বনভোজনের মেনু হয়েছিল সাদা ভাত, বেগুনি, কড়াইশুঁটি দিয়ে সোনামুগ ডাল, চিকেন কষা আর পেঁপের চাটনি। কালাকাঁদ শেষপাতে দেওয়ার কথা হয়েছিল। কিন্তু বাজেটে কুলোয়নি। বেলা দুটোর সময় ক্লাবের আটজন সদস্য খেতে বসেছে। শীতকালের বেলা পড়ে আসছে। আমগাছের পাতার ফাঁকে ঝিরিঝিরি রোদ। কিলোটাক মাংস ও সমপরিমাণ ভাত শালপাতায় নিয়েও মুটুকুদা কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। যেন একটা হিসেব মিলছে না।
ভাতে-মাংসে মেখে সে মুখের ভিতর বিপুল গরাস পুরে দেয়। তার অন্যমনস্কতায় মাংসের ঝোল শালপাতার কিনার দিয়ে গড়িয়ে গেল ঘাসের উপর।
মাংস চিবুনোর ফাঁকে মুটকুদা বারবার ক্লাবের অন্যান্য সদস্যদের পাতের দিকে তাকাচ্ছে। মাংস আনতে পাঠানো হয়েছিল হৃষিকেশকে। ওর গায়ে খুব জোর আর মাথায় তেমনি কম বুদ্ধি। হৃষিকেশের সঙ্গে তাই বাজারে দরদাম করতে গেছিল নাথু। নাথুর পড়াশুনায় বেজায় মাথা। ধূপকাঠির মতো লিকলিকে হাত-পা। হৃষিকেশ আর নাথুর পাতে দু-পিস করে চিকেন পড়েছে। সঙ্গে দুটো আলু। এই সামান্য পরিমাণ খেতে দুজনে হিমশিম খাচ্ছে। বনভোজনের খেলাধুলার দায়িত্বে রণেন, তুরু আর সোমপ্রকাশ। সোমপ্রকাশ খেতে পারে। তার শালপাতার এককোণে মাংসের স্তূপ। মুটকুদা মনে মনে হিসেব কষল— সোমপ্রকাশ প্রায় পাঁচশ গ্রাম চিকেন খেল। রণেন আর তুরু তিন পিস করে চিকেন পেয়েছে। ওরা দুজনেই খেলাধুলোয় ভালো। ডায়েট মেপে খাওয়াদাওয়া করে। ক্লাবের সেক্রেটারি বিশ্বর বাবা মুদি দোকানের মালিক। বিশ্ব তাই চাল, ডাল, আলু আর মশালা সস্তায় জোগাড় করেছে। মুটকুদা আড়চোখে বিশ্বের পাতের দিকে তাকাল। বনভোজনের অন্যান্য কাজের দায়িত্ব ছিল বিশ্বর কাঁধে। ঠাকুরকে সে মশালা বেটে দিয়েছে। মাটির উনান কাটতে সাহায্য করেছে। খেতে বসে বিশ্ব এখন হাঁপাচ্ছে। এক পিস মাত্র চিকেন তার পাতে। বিশ্বের চেলা নবধর। ক্লাস সিক্স। নাদুসনুদুস। নবধর তার গুরুর ভাগের চিকেন কষা নিজের পাতে নিয়েছে। অবশ্যই গুরু তার চেলাকে পারমিশান দিয়েছে। মুটকুদা মনে মনে আঁক কষল— সবার যা চিকেন খাওয়ার বহর তাতে বড়জোর তিনকেজি চিকেন পরিবেশিত হয়েছে।
মুটকুদা গলা উঁচিয়ে বলল— ও ঠাকুর আরও চিকেন আনো।
রাঁধুনি ঠাকুর চাটনি পরিবেশান করা শুরু করেছিল। বিরক্ত হয়ে জবাব দিল— চিকেন আর কাঁহা ! সব তো একা তুম হি খা গ্যায়া।
মুটকুদা ফের চিন্তার সাগরে ডুব দিল। পরিকল্পনা হয়েছিল পাঁচ কেজি মুরগি কেনা হবে। মুটকুদার ভাগে পড়বে এক কেজি। বাকিদের মাথা প্রতি পাঁচশ গ্রাম। এক্সট্রা রইল আরও পাঁচশ গ্রাম। যাতে চিকেন কষা কারোর ভাগে কম না পড়ে। একটু বেশি বেশি করেই হিসেবটা করা হয়েছিল। থুড়ি, মুটকুদা করেছিল। সে ভালোমতো জানত যে তাকে বাদ দিলে বাকিরা গড়ে দুশ গ্রাম মাংসও খেতে পারবে না। ফলে অনায়াসে আড়াই-তিন কেজি চিকেন কষা বেঁচে যাবে। সেই অতিরিক্ত চিকেন কষা মুটকুদার নিজস্ব। আহা কত স্বপ্নই না সে দেখেছিল। বাস্তবে দেখা গেল দু-কেজি চিকেন জাস্ট গায়েব। ভ্যানিশ। ফুড়ুত। ধরে নিই, মুরগি কাটা ও পরিষ্কারের সময় নাড়িভুঁড়ি বাদ যাবে। একশ গ্রাম, দুশ গ্রাম, আচ্ছা না-হয় পাঁচশ গ্রামই নষ্ট হল। বাকি দেড় কেজির চিকেন কষা কই! এ তো দিনেদুপুরে চুরি।
মুটকুদা ইলেভেন সায়েন্স। বায়োলজিতে বেজায় ভালো। অঙ্কে কাঁচা। ডিটেকটিভ গল্পের পোকা। পাড়ার লাইব্রেরির চাইল্ড সেকশানের সব ডিটেকটিভ বই সে পড়ে ফেলেছে। আঠারো বছর বয়স হলে আডাল্ট সেকশানের বই পড়া যায়। বুড়ো লাইব্রেরিয়ানের ক্ষীণ দৃষ্টির সুযোগ নিয়ে মুটকুদা এখন আডাল্ট সেকশানের ডিটেকটিভ বই পড়া শুরু করেছে। কীসব নাম তাদের— পোস্টম্যান কখনও দুইবার বেল বাজায় না। স্কুলে ল্যাবরেটরির ক্লাসে মুটকুদা গোয়েন্দা গল্পের বইয়ে নিমগ্ন থাকে। যেন বইয়ের প্রতিটা অক্ষর খুঁটে তুলে নেবে। ক্লাসের ছেলেরা মুটকুদার নাম দিয়েছে রহস্যখুঁটুনে মুটকু।
হাতের তালু থেকে চাটনি চাটতে চাটতে মুটকুদা মনে করবার চেষ্টা করল— বাজার থেকে পাঁচ কেজি মুরগির মাংস এসেছিল। ঠাকুর আর বিশ্ব মিলে সেই মাংস ধুল। মশালা মাখানো হল। আমতলায় খেলাধুলার ফাঁকে মুটকুদা আড়চোখে রান্নার আয়োজন দেখছিল। ঠাকুর বিলের জলে কড়াই ধুতে গেলে বিশ্বও তার পিছু পিছু গেছিল। কড়ায় যখন মাংস চাপল মুটকুদা তখন ইটের পাঁজার উপর বসে মাংস রান্নার সুঘ্রাণ নিচ্ছিল। মোটের উপর পাঁচ কেজি মুরগি সারা সকাল তার চোখের সামনেই ছিল। তাহলে দেড়-দু কেজি চিকেন কষা কোথায় পালাল? মরা মুরগির নিশ্চয়ই ডানা গজাবে না। চোখের সামনে দিয়ে অতটা চিকেন কষা ভ্যানিশ হয়ে যাবে আর রহস্যখুঁটুনে মুটকুদা তা মেনে নেবে! নেভার, কভি নেহি।
চাটনি পরিবেশন করে ঠাকুর উনানের আগুন নেভাতে গেছিল। সেই সুযোগে মুটকুদা বিশ্বের কাছে জানতে চাইল— হ্যাঁ রে বিশ্ব, ঠাকুর কাঁচা মাংস সরিয়ে রাখেনি তো?
বিশ্ব হাঁপাতে হাঁপাতে বলল— অত ভেব না তো। চাটনি খাবে, চাটনি খাবে আরও? চাটনি আছে।
“নিকুচি করেছে চাটনির।” বলে মুটকুদা হাত ধুতে উঠে গেল।
খেয়ে উঠে তার প্রবল অম্বল হল। অম্বলের জ্বালা নয়, মুটকুদাকে অশান্ত করছিল চিকেন কষার শোক। খাওয়াদাওয়ার পর বাকিরা আমতলায় মাদুর পেতে তন্দ্রা দিল। মুটকুদা ভুঁড়িতে তুড়ি মেরে উঠে গুটিগুটি পায়ে রান্নার জায়গায় এল। এঁটো বাসনকোসন পড়ে আছে। নিভন্ত উনান থেকে ধোঁয়া উঠছে। রাঁধুনি ঠাকুরকে চোখে পড়ল না। মুটকুদা এঁটো থালাবাসনে উঁকি দিল। চিকেন কষার চিহ্ন নেই। চেটেপুটে সব সাফ। একটা শুকনো আমকাঠ দিয়ে কাঠকয়লা সরিয়ে দেখল। সেখানে কিছু লুকানো নেই। কেবল ছাই। এক-পা জঙ্গলের দিকে এগোতেই দেখে আমগাছের আড়ালে ঠাকুর শালপাতার থালা নিয়ে গপাগপ খাবার সাঁটাচ্ছে।
মুটকুদা ঝাঁপিয়ে পড়ল— হ্যাঁ রে ব্যাটা, তুই এখানে বসে মাংস খাচ্ছিস?
ঠাকুর বেজায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল— আমি ভেজ আদমি আছি। এই দেখ বাবুসাব, ডাল, ভাত। চাটনি। বেগুনি অবধি খতম হো গিয়া।
ঠাকুরের পাতে মাংসের হাড়গোড় অবধি নেই। মুটকুদা লজ্জায় লাল হল। ফিরে আসতে যাবে এমন সময় কানে এল বাসনকোসনের ধাতব শব্দ। মুটকুদা ছুটে রান্নার জায়গায় এল। তুরু বাসনকোসনের ভিতর কিছু খুঁজছে। আগেরবারের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে মুটকুদা মিষ্টি করে হেসে বলল— হ্যাঁ রে তুরু, চিকেন কষা খুঁজছিস বুঝি?
তুরু হতাশ গলায় বলল— চিকেন? কোথায় চিকেন কষা, সে তো শেষ।
– তাহলে এঁটো বাসনকোসন ঘাঁটছিস কেন রে? মুটকুদা প্রশ্ন করল।
– আমি তো কালাকাঁদ খুঁজছি। কালাকাঁদ হওয়ার কথা ছিল না। জিভটা কেমন যেন মিষ্টি-মিষ্টি করছে। তুমি কি চিকেন কষা খুঁজে পেলে?
বলে তুরু চলে গেল।
মুটকুদা ইটের পাঁজার উপর ভগ্নমনোরথ হয়ে বসে রইল। খানিক বাদে ঠাকুর ঢেঁকুর তুলতে তুলতে এসে বলল— চিকেন যা এসেছে তা তো হামি পুরাই রেঁধেছে। এক্সট্রা চিকেন হামি কী করে রাঁধবে মুটকুবাবু!
ঠাকুরের কথায় মুটকুদার মৃদু খটকা লাগল। ফের কোনও বুদ্ধি ভাঁজতে ভাঁজতে সে আমতলায় ফিরে এসে মাদুরের উপর তন্দ্রা দিল। পায়ের উপর পা। আঙুল দিয়ে ভুঁড়িতে তবলা বাজাচ্ছে। দুই চোখ বন্ধ। ক্লাবের অন্যান্য সদস্যরা সবে দ্বিপ্রাহরিক তন্দ্রা দিয়ে উঠেছে। খানিক অন্ত্যাক্ষরী খেলা হল। রণেন প্রস্তাব দিল— চল, ক্রিকেট খেলি। বাকিরা রাজি হল না। এখনও দুপুরের খাওয়া হজম হয়নি। তার উপর শীতের বেলা পড়ে আসছে। আলো কম। বল হারিয়ে যাবে। সোমপ্রকাশ বলল— ধাঁধার কম্পিটিশান হোক। সবাই তাতে রাজি। বিশ্ব বলল— আমি একটা ধাঁধা বলছি। একটা অ্যাকোয়ারিয়ামে দশটা মাছ ছিল। তার মধ্যে দুটো মাছ অসুখে ভুগে মারা গেল। এখন ক-টা মাছ আছে?
তুরু উত্তর দিল— আটটা।
সোমপ্রকাশ বলল— ভুল। দশটা মাছই আছে, মরা মাছগুলো আর যাবে কোথায়!
তুরু গজগজ করে বলল— কেন নেট দিয়ে তুলে মাটিতে পুঁতে দিয়ে আসা হবে। আমাদের কাকা তো তাই করে।
সোমপ্রকাশের ধাঁধার পর হৃষিকেশ বেজায় উৎসাহে উঠে দাঁড়িয়ে বলল— আমিও একটা ধাঁধা বলব। একটা ইলেকট্রিক তারে দশটা পাখি বসে ছিল। এক শিকারি পাখিদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল। দুটো পাখি গুলি খেয়ে মরে গেল। এখন তারে ক-টা পাখি আছে?
তুরু ফের গজগজ করে বলল— কী সব পুরানো ধাঁধা। তারে এখন একটাও পাখি নেই।
– ভুল। তারে আটটা পাখিই আছে। হৃষিকেশ সোৎসাহে ঘোষণা করে।
হাসির রোল উঠল। রণেন আর নাথু হৃষিকেশের হাত ধরে টেনে মাদুরে বসিয়ে দিল। মুটকুদা হৃষিকেশের ধাঁধা শুনে তড়াং করে মাদুরের উপর উঠে বসে বললে— হ্যাঁ রে হৃষিকেশ, আমার একটা ধাঁধার জবাব দে দেখি। অন্য কেউ কিন্তু উত্তর দিবি না। এক কেজি মুরগির দাম যদি আশি টাকা হয় তাহলে পাঁচ কেজি মুরগির দাম কত হবে?
হৃষিকেশ সামান্যও না-ভেবে উত্তর দিল— খুব সোজা! দুশো চল্লিশ টাকা।
আসরে ফের হাসির রোল উঠল। মুটকুদাও হাসিতে যোগ দিল। কেবল নাথুর মুখ গম্ভীর। মুটকুদা খেয়াল করল।
বিকেলবেলা বাড়ি ফেরার পথে মুটকুদা নাথুর কনুই ধরে রাস্তার ধারে সরিয়ে আনল। নাথু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।
মুটকুদা বলল— যে মুরগি বাজার থেকেই আসেনি, সেটা রান্না হবে কী করে! হৃষিকেশের উপর দায়িত্ব ছিল পাঁচ কেজি মুরগি কেনার। বাজারে মুরগির রেট যাচ্ছে আশি টাকা কেজি। সেই হিসেবে হৃষিকেশকে দেওয়া হয়েছিল চারশো টাকা। হৃষিকেশ অঙ্কে কাঁচা। পয়সার হিসেব বোঝে না। বাজার-খরচ ওর পকেটে থাকলেও, বাজারটা আসলে তুই-ই করেছিস। সম্ভবত কাল বা পরশু তুই দোকানদারের সঙ্গে বোঝাপড়া সেরে রেখেছিলি। দোকানদার চাইলে আপত্তি করতে পারত। সেক্ষেত্রে তুই অন্য দোকানে চলে যেতিস। দোকানদারের ব্যবসার ক্ষতি হত। আজ সকালে মুরগির দোকানে গিয়ে তুই চেয়েছিলি পাঁচ কেজি চিকেন। দোকানদার চুপচাপ প্যাকেট করে দিয়েছে তিন কেজি মুরগি। দাম চেয়েছে দুশ চল্লিশ টাকা। পাঁচ কেজি মুরগির দাম তুই মিটিয়েছিস দুশ চল্লিশ টাকায়। হৃষিকেশ সেটাই মনে রেখেছে। তাই আমার ধাঁধার উত্তরে বিন্দুমাত্র না ভেবে ও যা দেখেছে তা-ই বলেছে।
নাথু দুই কান ধরে বলল— খুব ভুল হয়ে গেছে মুটকুদা। আর কোনোদিন হবে না।
মুটকুদা হেসে বলল— সে ভালোই করেছিস। বেশি চিকেন কষা-টষা খাওয়া ভাল না। খুব অম্বল হয়। পয়সাও বাঁচল।
নাথুও অল্প হেসে বলল— একশ ষাট টাকা। টোটাল।
– বেঁচে যাওয়া টাকাটা ক্লাবের ফান্ডে জমা করে দিস। সামনের হপ্তায় একদিন আমাদের বাড়ির ছাদে খিচুড়ি পিকনিক হবে। বলে মুটকুদা বাড়ি ফেরার পথ ধরল।
এই গল্পের কমিকস্ এঁকেছেন রেহা ঘোষ শর্মা। সেটা পড়তে ক্লিক করো এখানে।
অলংকরণ – লেখক
Leave a Reply