টুকুনের ট্যাক্সি মৃগাঙ্ক মজুমদার

টুকুন আসলে অনেক বড় একটা লোক। অনেক অনেক বয়েস হয়েছে তার। এখন একটা একলা বাড়িতে থাকে। সেই বাড়ির চারিপাশে অনেক গাছ, অনেক পাখি, একটা পুকুর। পুকুরটার একদিকের ঘাট বাঁধানো বাকি পাড়গুলো ধরে ছোট-বড় গাছ। সেই গাছগুলো পুকুরটাকে ঘিরে আছে ঠিকই, কিন্তু সূর্য উঠলে ঠিক জলের সঙ্গে দেখা করে যায়। তারপরে সারাদিন সেই পুকুরের জল, সূর্য, ফড়িং কয়েকটা মাছরাঙা, কিছু বড় বোয়াল আর রুই একদিকের কাদাতে দুটো সোনাব্যাঙ— সবাই মিলে খেলা করতে থাকে। সূর্যের আলো পড়লেই জল ঝকঝকিয়ে হেসে ওঠে আর টুকুন?

টুকুন কখনও সেই বাঁধানো ঘাটের ধারে আর কখনও পুকুরের অন্য পাড়ে ঘাসের ওপরে থেবড়ে বসে দেখতে থাকে। টুকুনের কথা এই আধা শহরের সবাই জানে। টুকুনের আশেপাশে কেউই আসে না চট করে। সবাই ভয় পায়। একে তো একা-একা থাকে। তার উপর ইয়া মোটা মোটা বই পড়ে।

চশমাটা আছে ঠিকই। কিন্তু সেটা যে কী কারণে আছে কেউই জানে না। এমনিতে মোটা পুরু কাঁচের চশমা তায় মোটা কালো ফ্রেম। সেটা পরলে চোখগুলো বড় বড় হয়ে বেরিয়ে আসে প্রায়।

এই টুকুনকে দেখে একজনই ভয় পায় না। সে হল বুকুন।

বুকুনের ভালো নাম অরিত্রা, অরিত্রা বসু। অরিত্রা বাবা একটা কলেজের ইতিহাসের শিক্ষক আর মা একটা হাইস্কুলের অঙ্কের দিদিমণি। অরিত্রা সবে ক্লাস টু তে পড়ছে। বাবা তাকে স্কুলে পৌঁছে দেয় আর মা নিয়ে আসে, তারপর আবার নিজের স্কুলে চলে যায়। বাড়িতে তখন সে দাদু আর ঠাকুমার সাথে গল্প করে।

বুকুনের বাবা-মা দুজনেই কাজ থেকে ফিরলে, বুকুন হোমটাস্ক নিয়ে আসে। স্কুল থেকে বাড়িতে করার জন্য যা যা কাজ দেয় তার সঙ্গেই বাবা-মা আরও কিছু কাজ দেয় বুকুনকে। যেমন একটা ছোট্ট ঝাঁঝরি করে গাছে জল দেওয়া, একটা করে ধাঁধা শিখে দাদু-ঠাকুমা-মা আর বাবাকে জিজ্ঞেস করা, ড্রয়িং খাতায় রোজ নতুন কিছু একটা আঁকা, নিজের মতো যা খুশি আর পাঁচ লাইন করে রোজ একটা কিছু লেখা।

বুকুন নিজের মতো খাতা নিয়ে বসে যা মনে হয় করে আর তারপর দাদু আর ঠাকুমার সঙ্গে রোজ ঝগড়া করে কেন তারা বুকুনের সঙ্গে নাচছে না। এদিকে নেচে-নেচে দাদুর শিরদাঁড়া সোজা কি ব্যাঁকা সেটা দাদু প্রায় ভুলেই গিয়েছে। তেমনই ঠাকুমার বাতের ব্যথাটাও ভয় পাচ্ছে আজকাল বুকুনকে।

 

এই বুকুনের সাহস এমনিতেই খুবই বেশি। ইস্কুলেও দিদিমণিদের প্রশ্ন করতে ভয় পায় না। একা-একা বাবার সাইকেল ধরে চালানোর চেষ্টা করে। তবে ভাগ্যক্রমে সেটা বারান্দার সঙ্গে লাগোয়া একটা জানলার গ্রিলের সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা থাকে। না হলে বুকুন কবে সেটা চড়ে চালিয়ে অনে-এ-এ-ক দূর চলে যেত।

বুকুন আরও ছোট থাকতে একবার বাবার এক বন্ধু বুকুনকে টুকুনের নাম করে ভয় দেখিয়েছিল যাতে সে দুষ্টুমি না করে। কিন্তু বুকুনের বাবা পরে বুঝিয়েছিল যে টুকুনকে অত ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

সেই থেকে বুকুন আর ভয় পায় না টুকুনকে।

একদিন এক গরমের বিকেলে বুকুন নিজের বাড়ির বাগানে জল দিতে দিতে আস্তে আস্তে গেট খুলে টুকুনদের বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। আসলে টুকুনদের বাড়িটা তো বুকুনদের ঠিক পাশেই। মাঝে অনেকটা বড় খালি জায়গা আর পুকুর আছে এই যা। যেতে যেতে বুকুন ভেবেই নিয়েছে, টুকুন যদি ওকে কিছু বলে, তা হলে দুদিন আগে শোনা হিংসুটে দৈত্যর গল্পটা টুকুনকে শুনিয়ে দেবে।
সেই যে সেই দৈত্যটা যার বাগানে কেউ ঢুকতে পারত না, ছোটরা খেলতে পারত না, তারপর বাগান শুকিয়ে গেল। অনেক পরে দৈত্য যখন বাগানের দেওয়াল ভেঙে দিল, তার পরে বাগানটা আবার নতুন করে ঝলমল করতে লাগল।

সেই দৈত্যর কথা শুনলে টুকুন আর কিছুই বলবে না বুকুন ঠিক জানে।

 

এই ভাবতে ভাবতেই বুকুন গেটের ফাঁক দিয়ে গলে ঢুকে পড়ল। আসলে টুকুনের বাড়ির গেট তো অনেক বড়। কিন্তু তাতে ফাঁক আছে, যেটা দিয়ে খালি বুকুনের মতো বাচ্চারাই ঢুকতে পারবে। বড়রা একদমই না।

বুকুন বাগানে ঢুকেই দেখে অনেক পাখি, অনেক ফড়িং আর অনেক ফুল। তার পরেই দেখে টুকুনকে। টুকুন একটা সাদা পাজামা আর সাদা পাঞ্জাবি পরে পুকুরের ধারে চুপ করে বসে আছে।

টুকুন খচমচ খচমচ আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুরাতেই বুকুনকে দেখতে পেল আর দেখে অবাক। ততক্ষণে বুকুনের বকবকানি শুরু হয়ে গিয়েছে।

“তুমি টুকুন?”

“কিন্তু তুমি তো বড়, তোমাকে কেন সবাই টুকুন বলে?”

“তুমি তো আমার দাদুর মতো বড়, তাও তোমাকে সবাই টুকুন বলে? তুমি সবাইকে কিছু বলতে পারো না? জানো তো আমার স্কুলে আজ ছুটি হয়ে গিয়েছে তাই আমি এখানে এসেছি, একটু পরে চলে যাব।”

“আমি কিছু খাব না এখন। অত খেতে ভালো লাগে না আমার বিকেলে। বাবা-মা এলে একসাথে খাব সন্ধেবেলাতে।”

“আমার নাম কিন্তু বুকুন। কিন্তু আমি তোমার মতো বড় না, আমি ছোট। কিন্তু আমি বড় হয়ে যাব একদিন।”

একটানা এত কথা টুকুন অনেকদিন শোনেনি। এই বাড়িতে কেউই আসে না আজকাল। আর বুকুনের শেষ কথাটা শুনে টুকুন না হেসে থাকতে পারল না।

টুকুন বলল, “ওহ আচ্ছা, তোমার নাম টুকুন?”

বুকুন প্রবল প্রতিবাদ করে হাত নাড়িয়ে বলল, “আহ, কিছুই বুঝছ না দেখছি, আমার নাম বুকুন, বু উ কু উ ন, তোমার নাম টুকুন, কিন্তু তুমি তো বড় তাও তোমার নাম টুকুন কেন তুমি তো এত্তটুকুন না?”

টুকুন বলল, “তাই তো, তাই তো বড় ভুল হয়েছে। আচ্ছা শোনো, এর একটা গপ্পো আছে।”
বুকুন আবার প্রতিবাদ করল, “গপ্পো না, বলো গল্প।”

টুকুন হেসে চশমা খুলে বলল, “আচ্ছা বেশ গল্প।”

আবার শুরু করল টুকুন।

“আমি যখন তোমার মতো ছোট ছিলাম, তখন আমি কলকাতা গিয়েছিলাম বেড়াতে। কলকাতায় আমার কাকা আর জেঠুরা থাকত আর দুটো মামা। সেখানে ঘুরতে গিয়ে অনেক অনেক কিছু দেখেছি, ঘোড়ার গাড়িতে চড়েছি, ট্রামে চড়েছি, নৌকাতে চড়েছি আর চড়েছি ট্যাক্সিতে। গাড়ি না কিন্তু ট্যাক্সি। তুমি জানো ট্যাক্সি কী?”

“ট্যাক্সি আমি জানি। চড়লে পয়সা দিতে হয়। বাবা আর মা আমাকে নিয়ে বেড়াতে গেলে ট্যাক্সি চড়ে আর মোবাইল থেকে টাকা দিয়ে দেয়।”

বুকুনের সটান জবাব ।

শুনে টুকুন নড়েচড়ে বসে বলল, “ও বাবা! তুমি তো সব জানো দেখছি।”

বুকুন বলে আবার, “কই সব জানি, আমি কি বড় হয়েছি নাকি?”

টুকুন ঘাড় নেড়ে আবার শুরু করে, “আসলে ট্যাক্সিটা এই রকম ট্যাক্সি না। মোবাইলে ডাকা যেত না। সেটা হলুদ ট্যাক্সি। এই হলুদ ট্যাক্সিতে বসলে জানো আমি জানলা অবধি পৌঁছাতাম না আর কিচ্ছু দেখতে পারতাম না। তখন খুব কাঁদতাম। একদিন এই ট্যাক্সিতে আমি দরজা খোলা দেখে টুক করে পিছনের সিটে ঢুকে পড়েছিলাম বাবা-মায়ের হাত ছাড়িয়ে। আমি তো ছোট্ট ছিলাম তখন, তাই ড্রাইভার আমাকে দেখতে পায়নি। আমি সিটের তলায় গুটিশুটি মেরে ছিলাম। তারপর ট্যাক্সি খানিক চলার পরই আমি হামাগুড়ি দিয়ে উঠে সিট বেয়ে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে শক্ত করে সেই হলুদ ট্যাক্সির দরজা ধরে বাইরে দেখতে যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পরেই ড্রাইভার আমাকে দেখতে পায়। সেই ড্রাইভারের মাথায় এক বিশাল পাগড়ি, মুখে দাড়ি। সে আমাকে দেখেই বলে, আই বাআপ, এই টুকুন লেড়কা কোথা থেকে এসে গেল?

“তার পরে গাড়ি থামিয়ে আমাকে কত্ত প্রশ্ন করে সব জেনে খানিক ঘুরিয়ে পুলিশের কাছে নিয়ে গেল, পুলিশ তার পর বাবা-মাকে ডেকে এনে আমাকে তাদের কাছে দিল। সেই থেকেই আমাকে সবাই ‘টুকুন’ বলে।”

এত অবধি শুনে বুকুন বলল, “ও, ঠিক আছে। এই ব্যাপার! কিন্তু শোনো, বাবা-মায়ের কথা শুনবে কিন্তু। এইভাবে একাএকা ট্যাক্সিতে আর উঠবে না। বাবা-মাকে বললে তোমায় নিয়ে ঘুরতে যাবে আর জানলার সামনে বসতেও দেবে, কেমন? আচ্ছা আমি যাই এবারে, আমার বাবা-মা ভাববে।”

বলে বুকুন তার গোলাপি ফ্রক উড়িয়ে টুকটুক করে দৌড়ে চলে গেল।

 

সেইদিন রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে টুকুন স্বপ্ন দেখল সে আবার বেরিয়েছে বেড়াতে। সেই হলদে রঙের ট্যাক্সি, সামনে সেই শিখ ড্রাইভারকাকু, পাশে বাবা আর মা। টুকুন আবার ছোট্ট টুকুন হয়ে গিয়েছে আর ট্যাক্সিটা একটানা চলছে শহর ছাড়িয়ে অনেক অনেক দূরে।

 

অলংকরণ – সুমিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published.