বুকুনের বাক্স মৃগাঙ্ক মজুমদার

বুকুনের বাড়িতে ভারী হইচই। বুকুনের দাদু, ঠাকুমা, মা আর বাবা সবাই মিলে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বুকুনকে নিয়ে। সকাল থেকে বুকুন বলছে স্কুলে যাবে না। বাড়ির সবাই জানে বুকুন স্কুলে যেতে খুবই ভালোবাসে। ক্লাসের শিক্ষক আর শিক্ষিকারা বুকুনকে খুব ভালোও বাসেন। বুকুনের সারা ক্লাস জুড়ে বন্ধু, কারোর সঙ্গে ঝগড়া করে না বুকুন। বন্ধুদের কেউ রেগে গেলে বুকুন তার পাশে গিয়ে চুপ করে বসে থাকে আর জিজ্ঞেস করে, “কেন রেগে গিয়েছিস? আচ্ছা শোন না বন্ধুদের মধ্যে রাগারাগি করতে নেই। আমরা সবাই বন্ধু তো। জানিস তো আমার দাদু আর টুকুন দুজনেই বলেছে সবাই সমান হয় না, কেউ লম্বা, কেউ বেঁটে, কেউ রোগা, কেউ একটু মোটা। কিন্তু আমরা সবাই বন্ধু। এই দেখ না দেখ, আমার দুটো হাত, তোরও দুটো হাত, আমার দুটো পা তোরও দুটো পা, আমারও চুল আছে মাথায় আর তোরও চুল আছে। খালি আমাদের বাবা, মা, দাদু, দিদা এরা আমাদের থেকে বড় আর আমাদের টিচারও আমাদের থেকে বড়। আর জানিস তো বেশিক্ষণ রেগে গেলে না শরীর খারাপ করে আর মনও খারাপ হয়। আমিও রেগে যাই তো। তখন না আমার দিদা আমাকে বলে যে অত কথায় কথায় রেগে যেতে নেই। আর তোর মন খারাপ হলে তো তোর বাবা-মায়েরও মন খারাপ হবে। আর আমরা তো তোর বন্ধু, আমাদেরও মন খারাপ হবে।”

এত কথা একটানা যাকে বলা সে ততক্ষণ রাগ ভুলে বুকুনের কথা মন দিয়ে শুনতে থাকে। আর তার পরে আবার দলের সঙ্গে মিশে হইচই করতে থাকে। বুকুনদের ক্লাসে দুজন দুজন একসঙ্গে বসার কাঠের বেঞ্চি আর ডেস্ক। ডেস্ক আর বেঞ্চ লাল আর হলুদ রং করা। ক্লাসের দেওয়াল সবুজ আর নীল। দেওয়ালে যার যখন ইচ্ছে হয় আঁকতে পারে। সারা দেওয়ালটাতে সবার জন্য জায়গা করা আছে। যার যখন মনে হয় তার জায়গাতে গিয়ে এঁকে চলে আসে। ক্লাসে দুটো বোর্ড আছে— ব্ল্যাকবোর্ড আর হোয়াইট বোর্ড। ক্লাসের দুদিকেই জানলা আছে। তার দুপাশেই দুটো দুটো করে চারটে বড় গাছ আছে। আম, নিম, কাঁঠালিচাপা আর পেয়ারা। সেই গাছগুলোতে রোজ প্রচুর পাখি আসে। তারা তুড়ক তুড়ুক করে এ ডাল থেকে ও ডাল লাফিয়ে বেড়ায় আর ইচ্ছে মতন ডেকে যায়। সব পাখি এখনও চেনে না বুকুন, তবে টুকুন বলেছে সে নাকি বুকুনকে পাখি চিনিয়ে দেবে। আর বুকুনের কাছে তার ক্লাসের বন্ধুরা টুকুনের গল্প শুনে টুকুনের সঙ্গে দেখা করতে চায় যখন, তখন বুকুন বিজ্ঞের মতো হাত-পা নেড়ে বলে, “আরে বাবা টুকুন খুব ব্যস্ত মানুষ, আমি দেখেছি মোটা চশমা পরে মোটা মোটা বই পড়ে। তোরা এখন এত ছেলেমানুষি করিস না তো! আমি টুকুনকে জিজ্ঞেস করব।”

বুকুনের স্কুলের মাঠটা বেশ বড় আর মাঠ জুড়ে অনেক ঘাস আর এদিক সেদিক অনেক ঝোপঝাড়। টিফিনের সময় বুকুন আর তার বন্ধুরা মাঠের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। গুবরে পোকাকে দেখে একটা ছোট্ট মাটির দলা ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যেতে। বড় বড় গাছগুলোর ফোকর থেকে কাঠবিড়ালির বাবা আর মায়েরা বেরিয়ে আসে। আর এদিক-উদিক মাথা তুলে দেখে ছুটে ছুটে খাবার খুঁজে আবার ছুটে গাছে উঠে পড়ে ফোকরের মধ্যে ঢুকে যায়। বুকুন আর তার বন্ধুরা জানে ওদের একটা ছোট্ট ছানাও আছে সেই ফোকরের মধ্যে, মাঝে মধ্যেই চ্যাঁ-চ্যাঁ করে চেঁচায়। এটা গিয়ে টুকুনকে বলাতে টুকুন বলেছে, ছোট্ট ছানাদের গায়ে লোম গজায় না, তাই কাঠবিড়ালির বাবা আর মা চোখে চোখে রাখে যাতে বেরিয়ে না পড়ে বাইরে। আর খিদে পেলে বা বাবা-মাকে না দেখতে পেলেই চেঁচায়।

কিন্তু বুকুনের নেশা হল ভেলভেট পোকা জমানো। স্কুলের মাঠের কোনায় ঝোপের ধারে আর বড় বড় ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে লাল-লাল ভেলভেট পোকা ঘুরে বেড়ায়। তাদের তুলে ধরে পিঠে হাত বোলালেই নরম ভেলভটের স্পর্শ পাওয়া যায়। বুকুনের বন্ধুরা দেখে আদর করে আবার ছেড়ে দেয়, কিন্তু বুকুন তাদের নিজের একটা ছোট্ট কাগজের বাক্সে পুরে রাখে। সেই বাক্সের মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট ফুটো করা আছে হাওয়া ঢোকার জন্য। ভিতরে রাখা আছে কিছু ঘাস আর সবুজ পাতা। টুকুন বলে দিয়েছে বুকুনকে। পোকারা ঘাস খায় সবুজ খায় আর মাঝে ওখানেই ডিম পাড়ে। বাড়ি নিয়ে এসে বুকুন বাগানের এক কোনায় সেই পোকাগুলোকে জমায় একটু ঘেরা জায়গা করে যাতে পাখিরা ঠুকরে না খায়। সব ভেলভেট পোকার একটা করে নাম দিয়েছে বুকুন— পিংকা, রিঙ্কা, পুটুলি, গুটুলি আর হুপুস।

প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে, ওদের টা-টা করে দিয়ে আসে বুকুন। আজ টা-টা করতে গিয়ে দেখে হুপুসের পাত্তা নেই। ব্যস, বুকুন স্কুলে যাবেই না।

টুকুন এদিকে তার পুকুরপাড়ে বসে মাছেদের ঘাই মারা দেখছিল। অনেক মাছ জমেছে পুকুরে, টুকুন মাঝে মাঝে ঘাট দিয়ে নেমে মুড়ি খাওয়ায়। অনেক মাছের নাম দিয়েছে, তাদের নাম ধরে ডাকলে অনেকক্ষণ পর পর জল থেকে লাফ দেয় আর তারপর তার দিকে আসে। টুকুন মাছের মাথা চাপড়ে আদর করে দেয়। তবে কিছু মাছকে বের করেই দিতে হয়। মাঝে মাঝে নিয়ম করা থাকে যে কিছু মাছ লোকে এসে পুকুর থেকে ধরে নিয়ে যায়। তবে সবাই না, বহু বছর থেকে নিয়ম, এই শহরের বা আশেপাশের যারা খেতে পায় না বা কম খেতে পায়, তারাই খালি মাছ ধরে নিয়ে যায় আর খেতে পারে। আর কেউ না কিনতে পারে, না বেচতে পারে। আর হ্যাঁ, কিছু ছোট মাছ খায় লালি আর নিলী। লালি আর নিলী হল দুটো মাছরাঙা। এরা সকালে আর দুপুরে রোজ বসে থাকে চুপ করে। আর দুজনেই রোজ দুটো বা একটা করে রোজ মাছ খায় সাঁ করে গাছের ডাল থেকে জলে ঝাঁপ মেরে। এছাড়া তেমন কিছু হয় না সারা পুকুর জুড়ে। মাছদের খাওয়ানোর পরে টুকুন জামরুল গাছ দেখছিল। জামরুল গাছের গা বেয়ে কাঠপিঁপড়েগুলো দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সকালের আলো বাগান জুড়ে উপচে পড়ছে, ঠিক এমন সময় বুকুন মেঘের মতো মুখ করে টুকুনের কাছে এসে দাঁড়াল।

টুকুন এই সময় বুকুনকে দেখে অবাক! বুকুনের ভার মুখ দেখে জিজ্ঞেস করতে যাবে, বুকুন নিজেই বলতে শুরু করল, “আমার হুপুস হারিয়ে গিয়েছে। এখন ও একা একা কী করে থাকবে? হুপুসের ভাইবোনেরা সবাই কাঁদছে, আমার ভালো লাগছে না। হুপুস কি তোমার কাছে চলে এসেছে? আসলে আমি তো হুপুসকে কাল খুব বকেছিলাম, তাই কি আজ ও মনখারাপ করে চলে এসেছে তোমার কাছে? আমাকেও তো আমার বাবা আর মা বকে। দাদু আর ঠাকুমা বকে না অবশ্য, কিন্তু বাবা আর মা বকে। কিন্তু পরে আবার বুঝিয়ে বলে কেন বকেছিল। যখন বকে তখন আমার তো মনে হয় একা একা থাকি বা চলে যাই, কিন্তু আমি কি কোথাও গিয়েছি? আমি তো যাই না। আমি তো জানি বাবা আর মা আমাকে ভালোবাসে। আমি তো জানি দাদু আর ঠাকুমা কাঁদবে আমাকে দেখতে না পেলে। আমার মনখারাপ করলেও আমি যাই না। আর আমি হুপুসকে বকেছি বলে হুপুস হারিয়ে গেল? পিংকা, রিঙ্কা, পুটুলি, গুটুলি এদেরও বুঝি মন খারাপ হচ্ছে না? আসলে হুপুস তো খুব মারপিট করতে চাইছিল সবার সঙ্গে, তাই আমি ওকে সরিয়ে দিয়েছিলাম। এই দেখো, এখানে আমি সবাইকে নিয়ে এসেছি।”

বুকুন এতক্ষণ একটানা বলে যাচ্ছিল আর টুকুন তার মোটা চশমার ফাঁক দিয়ে বুকুনের দিকে তাকিয়ে ছিল। টুকুন তার সাদা দাড়িতে মাঝে মাঝে হাত বুলিয়ে নিচ্ছিল আর কিছু বুঝতে পারছিল না বলে শুনে যাচ্ছিল। আগের অভিজ্ঞতা থেকে টুকুন জানে বুকুন কথা বলতে শুরু করলে আর থামে না। যখন বুকুন হাতে ধরা বাক্সটা খুলে দেখাল, তখন টুকুন বুঝতে পারল যে এতক্ষণ ধরে বুকুন ভেলভেট পোকার কথাই বলছিল। টুকুন জানে এই ভেলভেট পোকা হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যায় না। এরা এমনিতে লাজুক হয়, কারোর কোনও ক্ষতি করে না।
টুকুন জানে এখন যদি বুকুনকে বলে ওই ভেলভট পোকা হয় পাখিতে খেয়েছে বা অন্য কোথাও চলে গেছে, তাহলে বুকুনের মনখারাপ হবে।

তাই টুকুন শান্ত গলায় বলতে শুরু করল, “শোনো, তোমার হুপুস আমার কাছেই এসেছে। আমি তো ফড়িং ধরছিলাম আর ছেড়ে দিচ্ছিলাম তাই দেখে আমার কাছে এসেছিল। ওদের তো এইভাবে ধরে রাখতে নেই। এই দেখো, এই বাগানে ছোট-বড় কত ফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছে আর প্রজাপতিও। তোমার ওই ভেলভেট পোকা এখন অন্য ধরনের প্রজাপতি হয়ে গিয়েছে। এমনিতে ভেলভেট পোকারা প্রজাপতি হয় না, সে তো তুমি জানোই। শুঁয়োপোকা থেকে পরে প্রজাপতি হয়। তুমি কিন্তু ভুলেও শুঁয়োপোকা ধরতে যেও না, ওদের গায়ে রোঁয়া থাকে। হাতে সেই রোঁয়া ফুটে গেলে খুব ব্যথা আর জ্বালা করবে, ফুলেও যেতে পারে। কিন্তু তোমার ভেলভেট পোকা অন্যরকম, তাই সে প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। ওর মনে আর দুঃখ নেই। তুমি বরং স্কুলে যাও আর কাউকে নিজের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এসো না তার যদি ইচ্ছে না থাকে। এদের বাড়ি তো তোমার স্কুলের মাঠে। ওখানেই তো ওদের সব বন্ধু আর বাবা মা থাকে। তাদের ছেড়ে কি এদের থাকতে ভালো লাগে বলো?”

বুকুন তাই শুনে আলতো করে বাক্সটা টুকুনের হাতে দিয়ে বলল, “আমি আর ওদের ধরব না। তুমি পিংকা, রিঙ্কা, পুটুলি, গুটুলি এদেরও বলে দাও না। ওরাও যেন প্রজাপতি হয়ে যায়। হুপুস তো একা থাকেনি আগে। ওদের ফিরে পেলে সবাই মিলে আনন্দ করবে।”

এই বলে বুকুন মাথা নিচু করে চলে গেল।

সেইদিন স্কুলে বুকুন স্কুলে জানলার বাইরে দেখে প্রজাপতি উড়ছে। সব লাল প্রজাপতি। গুনে গুনে পাঁচটা। বুকুন সবাইকে চিনতে পারল। পিংকা, রিঙ্কা, পুটুলি, গুটুলি আর সবার মাঝে রয়েছে হুপুস। সবাই ভালো আছে।

আর ওইদিন রাতে টুকুন স্বপ্নে দেখল, মাঠ জুড়ে সে প্রজাপতি আর ফড়িং-এর পিছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছে আর আর শিউলিগাছটার গোড়া জুড়ে যে শুঁয়োপোকারা সাদা হয়ে ঘিরে ছিল তারা একটা-একটা করে প্রজাপতি হয়ে যাচ্ছে।

 

ছবি — সুমিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published.