“না, এই জঙ্গলে কোনও বাঘ নেই। হাতি আছে, গাউর আছে, চিতল হরিণ আছে, কাঠবেড়ালি আছে, পাখি আছে। তবে বাঘ নেই। এমনি প্রশ্ন করলে লোকে বলবে বাঘ আছে। এদিকে নয় ভুটানের দিকে আছে। তবে আমি জানি, নেই। মানুষের এত উৎপাত সহ্য করে কেনই বা থাকবে? বাঘ বলে কথা!”
মানুষটা গাছের ওপর বসেছিল, নীচে তিন আগন্তুককে দেখে নেমে এসে এতগুলো কথা একটানা বলল। তিনজন প্রথমে একটু চমকে উঠেছিল। তারপর সিড়িঙ্গে লোকটাকে দেখে ভরসা পেল। ভ্যাগাবন্ড গোছের চেহারা। চোখদুটো কোটরাগত। কিন্তু তার চাহনির মধ্যে একটা গোপন ধার আছে।
একটু আগে তিনজনে আলোচনা করছিল, মহাকাল গুহা হয়ে জয়ন্তীর দিকে যাওয়ার। বলছিল, “তেরো কিলোমিটারের ট্রেকিং রুট। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অনেকটা হাঁটতে হবে। পারবি?”
“না পারলে উপায় আছে?”
ওরা তিন পলাতক। নিরঞ্জন, গোবিন্দ আর উইলসন। সামনে শাল, সেগুন, শিরীষ, আকাশমণির ছায়াঘন অন্ধকার। আরেকটু এগোলেই জয়ন্তী নদী। তিনজনে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে ক্ষণিকের বিশ্রামের জন্য দাঁড়িয়েছিল। আর নিজেদের মধ্যে কথায় কথায় নিরঞ্জন বলছিল, “বক্সায় শেষ গণনায় মাত্র তিনটে বাঘের আভাস পাওয়া গেছে।”
শুনে গোবিন্দ বলল, “তিনটের একটাই আমাদের তিনটেকে সাবাড় করার জন্য যথেষ্ট।”
এই কথায় উইলসন হেসে বলল, “বাঘ আমাদের কাছে আসবে না। ভয় করে আমাদের।”
“রাগও তো থাকতে পারে।“ গোবিন্দ বলল, “হয়তো বাগে পেলেই…”
“বাগে পেলেই বাঘে পাবে, বলছিস?” নিরঞ্জন ঠাট্টার স্বরে বলল। সেই সময়ই লোকটা গাছ থেকে লাফিয়ে নামল তিনজনকে চমকে দিয়ে। বাঘ নিয়ে কথাগুলো বিনা বাধায় বলে গেল একটানা। ততক্ষণে চমক কাটিয়ে তিনজনেই নিজেদের নজরে মেপে নিয়েছে লোকটাকে। চেহারা দেখে স্থানীয় লোক বলে মনে হল না ওদের। অযত্নের চেহারা হলেও তাতে শহরের ছাপ আছে। এমন একজনের এই গভীর জঙ্গলে গাছে চড়ে বসে থাকাটা সন্দেহজনক। যদি বনরক্ষীদের কোনও ইনফরমার হয়? তিনজনেই নিজেদের পকেটের আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর ওপর একবার হাত বুলিয়ে নিল।
নিরঞ্জন বলল, “বাঘ নেই তো কী হয়েছে?”
গাছ থেকে নামা লোকটা ফিক করে হাসল। “বনের রাজা বলে কথা। তার থাকা দরকার। না হলে জঙ্গলের নাম বৃথা।”
“তুমি কোনওদিন বাঘ দেখেছ এখানে?”
“হ্যাঁ, দেখেছিলাম তা অনেক কাল হয়ে গেল। এই নদীতেই জল খেতে এসেছিল। দেখে বুঝেছিলাম পেটে খিদে আছে। শিকার জোটেনি বেচারার। তো এদিক ওদিক শিকারির চোখ দিয়ে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ সামনে দেখল…”
ওদের তিনজনের মুখের ওপর একটু ছায়া পড়ল। গন্তব্যে পৌঁছবার তাড়া আছে। কিন্তু জঙ্গলে লুকিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর মধ্যে এমন একজন আজগুবি লোক। ভারী বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
গোবিন্দ প্রশ্ন করল, “শিকার জোটেনি তো বাঘটা তারপর কী করল?”
লোকটার মুখ কাঁচুমাচু হয়ে গেল। “আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারব না। প্রতিবার এক জায়গায় শুরু করি কিন্তু শেষটা পালটে যায়।”
“আমরা তো আগে তোমার গল্প শুনিনি। তাই পালটে গেলেও বুঝতে পারব না।”
“কিন্তু যেটা আসল ঘটনা সেটা তো বলতে হবে। পালটে গেলে চলবে না।”
উইলসন বিরক্ত হয়ে বলল, “আসল ঘটনাটা যদি তুমি জানো, তাহলে বদলাবে কেন?”
উইলসনের কথার রেশ টেনে গোবিন্দ বলল, “চল, চল বোঝা গেছে, কেন একা জঙ্গলে। এখানে পাগলের কাছে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। অনেকটা যেতে হবে।”
ওরা লোকটাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল। স্থানীয় পুলিশ ওদের সন্ধান করছে। ওরা পাচার করে। গেকো, তক্ষক, প্যাঙ্গোলিন আরও কত কী। ডুয়ার্স আর অসমের বনে বনে ওদের গ্যাংগুলো বন্যপ্রাণী চোরাকারবারের কাজ করে চলে। উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে মায়ানমার, চিনদেশে পাচার হয় গোটা গোটা জীবজন্তু কিংবা তাদের দেহাংশ। কাঁচা টাকা আয়ের এই লোভ ছড়িয়ে বসে আছে বড় বড় সাগরেদরা। সেই লোভের ফাঁদে সহজেই ধরা দেয় এদের মতো শিক্ষিত যুবকেরাও। এবার আয়টা বেশ ভালই হয়েছিল। গ্রামে ফেরার জন্য এসেছিল ওরা। কিন্তু ওদের কাছে খবর এল পুলিশ নাকি ওদের খুঁজছে। প্রশাসনের কাছে জানাজানি হয়ে গেছে ওদের নামগুলো। গুরুর নির্দেশ এল, “পরে ম্যানেজ করছি। আপাতত পালাও!”
ওরা পালাচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। ছায়ার অন্ধকার জড়িয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের গায়ে গায়ে। চারপাশ নিস্তব্ধ। নির্জন। কারও থাকার কথাও নয়। তবু ওই গেছো লোকটা! কীভাবে যে এখানে…
নিরঞ্জন বলল, “পাগলটাকে পিছন ফিরে আর দেখতে পেলাম না। কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল।”
“তুই আবার পিছন ফিরে দেখার চেষ্টা করেছিলি? একটাই গল্প প্রতিবার নতুন হয়ে যায় বলার পরেই আমি আর ওর দিকে তাকাইনি। বুঝে গিয়েছিলাম ওর মাথার হাল।”
গোবিন্দর কথায় উইলসন বলল, “ওকে জঙ্গলই নেবে। আর বেরোতে হবে না।”
“কিছুই হবে না। ওর দেখবি আমাদের মতোই জঙ্গল চষে বেড়ানোর অভ্যাস আছে।” গোবিন্দ প্রত্যয় নিয়ে বলল। ওরা গন্তব্যের দিকে চলেছিল। আপাতত জয়ন্তী। সেখানে গেলে জানতে পারা যাবে এরপর কোথায়। কিছু দিন গা ঢাকা দিয়ে আবার ফিরে আসা যাবে কিনা। শুকনো পাতা জমে আছে পথের উপর। তার ওপর দিয়ে খসখস শব্দ তুলে কোনও সরীসৃপ চলে গেল। তিনজনে একটু থমকে দাঁড়াল। পাতার খসখস পার হয়ে এখন জলের কুলকুল শোনা যাচ্ছে। নদী ছাড়িয়ে এখনও খুব বেশি দূরে আসেনি ওরা। নিরঞ্জন চোখ বন্ধ করে আবার খুলল। কেমন যেন অচেনা লাগছে এই চেনা জঙ্গলটাকে। ঠিক গভীর ঘুম থেকে উঠে যেমন চারপাশটা অচেনা লাগে তেমন। গাছের ছায়াগুলো যেন নড়ছে। সামনের দৃশ্যগুলো কেমন ধোঁয়ার আস্তরণ দিয়ে মোড়া। নিরঞ্জন কয়েকবার ঘাড় ঝাঁকিয়ে নিজের দেখাটাকে ঠিক করার চেষ্টা করল। গোবিন্দ বারবার নিজের চারপাশে ঘুরে ফিরে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। যেন কেউ বা কারা পিছু নিয়েছে ওর। উইলসন কান খাড়া করে শুনে নিতে চাইছিল সামান্য শব্দটুকুও। তার মনে হল হঠাৎ করে যেন জঙ্গলের নিজস্ব আওয়াজগুলো থেমে গিয়ে চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
“সেদিন গুরুর কাছে বাঘের চামড়া এসেছিল। ও জিনিস আগে কোনওদিন দেখিনি। আজ হঠাৎ করে কেন জানি না বাঘের ভয় করছে।”
২
“না, বাঘ নেই এই বনে। লোকে অবশ্য বলবে বাঘ আছে এই বক্সায় নয়, ভুটান জঙ্গলের দিকে। কিন্তু আমি জানি নেই। বাঘ বলে কথা!” আচমকা এই গলার স্বর শুনে তিনজনেই আঁতকে উঠেছিল। চোরাশিকারির মন তো। অন্য কারোর আচমকা উপস্থিতিতে বড্ড ভয় হয়। ধরা পড়ে শাস্তি হওয়ার ভয়।
“তুইও পিছন পিছন চলে এসেছিস?” একটুও ভদ্রতা না দেখিয়ে গোবিন্দ কড়া গলায় চেঁচিয়ে উঠল। “তোর নিশ্চয়ই কোনও মতলব আছে।”
কথাটা শেষ হতেই ওদের তিনজনেই নিজের নিজের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা কনকন ঠান্ডা স্রোত অনুভব করতে পারল। আশ্চর্য এই লোকটার গলা অবিকল আগের গেছো লোকটার মতো হলেও এ তো আলাদা জন। তিনজন পরস্পরের কাছে ঘেঁষে এল। বিপদ এলেই একসঙ্গে গুলি চালাবে।
লোকটা অন্য কোনও প্রসঙ্গে গেল না। নিজের হলুদ দাঁতগুলো বার করে হেসে বলল, “এখন নেই। তবে একসময় বাঘ ছিল। আমি দেখেছি নিজের চোখে। নদীতে জল খাচ্ছে। আমি একা নয়। আরও দুজন দেখেছে। আকাশ আর বিশু। সেসময় জঙ্গল আমাদের পেয়ে বসেছিল। মানস, পালামু, সুন্দরবন, সিমলিপাল। নিজের সাধ্যের যেটুকু কুলিয়েছে, সেখানেই ঘুরে বেড়িয়েছি। জঙ্গল তো জঙ্গলই। আদিম। রহস্যময়। কত কী যে লুকিয়ে আছে আমাদের জানার বাইরে।”
লোকটার কথা শুনতে শুনতে উইলসনের কেমন একটা অজানা অস্বস্তি হচ্ছিল। সে একজায়গায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। সে তাড়া দিয়ে বলল, “তারপর নদীতে জল খেতে খেতে বাঘটা কী করল?”
লোকটা মাথার উসকোখুসকো চুলে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, “দেখে বুঝেছিলাম পেটে খিদে আছে। শিকার জোটেনি বেচারার। তো এদিক ওদিক শিকারির চোখ দিয়ে খুঁজতে খুঁজতে সামনে দেখল তিনটে মানুষ। তিনটে বেপরোয়া মানুষ জঙ্গলের নেশায় পথ ভুলে কোর এরিয়ায় ঢুকে পড়েছে। ভেবে দেখুন ক্ষুধার্ত বাঘের নাগালের মধ্যে মানুষ। বাঘটা ম্যান ইটার ছিল না হয়তো। কিন্তু খিদে পেলে কী করবে? শিকার করবে না?”
ওরা তিনজন থমথমে মুখে লোকটার দিকে তাকাল। আগের গেছো লোকটার গল্পই এ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এমন আজগুবি কাণ্ড কীভাবে ঘটছে তাদের চোখে সামনে? পুলিশে তাড়া খাওয়া আর ধরা পড়ার ভয় থেকেই কি কিছু ভুল দেখছে ওরা? নিরঞ্জনের মাথাটা ভনভন করতে লাগল। সত্যিই চারপাশ কেমন ঘোলাটে হয়ে আসছে।
সে বেজার মুখে জিজ্ঞাসা করল, “তিনজনকে বাঘে খেল তাইতো?”
“হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কী করে জানলেন? সে সময় কি আপনি ঘটনাস্থলে ছিলেন?” লোকটা অবাক চোখে তাকাল ওদের দিকে।
“এতে অবাক হবার কিছু নেই। গল্পটায় সেটাই হবার ছিল। অন্য কিছু হত না।” এই বলে নিরঞ্জন গোবিন্দ আর উইলসনকে ঠেলা দিল। এভাবে গল্প শুনে নষ্ট করার মতো সময় তাদের হাতে নেই।
যাবার আগে নিরঞ্জন মুখটা কঠিন করে বলল, “তবে এই গভীর জঙ্গলে তিন বন্ধু মিলে এমন মজা করে বেড়াবেন না। জানেন তো জঙ্গলের নাম জঙ্গল। তার অনেক কিছুই আমরা টের পাই না। সেটা জঙ্গলের নিজের গোপন রহস্য। বড্ড ভয়ংকর।”
লোকটা নিরঞ্জনের কথায় একটু ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তাকে দেখে মনে হল যে, পুরো মানুষ নয় কোনও মানুষের ছায়া, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই ছায়ার লোকটাই গম্ভীর গলায় বলল, “সেদিন আকাশ, বিশু আর অমলকে কিছুতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল বাঘের সামনে। এই জঙ্গলে অনেক দুষ্ট আত্মা ঘোরাঘুরি করে। মানুষকে বিপথে টেনে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে। আচ্ছা আপনারা কি করে জানলেন ওদের বাঘে খেয়েছিল? জঙ্গলের এই গোপন খবরটা তো প্রকাশ পায়নি?”
“বিরক্ত করার একটা সীমা আছে!” গোবিন্দ হঠাৎ নিজের পিস্তলটা বের করে লোকটার দিকে তাক করল।
“আপনারা কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?”
“না, আমরা আপনাকে ভয় দেখাচ্ছি!” গোবিন্দ কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ওরা তিনজন ভয়ে শক্ত হয়ে গেল। সামনের লোকটা কোথাও নেই। একটু আগে ছিলও না। যেন এতক্ষণ হাওয়ার সঙ্গে বাগবিতণ্ডা করে চলেছিল ওরা।
উইলসন আদিবাসী মানুষ। ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান। ছোটবেলা থেকে ভূত, প্রেত, ডাইনের গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছে। তার অশরীরী ঘটনায় ভয় বেশি। সে চিৎকার করে বলল, “ওরা সবাই ওই বাঘের আক্রমণে মারা যাওয়া মানুষের প্রেতাত্মা। আমাদের ওরা ছাড়বে না।”
“চেঁচাস না। কিছু হয়নি। সব মিথ্যে, সব দেখার ভুল।” গোবিন্দ উইলসনের হাতটা চেপে ধরল।
“আমরা এই জঙ্গলের অনেক ক্ষতি করেছি। এই জঙ্গলই আমাদের গিলে খাবে। আমরা ভূতের পাল্লায় পড়েছি।”
“কিছু হবে না। সব দেখার ভুল। ভয় পেলে মানুষ ভুল দেখে। আমরা ধরা পড়ার ভয় পেয়েছি।” এবার নিরঞ্জন উইলসলকে আশ্বাস দেবার চেষ্টা করল।
তিনজনে হাঁটার বেগ বাড়িয়ে দিল। চলার পথ এখন অনেকটা। জঙ্গল সহজে ফুরবার নয়। কখন কাছে ঘেঁষে আসা গাছেরা সারিবদ্ধ পরপর। কখনও বা ঝোপঝাড়। পাথুরে ভূমি উঁচু-নিচু। ওরা আর কারও দেখা পেতে চাইছিল না। কোনও জ্যান্ত মানুষেরও না। আজ সবই যেন অবাস্তব আজগুবি। একটা টানা ডাক নিস্তব্ধ পরিবেশে হালকা দাগ টেনে যাচ্ছিল। কী ডাকছে? কিছু চিতল হরিণ যেন আশেপাশে আড়ালে কোথাও দৌড়ে পালাল। ওরা কীসের ভয়ে পালাল? এ জঙ্গলে চিতা আছে। সে বাঘের চেয়ে কম ভয়ংকর নয়। কিন্তু ওদের তিনজনের মাথায় শুধু ভূতুড়ে লোকদুটো চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বাঘ নয়, চিতা নয় , কিছু আজগুবি ভূতের গল্প।
“জঙ্গলের প্রেতাত্মারা বিপথে নিয়ে গিয়ে মানুষকে মেরে ফেলে! আমি শুনেছি।” উইলসন বিড়বিড় করে বলে চলেছিল।
৩
“কোথায় প্রেতাত্মা আছে? কী যেন আলোচনা করছিলেন আপনারা? আমি এই জঙ্গলে ট্রেকিং করতে এসে পথ হারিয়েছি। আমার ভীষণ ভয় করছে।”
ওরা আবার পাশাপাশি ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেই একই গলার স্বর। সামনের মানুষটা আলাদা। ওদের হাত পা অবশ হয়ে আসছিল। সঙ্গে অস্ত্র থাকলেও চালাবার মতো শক্তি জোগাড় করতে পারছিল না।
নিরঞ্জন কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, “কে আপনি?”
“আমি পথ হারিয়েছি। আমার নাম বিশ্বনাথ কিংবা নিরঞ্জন। আমার সাথে আরও দুজন ছিল। অমল সুর আর আকাশ শীল না ভুল বলছি গোবিন্দ আর উইলসন। আজকাল কিছুতেই নাম মনে থাকে না! ওদের কোথাও সাড়া পাচ্ছি না। আচ্ছা এই জঙ্গলে বাঘ নেই তো?”
উইলসন হঠাৎ তেড়ে গিয়ে লোকটার দিকে এগিয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে থরথর করে কাঁপতে থাকা হাতটা লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “মিথ্যে বলছেন! আপনি কেউ নন!”
সত্যিই সামনের লোকটাকে ছুঁতে পারল না উইলসন। সে যেন জঙ্গলের অন্য গাছের ছায়ার সঙ্গে মিশে গেল। উইলসন উলটো দিকে দৌড় লাগাল প্রাণপণ। নিরঞ্জন আর গোবিন্দ পিছন পিছন ছুটল ওকে আটকাতে। লতায় পা জড়িয়ে আছাড় খেল উইলসন। পরক্ষণেই উঠে আবার ছুটতে লাগল। সামনে ছোট পাহাড়ি নদী। সরু জলের প্রবাহ।
উইলসন জলে পা ডুবিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ওরা কে? বাঘের থাবায় মারা যাওয়া মানুষের ভূত? না আমাদেরই ভবিষ্যৎ? আমরা কেউ বাঁচব না। এখন ওরা আমাদের টেনে নেবে এই জঙ্গলের মধ্যে। আমরা মারা যাব। বাঘে খাবে আমাদের!”
“শান্ত হও। কিচ্ছু হবে না। সব দেখার ভুল। ভূত বলে কিছু নেই। আমরা ভয় পেয়েছি। ভয়ের চোখ দিয়ে শুধু ভুল দেখছি। আমরা বক্সা জঙ্গল পার হয়ে লোকালয়ে যাব। তারপর অন্য দেশে, অন্য কোথাও গা ঢাকা দেব। আমাদের কেউ চিনবে না। তারপর আমরা অন্য কিছু করব। জঙ্গলে ফিরব না।” গোবিন্দ হড়বড় করে বলে চলেছিল।
উইলসন ভয়ার্ত চোখ আরও বড় বড় করে সামনে তাকাল। ওর চোখের ভাষা পড়ে নিয়ে মুহূর্ত পরে বাকি দুজনেও দেখল। ডোরাকাটা প্রাণীটা জলের ওপারে। ওদের দিকে জুলজুলে নজর ফেলে তাকিয়ে আছে। প্রাণীটা পিঠ টানটান করল একবার। যেন আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
উইলসন পিস্তলটা বের করার চেষ্টা করতে গেল। কিন্তু সেটা হাত ফস্কে নদীর জলে পড়ে গেল। নিরঞ্জন কিছু করতে পারল না। তার চোখে সামনের দৃষ্টিপথ ধোঁয়াশায় ভরা। এ জঙ্গল যেন সত্যি নয়। কেবল মায়া। কিংবা তারা ভুল করে কোনও মায়া-জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে। ভবিষ্যত কি কখনও বর্তমানে ঘটতে পারে? সে শুধু বলল, “ভুল দেখছি। সবকিছু ভুল দেখছি আমরা। মানুষ থেকে বাঘ। সব ভুল এই জঙ্গলে। ইলিউশন! ইলিউশন!”
গোবিন্দ পিস্তলটা হাতে নিতে পেরেছিল। চালাতে পারল না।
“এই জঙ্গলে বাঘ থাকতে পারে না।” নিরঞ্জনের কথাগুলো বেজে চলেছিল গোবিন্দর কানের পাশে। “ওরা ছায়া মানুষ ছিল। এটা ছায়ার বাঘ। ওই লোকগুলোর মতোই ইলিউশন।”
ডোরাকাটা প্রাণীটার অত সময় ছিল না। সহজ শিকার তার নাগালের মধ্যে। সময়কে থামিয়ে দেওয়া একটা হুঙ্কার ছেড়ে প্রাণীটা ঝাঁপাল। ওরা তিনজন বুঝে উঠতে পারল না সেটা মায়া না বাস্তব। তবে গাছের ছায়ায় পাশে যেটুকু মৃদু আলো পড়েছিল নদীর জলে। তাতে রক্তের গাঢ় লাল রঙ স্পষ্ট দেখা গেল স্রোতের জলে।
ছবি – পার্থপ্রতিম দাস
গল্পটি টগবগ উৎসব সংখ্যা ১৪২২-এ প্রকাশিত
Leave a Reply