ঝিলিক নাকি তার দাদুকে দ্যাখেনি। বললেই হল? ওই তো ডাইনিং টেবিলের পিছনের দেয়ালে বাবাকে কোলে নিয়ে দাদু হাসছে। বললেই মা বলবে, “ওটা তো ওনার অল্প বয়সের ছবি। দেখছিস না তোর বাবা কতটুকু? শেষে কি আর ওই চেহারা ছিল?” আচ্ছা সে না হয় হল। পিসির বিয়ের অ্যালবামে তো দাদু রয়েছে। সেখানে তো সব চুল পাকা, গোঁফও কাঁচা পাকা মেশানো। তবে? কিন্তু পিসি এই সেদিনও বলে গেল ঝিলিক দাদুকে ‘একটুর জন্যে’ দেখতে পায়নি। কথাটা শুনলেই ভীষণ রাগ হয়। দিব্যি মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে সারাদিন, আর বলে কি না দেখতে পায়নি!

বাবা একদিন বুঝিয়ে বলল, “আহা, দেখতে পাসনি মানে মানুষটাকে জীবন্ত দেখতে পাসনি। আলাপ হয়নি আর কী। আমাদের সাথে যেমন কথা বলিস, খেলা করিস, তেমনটা করতে পাসনি। তা পাবি কেমন করে? বাবা তো তোর জন্মের মাস তিনেক আগেই মারা গেলেন।”

ও কথা ঝিলিক আগেই জানত। কিন্তু বাবাকে বুঝিয়ে পারা যায় না যে জীবন্ত লোকটাকে দেখা হয়নি বলেই তাকে চিনি না, এমনটা ভাবা ভুল। একদিন রাতে শুয়ে শুয়ে কথাটা মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মা বুঝতেই পারল না। কিছুক্ষণ ‘হ্যাঁ হুঁ’ করার পর ধমকাল, “অ্যাই, অনেক রাত হয়েছে, এবার ঘুমো। আবোলতাবোল বকে রাত করছিস, তারপর সকালে স্কুল যাওয়ার সময় চোখই খুলতে চাইবি না।” সেদিনই ঝিলিক বুঝে ফেলেছে বড়দের বুঝিয়ে লাভ নেই। ওরা ভাবে ওরা সব বোঝে। কত কিছু যে বোঝে না সে যদি ওরা জানত…

সেদিন ভ্যানে করে স্কুল থেকে ফেরার সময় ঝিলিক দেখল একজন রিকশাকাকুকে একটা দুষ্টু লোক ঠাস ঠাস করে চড় মারছে। আরও মারত, যদি ঝিলিকের ভ্যানকাকু দৌড়ে গিয়ে লোকটার সামনে হাত জোড় না করত, আর রাস্তার অন্য লোকেরা রিকশাকাকুকে সরিয়ে না নিত। ঝিলিক আর ওর বন্ধুরা মারামারি, চেঁচামেচিতে বেশ ভয় পেয়ে গেছিল। দুষ্টু লোকটা কীসব বিচ্ছিরি কথা বলছিল তার পরেও। ঝিলিক মানে বুঝতে পারেনি, কিন্তু একটা খারাপ লোক চোখমুখ লাল করে কি আর ভালো ভালো কথা বলে? ওখান থেকে চলে আসার সময়ে ঝিলিক দেখতে পেল সকলে মিলে যে কাকুটা মার খেল তাকেই বকছে, আর দুষ্টু লোকটা দূরে দাঁড়িয়ে খারাপ-খারাপ কথা বলেই যাচ্ছে। ঝিলিকের খুব আপশোশ হয়েছিল। ও জানত, দাদু এখন থাকলে দুষ্টু লোকটাকে মজা টের পাইয়ে দিত। এ কথা বড়দের বললেই বোকার মতো প্রশ্ন করবে— “তুই কী করে জানলি?” কী আশ্চর্য! ঝিলিক কি অত ছোট আছে যে এটুকু বুঝবে না? সে ঠাম্মির কাছে শোনেনি দাদুকে গুন্ডারা কেমন ভয় পেত? বাবাও তো গল্প করেছে, রিকশাকাকুরা মুশকিলে পড়লে প্রথমেই দাদুর কাছে আসত। তাহলে? এটুকু বুঝতে কি অনেক বড় হতে হয়?

কেবল দুষ্টু লোক নয়, অনেক সময় বড়দের শাস্তি দিতেও দাদুকে দরকার হয় ঝিলিকের। চন্দ্রা পিসি যখন রান্না করতে আসে তখন সঙ্গে নিয়ে আসত লোটনকে। ঝিলিকের চেয়ে হয়তো একটু বড়, কিন্তু লোটনের সঙ্গে খেলতে খুব ভালো লাগে। ও আলমারির পিছনে জমে থাকা ধুলো দিয়ে রান্না করতে পারে। বাড়ি বানানোর লেগো জুড়ে জুড়ে কুকুর বেড়াল বানাতে পারে। ডোনাল্ড ডাক আর মিকি মাউসকে রাজা আর মন্ত্রী বানিয়ে পেপা পিগের বিচার করতে পারে। ডোরেমন আর ছোটা ভীমকে নিয়ে গুহায় গুপ্তধন খুঁজতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগে লোটন হিংসুটে নয় বলে। রিচা, রিয়াঙ্কা, রোহণ, সৌম্যদীপদের মতো খেলনা নিয়ে টানাটানি করে না। কিন্তু লোটনের সঙ্গে বেশিদিন খেলা হল না। একদিন রাতে বাবা-মা ভেবেছিল ঝিলিক ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই বলাবলি করছিল।

“চন্দ্রাকে ভাবছি বলব ওর ছেলেটাকে যেন আর না আনে।”

“কেন? কী হল?”

“আরে ওর সাথে মিশে মিশে কী উলটোপালটা শিখে যাবে মেয়ে তার ঠিক আছে?”

“ওইটুকু ছেলে নিজে কী এমন উলটোপালটা জানে? ঝিলিকেরই বয়সি তো।”

“আরে ওদের মধ্যে কি কোনও বাছবিচার আছে? মা-বাবা হয়তো ছেলের সামনেই গালিগালাজ করে…”

“সে ঝগড়াঝাঁটি তো আমাদেরও হয় অনেক সময়।”

“কী যে বলো না! আমরা কি গালাগাল করি নাকি রেগে গেলে?”

“সে কী! ঝিলিক গালাগাল শিখে গেছে নাকি!”

“শেখেনি, শিখতে কতক্ষণ? তুমি কি ততদিন ওয়েট করতে বলছ?”

“আচ্ছা, বলেই দাও তাহলে।”

“তাছাড়া ছেলেটা বড্ড নোংরা।”

“নোংরা?”

“হ্যাঁ, সেদিন দেখলাম ঘরের কোণের ধুলো ঘাঁটছে দুজনে মিলে। চোখে পড়ে গেল বলে ঝিলিককে ধমকে সরিয়ে দিলাম। সবসময় কি খেয়াল রাখা সম্ভব? কোনদিন ছেলেটার একটা অসুখবিসুখ হবে, তার থেকে তোমার মেয়েও বাধাবে।”

বাবা সায় দিল। তারপর থেকে লোটন আর আসেনি। কেন আসেনি বুঝতে পেরে ঝিলিক লুকিয়ে কেঁদেছিল। আর ভেবেছিল দাদু থাকলে এমন হত না। দাদু বাবা-মা দুজনকেই বকে দিত খুব করে। লোটন খুব ভালো ছেলে। ওর সঙ্গে মিশলে শরীর খারাপ হবে, এরকম কথা শুনলে দাদু ভীষণ রেগে যেত।

এইসব হলে দাদুর কথা যেমন মনে পড়ে ঝিলিকের, তেমনই দাদুর উপর রাগও হয়। কী দরকার ছিল অত সিগারেট খাওয়ার? না খেলেই তো দাদু আরও অনেকদিন বাঁচতে পারত। তা হলেই ঝিলিকের সব বিপদে দাদু ওকে বাঁচাতে পারত।

তবে এরপর একদিন সত্যি সত্যি দাদু ঝিলিককে বাঁচাল।

 

 

ঝিলিক খুব শান্ত, তাই ক্লাসে তার খুব বেশি বন্ধু নেই। আবীর আর মৌসুমীই তার বন্ধু। ওরা তিনজনে টিফিন ভাগ করে খায়। একদিন মাঠের ধারে বসে টিফিন খাওয়ার সময় একটা বল উড়ে এসে পড়ল মৌসুমীর টিফিন বাক্সে, বাক্সটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে রুটি আর আলুভাজা ছড়িয়ে গেল মাঠের মধ্যে। কয়েকজন দৌড়ে চলে গেল সেগুলোর উপর দিয়েই। মৌসুমীর সে কী কান্না! আবীর আর ঝিলিক বুঝতে পারছিল না কী করবে। শেষে কান্না থামে না দেখে আবীর বলল, “নে, তুই আমার টিফিনটা খা।” মৌসুমী ওর জেলি মাখানো পাঁউরুটিগুলো একাই খেয়ে ফেলল। বোধ হয় খুব খিদে পেয়েছিল। কিন্তু তাহলে আবীর কী খাবে?

ঝিলিকের কাছে ছিল ম্যাগি। ও আবীরের সঙ্গে ভাগ করে সেটাই খাচ্ছিল, এমন সময় দুষ্টু ছেলে অরিত্র এসে “অ্যাই, তোরা লুকিয়ে লুকিয়ে ম্যাগি খাচ্ছিস?” বলে ছোঁ মেরে টিফিন বাক্সটা নিয়ে নিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সব শেষ। খালি টিফিন বাক্সটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবার খেলতে চলে গেল। অরিত্র ইয়া লম্বা আর এই মোটা, গায়ে ভীষণ জোর। তাই আবীর আর ঝিলিকের চোখ ফেটে জল এলেও কিছু করতে পারল না। অরিত্র আবার লেখাপড়ায় ভালো, তাই টিফিনের পরের ক্লাসে ইংলিশের আন্টিকে নালিশ করেও লাভ হল না। তিনি কেবল চশমার ফাঁক দিয়ে কটমটিয়ে বললেন, “নেভার কমপ্লেন আগেন্সট ইয়োর ফ্রেন্ড। ইটস্‌ আ ভেরি ব্যাড হ্যাবিট।” আবীর আর ঝিলিককে সেদিন আধপেটা খেয়েই থাকতে হল।

ঝিলিক যখন বাড়ি ফেরে তখন বাবা-মা দুজনেই অফিসে থাকে। রূপা মাসি ভ্যান থেকে নিয়ে আসে। মুখ শুকনো দেখে জিজ্ঞেস করল, “কী হল, মা? খিদে পেয়েছে?” সব শুনে বলল, “ছি ছি ছি! ভদ্দরলোকের ছেলেদের কি শিক্ষা দীক্ষা! আর দিদিমুণিগুলোই বা কেমন ধারা? একবার খোঁজ করে দেখবি না সত্যি বলচে কি মিথ্যে বলচে? কী পাষাণ রে বাবা! চলো, আমি তোমার দুধ জ্বাল দিয়ে রেখেচি। গরম গরম খেয়ে নেবে ওরেও বিস্কুট দিয়ে, পেট ভরে যাবে।”

দুধ খেয়েও ঝিলিকের খিদে তেমন মিটল না। মনে হল একটা অমলেট খেতে পারলে পেটটা বেশ ভরে যেত। রূপা মাসিকে বলতে সে জিভ কেটে বলল “আহা গো! কী করি এখন? ডিম তো ফ্রিজে। ফ্রিজ তো আবার বৌদি চাবি দিয়ে গেছে। আমার ব্যাগে মুড়ি চানাচুর আছে। খাবে একটু?” ঝিলিকের একটুও ইচ্ছে করল না। তাই সে রাগ করে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। চোখ বুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, এমন সময় শুনল কে যেন বলছে, “নাতনিটা কাঁদে কেন?” চোখ খুলতেই অবাক কাণ্ড! এ তো সেই পিসির বিয়ের অ্যালবামের দাদু! হ্যাঁ, তেমনই দুধের মতন সাদা এক মাথা চুল, কাঁচাপাকা গোঁফ, গায়ে সেই নীলের উপর সাদা নকশা করা পাঞ্জাবি!

“দাদুউউউ! তুমি কোথা থেকে এলে? তুমি না মরে গেছ?” ঝিলিক বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে বলল।

“কে বললে মরে গেছি? মোটেই না। আমি ছবির ভেতর অপেক্ষা করছিলাম। কবে আমাকে কেউ আদর করে ডাকবে, অমনি এসে হাজির হব। তা দেখছি তুমিই আমায় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো দিদিভাই। তুমি রোজ আমার কথা মনে করো। তাতেই ছবি থেকে বেরিয়ে আসার জোর পেলাম। সেই কবে ছবি হয়েছি, তারপর থেকে কত লোক কতবার নাম করল। শুনতে পেয়েছি, কিন্তু বেরিয়ে আসার মতো জোর পাইনি।”

“আচ্ছা, তুমি তো ভূত। তোমাকে আমি ছুঁতে পারব?”

“চেষ্টা করেই দ্যাখো না।”

দাদু একবার বলতেই ঝিলিক লাফিয়ে কোলে উঠে পড়ল। ও মা! ভূত হলেও দাদুর সঙ্গে মানুষের তো কোনও তফাত নেই! দিব্যি কোলে বসা যাচ্ছে, চুমু খাওয়াও যাচ্ছে। চুমু খেতে গিয়ে অবশ্য কেমন খোঁচা খোঁচা লাগল, গালে তেমন ভালো গন্ধও নেই। তাই ঝিলিক জিজ্ঞেস করল, “দাদু, তোমার গালটা এত শক্ত কেন? ঠান্ডা ঠান্ডা গন্ধ নেই কেন বাবার মতো?”

“বুড়ো হয়ে মরেছি যে দিদি। বুড়ো হলে চামড়া শক্ত হয়ে যায়। তাছাড়া আমি তো তোমার বাবার মতো ক্রিম দিয়ে দাড়ি কামাইনি কোনোদিন, আমার ছিল গোল সাবান। আর গন্ধ তো হয় আফটার শেভ লোশনে। আমি তো ফটকিরির লোক।”

“আহা রে! আচ্ছা আমি বড় হয়ে তোমাকে লোশন কিনে দেব।”

“আচ্ছা সে নয় দিও। এখন আগে তোমার সমস্যাটা মেটানো যাক। চলো অমলেটের ব্যবস্থা করি।”

“কী করে হবে? মা তো ফ্রিজে তালা দিয়ে যায়।”

“তালা খুলতে মানুষের চাবি লাগে। আমি তো মানুষ নই।”

ঝিলিক আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠেছিল। দাদু বলল, “আস্তে, আস্তে। কেউ যেন জানতে না পারে দিদিভাই।”

“সে কী! তুমি যে বেঁচে আছ সবাইকে বলতে হবে না?”

“না গো দিদি। তা হবে না। আমি সকলের জন্যে বেঁচে নেই। তুমি আমায় এক আকাশ ভালবাসো বলে তোমার কাছে বেঁচে আছি। আমাকে কেবল তুমিই দেখতে পাবে, আর কেউ নয়। তুমি যদি সকলকে বলো আমায় দেখতে পাচ্ছ, তবে সবাই ভাববে তুমি মিথ্যে কথা বলছ। তখন তোমাকে বকা দেবে।”

শুনে ঝিলিকের একটু মন খারাপ হল। ও ভেবেছিল দাদুর সঙ্গে আবীর আর মৌসুমীরও আলাপ করিয়ে দেবে। বেশ মজা করে খেলা যাবে। দাদু বলল, “মন খারাপ কোরো না। তোমাতে আমাতেও খেলা খুব জমবে। এখন চলো, অমলেট খাবে আগে।”

রূপা মাসি ততক্ষণে ডাইনিং হলের মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঝিলিক সটান গিয়ে ফ্রিজের দরজা খুলে একটা ডিম বার করে ফেলল। তারপর মাসির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “মাসি, এই যে ডিম।” মাসি চোখ খুলে ডিমটা দেখে অবাক। “ও মা! বৌদি আজ চাবি দিতে ভুলে গেল নাকি? আচ্ছা যাক, ভালোই হয়েচে।”

কয়েক মিনিট পরে নিজের ঘরে পড়ার টেবিলে বসে অমলেট খেতে খেতে ঝিলিক বলল, “ওফ, দাদু! ভাগ্যিস তুমি এলে। আমার অমলেট খাওয়াই হত না তা না হলে।”

দাদু মাথা নেড়ে বলল, “তা বটে, দিদি। তুমি আমার সামনে বসে খাচ্ছ, দেখেও সুখ। তবে একদিন আবদার করলে ভালো, রোজ রোজ অমন কোরো না কিন্তু। রূপা মাসি বিপদে পড়বে। মা বলবে, ‘রোজ একটা করে ডিম যায় কোথায়?’”

“তুমি তো সব পারো। একটা ডিম বানিয়ে আবার ফ্রিজে রেখে দিতে পারবে না?”

দাদু হেসে গড়াগড়ি।

“ভূতে কি আর ডিম পাড়তে পারে? ও কাজটা হাঁস মুরগিরই থাক, বুঝলে? তাছাড়া যদি গুপি-বাঘার মতো এমনি এমনি খাবারদাবার এনে ফেলতে পারত ভূতেরা, তাহলে কি আর দুনিয়ায় কেউ খালি পেটে থাকত? তখন দেখতে সকলে ভূতেদেরই পুজো করছে, আর প্রসাদ খেয়েই পেট ভরে যাচ্ছে।”

শুনে ঝিলিকের মনে হয়েছিল তেমন হলে বেশ হয়। কিন্তু দাদু বলল, “অমন তো হয় না, তাই যখন যা পাবে সোনামুখ করে খেয়ে নিও, দিদিভাই। খিদে পেলেই খেতে পাওয়া বড় সোজা কথা নয় গো। বড় হলে বুঝবে।”

দাদুর এই একটা কথাই ঝিলিকের পছন্দ হয়নি। বাবা-মাও কথায় কথায় বলে, “বড় হলে বুঝবি।” যেন বড় হলেই সবাই সব বুঝতে পারে।

 

 

দাদুর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে ঝিলিকের আর একা লাগে না। বাড়িতে যতক্ষণ বাবা-মা থাকে না, ঝিলিক নিজের ঘরে দাদুর কাছে গল্প শোনে, খেলা করে, আর সময় হলে দাদুই ঘুম পাড়িয়ে দেয়। স্কুলের দুষ্টু ছেলেমেয়েরা আজকাল ওকে আর ওর বন্ধুদের চট করে বিরক্ত করে না। ঝিলিক চেয়েছিল দাদু দুষ্টুগুলোকে একদিন আচ্ছা করে ভয় দেখাক, কিন্তু দাদু রাজি হয়নি। কেবল মাথায় হাত রেখে বলেছিল, “রাগতে শিখে ফ্যালো। দুনিয়া বড় কঠিন। ঠিক সময় রাগতে হবে, নইলে দুষ্টু লোকেরা তোমার ঘাড়ে চেপে বসবে। রেগে এমন কটমটিয়ে তাকাবে যে ভয়ে কেউ তোমার সাথে অসভ্যতা করবে না। তারপর যত বড় হবে, তত নিজেকে বাঁচানোর আরও সব কায়দা শিখতে হবে।”

আগে ঝিলিকের রাগ হলেই কান্না পেত। বাড়িতে ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কাঁদলেই বাবা, মা বা রূপা মাসি কোলে নিত, আদর করত। কিন্তু স্কুলে কেঁদে লাভ হত না। আন্টিরা বড় কড়া। এখন রাগ হলে ঝিলিক খুব গম্ভীর হয়ে যায়, চোখ জ্বলতে থাকে, ও নিজেই টের পায় গাল শক্ত হয়ে গেছে। একদিন অরিত্র ওর ঝুঁটি ধরে টেনেছিল, তারপর ঝিলিক এমন রেগে গেল যে অরিত্র ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলল। তারপর থেকে আর কাছাকাছি আসে না।

সারাদিন যেখানে যা হয় সব ঝিলিক দাদুকে বলে। একদিন অনেক দূরের বিয়ে বাড়ি থেকে নেমন্তন্ন খেয়ে ফেরার সময় ঝিলিক ট্রেনেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন পাশ ফিরতে গিয়ে ঘুম ভেঙে গেল, বুঝল বিছানায় শুয়ে আছে। কিন্তু খাটের এক পাশে বসে বাবা কাঁদছে কেন? ঝিলিক চোখ বুজে ঘুমের ভান করে বাবা-মায়ের কথা শুনল। দাদুকে বলতে হবে তো।

“দাদু, জানো, কালকে বাবা কাঁদছিল?”

“কেন গো?”

“বলছিল বাবার নাকি চাকরি থাকবে না।”

“ঠিক শুনেছ তো দিদি?”

“আমি কি তোমার মতো বুড়ো হয়েছি যে কানে কম শুনব?”

“হা হা হা! তাও তো ঠিক। দিদিভাই আমার জোয়ান। আচ্ছা, তাহলে আমাকে বলো তো কী কী শুনলে? কিচ্ছু বাদ গেলে হবে না কিন্তু।”

তখন ঝিলিক একটু মুশকিলে পড়ে গেল। সবই শোনা গেছে কান খাড়া করে, কিন্তু সব কি ছাই বোঝা গেছে?

“বাবা বলল এক তারিখ থেকে আর অফিস যাবে না। তখন মা বলল কত দিনের মাইনে দেবে? বাবা বলল তিন মাস। মা জিজ্ঞেস করল কোনও উপায় নেই? বাবা বলল সবার নামে কী যেন চিঠি এসেছে। তখন মা বলল চিন্তা কোরো না, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তখন বাবা বলল ঝিলিকের ফিউচার? মা বলল ঠিক ব্যবস্থা হবে। বাবা তাও কাঁদছিল। বলছিল আমি বাড়িতে বসে থাকব আর তুমি একা খেটে মরবে? তারপর খুব ঝগড়া করল। এত জোরে জোরে কথা বলল, আমি বুঝতে পারলাম না।”

ঝিলিক কখনও দাদুকে গম্ভীর দ্যাখেনি, তখন দেখল। বাবা-মার ঝগড়া শুনেই ভয় হয়েছিল। মৌসুমীর বাবা-মার আড়ি হয়ে গেছে, যদি ওর বাবা-মারও হয়? দাদুকে ভয়টা বলতেই দাদু চুমু খেয়ে বলল, “কোনও ভয় নেই। কারও সাথে কারও আড়ি হবে না। এটুকু ঝগড়ায় আড়ি হয় না, দিদি। তবে তোমার বাবা খুব চিন্তায় পড়ে গেছে, তার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তোমাকে একটা কাজ দেব। পারবে তো?” ঝিলিক তো এক পায়ে খাড়া।

পরের দিন রবিবার, ঝিলিকের বাবার সারা বাড়ির বইয়ের তাকের ধুলো ঝাড়ার দিন। ঝিলিক মন দিয়ে বাবাকে সাহায্য করে, কিন্তু মা কোনোদিন সেটা মানতে চায় না। বলে, “ভারী তো সাহায্য। কেবল পিছু পিছু ঘোরা আর রংচঙে বই দেখলেই ‘বাবা, এটা কী বই, ওটা কী বই’ জিজ্ঞেস করা।” বাবা অবশ্য বলে, “না না, ও আমাকে অনেক হেল্প করে। এক ধরনের বই আরেক ধরনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে কি না ও খেয়াল করে।”

সে যাই হোক, সেদিন ঝিলিক বায়না ধরল তিনতলার পড়ার ঘরটা খুলতে হবে। ও ঘরটা খুব পুরনো। দাদু ওখানে বসে বই পড়ত। কেবল প্রতিবার পুজোর আগে ওই ঘরটা খুলে পরিষ্কার করা হয়। ওখানে সব দাদুর বই। বাবা ওসব পড়ে না। তবে ও ঘর খোলা হলে যে গন্ধটা বেরোয়, সেটা ছোটবেলা থেকেই ঝিলিকের খুব পছন্দ। এখন দাদুর গায়ে সেই গন্ধই পাওয়া যায়। তাছাড়া ওখানে ইয়া মোটা একরকম মলাটের দশখানা ইংরেজি বই আছে। ঝিলিক পড়তে পারে না, কিন্তু বইগুলোর তেলতেলে পাতায় আশ্চর্য সব জিনিসের রঙিন ছবি আছে। কোনোটায় বেলুনে চড়া মানুষ, কোথাও তিমি, কোথাও সমুদ্রের তলার স্পঞ্জ আর তারা মাছ, কোথাও সিনেমার শুটিংয়ের ছবি, কোথাও আবার মহাকাশযানের ভিতরের ছবি। তাই ঘরটা ঝিলিকের খুব পছন্দ। মা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না, অনেক কান্নাকাটি করে বাবাকে রাজি করানো গেল।

পুজো চলে গেছে সেই কবে, বেশ গরম পড়ে গেছে। ঘরে ঢুকে বাবা দক্ষিণের জানলাগুলো খুলতেই মিষ্টি হাওয়া এল, আর দাদুর গায়ের গন্ধটা সারা ঘরে ছড়িয়ে গেল। দাদু অবশ্য তখন ঝিলিকের পাশেই দাঁড়িয়ে, বাবা তো আর জানে না। বাবা তখন বহুকাল হাত না পড়া বইয়ের তাক ঝাড়তে ব্যস্ত। পশ্চিমের দেয়ালের পা থেকে মাথা অব্দি দাদুর বইয়ের তাক৷

বাবা লম্বা টুলের উপর উঠে বইগুলো এক-এক করে ঝিলিকের হাতে দিচ্ছে আর ও মাটিতে রাখছে। ওগুলো ছাদে রোদে দিতে হবে। এমন সময় একটা বই টানতে গিয়ে হুড়মুড় করে এক সারি বই মাটিতে পড়ে গেল। কেন পড়ল বাবা ভেবেই কুল পেল না। কেমন করে পাবে? ঝিলিক কিন্তু খিলখিল করে হাসল। বাবা খুব বিরক্ত হয়ে “ধুত্তোর! কাজ বেড়ে গেল” বলে টুল থেকে নেমে এল। ঝিলিককে বলল, “বইগুলো আপাতত গুছিয়ে ঠিক করে রাখ। মোটা মোটা বই ওভাবে পড়েছে, ছিঁড়ে টিড়ে গেল কিনা দেখি।”

দুজনে মিলে কাজটা করতে করতে ঝিলিকের হাতে এল এই মোটা একটা বই— মহাভারত। ঝিলিক জানে মহাভারত ব্যাসদেবের লেখা, কিন্তু এই বইটায় তাঁর নাম ছোট হরফে লিখে বড় বড় করে অন্য একজনের নাম লেখা। রাজশেখর বসু। ঝিলিক কখনও নামটা শোনেনি। দাদু ফিসফিস করে বলল, “খুব বড় লেখক। তুমি বড় হয়ে পড়বে। অনেক মজার মজার গল্পও লিখেছেন উনি। এখন কাজটা করে ফ্যালো চটপট।” বাবা অন্য কাজ করছে দেখেই ঝিলিক সোজা ৩৪৮ নম্বর পাতায় চলে গেল। দাদুর জন্ম ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে। ওই পাতায় ভাঁজ করে রাখা ছিল এক তাড়া কাগজ।

“বাবা, এটা কী?”

হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজগুলোকে বাবা ভুরু কুঁচকে দেখল।

“হবে পুরনো কিছু। এখন আর কোন কাজে লাগবে? পাশে রেখে দে। ফেলে দেব পরে।”

ঝিলিক ভাঁজ খুলে দেখে বলল, “কোথায় পুরনো? তোমার নাম লেখা তো।”

বাবাকে হাতে নিয়ে দেখতেই হল।

“আরে! এ তো এল আই সি পলিসি! আমার নামে! এটা কবে করল বাবা? এত বছর আগে! কবেকার কথা! তখন আমরা শ্যামনগরে থাকতাম। মাধ্যমিক পাশ করার আগেই এই বাড়ি হয়ে গেল, আমরা চলে এলাম… সুধা! সুধা! চল চল, নিচে চল।”

মাকে ডাকতে ডাকতে বাবা তাড়িয়ে ঝিলিককে নিচে নিয়ে এল।

“কী হল? ওভাবে চেঁচাচ্ছ কেন? বুকটা ধড়াস করে উঠল,” মা বলল।

“আরে সুধা, দ্যাখো কী কাণ্ড! ভাগ্যিস তোমার মেয়ে আজ ওই ঘরটা খোলার বায়না ধরেছিল! এই দ্যাখো কী পেয়েছি। আমরা যখন শ্যামনগরে থাকতাম তখন বাবা আমার নামে এল আই সি করেছিল, আমি জানতাম না! আসলে বাবা তো হঠাৎ মারা গেল, তাই হয়তো…”

 

দাদুর সঙ্গে প্রতীক

 

“কত টাকা পাবে গো?”

“দু-লক্ষ দু-হাজার চুয়ান্ন টাকা। কম নয়, বলো?”

“কী বলছ? অতগুলো টাকা চট করে পাওয়া যায়? কিন্তু ম্যাচিওর করছে কবে?”

“আরে সেটাই তো আসল কথা। গত মাসেই ম্যাচিওর করেছে দেখছি। কী আশ্চর্য ব্যাপার!”

“ভগবানের অশেষ দয়া,” মা কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল। “নইলে এই সময় এই টাকাটা পাওয়া গেল? হ্যাঁ গো, তোমার অফিস থেকে কত টাকা দেবে?”

“কম নয়। সব মিলিয়ে লাখ আষ্টেক পাওয়া উচিত।”

এমন সময় ঝিলিক বলল, “বাবা, তুমি যে সেই একটা বড় ক্যামেরা কিনবে বলেছিলে? অনেক ছবি তুলবে, বিদেশে পাঠাবে। এই টাকা দিয়ে সেই ক্যামেরা হবে না?”

“ঠিকই তো। তুমি এই এল আই সি-র টাকাটা দিয়ে সেই ক্যামেরাই কেনো। তোমার আর রোজগারের চিন্তা থাকবে না। হয়ে যাবে না ওর মধ্যে?”

বাবা মনমরা হয়ে বলল, “হয়ে তো যাবে, কিন্তু আর কি আমি পারব?”

“কেন পারবে না? এ আবার কেউ ভোলে নাকি? তাছাড়া তুমি তো একেবারে ছেড়ে দাওনি কখনও। কেবল এদিক ওদিক পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছ।”

“বাবা, তুমি সেই যে আমার ছবিটা তুলেছিলে, ওটা প্রাইজ পেয়েছিল না?”

“হ্যাঁ মা, ওটাই লাস্ট পাঠিয়েছিলাম। আমার তোলা বেস্ট ছবিগুলোর একটা।”

“তাহলে তুমি আবার পারবে বাবা। দাদু সেই যে একটা গান করত তুমি বলো?”

“কোনটা?”

দাদু ঝিলিকের কানে কানে বলে দিল, “স্বপ্ন দেখার সাহস করো।”

“বাবা, মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে গো, সুধা?” বলে বাবা ঝিলিককে কোলে তুলে নিল।

মা হেসে বলল “তাহলে ওই কথাই রইল, তুমি অনলাইনে কিনে ফ্যালো ক্যামেরাটা। একদিকে ভালোই হয়েছে তোমার চাকরি গিয়ে। সারাজীবন কেবল ডাক্তারদের দোরে দোরে ঘুরে বেড়াতে, তোমার প্রতিভা কেবল ফেসবুকের বন্ধুরা দেখত। এবার আদাজল খেয়ে লেগে পড়ো ফটোগ্রাফি নিয়ে, সংসারটা ভেসে যাবে না। আমি তো রয়েছি। তুমি উলটোপালটা না ভাবলেই হল।”

 

 

সোমবার বাবা-মা অফিসে গেল, ঝিলিক স্কুলে। ফিরে আসার পর দাদুর কোলে মাথা রেখে ঘুমোবার সময় দাদু বলল, “আজকে আমি অ্যালবামে ফিরে যাব কিন্তু।”

“আর আমার কাছে আসবে না?”

“সবসময় তোমার সাথেই তো থাকব।”

“এই যে বললে চলে যাবে?”

“এ তেমন যাওয়া নয়। আমি তোমার বুকের ভিতরেই থাকব সবসময়।”

“কিন্তু তোমায় দেখতে পাব না তো,” ঝিলিক ফোঁপাতে শুরু করেছে ততক্ষণে।

“না দেখলেও আমার কথা বুঝতে পারবে ঠিক। তুমি যে এ ক-দিনে অনেক বড় হয়ে গেলে, দিদি।”

“না, আমি বড় হইনি। আমি বড় হতে চাই না।”

“তা কেন? তুমি আরও বড় হবে, অনেক বড় হবে। আমি অ্যালবাম থেকে দেখব আর আমার ভূত-বন্ধুদের বলব ‘দেখেছ? ওই আমার নাতনি।’”

“না আমি বড় হইনি। কে বলল আমি বড় হয়েছি? মিথ্যে কথা।”

“যদি মিথ্যে কথাই হবে, তাহলে বাবাকে ক্যামেরা কেনার বুদ্ধিটা দিলে কী করে? টাকাটা নয় আমি জমিয়েছিলাম অনেকদিন আগে, সে টাকা দিয়ে কী করা যায় তা তো আমি ভেবে পাইনি।”

দাদু আর থাকবে না বুঝে হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে ঝিলিক ঘুমিয়ে পড়ল। মা অফিস থেকে ফিরে আদর করে ঘুম থেকে তুলল।

“এ কী রে! সোমার বিয়ের অ্যালবামটা এখানে এল কী করে? তুই নামিয়েছিস? নিজে নিজে আলমারি খুলতে পারলি? সত্যি কত বড় হয়ে গেছিস মা!”

 

ছবি — সুমিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published.