চোরাই হিরের চাতুরি অমিত দেবনাথ

ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে ভৃত্যের এগিয়ে দেওয়া কার্ডটায় চোখ বোলাল ট্রেন্ট। “ইনস্পেক্টর চার্লস বি ম্যুরহেড। পাঠিয়েছেন চিফ ইনস্পেক্টর ডব্লিউ মার্চ। হুম! জানতাম না তো যে মিস্টার মার্চ নতুন লোক নিয়েছেন। লোকটাকে দেখতে কেমন, ডেনিস?” জিজ্ঞেস করল ট্রেন্ট।

“মামুলি চেহারা স্যার। একদম সাধারণ।”

“বাহ! এক্কেবারে সাদা পোশাকের পুলিশ যাকে বলে।”

কফিটা শেষ করে উঠে দাঁড়াল ট্রেন্ট। “ওকে স্টুডিয়োতে নিয়ে বসাও। আর যদি ওর সঙ্গে কোথাও যেতে হয়, তাহলে মিস্টার ওয়ার্ডকে টেলিফোন করে বলবে আমি বিকেলে দেখা করতে পারব না।”

স্টুডিয়োতে ঢুকে ট্রেন্ট আর পুলিশ অফিসার পরস্পর পরস্পরকে ভালো করে দেখে নিচ্ছিলেন। পুলিশ অফিসারকে দেখে অবশ্য মনে হচ্ছিল না যে তিনি খুব আশ্বস্ত হয়েছেন। বছর কয়েক আগে স্যান্ডারসন সমস্যার সমাধানের পরই ট্রেন্টের জীবনটা বদলে গেছে। বয়স এখনও তিরিশ না ছুঁলেও তার মধ্যে এমন একটা হালকা চাল আর ঢিলেঢালা ভাব আছে যে প্রথম দর্শনে লোকজনের তাকে ভালো লাগতে পারে, কিন্তু মানসিকভাবে বিশেষ জোর পাবে বলে মনে হয় না। তার চেহারাটিও সাধারণ গোছের, ছোট ছোট কোঁকড়া চুলে ভরা মাথা, ছোটখাটো গোঁফ এবং তাকে দেখলেই বোঝা যায় যে সে বাহ্যিক ব্যাপারস্যাপার নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না।

পুলিশ অফিসার মিস্টার ম্যুরহেড অবশ্য আধুনিক চিত্রকলা সম্বন্ধে একেবারেই খোঁজখবর রাখেন না, কিন্তু তিনি এটা ভেবেই অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন যে কোনও চিত্রশিল্পী পুলিশি ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায়। কীসের আগ্রহ পায় কে জানে!

ম্যুরহেডের পাতলা চেহারা, মাথার চুল হালকা, হলদেটে গোঁফ। পরনে বেখাপ্পা গাঢ় রঙের স্যুট, গলায় একটা নিচু কলার, যেটা সাইজে অনেক বড়। চেহারায় বৈশিষ্ট্য বলতে বিশেষ কিছু নেই, শুধু খেলোয়াড়ি কাঠিন্য আর একজোড়া তরোয়ালের মতো তীক্ষ্ণ নীল চোখ ছাড়া। দেখে মনে হয় যেন কাম্বারল্যান্ডের কোনও সরল রাখাল ছেলে, শুধু চেহারাটা হয়ে গেছে ভাড়া–আদায়কারীর মতো।

“ইনস্পেক্টর মার্চের বন্ধুর দেখা পেয়ে বড়ই প্রীত হলাম,” ট্রেন্ট বলল, “বসুন, চুরুট খান। খান না? বেশ, বেশ। আপনাকে দেখে তো শক্ত ধাতের লোক বলে মনে হচ্ছে মশাই। এবার বলুন, কী ব্যাপার।”

অফিসার কাঁধ সোজা করে হাত দুটো হাঁটুর ওপর রাখলেন। “একটু সমস্যায় পড়েছি, মিস্টার ট্রেন্ট, ইনস্পেক্টর মার্চের ইচ্ছে আপনি আমাদের আনঅফিসিয়ালি সাহায্য করেন। গতকাল বিকেলে ডার্টমুর থেকে জেমস রাডমোর পালিয়েছে, জানেন বোধ হয়।”

“কই, না তো!”

“আজকের কাগজেই বেরিয়েছে, তবে শুধু খবরটাই, বিশদ বিবরণ নেই। ব্যাপার কী জানেন, ডার্টমুর থেকে পালানোর ঘটনা কিন্তু সচরাচর ঘটে না। যেভাবে পালিয়েছে, সেটাও খুব সাধারণ— বাইরে যেসব কয়েদিরা কাজ করছিল, তাদের ফাঁক দিয়ে, আসলে ওই সময় আচমকা খুব কুয়াশা পড়েছিল, তারই সুযোগ নিয়েছে আর কী। কিন্তু অন্য সবাই পালিয়ে যেভাবে জলায় ঘোরে, আর ধরাও পড়ে, তা না করে সে চলে যায় কয়েক মাইল দূরের রাস্তায়, আর কপালজোরে একটা মোটরগাড়ি পাকড়ায়, কুয়াশার জন্য ধীরে ধীরে আসছিল সেটা। সে গাড়িটার সামনে লাফিয়ে পড়ে আর ড্রাইভার গাড়ি থামাতেই রাডমোর তার দিকে তেড়ে গিয়ে একটা পাথরের বাড়ি মেরে তাকে অজ্ঞান করে দেয়। গাড়িটা ছিল এক আমেরিকানের, নাম ভ্যান সমারেন, বউয়ের সঙ্গে ঘুরতে এসেছিল এখানে।”

“বাহ, চমৎকার,” বলে উঠল ট্রেন্ট, “ওরা বুঝতে পারল ইংরেজরা ওদের কত আপন করে নিয়েছে।”

“মিস্টার ভ্যান সমারেন রিভলভার বার করে দুবার গুলি ছুঁড়েছিলেন বটে, কিন্তু তার মধ্যেই রাডমোর তাঁর সঙ্গে খানিকটা ধ্বস্তাধস্তি করে রিভলভারটা বাগায়। মিস্টার ভ্যান সমারেনের অবশ্য ধারণা, একটা গুলি ওর হাত ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে। যাই হোক, রাডমোর ওদের রিভলভার দেখিয়ে মোটরগাড়ি, কোট, টুপি, মিস্টার ভ্যান সমারেনের পকেটে যা ছিল, এমনকী মহিলার মানিব্যাগ পর্যন্ত সব কেড়েকুড়ে নেয়। তারপর সে তার কয়েদির পোশাকের ওপরে সেই কোট আর টুপি পরে গাড়ি চালিয়ে পুবদিকে চলে যায়। বাকিরা সেখানেই অপেক্ষা করে, যতক্ষণ ড্রাইভারের জ্ঞান না ফেরে, তারপর হাঁটা শুরু করে। বহুক্ষণ বাদে টু ব্রিজে এসে তারা সব খুলে বলে।”

“বাহ, চমৎকার!” পাইপ ধরিয়ে ট্রেন্ট আরেকবার বলল কথাটা। “ছোকরা ব্যাপারটা ম্যানেজ করেছে ভালো। তৎপরতা আছে, সিদ্ধান্তও সঠিক। সেনাবাহিনীতে গেলে পারত।”

“ছিল তো,” বললেন মিস্টার ম্যুরহেড, “ছিল তো একসময়। কিন্তু ব্যাপার হল, এখন সে কোথায়? আমরা এটুকু জানতে পেরেছি যে, সে গাড়িটা নিয়ে এক্সটার অবধি গেছিল, সেখানে রেলস্টেশনের ধারে গাড়িটা ফেলে রাখে। তার সঙ্গে ছিল দুটো ঢাউস সুটকেস আর একটা ড্রেসিং-ব্যাগ। মনে হচ্ছে গত রাত্তিরেই সে ট্রেনে করে ওখান থেকে লন্ডন এসেছে। এখানে নিশ্চয়ই ওর বন্ধুবান্ধব আছে, যারা ওকে সাহায্য করবে। যাই হোক, আপনার কি ডানবেরি লকেটের কেসটা মনে আছে, মিস্টার ট্রেন্ট? দু-বছর হতে চলল।”

“না, আমি বোধ হয় ও সময় ইংল্যান্ডে ছিলাম না।”

“তাহলে আপনাকে ঘটনাটা বলি। রাডমোররাও এর সঙ্গে জড়িত। আপনি এটা না জানলে আমাদের সাহায্য করবেন কী করে? বুড়ো জন রাডমোর বহু বছর কলকাতায় ডাক্তারি করত, ভালো প্র্যাকটিস ছিল সেখানে। প্রথমে সে ছিল আর্মির ডাক্তার। ভদ্রলোক বিপত্নীক, ভালো ফ্যামিলির লোক, ভালো পড়াশোনা, অত্যন্ত বুদ্ধিমান আর সেইরকম জনপ্রিয়। তার একমাত্র ছেলে হল এই জেমস রাডমোর, যে বেঙ্গল ক্যাভালরি রেজিমেন্টের একজন লেফটেন্যান্ট ছিল। জেমসও ছিল সবদিক দিয়ে ওর বাবার মতোই। ওর এক বোনও ছিল, ওর চেয়ে অনেক ছোট। দু-বছর আগে, জেমসের বয়স তখন তেইশ বছর, বুড়ো রাডমোর কোনও কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে। ঘটনাটা কী জানা যায়নি, কারণ পুরো ব্যাপারটাই চমৎকারভাবে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু লোকজনের মুখ কি আর বন্ধ রাখা যায়? বুড়ো রাডমোর প্র্যাকটিস ছেড়ে দেয়, তার ছেলেও কাগজপত্র পাঠায়। তারপর তারা তিনজনেই ইংল্যান্ডে চলে আসে, লন্ডনে থাকতে শুরু করে। ওদের যোগাযোগ ছিল ভালো, ফলে বোর্ড অব ট্রেড-এ জিম একটা চাকরিও জুটিয়ে নেয়। তার বোন তার মায়ের দিকের আত্মীয়দের কাছে চলে যায় থাকবে বলে। তার বাবা জার্মিন স্ট্রিটের ব্যাচেলরস চেম্বারে থাকতে শুরু করে। খনিজ সম্পদের দিকে তার বেশ আগ্রহ ছিল এবং সম্ভবত এখান থেকেই সে বেশ ভালোরকম পয়সা করে। তার থেকে বোধ হয় ছেলেকে একটা মোটা টাকাও দিয়েছিল সে।”

“তাতে কী হল? এতে কোনও গন্ডগোল ছিল কি?”

“তা জানি না, তবে এর পরে যা হল, তাতে এরকম ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে। জেমস রাডমোর জুয়া খেলতে শুরু করল, জিনিসপত্র নষ্ট করতে লাগল, আর খেলাধুলার জগতের কিছু সন্দেহজনক চরিত্রের লোকজনের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি শুরু করল। জেমস এমনিতেই বেপরোয়া গোছের, তার ওপর রাগলে একেবারে মুচির কুকুর, আর এই লকেটের ঘটনাটা যখন ঘটেছিল, তখন ও নিয়মিতভাবে বদ কাজ করে যাচ্ছিল। কিন্তু এটাও ঠিক যে, ও খুব চালাক, মজলিশি আর মজার মানুষ, একঝলক দেখলে দস্তুরমতো ভদ্রলোক মনে হবে, এবং যা শুনেছি, নজরটা সে উঁচুই রেখেছিল।”

ট্রেন্ট মাথা নাড়ল। “পুরোটাই তো বললেন দেখছি। লোকটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”

“একদিন ডানবেরি হাউসে বিরাট এক গার্ডেন-পার্টি হচ্ছে, জেমসও সেখানে ছিল। লেডি ডানবেরি পরেছিলেন লকেটটা। এটা ওই পরিবারের বিখ্যাত গয়না, তিনখানা হিরে আর কয়েকটা ছোটখাটো রত্ন দিয়ে তৈরি। সন্ধের বেশ খানিকক্ষণ পরে তিনি খেয়াল করেন হারের চেনটা ভাঙা আর লকেটটা উধাও। সে সময় বেশিরভাগ অতিথিই বিদায় নিয়েছিল, জেমস রাডমোরও তার মধ্যে ছিল। সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও কিন্তু কিছুই হল না। পরে একটা দাসীর মুখ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। তার কথা শুনে মনে হল, মাঠের একধারে সে এখানকারই কোনও চাকরের সঙ্গে একটু ফষ্টিনষ্টি করছিল। যদিও খানিকক্ষণ আগেই সেখানে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়েছে, তবে তখন ও জায়গাটা ফাঁকাই ছিল। ঘাসের ওপর কিছু একটা পড়েছিল, চাকরটির চোখ গিয়ে পড়ে সেখানে এবং কাছে গিয়ে দাসীটি লকেটটাকে চিনতে পারে। সে যখন এটা কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য এগোচ্ছে, তারা শুনতে পায় কারোর পায়ের আওয়াজ, কেউ একজন হেঁটে আসছে রাস্তা দিয়ে। ওরা ভাবে বোধ হয় ওদের ওপরতলার আর কোনও চাকর আসছে, এবং ওদের ওখানে দেখলে সে ঝামেলা পাকাতে পারে, এই ভেবে ওরা দুজনেই একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। তারপর দেখে জেমস রাডমোর মাটিতে কিছু খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে আসছে। জেমস লকেটটাকে দেখতে পেয়েই মুহূর্তের মধ্যে সেটাকে তুলে হাতে নিয়ে যেদিকে লোকজন ছিল, সেদিকে চলে যায়। ওরা দুজনই এটা দেখেছিল এবং স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছিল যে জেমস ওটা নিয়ে সোজা কাউন্টেসকেই দেবে, ওদের মাথাতেই আসেনি যে রাডমোরের মতো একজন তরুণ এটা চুরি করতে পারে।”

“কাঁচা কাজ হয়ে গেছে,” বলল ট্রেন্ট।

“পরে অবশ্য জানা গেছে যে বাজারে ওর প্রচুর দেনা ছিল এবং স্টক এক্সচেঞ্জেও বহু টাকা ঝাড় খেয়েছে,” বললেন ডিটেকটিভ, “কাজেই যেভাবেই হোক, ওকে টাকা জোগাড় করতেই হত।”

“ওর অবশ্য টাকা জোগাড় করার জায়গা আছে,” ট্রেন্ট বলল, “বাপের টাকা। চাপ দিলেই হয়।”

“হ্যাঁ, তবে সে তখন এখানে ছিল না,” মিস্টার ম্যুরহেড কাষ্ঠ হেসে বললেন, “সে গেছিল পূর্ব আফ্রিকার কোথাও কোনও খনিজ সংক্রান্ত ব্যাপারে, যদিও বোধ হয় বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। আর চাপ দিয়েও বিশেষ লাভ হত না, জেমসও সেটা ভালো করে জানত। ওদের সম্পর্কটা খুব ঘনিষ্ঠ আর গোপনীয় ছিল। যাই হোক, যা বলছিলাম, ওই দুজন সাক্ষী লকেট খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে জানানোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমি গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে জেমসের খোঁজে বেরোই এবং ন-টা নাগাদ সে যে হোটেলে ছিল, সেখান থেকে তাকে ধরি। ব্যাপার হল, আমি তাকে ধরতেই সে অবাক হয়ে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে, কিন্তু কোনও বাধা দেয়নি। লকেটটা ওর কাছে ছিল না। আমি একটা ট্যাক্সি করে ওকে নিয়ে রওনা হই। প্যান্টন স্ট্রিটে এসে সে আমার চোয়ালে একটা ঘুঁষি কষিয়ে আমাকে পেড়ে ফেলে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে হুইটকম্ব স্ট্রিটে ঢুকে দৌড়তে গিয়ে এক্কেবারে একটা কনস্টেবলের হাতের নাগালে গিয়ে পড়ে, কনস্টেবল ধরে ফেলে তাকে। জেমস অবশ্য হাত-পা চালাচ্ছিল সাঙ্ঘাতিকভাবে। তারপর আরও দুজন লোকের সাহায্যে তাকে বাগে আনা হয়। সে আর পালাতে পারেনি।”

“গতকাল পর্যন্ত পারেনি বলুন,” বলে উঠল ট্রেন্ট, “আচ্ছা, ডানবেরি হাউস থেকে বেরিয়ে হোটেলে ফেরার মধ্যে সে আর কোথায় গেছিল?”

“সে সম্ভবত গেছিল অ্যাডেলফির একটা ক্লাবে, সেখানে ঘণ্টাখানেক বিলিয়ার্ড খেলে সে ডিনার করে। যদিও তার বক্তব্য হল সে ডানবেরি হাউস থেকে বেরিয়ে সোজা হোটেলে যায়। সে যে ঠিক কখন ডানবেরি হাউস থেকে বেরিয়েছিল, সেটাই কেউ ঠিক করে বলতে পারছে না। আদালতে তার একটাই বক্তব্য ছিল, সে এ ব্যাপারে কিছুই জানে না, এসবই তাকে ফাঁসানোর চক্রান্ত। অকাট্য প্রমাণ ছিল তার বিরুদ্ধে, তার ওপর পুলিশ-টুলিশ পিটিয়ে কেসটা আরও খারাপ হয়ে গেছিল। বিচারে তার সশ্রম কারাদণ্ড হয়ে যায়।”

“তাহলে আপনি বলতে চাইছেন ও জিনিসটা কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল, বেরিয়ে এসেই নেবে বলে?”

“তা তো বটেই,” বললেন ডিটেকটিভ, “যেভাবেই হোক, ওর বহু টাকা ধার হয়েছিল, আর লোকজনের কথা সহ্য করতে না পেরেই ও এতবড় ঝুঁকিটা নিয়েছিল। জিনিসটা কোথায় ও জানত, সব কিছু মিটে গেলেই ও সেটা হাতাত।”

“তাই দাঁড়াচ্ছে ব্যাপারটা। তারপর বলুন।”

মিস্টার ম্যুরহেড একটা পকেটবই বের করলেন। “পালানোর তিন সপ্তাহ আগে জেমস রাডমোর একটা চিঠি লেখার সুযোগ পায়, সমস্ত নিয়মকানুন মেনেই অবশ্য। আসলে প্রথম থেকেই ও খুব ভালো ব্যবহার করছিল, কাজেই ওকে আদর্শ আসামির মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। ও চিঠিটা লেখে ওর বাবাকে। এখন ঘটনা হল, ওর বাবা, বুড়ো রাডমোরও সেই সময় ছ-মাসেরও বেশি সময় ধরে জেলে ছিল। আমিই তাকে গ্রেফতার করি, ব্যাংকের টাকা জুয়াচুরির দায়ে। কোর্টে সবার নজর কেড়েছিল কেসটা এর অভিনবত্বের জন্য। বুড়ো অবশ্য ভিজে বেড়ালের মতো নিজের অপরাধ স্বীকার করে কোনও ঝামেলা ছাড়াই সাজা নিয়ে নেয়।”

“বিরাট দার্শনিক,” বলল ট্রেন্ট, “তাহলে ও জেমসের কোনও চিঠি পায়নি।”

“অবশ্যই না। জেমস রাডমোরকে সব নিয়মকানুন মেনেই জানানো হয়েছিল যে তার চিঠিটা পাঠানো যাবে না, কারণটা অবশ্য ওকে বলা হয়নি। সে তখন তার চিঠিটা ফেরত দিতে বলে। সেটা একটা বড় ভুল, কারণ ডার্টমুরের গভর্নর আগেই ভেবেছিলেন যে ওই চিঠির মধ্যে নির্ঘাত কোনও খবর আছে, যা সাধারণভাবে বোঝা যাচ্ছে না। ওর চিঠিটা ফেরত চাওয়াতে এই ধারণা আরও দৃঢ় হয়। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে ওই চিঠির মধ্যে লকেটটা কোথায় লুকোনো আছে, তা কৌশলে বুড়ো রাডমোরকে জানানো হয়েছে। কেন তাঁর এরকম ধারণা হয়েছিল, আমি জানি না। চিঠিটা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হয়, যদিও তারা কিছু উদ্ধার করতে পারেনি।”

“বিশেষজ্ঞ বলেই পারেনি,” বলল ট্রেন্ট। “হুম! তাহলে আপনাদের ধারণা এই চিঠিটার মধ্যে বলা আছে গয়নাটা কোথায় লুকোনো রয়েছে, যদি মানেটা বার করা যায়, তাহলে গয়নাটা উদ্ধার করা যাবে। তার মানে আমাকে চিঠিটা পড়ে একটা মতামত দিতে হবে। বেশ। কই, দেখি চিঠিটা। আছে?”

ইনস্পেক্টর কথা না বলে পকেটবইটার থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বার করে ট্রেন্টের দিকে এগিয়ে দিলেন। সেখানে পরিষ্কার হস্তাক্ষরে লেখা—

 

বাবা,

এই প্রথমবার আমি অনুমতি পেয়েছি, তাই তোমাকে চিঠি লিখছি। আমার কাজের জন্য তুমি যে কষ্ট পেয়েছ, তার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত। আমার সবচেয়ে খারাপ লেগেছে এই কথা ভেবে যে আমাকে বলির পাঁঠা করার ফলে আমাদের সুনাম ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।

আমি ভেবেছিলাম আমাকে এখানে আনার আগে অন্তত একবার তোমার সঙ্গে দেখা হবে। আমি জানি, তুমি অন্তত বুঝবে যে আমি নিরপরাধ। যদি আমি ছাড়া পেয়ে দেখি তোমার দরজাও আমার কাছে বন্ধ, তাহলে আমি শেষ।

আমার শরীর ভালোই আছে, আগের চেয়ে ভালো। এখানে বেশিরভাগ সময়েই আমাকে খোলা আকাশের নিচে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করতে হচ্ছে, পতিত জমি পুনরুদ্ধারের কাজ। প্রথমে এই কাজ সাংঘাতিক কঠিন লাগছিল, মনে হচ্ছিল, আমার কোমরে যদি একটা কবজা আর তোমার ম্যান্টেলশেলফের ওপরে রাখা মূর্তিটার মতো, যার নাম আমি ভুলে গেছি, দশটা হাত থাকত, তাহলে ভালো হত। পরে অবশ্য সামলে নিয়েছি। বহু বছর ধরে তো বাইরের কাজ করিনি, কাজেই এটা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে বলা যায়। মনে হচ্ছে সব কিছু আরও নতুন করে শিখছি। এখন আমি সুস্থ, কিন্তু এর আগেই আমার একপ্রস্থ জ্বর হয়েছিল। কারোর ম্যালেরিয়ার ধাত থাকলে তার পক্ষে এ জায়গাটা মোটেই সুবিধের নয়। এর আবহাওয়া অনেকটা অ্যাপেলডিজকের কাছে গেল্ডারল্যান্ডের মতো, যেখানে আমি তিন বছর শয্যাশায়ী ছিলাম, মনে আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু এখানকার অসুখটা আরও মারাত্মক ছিল। দিনের পর দিন মাথা ঝিমঝিম করত, মনে হত মরেই যাব। শেক্সপিয়ারের লেখায় আছে না, যেখানে একজন সেই হতভাগ্য সম্বন্ধে বলছে যার ‘জ্বরে ভোগা গ্রন্থিগুলো জীবনের বোঝা নিতে পারে না’? আমার অবস্থা হয়েছিল একদম সেইরকম।

আমরা এখানে কীভাবে বাস করি এবং এখানকার ব্যবস্থা কীরকম, সেই নিয়ে আমার লেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু এই লেখাটা পরে অফিসাররা পড়ে দেখবে, তাই ইচ্ছে থাকলেও লিখতে পারছি না। জানো তো, স্ক্রব-এ বলেছে, ‘সাই বার্ডেন দাস নাখট সো হিনজহেন লাসেন’।

আমি এই চিঠি জার্মিন স্ট্রিটের পুরোনো ঘরের ঠিকানায় পাঠাচ্ছি, আশা করি তোমার হস্তগত হবে।

শেষ করলাম।

তোমার ভালোবাসার

জিম

 

ট্রেন্ট চিঠিটা খুব খুঁটিয়ে পড়ে ইনস্পেক্টর ম্যুরহেডের দিকে তাকাল। “কী বুঝলেন?” জানতে চাইলেন অফিসার।

“মামলা-মোকদ্দমার ক্ষেত্রে এ ধরনের চিঠিকে জজসাহেবরা যথাযথ বলে থাকেন, যার মানে হল, এই চিঠির মধ্যে দিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে কাউকে বোকা বানানোর চেষ্টা আছে। আমি এই চিঠির করুণ রসকে পাত্তা দিচ্ছি না, বরং আমারও মনে হচ্ছে এর মধ্যে কোথাও গড়বড় আছে। এর মধ্যে একটা জায়গা তো পুরোপুরি মিথ্যে বলেই মনে হচ্ছে আমার।”

“আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না,” ইনস্পেক্টর বললেন, “কিন্তু ও জেলে থাকার সময় যা যা লিখেছে, সবই তো সত্যি। সত্যিই তো ও খুব অসুস্থ ছিল…”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওগুলো তো সত্যিই, ও তো জানতই এই চিঠি কর্তৃপক্ষ পড়তে পারে। আমি সেসব নিয়ে কিছু বলছি না। শুনুন, এটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা দরকার, আর তার জন্য লাইব্রেরিতে যেতে হবে। আপনি কি ঘণ্টাখানেক বাদে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সামনে আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন?”

“পারব মিস্টার ট্রেন্ট,” উঠে দাঁড়ালেন ডিটেকটিভ, “সময় একদম নষ্ট করা যাবে না।”

ঠিক পঞ্চাশ মিনিট বাদে ইনস্পেক্টর সেখানে গিয়ে দেখলেন ট্রেন্টই একটা ট্যাক্সি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“উঠে পড়ুন,” বলল ট্রেন্ট, “ড্রাইভার জানে কোথায় যেতে হবে। এখানে বেশিক্ষণ লাগেনি, এমনকী আমি হলবোর্নে গিয়ে এটাও কিনে এনেছি।” সে পকেট থেকে একটা শক্তপোক্ত স্ক্রু-ড্রাইভার বার করল।

“এটা আবার কী? কীসের জন্য এটা?” গাড়ি পশ্চিমের দিকে ছুটতেই ইনস্পেক্টর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, “আমরা কোথায় যাচ্ছি? চিঠিটার থেকেই বা কী পেলেন?”

“কৌতূহলী!” ট্রেন্ট বিড়বিড় করে বলল, তার আঙুলগুলো ডিটেকটিভের দিকে নাড়াতে নাড়াতে। তার চোখ চকচক করছে, যেন ভেতরের চাপা উল্লাস আর আশাকে দমন করে রেখেছে।

“স্ক্রু–ড্রাইভারটা কীসের জন্য? আরে, বিপদজনক লোকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে সঙ্গে একটু অস্ত্রশস্ত্র রাখা দরকার। আমি এটা লেক অ্যান্ড কোম্পানি থেকে জোগাড় করেছি, কাজেই আমি এটাকে এক্সক্যালিবার বলতে পারি, তাই না? আর আপনার পরের প্রশ্নের উত্তর— আমরা এখন জার্মিন স্ট্রিটে যাচ্ছি।”

“জার্মিন স্ট্রিট!” মিস্টার ম্যুরহেড এমনভাবে ট্রেন্টের দিকে তাকালেন, যেন ট্রেন্ট নয়, অদ্ভুত কোনও কিছুকে দেখছেন। “আপনার কী ধারণা, ও ওখানে বসে আছে?”

“চিঠি পড়ে যা মনে হয়েছে, জিনিসটা ওখানেই, বুড়ো রাডমোরের ঘরেই আছে, বা ছিল।”

“কিন্তু চুরিটা যখন হয়েছে, তখন তো বুড়ো রাডমোর বহু দূরে ছিল। ওর ঘরও তালা বন্ধ ছিল।”

“আরে, জেমসের কাছে আরেকটা চাবি থাকতে পারে না? আপনিই তো বলেছেন, ওদের সম্পর্কটা খুব গভীর আর গোপন। বাবা দরকার মনে করলে ছেলেকে একটা চাবি দিয়ে রাখবে, এটাই তো স্বাভাবিক। আর সামনের দরজায় হুড়কো আছে নিশ্চয়ই।”

ইনস্পেক্টর মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ, এটা হতে পারে। তাহলে আপনি বলছেন, সে লকেটটা নিয়ে জার্মিন স্ট্রিটে ওর বাবার ঘরে গিয়ে লুকিয়ে রেখে তারপর ক্লাবে চলে গেছে। হুম! তা সম্ভব। কেউ অবশ্য ভাবেনি।”

“আপনাদের সবার ওপর শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, কেউ ব্যাপারটা ভাবলেও ওখানে গিয়ে কিছু খুঁজে পেত কি না সন্দেহ। এই চিঠির সূত্র না পেলে কোনও কিছুই করা যেত না।”

“তাহলে…”

“উঁহু! আর নয়, আমরা জার্মিন স্ট্রিটে ঢুকে গেছি। কত নম্বর যেন, ইনস্পেক্টর? ২৩০… আচ্ছা!” ট্রেন্ট জানলা দিয়ে বাইরে ঝুঁকে ড্রাইভারকে বলে দিল। গাড়িটা গিয়ে দাঁড়াল একটা জুতোর দোকানের সামনে। সেই দোকান এতই জাঁকজমকপূর্ণ যে, মাত্র তিনখানা জুতোই দেখা যাচ্ছে সেখানে, তাও সেগুলোর এমন ছিরি, যেন কোনোক্রমে সেখানে এসে পড়েছে। দোকানের বাঁদিকে একটা বন্ধ দরজা, যেটা দিয়ে ওপরের ঘরে যাওয়া যায়।

ইনস্পেক্টরের ঘণ্টার আওয়াজে দরজা খুলল একজন বিপুলদেহী মানুষ, দুধসাদা ঝাঁটা গোঁফ, মাথায় ধবধবে সাদা মসৃণ চুল। তার হাবভাব আর পোশাকআশাক দেখে অবসর নেওয়া বাটলার বলেই মনে হচ্ছে।

“কী হাডসন, আমাকে ভুলে গেছ নাকি?” গোছানোগাছানো ছোট্ট কিন্তু আঁধার-আঁধার হলঘরখানায় ঢুকতে ঢুকতে খোসমেজাজে বলে উঠলেন ডিটেকটিভ। লোকটা একটু ইতস্তত করে বলল, “ও হরি! এ যে সেই অফিসার! আপনি মিস্টার রাডমোরকে ধরতে এসেছিলেন না?” দরজা বন্ধ করতে করতে বলল সে, “আবার সেইরকম কোনও কেসে এলেন নাকি? আমার বাড়ির তো বদনাম হয়ে যাচ্ছে।”

“না না, চিন্তার কিছু নেই,” বললেন অফিসার, “আমি শুধু জানতে এসেছি যে বুড়ো রাডমোরের ঘরটা ফাঁকা আছে কিনা।”

“না, ফাঁকা নেই, ইনস্পেক্টর। ওই বিচ্ছিরি ঘটনার পরপরই ঘরটা ভাড়া নিয়েছেন ক্যাপ্টেন এইংগার, ভারতে ছিলেন, মিলিটারিতে, চোট খেয়ে দেশে ফিরেছেন। চমৎকার মানুষ, খাঁটি ভদ্রলোক।”

“তিনি কি ঘরে আছেন?”

“ক্যাপ্টেন এইংগার দুপুরে খাওয়ার আগে ঘর থেকে বেরোন না।”

“একবার দেখা করব। তোমাকে আর আসতে হবে না, হাডসন, সিঁড়ি ভাঙা তোমার পছন্দ নয়, বুঝতেই পারছি। তিনতলা, তাই না? মনে আছে আমার।”

“তিনতলায় উঠে বাঁদিকের দরজা, স্যার। আশা করি কোনও…” বলেই চুপ করে গেল হাডসন, বিড়বিড় করে কীসব বকতে বকতে নামতে লাগল বেসমেন্টের দিকে, মিস্টার ম্যুরহেড তখন ট্রেন্টকে নিয়ে সরু সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে উঠছেন। উঠতে উঠতে থেমে গেলেন তিনি, বললেন, “আমার মনে হয় সাড়া না দিয়ে যাওয়াই ভালো। আমরা যদি এমনিই ঢুকে যাই, তাহলে লোকটা বলতে পারবে না যে দেখা করবে না।”

দোতলায় উঠেই তাঁরা দুজন শুনতে পেলেন, ওপরের কোনও একটা ঘরের দরজা আস্তে করে বন্ধ হয়ে গেল, তারপর শোনা গেল একটা লঘু পদশব্দ। সরু সিঁড়ির মাথায় আবির্ভাব হয়েছে এক দীর্ঘাঙ্গী তরুণীর, পরনে খুব দামি দরজির বানানো পোশাক, তাদের সম্ভবত না দেখেই সেখানে দাঁড়িয়ে সে টুপি আর মুখের ঢাকাটা ঠিকঠাক করে নিল। মিস্টার ম্যুরহেড উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্যই একটু কাশির আওয়াজ করলেন, সেই আওয়াজে চমকে উঠে তরুণী দ্রুতপায়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে চলে গেল। তাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ল্যান্ডিং-এর আবছা আলোয় তাঁরা দেখতে পেলেন মেয়েটির চকচকে গাঢ় চুল আর আঘ্রাণ পেলেন উগ্র সুগন্ধির। যতক্ষণ পর্যন্ত মেয়েটি দ্রুতবেগে একতলার প্যাসেজ দিয়ে বাইরে চলে না গেল, ততক্ষণ পর্যন্ত ট্রেন্ট তাকিয়ে রইল সেদিকে।

“স্মার্ট মহিলা,” সামনের দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতে মন্তব্য করলেন ইনস্পেক্টর।

“এ যুগের স্বাস্থ্যবতী মেয়েদের হাতেগরম উদাহরণ,” বলল ট্রেন্ট। “কেমন লম্বা-লম্বা পা ফেলে গেল দেখলেন? জামার কাটিং দেখে মনে হচ্ছে আমেরিকান।”

তার বলার মধ্যে এমন কিছু ছিল যে অপরজন তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল।

“ও যখন ওপরে দাঁড়িয়েছিল, তখন ওর পা আর গোড়ালিগুলো খেয়াল করেছিলেন?” বলল ট্রেন্ট।

“না,” রুক্ষস্বরে বললেন মিস্টার ম্যুরহেড, “দেখার কী আছে?”

“সাইজটার কথা বলছিলাম,” বলল ট্রেন্ট, “মেয়েটা ছেলেদের জুতো পরেছিল।”

এক মুহূর্তের জন্য ইনস্পেক্টর ট্রেন্টের দিকে পাগলাটে চোখে তাকালেন, তারপর একটি কথাও না বলে সিঁড়ির দিকে চললেন। দরজায় পৌঁছে হাতলে হাত রাখলেন।

“এ তো তালাবন্ধ! বাইরে থেকে ডবল লক করা! হাডসন! হাডসন!” চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি ষাঁড়ের মতো গলায়। সেই আওয়াজ শুনে নিচে শোনা গেল ধুপুসধাপুস আওয়াজ, দশাসই চেহারার হাডসন সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসছে কষ্টেসৃষ্টে। কাঁপতে কাঁপতে আর হাঁপাতে হাঁপাতে সঙ্গে একজন ঝি-কে নিয়ে ওপরে ওঠার পর হাডসনকে হুকুম করলেন ইনস্পেক্টর, “তোমার চাবিটা দাও।“ খানিকক্ষণ ধরে পকেট হাতড়াল সে, ইন্সপেক্টরের মুখ থেকে অবিরল বাক্যবাণ নির্গত হচ্ছিল তার ওপর। অবশেষে বেরোল চাবিটা। তার হাত থেকে সেটা ছিনিয়ে নিয়ে ফুটোয় ঢুকিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করলেন ইনস্পেক্টর, কিন্তু বার ছয়েক ব্যর্থ চেষ্টার পর চাবিটা তিনি ফেরত দিলেন হাডসনকে, যে প্রথমবারেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলল।

“স্যার, মনে হচ্ছে ওদিকে আরেকটা চাবি ঢোকানো আছে,” হাঁফাচ্ছিল সে, “ওটা ওদিক দিয়ে না খুলে নিলে এদিকে চাবি ঢুকবে না।”

মিস্টার ম্যুরহেড আচমকাই তাঁর মেজাজ ফিরে পেলেন, হাতদুটো ঢুকিয়ে নিলেন পকেটে। “ও আমাদের মেরে বেরিয়ে গেল, বুঝলেন,” বললেন তিনি। “ধীরেসুস্থে হাঁটলেও পনেরো সেকেন্ডে এখান থেকে পিকাডিলি পৌঁছনো যায়। পালানোর পরিষ্কার রাস্তা। হাডসন, তুমি বলোনি কেন যে ক্যাপ্টেনের ঘরে মেয়ে আছে? ঘর থেকে বেরোবে জানলে আমি ওকে পাশ দিয়ে যেতেই দিতাম না।”

“ওর সঙ্গে কেউ আছে জানতাম না তো ইনস্পেক্টর,” মিনমিন করে বলল হাডসন, কোন লিঙ্গ প্রয়োগ করবে বুঝতে পারছিল না সে। “আমার মনে হয় এই মেয়েটাই ওই মহিলাকে ঢুকতে দিয়েছে।”

ঝি-টা কেঁদে উঠল হাপুসনয়নে। “কোনও গন্ডগোল হবে বুঝব কী করে! এত চমৎকার সুরে কথা বলছিল খাঁটি ভদ্রমহিলার মতো, তারপর আমাকে কার্ড দিয়ে ওপরে পাঠাল। আমি ভাবিনি যে…”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে,” রুক্ষ স্বরে বললেন ইনস্পেক্টর, “সত্যি কথা বললে কোনও ঝামেলা হবে না। হাডসন, তোমার টেলিফোনটা কোথায়? পেছনের ঘরে? ঠিক আছে! আর তুমি বরং লোকজন জোগাড় করো, দরজাটা খুলতে হবে।”

ডিটেকটিভ ঘরে ঢুকলেন, হাডসন প্যাসেজ দিয়ে বাড়ির পেছনদিকে গেল, হতবুদ্ধি অবস্থায়। “এখনও বুঝতে পারছি না,” বিড়বিড় করছিল সে, “ওই মেয়েটা, বা ছেলেটা, বা যেই হোক না কেন, চাবিটা পেল কোথায়।” কথাটা বলতেই ট্রেন্ট, যে এতক্ষণ দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, আচমকা ঘুরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরের দিকে রওনা হল।

ক্যাপ্টেন এইংগারের ঘরের দরজাটা খুলে গেল সহজেই। ছোটখাটো চেহারা, কদমছাঁট চুলের ক্যাপ্টেন রুচিসম্পন্নভাবে সাজানো ডাইনিংরুমের সোফায় পড়ে আছেন। ট্রেন্ট ঘরে ঢুকতেই তাঁর হতবুদ্ধি চোখে একটা স্বস্তির ছাপ পড়ল। তাঁর মুখে গোঁজা আছে তামাকের পাউচ আর রেশমি কাপড়ের তৈরি একটা স্কার্ফ, হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। খুবই কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছেন তিনি, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।

মিনিট পাঁচেক পর ট্রেন্টের হাঁকাহাঁকিতে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে বাতচিত বন্ধ করে মিস্টার ম্যুরহেড ওপরে উঠে দেখলেন ক্যাপ্টেন এইংগার আরামকেদারায় বসে বড় এক গ্লাস হুইস্কি-সোডায় চুমুক দিতে দিতে নিজেকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছেন। কী অবস্থায় ট্রেন্ট ক্যাপ্টেনকে পেয়েছে, সেটা শুনে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন ইনস্পেক্টর। তারপর বললেন, “এটা বোধ হয় আপনার চাবি, স্যার।”

“হ্যাঁ,” বললেন ছোটখাটো চেহারার ক্যাপ্টেন, “মেয়েটা… ইয়ে, ছেলেটা আমার চাবিটা নিয়েছিল। আপনাদের বলি ঘটনাটা। মেয়েটা আমাকে তার কার্ডটা পাঠাতে আমি দেখলাম— ছেলেটা বলাই উচিত অবশ্য—ওটা এক মহিলার কার্ডই ছিল— এখানে রেখেছি,” তিনি উঠে ম্যান্টেলশেলফ থেকে একটা কার্ড বার করে দিলেন।

মিস্টার ম্যুরহেড কার্ডটায় চোখ বুলিয়ে অবাক হয়ে বললেন, “তাই তো!”

জানলার সামনের চেয়ারে বসে থাকা ট্রেন্ট বলে উঠল, “মিসেস ভ্যান সমারেনসের কার্ড নিশ্চয়ই।”

“ঠিক।”

“তার সঙ্গে মিসেস ভ্যান সমারেনসের পোশাক আর টুপি, তার সঙ্গে মিসেস ভ্যান সমারেনসের পছন্দের সুগন্ধি— এই মাত্রই আমাদের পাশ দিয়ে গেল তো,” বলল ট্রেন্ট, “তার সঙ্গে, মনে হয় মিস্টার ভ্যান সমারেনসের জুতোজোড়া আর মিস্টার জেমস রাডমোরের পরচুলা। সম্ভবত ও সিঁড়ির নিচে আপনাকে দেখে একটু হকচকিয়ে গেছিল, ইনস্পেক্টর। তাহলেও বলব, ওখানে দাঁড়িয়ে মুখের ঢাকা ঠিকঠাক করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আপনার পাশ দিয়েই বেরিয়ে যাওয়া— এ বড় সোজা ব্যাপার নয়। দম আছে, মানতেই হবে।”

ঘোঁতঘোঁত করছিলেন ইনস্পেক্টর। বিরক্তি, আত্মধিক্কার, এই দৃশ্যের পেছনের মজাদার ব্যাপারটার তারিফ করা— সব কিছুই প্রকাশ পাচ্ছিল সেই আওয়াজ থেকে।

“সে যদি ওই বেরোনোর সময়টাতে তড়বড় করে না হেঁটে মহিলার মতো হাঁটত, তাহলে তার পায়ে ছেলেদের জুতো থাকলেও আমি বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতাম না। আসলে ওই রাস্তার দিকের দরজা আর তার পরেই গা ঢাকা দেওয়ার সহজ পথ দেখে ও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। তারপর চাবির ব্যাপারটাও ভালোই সামলেছে। নাহ, জিম একদম তৈরি ছেলে, মানতেই হবে। কিন্তু আপনি…” ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বলল ট্রেন্ট, “মহিলার ঘরে ঢোকার ব্যাপারে বলছিলেন।”

“কার্ডটা দিয়ে বলা হয়েছিল যে,” বললেন ক্যাপ্টেন, তাঁর মুখ দেখেই মনে হচ্ছিল হাত-পা বাঁধার যন্ত্রণা তাঁর গা থেকে এখনও যায়নি, “একটা পারিবারিক খোঁজখবরের ব্যাপারে যদি তাঁকে সাহায্য করি তো তিনি উপকৃত হবেন। শুনে আমি কৌতূহলী হয়ে বলি আমি মেয়েটির সঙ্গে দেখা করব। মেয়েটার মুখে একটা খুব পুরু ঢাকা ছিল— মানে ছেলেটার মুখে—”

“মেয়েটাই বলুন, ক্যাপ্টেন,” বলল ট্রেন্ট, “আমাদের তাড়া আছে।”

“ধন্যবাদ,” প্রবীণ ক্যাপ্টেন কৃতজ্ঞ হলেন, “তাড়াতাড়িই হয়ে যাবে। পুরোটাই এত ঘোরালো ছিল, মানে প্রথম থেকে শেষ অবধি সে মেয়েদের মতো গলাতেই কথা বলছিল তো। কী যেন বলছিলাম? হ্যাঁ, তার মুখ আমি দেখতে পাইনি বটে, কিন্তু কথাবার্তা আর হাবভাব ছিল একেবারে বড় ঘরের মহিলার মতো। সে বলছিল যে বছরখানেক আগে তার এক ভাই মারা গেছে, তার খুবই প্রিয় ছিল সে, আর মৃত্যুশয্যায় সেই ভাই তার ওপর একটা গোপন দায়িত্ব দিয়ে গেছে। কথাবার্তা শুনে মনে হল সেই ভাই যখন ভারতে ছিল, তখন আমারই নামের এক ইংরেজ অফিসারের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। বহু বছর তাদের দেখা হয়নি। তো মারা যাওয়ার সময় সে বোনকে বলে গেছিল, সম্ভব হলে সেই অফিসারকে খুঁজে বার করে তার হাতে বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ যেন একটা স্মারক তুলে দেয়। মেয়েটা খোঁজাখুঁজি করে প্রথমেই আমাকে পায়, কিন্তু বুঝতে পারে আর্মি লিস্টে আমার নামের মতো আরও অনেকেই ছিল।”

“রাডমোর আপনাকে খুঁজে পেল কী করে?” ইনস্পেক্টর বললেন, “ও মাত্র গতকালই ডার্টমুর থেকে পালিয়েছে।”

“এই ধরনের লোকের জন্যে ওটা খুব একটা কঠিন কাজ নয়,” ট্রেন্ট বলল, “হয়তো যে ঝি দরজা খুলেছে, তার কাছে জেনেই ও খবরটা পাঠিয়েছে।”

ক্যাপ্টেন অস্ফুটে কয়েকটা গাল পেড়ে আরেক চুমুক পান করলেন। তারপর বললেন, “অস্বীকার করব না, আমি গলে গেছিলাম। আমার যখন কিছু ক্ষমতা ছিল, তখন আমি অনেকের উপকার করেছি, কিন্তু কখনও কোনও আমেরিকানের কিছু করেছিলাম বলে তো মনে পড়ে না। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম নামটা কী। মেয়েটা বলল তার নাম স্মিথ। ব্যাপার হল, এরকম খান পঞ্চাশেক স্মিথকে আমি চিনি। সেটা বলতেই সে বলল তার কাছে তার একটা ফটো আছে। সে ব্যাগ থেকে সেটা বের করলও। দেখি সেটা বেশ সুন্দর একটা ছেলের ছবি, কমবয়সি, ছবির বাঁধাইয়ের ওপর ফিলাডেলফিয়ার কী একটা ফার্মের নাম লেখা।”

“ভ্যান সমারেনসের ছবি,” বিড়বিড় করল ট্রেন্ট, “মেয়েটা সঙ্গে নিয়ে ঘুরছিল। ইনস্পেক্টর, ওরা যে হনিমুন করছিল, আমায় তো বলেননি।”

“দেখেই বুঝতে পারলাম, একে আমি কস্মিনকালেও দেখিনি,” বললেন ক্যাপ্টেন এইংগার, “তবুও ভালো করে দেখব বলে যেই ছবিটা জানলার কাছে নিয়ে গেছি, অমনি মেয়েটা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি কোনও সুযোগই পাইনি। সে একেবারে বাঘের মতো হিংস্র, তার ওপর আমি আবার দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলাম, কাজেই গায়ে একফোঁটাও জোর নেই। যখন আমার প্রায় দম বেরিয়ে এসেছে, তখনই সে আমার মুখে ওই জঘন্য জিনিসটা গুঁজে দেয়, তারপর টানতে টানতে বেডরুমে নিয়ে এসে আমার দড়ি দিয়েই আমাকে বেঁধে ফেলে। তারপর আমার পকেট হাতড়ে চাবিটা বের করে আমাকে বেডরুমের দরজার পেছনে নিয়ে যায়। বলে আমার সঙ্গে এসব করার জন্য সে খুবই দুঃখিত আর এ-ও বলে যে মেয়েরা সবসময়েই ছেলেদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে, এটা তার পছন্দ নয়। তারপর মুখের ঢাকাটা একটু সরিয়ে হুইস্কি-সোডা নিয়ে বসে আর আমারই একটা চুরুট ধরায়। তারপর ব্যাগ থেকে একটা স্ক্রু-ড্রাইভার বার করে কী যেন করে, পেছন ঘুরে থাকায় আমি দেখতে পাইনি আর বুঝতেও পারিনি সে কী করছিল। আমি নড়তে পারছিলাম না পর্যন্ত। মিনিট পাঁচেক বাদে হাতে একদলা তুলোর মতো জিনিস নিয়ে সে জানলার ধারে চলে যায়, চোখেমুখে সে কী ফুর্তির ছাপ, যেন যুদ্ধজয় করে ফেলেছে! সেখানে সে অনেকক্ষণ ছিল, সিগার ফুঁকছিল আর বাইরে তাকাচ্ছিল, তারপর হঠাৎ দেখলাম মেয়েটা চমকে উঠে রাস্তার দিকে তাকাল, তারপরই শুনলাম বাইরের দরজায় ঘণ্টাধ্বনি। তারপরই সে, মানে, মেয়েটা চলে গেল।” ক্যাপ্টেনের মুখটা আচমকা লাল হয়ে উঠল।

“গুডবাই জানিয়েছিল নিশ্চয়ই,” ট্রেন্ট বলল ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে।

“তারপর ও কী করল জানেন?” এই প্রথম ক্যাপ্টেন খেপে গেলেন। “ও… ও বলল, আমাকে কীভাবে ধন্যবাদ জানাবে বুঝতে পারছে না, তাই ও আমাকে একটা চুমু খাবে, আর তারপর… তারপর ও তা-ই করল।” ক্যাপ্টেন বিকট অঙ্গভঙ্গি করলেন। “তারপর ও বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। আমার আর কিছু বলার নেই।” ক্যাপ্টেন ক্লান্তভাবে আবার হুইস্কিতে চুমুক দিলেন।

ট্রেন্ট আর ইনস্পেক্টর শেষের দিকটায় অতিকষ্টে হাসি চেপে রেখেছিলেন, তাঁরা পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছিলেন না পর্যন্ত, পাছে হেসে ফেলেন, এখন আবার সিরিয়াস হয়ে গেলেন।

“জিনিসটা কোথায় লুকোনো ছিল, সেইটা জানা দরকার,” বললেন ডিটেকটিভ, “মিস্টার ট্রেন্ট, আপনি কি জায়গাটা বুঝতে পেরেছেন, নাকি খুঁজতে হবে?”

ট্রেন্ট পকেট থেকে চিঠিটা বার করল। “কীভাবে ধরলাম ব্যাপারটা, শুনুন আগে। ক্যাপ্টেন, পড়ুন তো এটা, আগ্রহ পাবেন।” চিঠিটা ক্যাপ্টেনকে দিয়ে সে পুরো ঘটনাটা সংক্ষেপে বলল।

ক্যাপ্টেন এতক্ষণে মজা পেয়ে গেছেন, তিনি চিঠিটা দুবার খুঁটিয়ে পড়ে ট্রেন্টকে ফেরত দিলেন। “ইয়ে, এক হাজার বছর ধরে চেষ্টা করলেও আমি এর মানে উদ্ধার করতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। আমার কাছে এটা এমনিই একটা চিঠি বলে মনে হচ্ছে। বড়জোর ইন্টারেস্টিং চিঠি, ব্যস।”

“এই চিঠিটা,” চিঠিটার দিকে একবার সসম্ভ্রমে তাকিয়ে বলল ট্রেন্ট, “একটা অসাধারণ চিঠি, সব দিক দিয়েই, যতই পড়েছি, ততই মনে হয়েছে। এর মধ্যে লকেটটা কোথায় লুকোনো আছে, তা বলা নেই, বরং গ্রেফতার হওয়ার আগে জেমস রাডমোরের হিরেগুলো কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল, তা বলা আছে। এর সেটিংটা জিম কীভাবে করল জানি না, তবে সেটা খুব একটা কিছু ব্যাপার নয়। ব্যাপার হল, হিরেগুলো এখানেই লুকোনো ছিল এবং আমার ধারণা, ওগুলো আবার জিমের জিম্মায় গেছে।”

ইনস্পেক্টর ম্যুরহেড অধৈর্য হলেন। “কাজের কথায় আসুন মিস্টার ট্রেন্ট। চিঠিটা থেকে আপনি কী বুঝলেন? জিনিসটা কোথায় লুকোনো ছিল?”

“বলছি। প্রথম যখন আমি চিঠিটা পড়ি, আপনি ছিলেন তখন, একটা লাইনে আমার চোখ আটকে যায়, সেটা হল— ‘এর আবহাওয়া অনেকটা অ্যাপেলডিজকের কাছে গেল্ডারল্যান্ডের মতো’। ডার্টমুর পাহাড়ি এলাকা, কিন্তু গেল্ডারল্যান্ড হল্যান্ডের একটা জায়গা, যে দেশটার বেশিরভাগ এলাকাই সমুদ্রতলের নিচে।”

“এ ব্যাপারটা আমি খেয়াল করিনি,” ক্যাপ্টেন এইংগার বললেন।

“তাহলে,” ক্যাপ্টেনের কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল ট্রেন্ট, “একইরকম আবহাওয়ার প্রশ্নটা আসে কোত্থেকে? এটা জেলের গভর্নরও খেয়াল করেছিলেন, তাঁর সন্দেহও হয়েছিল। তারপর যেটায় খটকা লাগে, তা হল শেক্সপিয়ারের বাণী। আমি শেক্সপিয়ারের লেখায় এটা পড়েছি, কিন্তু তবুও মনে হচ্ছিল কোথাও গন্ডগোল আছে। মনে হচ্ছিল কিছু শব্দ-টব্দ কম আছে। তার ওপর এটা কোনও গদ্যের লাইন বলেও মনে হচ্ছে না। আবার কবিতার লাইন— দশপদী বা ওই ধরনের কিছুও নয়। আবার এটাও অদ্ভুত লাগল যে এত ভালো ভালো ইংরেজি বাগ্‌ধারা থাকতে জার্মান ব্যবহারের মানেটা কী?

“তখন আমি চিঠিটা নিয়ে ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে গেলাম ভালো করে দেখার জন্য। ভাবলাম এর মধ্যে কোনও গোপন সংকেত থাকলে তা বের করা আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু মনে হল এতে কথা বা শব্দগুলো যেভাবে আছে, সেভাবেই যদি খবরটা দেওয়া থাকে, তাহলে এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও চিহ্ন আছে। কী সেই চিহ্ন? আবার এ-ও শুনেছি, রাডমোর আর তার বাবা দুজনেই খুব বুদ্ধিমান এবং দুজনেই দুজনকে খুব ভালো বোঝে।

“তখন ভাবলাম, এই যে লাইনটা— ‘তোমার ম্যান্টেলশেলফের ওপরে রাখা মূর্তিটার মতো, যার নাম আমি ভুলে গেছি’— এর মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা তো সবাই হিন্দুদের সেই দশভুজা প্রতিমা দেখেছি। জিম রাডমোর বহু বছর ভারতে ছিল, সে বলছে এর নাম ভুলে গেছে। তার মানে সে এর নামটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে।”

“নামটা হল পার্বতী, কতবার শুনেছি,” বললেন ক্যাপ্টেন।

“ঠিক তাই, হিন্দু পুরাণ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে দেখলাম। কিন্তু আরেকটা নামও আছে, বাংলায় যে নামে এই দেবী পরিচিত। রাডমোর সেখানে বহু বছর কাটিয়েছে। পুরাণ বলছে, সেখানে এই দেবীর নাম দুর্গা। আমি দুটো নামই লিখে নিলাম। এবার পরের অংশ, সেটা অনেকটা সাদামাটা— ‘অ্যাপেলডিজকের কাছে গেল্ডারল্যান্ডের মতো’। প্রথমেই অ্যাপেলডিজকের ব্যাপারে গেজেটিয়ার দেখলাম। গেজেটিয়ারে এরকম কোনও জায়গার নাম নেই, তবে এর কাছাকাছি একটা নাম আছে, সেটা হল অ্যাপেলদুরন, একটা টাউন। তখন আমি একটা বড় ম্যাপ খুলে তন্নতন্ন করে দেখলাম। অ্যাপেলডিজকের কোনও চিহ্ন নেই, তবে হল্যান্ডের দিকের বেশ কিছু শহরের নাম পেলাম, যেগুলোর শেষ হচ্ছে ‘ডিজক’ দিয়ে। জিম কী রকম শিল্পী জিনিস, ভেবে দেখুন। এখন সে যদি অ্যাপেলডিজকে অসুস্থ হয়, আমার ধারণা সে হয়েওছিল, তার বাবা সহজেই বুঝতে পারবে। অ্যাপেলদুরন নাম লিখতেই আস্তে আস্তে অন্ধকার সাফ হতে লাগল।”

মিস্টার ম্যুরহেড হতবুদ্ধির মতো তাঁর নাকটা ঘষতে লাগলেন। “আমি তো কিছুই…”

“বুঝবেন, বুঝবেন। তারপর আমি শেক্সপিয়ারের উদ্ধৃতিটা ধরলাম। কোডেন— ক্লার্ক কনডোরড্যান্স-এর ‘জয়েন্টস’-এ আমি এই প্যাসেজটা পেয়েছি। হেনরি ৪-এ নরদামবারল্যান্ড বলছে,

সেই হতভাগ্য, যার জ্বরে ভোগা গ্রন্থিগুলো

যেন শক্তিহীন কবজা, জীবনের বোঝা নিতে পারে না—

এর থেকে আপনি কী ভাবছেন?”

ইনস্পেক্টর মাথা নাড়লেন।

“তারপর, জার্মান বাগ্‌ধারাটা দেখা যাক। ‘সাই বার্ডেন দাস নাখট সো হিনজহেন লাসেন’। এর মানে ‘ওরা এটা মানবে না’ বা ওই ধরনের কিছু। এবার ধরা যাক কোনও লোক এই বাগ্‌ধারার থেকে কোনও মানে খুঁজতে চাইছে।”

মিস্টার ম্যুরহেড চিঠিটা নিয়ে মন দিয়ে পড়তে লাগলেন। “আমি জার্মান পণ্ডিত নই,” বলতে বলতেই তাঁর চোখ গোলগোল হয়ে উঠল। “আরে, সেই হারানো শব্দটা যেন কী?”

“যেন শক্তিহীন কবজা,” ট্রেন্ট বলল।

“তাই তো, আর এখানে…” ইনস্পেক্টর উত্তেজিত হয়ে হিনজহেন শব্দটার ওপর টোকা দিতে শুরু করলেন, “তার মানে আপনি এখান থেকে ইংরেজি হিনজ আর হেন শব্দদুটো নিয়েছেন।”

“এই তো বুঝেছেন! হেন শব্দটা বাদ দিন, মুরগি দিয়ে আমাদের কোনও কাজ নেই। আরেকটা জিনিস বলব, যেটা সম্ভবত আপনি জানেন না। জার্মান ভাষায় স্ক্রব মানে স্ক্রু।”

মিস্টার ম্যুরহেড হাঁটুতে একটা চাপড় মারলেন উত্তেজনায়।

“এবার দেখুন!” ট্রেন্ট নোটবই থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে আনল। “যে সব শব্দ লুকিয়ে আছে, সেগুলো লিখছি।” সে ঝটপট শব্দগুলো লিখে কাগজটা ইন্সপেক্টরকে এগিয়ে দিল। ক্যাপ্টেন আর ইনস্পেক্টর দুজনেই দেখলেন লেখাটা—

দুর্গা

দুরন

হিনজহেন

হিঞ্জ

স্ক্রু

 

“তার ওপর দেখুন,” ট্রেন্ট বলল, “ডোর শব্দটা চিঠিতে দুবার এসেছে, আর হিঞ্জ একবার। এতে বুড়ো রাডমোরকে বোঝানো হয়েছে শব্দগুলোকে নিয়ে ঠিকঠাক নাড়াচাড়া করলেই রাস্তা পাওয়া যাবে। তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে? লুটের মাল কোনও দরজার কবজার স্ক্রু-এর নিচে লুকোনো আছে। সেটা কোথায়?” সে আবার চিঠিটার দিকে তাকিয়ে বলল, “একমাত্র ঠিকানা, যেটা চিঠিতে লেখা আছে, তা হল ‘জার্মিন স্ট্রিটের পুরোনো ঘর’। আর এখন সেখানেই আমরা আছি।”

ট্রেন্ট পকেট থেকে স্ক্রু-ড্রাইভারটা বের করে ক্যাপ্টেনের বেডরুমের খোলা দরজার দিকে এগোল। “এই দেখুন,” সে দেখাল দরজার ফ্রেমের কাঠের ওপরের কবজাটাকে, “এই স্ক্রুগুলোতে একটু ঘষার দাগ আছে।”

মিনিট তিনেকের মধ্যেই সে তিনটে স্ক্রু-ই খুলে আনল। খোলা দরজাটা ঝুলতে লাগল নিচের কবজার ওপর ভর করে, ওপরের কবজাটা খুলে বেরিয়ে এল। এর নিচে কাঠ খুদে করা একটা ছোট গর্ত। ইনস্পেক্টর চুপচাপ একটা ছোট ছুরি দিয়ে ভেতরটা খোঁচালেন।

“পাথরগুলো নেই। জানাই ছিল।” বললেন তিনি গম্ভীর হয়ে।

“নেই-ই তো,” ট্রেন্ট বলল, “ওগুলো তো তুলোর ভেতরে রাখা ছিল, যেটা ক্যাপ্টেন দেখেছিলেন।”

মিস্টার ম্যুরহেড লাফিয়ে উঠলেন। “আমার মনে হয় ও বেশিদূর যেতে পারেনি।” টুপিটা মাথায় চাপিয়ে বেরোতে যাচ্ছেন তিনি, এমন সময় দরজায় টোকা মারল কেউ, পরক্ষণেই ঘরে ঢুকল হাডসন হাঁপাতে হাঁপাতে, হাতে একটা ছোট প্যাকেট।

“একটা ছেলে এইমাত্র এটা আপনার জন্য দিয়ে গেল ইনস্পেক্টর।”

প্যাকেটের গায়ে সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা, ‘ইনস্পেক্টর সি বি ম্যুরহেড, প্রযত্নে ক্যাপ্টেন আর এইংগার, ২৩০ জার্মিন স্ট্রিট’।

ঝটপট ইনস্পেক্টর খুলে ফেললেন সেটা। ভেতরে রয়েছে একটা ছোট কালো সোয়েডের দস্তানা, হালকা সুবাসিত। সঙ্গে আছে একটা চিরকুট, যাতে একই হস্তাক্ষরে লেখা—

হাতে পরে বসে থাকুন – জে আর

ছবি – আশিস ভট্টাচার্য

E C Bentley (১৮৭৫ – ১৯৫৬) একজন জনপ্রিয় ইংরেজ ঔপন্যাসিক এবং রম্যলেখক। তিনি clerihew নামে এক নতুন রম্যকবিতার ধারার প্রবর্তক। ‘চোরাই হিরের চাতুরি’ তাঁর ‘The Inoffensive Captain’ গল্প থেকে অনূদিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published.