সত্যান্বেষণে মাছি অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

সকাল সকাল ছোটবাবু ছুটতে ছুটতে এসে হাজির। হাতে একটা ছোট শিশি – ওষুধের খালি শিশিই হবে। বাবা ডাক্তার, তাই বাড়িতে ওষুধের শিশির অভাব নেই। শিশিটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “মামাদাদু, দেখো কী ধরেছি।” শিশিটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম শিশির ভিতরে কী আছে। বুঝলাম ছোটবাবু বাগান-সফর করেছেন এবং গাছে পোকা দেখতে পেয়ে সেটা বোতলবন্দী করতে দেরি করেননি। আমি না বোঝার ভান করে বললাম, “নাঃ, বুঝতে পারছি না। কী আছে বলো তো?” আমার থেকে শিশিটা নিয়ে বোতলবন্দী পোকাটাকে দেখিয়ে বলল, “তুমি বুঝতে পারছ না। দেখো, একটা পোকার লার্ভা ধরেছি। এটা কয়েকদিন পরে প্রজাপতি হয়ে যাবে।” আমি তখন ছোটবাবুকে বললাম, “বা! বা! তুমি পোকার লার্ভা ধরেছ, ভালো কথা। মনে রেখো ওদেরও খিদে পায়। তাই তুমি ওদের খেতে দিও কিন্তু। না হলে তো ওরা মরে যাবে। তুমি যে গাছ থেকে এটা ধরেছ সেই গাছের কয়েকটা পাতা শিশিটার মধ্যে রেখে দিও। প্রতিদিন শুকনো পাতা পরিষ্কার করে, নতুন পাতা দিও।”  আমার কথা শুনে ছোটবাবু খুশিই হল। বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে।”

ওকে আবার বললাম, “তুমি তো গোয়েন্দা গল্প পড়তে ভালোবাস। গোয়েন্দারা কত বুদ্ধি খরচ করে নানা কৌশলে খুনি ধরে। তুমি কি জানো এই লার্ভাদের গতিবিধি দেখে অনেক কিছু বোঝা যায়। ফলে খুনি ধরতে অনেক সুবিধা হয়?” আমার কথা শুনে ছোটবাবু তো অবাক। বলল, “তাই বুঝি! আমি তো শুনিনি পোকাদের সাহায্যে খুনিদের ধরা যায়।”

আমি গল্প শুরু করলাম।

 

জোড়া খুনের গল্প

 

সে অনেকদিন আগের কথা। ১৯৩৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক সকালে এক মহিলা ছোট্ট এক নদীর সেতু পার হচ্ছিলেন। নীচের দিকে তাকাতেই তিনি চমকে উঠলেন। তাঁর মনে হল মানুষের মৃতদেহের অংশ নীচে পড়ে আছে। ঘটনাটি ঘটেছিল স্কটল্যান্ডের ডামফ্রিশায়ারে। পুলিস এসে মৃতদেহের অংশগুলি পরীক্ষা করে। পুলিস আরও জানতে পারে প্রায় ১০০ মাইল জায়গা জুড়ে কেউ বেশ কিছু মৃতদেহের অংশ ফেলেছে। মৃতদেহগুলি টুকরো-টুকরো করে ফেলার উদ্দেশ্য, যাতে সেগুলো সনাক্ত না করা যায়। তাছাড়া মুণ্ডগুলি থেকে নাক, মুখ এবং চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। যেভাবে এই কাজ করা হয়েছিল, তার ধরন দেখে পুলিসের সন্দেহ হয় যিনি খুন করেছেন, তাঁর মানবদেহ এবং তার গঠন সম্বন্ধে যথেষ্ট পরিষ্কার ধারণা রয়েছে।

ছোট্ট নদীর ধারে যে মৃতদেহের টুকরোগুলি পড়েছিল সেই টুকরোগুলির সঙ্গে মাছির ম্যাগট (মাছির শুককীট) পাওয়া যায়। এই ম্যাগটগুলি পরীক্ষা করার জন্য এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ জি মিরন্স-এর (Dr. A.G. Mearns) কাছে পাঠানো হয়। উনি এগুলি পরীক্ষা করে জানান যে এগুলি ব্লো ফ্লাই-এর (আম-কাঁঠালের সময় নীল বা সবুজ রঙের মাছি) ম্যাগট। মাছিটির বিজ্ঞানসম্মত নাম Calliphora vicina এবং তিনি আরও জানান, এই লার্ভাগুলির বয়স মোটামুটি ১২ থেকে ১৪ দিন। বিজ্ঞানীর দেওয়া এই তথ্য থেকে ধারণা করা হয় খণ্ডিত মৃতদেহগুলি ১২-১৪ দিন আগে নদীর ধারে ফেলা হয়। কারণ এই মাছিগুলি মৃত্যুর কয়েক মিনিটের মধ্যে মৃতদেহে ডিম পাড়ে। মাছিগুলি মৃতদেহ থেকে নির্গত গ্যাস সনাক্ত করতে পারে খুব তাড়াতাড়ি। এরা সাধারণত নাক এবং মুখের মধ্যে ডিম পাড়ে। কারণ মূলত দেহের এই দুটি ছিদ্র দিয়েই গ্যাস নির্গত হয়।

মৃতদেহের টুকরোগুলি খবরের কাগজে মুড়ে ফেলা হয়। এই খবরের কাগজগুলির একটি সানডে গ্রাফিকের একটি বিশেষ সংখ্যা। এই কাগজটি শুধুমাত্র ল্যাঙ্কাস্টার এবং মোরক্যাম্বে অঞ্চলেই পাওয়া যেত। পুলিস সানডে গ্রাফিকের গ্রাহক নামের তালিকা থেকে এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ ডাক্তারের সন্ধান পায়, যার বাড়িতে মেরি জেন রজারসন নামক এক পরিচারিকা কাজ করত। মেরি জেনের পিতা পুলিসকে জানায় তার মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

যে তিনটি কারণে ডাক্তারের উপর পুলিসের সন্দেহ গভীর হয়, সেগুলি হল –

১) যিনি খুনগুলি করেছেন তাঁর মানব শরীর সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান আছে।

২) সানডে গ্রাফিকের গ্রাহক নামের তালিকায় এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ ডাক্তারের নাম রয়েছে।

৩) মোটামুটি ১২-১৪ দিন আগে খুন সংঘটিত হয়েছে। পুলিস তাই লব্ধপ্রতিষ্ঠ ডাক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করে এবং ডাক্তারের হাতে একটি ক্ষতের সন্ধান পায় যে ক্ষতটি ১২-১৪ দিন আগেই তৈরি হয়েছে। এই ডাক্তারটি আর একটি ভুল করেছিলেন। তিনি এক মহিলা রোগীকে ডেকেছিলেন ক্ষতের পরিচর্যার জন্য। এই মহিলাটি পুলিসকে জানায় তিনি ডাক্তারের বাড়িতে দুর্গন্ধ পান এবং বিভিন্ন স্থানে রক্তের দাগ দেখেছেন। পুলিস এই ডাক্তারকে ১৯৩৫ সালের ১৩ অক্টোবর গ্রেফতার করে।

নিশ্চয় জানতে ইচ্ছা করছে কে এই খুনি ডাক্তার। এই ডাক্তারের নাম বক্তিয়ার রুস্তমজি রতনজি হাকিম। তৎকালীন বোম্বাইয়ের বাসিন্দা। ডাক্তারি পাস করার কিছুকাল পর ইংলন্ডে যান। সেখানে পুনরায় পড়াশোনা করেন আরও ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর ডাক্তারি শুরু করে যথেষ্ট নাম করেন। ডক্টর হাকিম পরে আইন মোতাবেক নিজের নাম পরিবর্তন করেন। নাম হয় ডাক্তার বাক রাক্সটন। সেখানে ইসাবেলা কের নামক এক মহিলাকে বিবাহ করেন। তাঁদের তিন সন্তান জন্মায়। ইসাবেলার সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে রাগের মাথায় তাঁকে খুন করেন। পরিচারিকা রজারসন খুনের ঘটনা জানতে পারায় ডক্টর রাক্সটন তাকেও খুন করেন। বিচারে রাক্সটনের ফাঁসি হয়।

 

আরও একটি খুন

 

উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্বের একটি স্থান। নভেম্বরের মাঝামাঝির এক বিকাল। একটি বাড়ি থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে, তাই প্রতিবেশীরা পুলিশ ডেকেছে। পুলিস এসে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে দুর্গন্ধের কারণ অনুসন্ধান করতে দেরি করেনি। খুঁজতে গিয়ে তারা লক্ষ করে নোংরা বেসমেন্ট (আমেরিকায় বাড়ির এক তলাকে বেসমেন্ট বলে। অনেক সময় বেসমেন্টটি মাটির নীচে অবস্থিত।) থেকে এই গন্ধ আসছে। বেসমেন্ট-এর মাটি খুঁড়ে পুলিস দেখতে পায় এক কমবয়সি মহিলাকে খুন করে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। এই মৃতদেহ পচে গন্ধ বের হচ্ছে। মৃতদেহের উপর মাটির আস্তরণ পাতলা হওয়ার জন্য গন্ধ বের হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে খুনি তাড়াতাড়ি এই কাজ করে পালিয়েছে। মৃতদেহের মাথায় একটি গুলির চিহ্ন রয়েছে, তাই সন্দেহ করা হচ্ছে গুলির আঘাতেই যুবতীর মৃত্যু ঘটেছে।

পুলিসের সঙ্গে এক জন ফরেনসিক এন্টোমলজিস্ট (অপরাধ বিষয়ে পারদর্শী বিশেষ ধরনের কীটতত্ত্ববিদ) এসেছিলেন। মৃতের দেহ এবং যে স্থানে কবর দেওয়া হয়েছিল সেই স্থানটি ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়। মৃতদেহ এবং কবরস্থ মাটিতে প্রচুর পরিমাণে মাছির লার্ভা এবং পিউপা মেলে। পোকার নমুনাগুলি আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করবার জন্য ল্যাবরেটরিতে আনা হয়। কবরের মাটির তাপমাত্রা এবং গত কয়েকদিনের আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। কীটতত্ত্ববিদ মাছির লার্ভা এবং পিউপাগুলি ল্যাবরেটরিতে প্রতিপালন করেন এবং দুইটি প্রজাতির পূর্ণাঙ্গ মাছি পাওয়া যায়। মাছির জীবনতত্ত্ব এবং অন্যান্য তথ্য পরীক্ষা করে কীটতত্ত্ববিদ বিজ্ঞানী পুলিসকে জানান যে, ২৮ দিন পূর্বে এই মহিলার মৃত্যু ঘটেছে।  বিজ্ঞানীর কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়ার পর পুলিস দোষী ব্যক্তির খোঁজ করতে থাকে এবং এক মহিলাকে সন্দেহভাজন হিসাবে সনাক্ত করা হয়। মহিলাকে পুলিস ধরার পর সে স্বীকারোক্তি দেয়। পুলিসকে জানায় যে সেই খুনি। ২৮ দিন আগে সে গুলি করে ওই যুবতীকে খুন করে এবং খুন করার পর তাড়াতাড়ি বেসমেন্টের মাটি খুঁড়ে মৃতদেহ মাটি চাপা দিয়ে পালায়। কীটতত্ত্ববিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই পুলিস খুনিকে ধরতে সক্ষম হয়।

 

আমার কাছে দুটো খুনের ঘটনা শুনে ছোটবাবু অবাক। ভাবতেই পারছে না পোকার সাহায্যে এইভাবে খুনি ধরা যায়। তাই অবিশ্বাসের সুরে আমাকে বলল, “মামাদাদু তুমি ঠিক বলছ তো?” ছোটবাবুকে বললাম, “এখনও আমাদের দেশে পোকার সাহায্যে অপরাধীদের ধরা হয় না। বিদেশে বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায় এই ধরনের কাজ করা হয়। তবে তুমি যখন বড় হবে তখন তোমরা আমাদের দেশে এই কাজ চালু করবে।” ছোটবাবু একটু হেসে বলল, “ঠিক বলেছ। সেটাই করতে হবে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published.