম মাখিয়ে পকেটে চালান করল। দাদুর সেলফোন মুঠোয় ধরে, আস্তে করে চেয়ার থেকে উঠে, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গেল। যাওয়ার আগে দেখল কালকের ভিজে ছাতাটা এখন শুকনো, কিন্তু যথাস্থানেই আছে।

 

বিল্টু জানে তাকে কোথায় যেতে হবে। গরমকালে ওরা যখন বেড়াতে যায়, বিন্তিমাসিকে ঘর পাহারা দিতে বলে। বিন্তিমাসি রাতে আসে, চিলেকোঠার ঘরে শোয়। সে ঘরে আলো-পাখা-খাট— সব ব্যবস্থা আছে। বাকি সময় ঘরে তালা দেওয়া থাকে। সকালে উঠেই বিল্টু দেখে নিয়েছে, সেই ঘরের চাবি জায়গায় নেই।

পা টিপে টিপে বিল্টু ওপরে উঠল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তার মানে ঘরে লোক আছে। আস্তে আস্তে ছাদে গেল। ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ক-দিন আগে শুভর মারা ছক্কা বিল্টুদের ছাদের জানলা ফুঁড়ে চলে যায়। ভাগ্যিস সেই কাচ এখনও সারানো হয়নি। সেই ফাঁকে চোখ রাখতে পারলে ছাদে দাঁড়িয়েই ঘরের ভেতর পরিষ্কার দেখা যায়।

ডালিয়ার টবের পাশে রাখা পুরনো জলের জেরিক্যানে খুব সাবধানে চড়ল বিল্টু। বুকের ধুকপুকানি অগ্রাহ্য করে জানলা দিয়ে দেখল।

 

বিছানায় শুয়ে আছে রোগা লম্বা একটা লোক। মুখের দাড়ি এখনও কাটা হয়নি, চুল এখনও উশকোখুশকো। ওপরে দাঁড়িয়েই পকেট থেকে ফোন বের করে নাম্বারটা ডায়াল করল বিল্টু।

সেই হিন্দি গানের কলারটিউন।

যুগি পকেট থেকে ফোন বের করে দেখল। নাম্বার দেখেই তড়াক করে সোজা হয়ে বসল।

“স্যার, কী করব এবার? কখন বেরোব? কিছু পাঠান স্যার, পেট চুঁই চুঁই করছে।”

এ আবার কী! যুগি তাকে স্যার বলছে কেন? বিল্টু তার নিজের কানে ধরা ফোনের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।

“হ্যালো হ্যালো স্যার, কিছু শুনতে পাচ্ছি না। আপনি রাখুন আমি ফোন করছি আপনাকে।” অন্য প্রান্তে যুগির গলা শুনে হুঁশ ফিরল বিল্টুর। খুট করে ফোন কেটে সুইচ অফ করে, পকেটে চালান করল। তারপর জলের ক্যান থেকে সাবধানে নামল বিল্টু।

কালকে ছাতা দেখেই সে চিনতে পেরেছিল। উত্তেজনায় ছটফট করেছে সারারাত। যুগি যে চোর না, সেটা প্রমাণ করার এই তো সুযোগ। নির্ঘাত যুগি ভয় পেয়ে তার বন্ধুর বাড়িতে লুকোতে এসেছে। সারারাত পেটে কিছু পড়েনি ভেবে বিল্টু রুটি নিয়ে এসেছিল। যুগি নিশ্চয় খুব চমকে যাবে। কিন্তু এটা কী হল? তার বাড়ি এসে যুগি তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা তো করলই না, উলটে কাকে স্যার বলছে! তাহলে কি ব্যাপার অত সহজ না? যুগির কি সত্যি অন্য কোনও অবতার আছে, যা বিল্টুর অজানা? তার কি নিচে গিয়ে বাবা-মা-দাদুকে সব খুলে বলা উচিত?

 

পকেটে রাখা রুটি-জ্যাম বের করে জানলার গ্রিলে গুঁজে দিল বিল্টু। দুবার টোকা মেরে সরে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানলার এক পাল্লা খুলে, ভেতর থেকে রোগা হাত বেরিয়ে এসে রুটি নিয়ে আবার জানলা বন্ধ করে দিল।

 

 

“কোথায় লাফিয়ে বেড়াচ্ছ বিল্টু, স্কুল ছুটি মানেই কি তোমার পড়াশুনো লাটে উঠেছে?”

“মা, মাথাটা খুব ব্যথা করছে। তাই একটু ছাদে গেছিলাম।”

“সারা বাড়ির কী হল রে বাবা। মাথাব্যথা হলে যে ভরদুপুরে ছাদে ঘুরে বেড়াতে হয়, এই প্রথম শুনলাম। এই একটু আগে শুনলাম খুব খিদে, এখন বলছ মাথাব্যথা। ওদিকে তোমার দাদু সকাল থেকে মোবাইল খুঁজে হদ্দ হচ্ছে। কী যে এমন দরকারি ফোন আসবে বুঝি না। দেখেছ কি ফোনটা?”

বিল্টু মাথা নাড়তে, গজগজ করতে করতে মা বেরিয়ে গেল।

 

সেরেছে! দাদুর ফোন তো এখন বিল্টুর পকেটে। পাগলের মতো ফোন খুঁজছে মানে নির্ঘাত কোনও কল আসবে। বা কাউকে ফোন করার আছে। সেইজন্যই কি যুগি ওর’ম হন্তদন্ত হয়ে ফোন ধরল? এমন কী জরুরি কথা আছে দাদুর আর যুগির? এদিকে খাবার টেবিলেও দাদু কেমন রহস্যময় কথাবার্তা বলল। যে দাদু ফুল চুরি ঠেকাতে ভোরবেলা উঠে পাহারা দেয়, সেই দাদু পাড়ায় এতবড় চুরি হয়ে গেল, কোনও উচ্চবাচ্য করল না! সে হোক না ফলস্‌ চুরি, রিম্পিদির গয়না না হয় সুরক্ষিতই আছে, তাই বলে দাদু ঘটনাটাকে এতটাই নিরামিষভাবে মেনে নেবে, মানতে পারছে না বিল্টু। কাল বিল্টু যখন বাবা-মা-র সঙ্গে চোর ধরতে গেল, বাড়িতে দাদু একা। সে তো দাদু একাই একশ। তার থাকাকালীন যখন যুগি এরকম চোরের মতো বাড়িতে ঢুকে ওপরের ঘরে ঘুম লাগাল, বুঝতে হবে দাদু ব্যাপারটা জেনেও না জানার ভান করছে। তা বেশ করেছে, নিশ্চয়ই যুগি বিল্টুর বন্ধু বলেই করছে। তবে তার থেকে লুকোল কেন? বয়সে ছোট হতে পারে, তাই বলে সে কি হেলাফেলার পাত্র? বিল্টুর ইচ্ছে করছিল এক ছুটে গিয়ে বাবাকে সব জানিয়ে দেয়। বাবা এমনি চুপচাপ থাকে বটে, কিন্তু রেগে গেলে দমাদম বোম ফাটতে থাকে। ব্যাপার হচ্ছে সেই বোম দু-চারটে যে বিল্টুর মাথায় এসে পড়বে না, তার কোনও গ্যারান্টি নেই।

 

কিছুক্ষণ সত্যি গরমের মধ্যে ঘোরাফেরা করল বিল্টু। দাদুকে কোনও কথা জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। তার বলার হলে ঠিক আগেই বলত। যুগির কাছেও তো ফোন আছে, সেও তো ইচ্ছে করলে বিল্টুকে ফোন করতে পারত। না হয় ল্যান্ডফোনেই করত। এমন তো না আগে করেনি। ওই আড়াইখানা রিং শুনলেই বিল্টু বুঝত যুগি ফোন করছে, দৌড়ে বড়দের আগে ফোন উঠিয়ে ফেললে কেউ টেরটি পেত না।

কিছুই বুঝছে না বিল্টু। শুধু একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত। দাদু যখন যুগিকে নিজের বাড়িতে ঠাঁই দিয়েছে, যুগি নির্দোষ।

 

সবার নজর এড়িয়ে আবার ছাদে গেল বিল্টু। চিলেকোঠার ঘর, যার ভেতরে যুগি এখন শুয়ে, তার দরজার হাতলে একটা লম্বা দড়ি বাঁধল। ছাদের পাঁচিলে রাখা ফুলগাছের টবে জড়িয়ে নিয়ে দড়িটা নিচে ঝুলিয়ে দিল। কাঠি বাঁধা লম্বা দড়ি ঠিক বিল্টুর ঘরের জানলার সামনে দুলতে লাগল। টুক করে নিচে নেমে নিজের ঘরের জানলা বন্ধ করল বিল্টু। সময়ের আগে ঝুলন্ত দড়ি কারুর নজরে পড়লে কেলোর কীর্তি।

এখন আর কী, রাত হওয়ার অপেক্ষা। তার মন বলছে, আজ রাতে আবার চোর ঢুকবে ডাক্তারকাকুর বাড়িতে।

 

 

ডাক্তারকাকুর বাগানে এত মশা কে জানবে বাবা। তাহলে তো ওডোমসটা লাগিয়ে এলেই হত। অবশ্য সব দোষই বা মশাদের দেয় কী করে? বিল্টু যে অবস্থায় শিউলি গাছের তলায় গুজুমুজু হয়ে ঠায় বসে আছে, সে প্রায় পোকামাকড়দের নেমন্তন্ন জানানোর সমান।

 

ঝামেলা কি আর কম? সেই দুপুর থেকে জানলার বাইরে সুতোয় চোখ বিঁধিয়ে বসে আছে। সকালে তার মনে হয়েছে যুগি আর দাদু ফোনে-ফোনে প্ল্যান করবে। সেই অনুযায়ী যুগি ঘর থেকে বেরোবে। ছাদ থেকে নেমে সে কায়দা করে দাদুর ফোন বসার ঘরে সোফার উপর ফেলে রাখল। তার আগে অবশ্য যুগিকে ডায়াল করা শেষ ফোনটা কললিস্ট থেকে মুছে দিয়েছিল।  কিছুক্ষণ পড়েই বিন্তি মাসির ‘ও বউদি এই তো ফোন’ শুনে আশ্বস্ত হল সে। যুগি কোথাও বেরোনোর কথা বলেছিল ফোনে। নিশ্চয়ই দাদু নিচের পরিস্থিতি অনুযায়ী যুগিকে অর্ডার দেবে। এদিকে বিল্টু যদি সিঁড়ির ওপর পাহারায় বসে, দাদু সাবধান হয়ে যেতে পারে।

 

দুপুরে যথাসম্ভব স্বাভাবিক থেকেছে বিল্টু। দাদুর অ্যাকটিংও তোফা। খেতে খেতে দাদু তার প্রথম চাল দিল। “বুঝলি, আজ একটু তোর পিসির বাড়ি থেকে ঘুরে আসি, খুকির শরীরটা ভালো নেই। অনেকদিন ধরেই ভাবছি, কিন্তু যাতায়াতে এত ক্লান্ত হয়ে যাই… এদিকে না যাওয়াও ভালো দেখায় না, খুকি তোর জন্য এত করেছে! পিশেমসাইও তোদের খুবই স্নেহ করতেন। দেখি যাই, কী আর হবে।”

“কই আমাকে বলোনি তো পিসির শরীর খারাপ? কী বলো অণিমা, আমাদের যাওয়া উচিত একবার। বাবা তুমি বরং বিল্টুর সাথে থাকো, আমরা চট করে ঘুরে আসি। এই বৃষ্টিতে বেরিও না। বিল্টু, একটা চিকেন এগরোল নিয়ে আসব নাকি?”

 

এরকম যে একটা কিছু হবে জানত বিল্টু। বাবারা বেরোল তখন প্রায় বিকেল পাঁচটা। দু-দুবার দড়ি নড়ছে দেখে যুগি কান খাড়া করে, চোখ বন্ধ করে, সব ইন্দ্রিয়দের সিঁড়ির নিচে নিয়ে গেল। নাহ, ভুল। হাওয়ায় নড়েছে। তৃতীয়বার আর ভুল হল না। ঘড়িতে তখন সাড়ে আটটা বাজে। কী করবে না করবে বোঝার আগেই দাদু এসে হাজির।

“বিল্টু, তোর বাবা ফোন করেছিল বুঝলি। তোর খুকি দিদার বাড়ির গলিতে প্রচুর জল জমেছে। আমাকে একবার গাড়ি নিয়ে বেরোতে হচ্ছে। তুই সাবধানে থাকিস। বিন্তিকে বলেছি, নুডলস বানিয়ে দেবে, খেয়ে নিস। বাবাদের নিয়েই আমি ফিরব।”

দড়ি নড়া দেখেই বিল্টু বুঝেছে যুগি চিলেকোঠার দরজা খুলে বেরল। এবার দাদুও ছুতো করে বেরিয়ে গেল মানে দুজনের গন্তব্য এক। পিছু নিতেই পারে বিল্টু, কিন্তু দরকার নেই। দাদু আর যুগি নাটকের শেষ অঙ্কে এসে ভুবন ডাক্তারকাকুর বাড়ি ছাড়া আর কোথায়ই বা যাবে?

 

ডাক্তারকাকুর বড় পাঁচিলঘেরা বাড়ি। গাড়ির রাস্তার দুপাশে নানা ধরনের গাছ। দেবদারু গাছের পেছনে আড়াল করল বিল্টু। ডাক্তারকাকুর একতলার চেম্বার বন্ধ, কিন্তু ওপরে যথারীতি আলো জ্বলছে।

দাদু বা যুগি কারুরই দেখা পায়নি বিল্টু। বেশ একটু ঘাবড়ে গেল। তবে কি ওরা অন্য কিছু প্ল্যান করেছে? সারা দুপুর দড়ি না দেখে দাদুর ঘরে আড়ি পাতা উচিত ছিল তার। টর্চটাও তো আনেনি। ফোনও নেই। বিল্টুকে খুব সাবধানে এগোতে হচ্ছে। ওফ! কীসে একটা হোঁচট খেয়ে পড়ল। বাগানে বিছানো নুড়িতে হাঁটুটা বেশ ছড়ে গেছে। চারিদিকে যেন হঠাৎ অন্ধকারটাও বেশ চেপে ধরেছে। এই পা নিয়ে বেশিদূর এগোনো মুশকিল হবে, দেখা যাক। এক পা এগোতেই আবার পায়ে কী একটা ঠেকল। নির্ঘাত এটাই বিল্টুকে মুখ থুবড়ে ফেলার আসামি। লম্বা লোহার রড। গাঁইতি না শাবল কী যেন বলে এটাকে দাদু। বাব্বাহ, বেশ ভারী কিন্তু! কোনোমতে এটাকে টেনে নিয়ে যেতে পারলে অন্তত সাপ-ব্যাঙের দুশ্চিন্তা কাটে।

 

সময় যেন কাটছেই না। কতক্ষণ হয়েছে মনে হয়? নিশ্চয়ই একঘণ্টার বেশি না, তবু বিল্টুর মনে হচ্ছে সে আজীবন ধরে এই শিউলি গাছের তলায় বসে আছে। বাবারা কোথায় কে জানে? বাড়ি এসে যদি দেখে দাদু আর বিল্টু গাড়িসমেত উধাও, নির্ঘাত ভাববে দুজনে ঘুরতে বেরিয়েছে। কিন্তু সে আর কতক্ষণ। উফ, আদৌ কি কিছু হবে আজ রাতে? কখন বাড়ি যাবে কে জানে। বাবা এদিকে রোল আনবে বলেছে, ঠান্ডা না হয়ে যায়। গোয়েন্দা হওয়া যতটা গ্ল্যামারাস সে মনে করেছিল, দেখা যাচ্ছে আদৌ তা নয়।

ফস করে কীসের আওয়াজ হল? ঠিক যেন দেশলাই কাঠি জ্বালাল কেউ। আওয়াজটা তার পেছনের কোনও এক ঝোপ থেকেই এল। লাঠিটা হাতে কষে ধরে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকল বিল্টু। একটা পোড়া বিড়ির গন্ধও যেন নাকে আসছে। ওই তো, কিছুক্ষণ আগে ওখানেই বিল্টু বসেছিল। হাফ শার্ট পরা লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছে সে। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু বিল্টু নিশ্চিত এই আসল চোর এবং চোর বাবাজিকে সে চেনে।

 

 

ঘণ্টাদুয়েক কেটে গেছে মশার কামড় খেতে খেতে। এর মধ্যে ডাক্তারকাকুর বাড়িতে আলো নিভে গিয়ে শুধুই একতলার বারান্দার আলো জ্বালানো হয়েছে। এই একতলাতেই ডাক্তারকাকুর চেম্বার। দাদু বলছিল বটে রিম্পিদির বিয়ের সব গয়নাগাটিই নাকি এই একতলার কোনও ঘরে রাখা। আর একটু কাছাকাছি গেলে হত না? পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেছে একভাবে বসে বসে। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলল বিল্টু। চোখ ফিরিয়ে দেখল তার নড়াচড়ায় বিড়িওয়ালার কোনও হেলদোল হল না। সে একমনে বসে আছে তো আছেই।

 

এদিকে চেম্বারে ডাক্তারকাকু এখন জেগে। বেশ আরাম করে বসে বই পড়ছেন। এত বয়স হয়ে গেলেও বুঝি ডাক্তারদের রাত জেগে পড়াশোনা করতে হয়? একবার ঘড়ি দেখে নিয়ে দরজার দিকে তাকালেন ভুবন ডাক্তার। চেয়ার ঠেলে উঠে, বেরিয়ে গেলেন। লাইট নেভালেন না কেন? আবার ফিরে আসবেন? ডাক্তারকাকুর সত্যি এবার বুড়ো হয়েছেন। এই সেদিন বললেন, গয়না চুরি হয়েছে; অমনি পরের দিন বললেন, না না, সব ঠিক আছে। আছেই যখন চুপ করে থাকো না বাপু, চেম্বারে আছে চেম্বারে আছে বলার দরকার কী? কিন্তু এ কী! ডাক্তারকাকুর টেবিলে ওটা যুগির ছাতা না?

ঘাড় ঘুরিয়ে একবার চোরের দিকে নজর দিল বিল্টু। ও মা! ঝোপ তো ভোঁভাঁ। কোথায় কেটে পড়ল হাফ শার্ট? খেয়েছে রে, এই অন্ধকারে তাকে খুঁজবে কী করে? খিদেটাও পেয়েছে জব্বর। এসব কিছু মিটলে যুগির পকেট কেটে একটা ইয়াব্বড় এগরোল খাবে বিল্টু।

হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠল। বাড়ির সামনের অংশ ঝলসে উঠল সেই আলোয়। বিল্টু পরিষ্কার দেখল নীল হাফ শার্ট পরা চোর হামাগুড়ি দিয়ে ডাক্তারকাকুর চেম্বারে ঢুকে গেল। আর কীসের অপেক্ষা? দে দৌড়। যে করেই হোক চোর সে আজকে ধরবেই।

 

বারান্দায় পৌঁছতে অসুবিধে হল না তেমন। বারান্দার দরজা দিয়েই সোজা চেম্বারে ঢোকা যায়। সেদিকে এগোতেই ঘরের লাইট নিভে গেল। যেখানে ছিল, দু-মিনিট সেখানে দাঁড়িয়েই অন্ধকার চোখে সইয়ে নিল বিল্টু। আবছা আবছা দরজাটা এবার সে বুঝতে পারছে। আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগোতে লাগল। ঘরের ভেতর থেকে খুটখাট আওয়াজ আসছে। রিম্পিদির গয়নার জন্য জোর তল্লাশি চালাচ্ছে নীল হাফ শার্ট। এবার একটু ভয় করছে। বাবাকে নিয়ে এলেই ভালো হত। অন্ধকারে বলা তো যায় না, চোরের ঘাড়ের ওপর গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল হয়তো।

টর্চটা মেঝেতে রেখে চোরটা আলমারি খুলেছে। চোর হোক আর যাই হোক, বকু মিস্ত্রি খারাপ না। এক-এক চাড়ে এক-একটা দেরাজ খুলছে আর মুখ দিয়ে অসন্তুষ্টিসূচক আওয়াজ করছে। খুব মন দিয়েই কাজ করছে বলতে হবে। না হলে বিল্টুর আবির্ভাব টের পাওয়ার কথা অনেক আগেই। অবশ্য চেম্বারে তো আলমারি কম না, মন দিয়ে কাজ না করলে গয়না পেতে রাত ভোর হয়ে যাবে। বিল্টু উঠে দাঁড়াবে ভাবছে, তক্ষুনি টেবিলের উপর রাখা ছাতাটা লক্ষ করল। ছাতার ভেতর একটা হাল্কা সবুজ আলো জ্বলছে নিভছে, জ্বলছে নিভছে। যুগির ছাতা এর’ম অবহেলায় টেবিলের উপর পড়েই বা আছে কেন? দাদু আর যুগি কী করছে কে জানে। বাইরে আবার মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। আর একটু সাহস সঞ্চয় করে বিল্টু উঠে দাঁড়াল।

 

“ব্যাটা! আর এক পা এগোবি তো গুলি মেরে খুলি উড়িয়ে দেব।”

সর্বনাশ! এ যে প্রণবদা। ডাক্তারবাবুর সেক্রেটারি। এক হাতে বন্দুক অন্য হাতে যুগির জামার কলার।

ঠিক বিল্টুর মতোই ওপাশের জানলায় চোর ধরার অপেক্ষায় ছিল যুগি। নিশ্চয় আর একটু হলে ধরেও ফেলছিল। কিন্তু চোরের সঙ্গে যে ডাকাতও আছে, সে আর কে জানত। যুগির পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে ডাক্তারকাকুর চেয়ারে বসাল প্রণবদা। এ চেম্বার তার নখদর্পণে। মোটা সেলটেপ দিয়ে যুগির হাত পেছনমোড়া করল।

“তোর সাহস কম না রে যুগি। ভারী তো ছিঁচকে পকেটমার। তোর এত আস্পরদা কীসের রে। অনেকদিন ধরে লক্ষ করছি তুই আমাদের উপর নজর রাখিস। কী মতলব কী তোর, মালের ভাগ পাবি ভেবেছিলি নাকি?”

“ছিঁচকে চোররা অনেক খবর রাখে প্রণবদা। তোমাকে দেখেই আমার কেমন লেগেছিল। রিম্পির বিয়ে ঠিক হল আর তুমি এখানে বহাল হলে। কিন্তু ডাক্তার কোনোদিনই তোমার কাজে খুশি না। এ বাড়ির পেছনেই থাকি, সব কথা শুনতে পাই। তারপর যেদিন আমার কপালে পুরনো সেলাই দেখে তুমি জিজ্ঞেস করলে কীসের দাগ, সেদিন আর সন্দেহ রইল না। লিডারকে তোমার ফটো দেখালাম। বলল বসিরহাটে তোমার নামে দুটো কেস চলছে।”

“বেশ হয়েছে। বেশ করেছি চুরি করেছে। কোথাও কোনও প্রমাণ রাখিনি। আজকেও রাখব না। ওই এক মিস্ত্রি আর তুই। দুটোরই আজ খেল খতম। এই বকু এদিকে আয়, একটা কাজ ঠিক মতো নামাতে পারিস না। আয় আয়, সামনের চেয়ারে বোস।”

 

বন্দুকটা বের করে বকুর কপালে ঠেকাল প্রণব। সে জানে না কখন বিল্টু এক-পা এক-পা করে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সিনেমার মতো ক্লাইম্যাক্সের অপেক্ষা না করে বাগানে পাওয়া শাবলটা দিয়ে সে প্রণবের মাথায় এক বাড়ি মারল।

 

বিল্টু আর যুগি সর্দার সুমনা পাই সহায়

 

১০

 

ভুবন ডাক্তারের চেম্বারেই সবাই বসে আছে। প্রণবকে মেরে বেশ ভয় পেয়ে গেছিল বিল্টু। মরে-ফরে গেল নাকি! কিন্তু না, তেমন কিছুই হয়নি। সত্যি বলতে কী শাবল মাথায় না লেগে কাঁধ আর পিঠই জখম করেছে বেশি। ভুবন ডাক্তারকাকুর ব্যান্ডেজ বেঁধে গরম দুধ দিয়েছেন। মুখ চুন করে তাই খাচ্ছে প্রণব।

বাবাদের গাড়ি এসেছে অনেকক্ষণ। দাদু আগেই পুলিশকে ফোন করে দেওয়াতে, তারা সোজা খুকি দিদার বাড়ি থেকে বাবা-মাকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। কিন্তু বাড়িতে বিল্টুকে না পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে দাদুকে ফোন করায় দাদু আন্দাজ লাগায় যে বিল্টু নির্ঘাত ডাক্তারকাকুর বাগানেই কোথাও লুকিয়ে আছে। কিন্তু স্বয়ং বিল্টুই যে হাতেনাতে চোর ধরে তাকে শয্যাশায়ী করবে, অতটা দাদু কল্পনা করেনি।

 

“হ্যাঁ রে বিল্টু, তুই এত সব জানলি কবে? তোকে তো কিছু বলিনি।” দাদুর কথায় ঝিম ভাঙল বিল্টুর। সে কি আর পারে? সেই ভোরবেলা কখন উঠেছে। ছাদে গিয়ে যুগিকে আবিষ্কার করা, দড়ি ঝোলানো, দাদুর পিছু নিয়ে ডাক্তারের বাগানে লুকিয়ে থাকা— সব যে একই দিনের ঘটনা, সেটাই বিশ্বাস হচ্ছে না তার।

“আমি তো কাল রাতে দেখলাম যুগির ছাতা জুতোর র‍্যাকের ওপর রাখা। আমি ভাবলাম পাড়ায় চুরি হয়েছে, সবাই ভাববে যুগি চুরি করেছে। পাড়ার লোকের থেকে বাঁচতে যুগি নিশ্চয়ই আমার কাছে এসছে। সকালে ওর জন্য রুটি নিয়ে গেলাম। ও মা, আমার ফোন পেয়ে ও স্যার-স্যার করতে লাগল। ওটা তো দাদুর ফোন থেকেই করা, তাই বুঝলাম ওর সঙ্গে নিশ্চয়ই দাদুর কোনও কথা আছে। আর দাদু, পাড়ায় চুরি হল, তাও তুমি এত নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছিলে, আমি ঠিক বুঝেছিলাম তোমার কোনও মতলব আছে।”

“বাব্বাহ, বিল্টু যে এক্কেবারে ফেলুদা হয়ে গেল, অ্যাঁ?”

“এবার তোমারটা বলো দাদু।”

“আমার আর কী বলার আছে বাবু, যুগিকে আমি অনেকদিন ধরেই চিনি। ধরে নাও তোমার আর বাকি সবার পাহারাদার হিসেবেই আমি ওকে এ পাড়ায় রেখেছি। যুগি এককালে পকেট মারত ঠিকই, কিন্তু সে নেহাতই বাচ্চা বয়েসে। ওর হাতখরচা আমিই দিই, তবে এ বছর পরীক্ষার পর যুগি পুলিশে ভর্তি হবে। বাকিটা ও-ই বলুক।”

 

“সরি বিল্টু, তোকে এসব আমি আগে বলিনি। এখন মনে হচ্ছে বললে আমাদেরই উপকার হত। এ পাড়ায় চোরের উপদ্রব তো থাকেই, শীতকালে বা বিয়ের সিজনে আরও বাড়ে। ভুবন ডাক্তারের মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে আমরা সবাই শুনেছি। একটি মেয়ে, অঢেল টাকা, সবাই ধরেই নিয়েছে একটা এলাহি আয়োজন হতে চলেছে। এসব খবর চাপা থাকে না। কানকাটা গুগল হল এদের সবার লিডার। বেছে বেছে সেরা লোক পাঠায় সিঁধ কেটে চুরি করতে। সাধারণত এরা একাই কাজ করে। এবার হল প্রণব, নাহ, ওর আসল নাম শিবু। শিবু ডাক্তারের সেক্রেটারি সেজে বেশ কয়েকদিন বসল, কিন্তু কূল করতে পারল না। ডাক্তারের বাড়ির নিচতলা উপরতলা গেট দিয়ে বন্ধ, রেলিং-এ ফাঁক করতে বকু মিস্ত্রিকে ধরল। বকুকে বেশ কয়েকবার অন্ধকার হলে যাতায়াত করতে দেখেছি। ডাক্তারের মালীটাকে জিজ্ঞেস করলাম, বকু কেন আসে? সে বলল, মিস্ত্রির কোনও কাজ তো বাড়িতে হচ্ছে না। সেদিন থেকে রোজ ডাক্তারের দেওয়াল পেরিয়ে করমচা গাছের নিচে বসে থাকতাম।”

“তাহলে সেদিন যে চুরি হল?” মা পেছন থেকে বলল।

“নাহ। হয়নি। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। হঠাৎ ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে ঝামেলা পাকল। কাদায় পা পিছলে ডাক্তারের বাগানে পড়ে গেলাম, বকু আর শিবু আমায় দেখে ফেলল। ওরা বুঝে যায় আর বেশিদিন টানা যাবে না। আমিও ওদের অবস্থা বুঝলাম। হয় এস্পার নয় ওস্পার।”

“তারপর?”

“তারপর আর কী। ফোন করলাম স্যারকে। স্যারের কথামতন সেই রাতে আমিই গেলাম ডাক্তারের বাড়ি। একজন সানগ্লাস পরা প্লেন ড্রেস পুলিশ অফিসারও ছিল আমার সাথে। তাকেই পাড়ার লোক দেখে ফেলে। ডাক্তারকে স্যার আগে থেকেই সব বুঝিয়ে বলে রেখেছিল। সব গয়না নিয়ে, কিছুক্ষণ খুটখাট আওয়াজ করে-টরে, আমরা চলে এলাম। আমি গয়না নিয়ে সোজা তোমাদের বাড়ি গেলাম। গয়না স্যারকে দিলাম, স্যার আমাকে ছাদের ঘরে শুতে বলল। তারপর তো সবাই জানেই।”

“আর তুমি ছাতাটা ভুলে ফেলে গেলে। ওহ, জানো যুগিদা, ছাতার মধ্যে একটা সবুজ আলো জ্বলছে দেখলাম। কী গো?”

“এই দ্যাখ। ছাতার বাঁটে ছোট্ট ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন। স্যার তো ডাক্তারকে বললেন রটিয়ে দিতে যে কিছু চুরি যায়নি, সব চেম্বারে আছে। আমরা নিশ্চিত যে শিবু সেই শুনে আজ রাতেই মাল নিয়ে কেটে পড়বে। এটাও আন্দাজ করেছিলাম যে ঘটনা ঘটবে এই ঘরেই। তাই লাইট জ্বালানো ছিল। তখন তো জানতাম না, বিল্টু এসে হিরোর মতন সব কাণ্ড করবে। কথা ছিল চুরি করাটা যাতে ক্যামেরায় বন্দি করা যায়, প্রমাণ করতে সুবিধে হবে। দ্যাখ বিল্টু, তোর ডান্ডা দিয়ে মারার সিনটা কিন্তু হেবি হয়েছে।”

 

ছোট্ট ক্যামেরায় নিজেকে দেখল বিল্টু। প্রণবদা কে সে কী ভাবত, সে হয়ে গেল চোর। এদিকে যুগি চোর বলে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব লুকিয়ে রাখল, সে হল কি না ভাবী পুলিশ। কত রহস্যই না এই ক-দিনে পরিষ্কার হয়ে গেল। হোক, এর’ম ঝড় আরও হোক। চারদিকের যত ভুল বোঝাবুঝি, রোগ, রাগ, দুঃখ সব ধুইয়ে দিয়ে যাক।

 

ছবি — সুমিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published.