মহীশুরের রাজবংশীয় শিল্পী রবিবর্মার ছবিতে আছে, পালোয়ান রাবণ জটায়ুর পাখা কাটছে, সীতা মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে। বাচ্চাকে জিগ্যেস করলাম, “তুই হলে কী করতিস?”
বলল, “আগুন লাগিয়ে দিতুম!”
“কিন্তু সীতার গায়েও যে আগুন লাগত?”
“বাঁচিয়ে করতুম!”
নতুন সীতা কী করবে?
মিথিলার রাজবাড়ির ব্যায়ামশালায় বজ্রমুষ্টি আসন প্রাণায়াম, যুযুৎসু, ক্যারাটে আগে থেকেই ওব্বেস করে এসেছে চার বোনে। অযোধ্যার রাজবাড়ির ব্যায়ামশালায় আরও বিশারদ হয়েছে। মায়েরা-মেয়েরা তো ওদের আসন দেখে অবাক। প্রায় সবাই আসব-আসব করছে। একসঙ্গে এলে তো চলে না, তাই বারা-ফিরতি অর্থাৎ পালা-বদল করবে। নাচতে নাচতে ময়ূরাসন, ঊর্মিলা দারুণ করে এটা। ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে একবার উঠে একবার নেমে তিন বোনে একসঙ্গে সমুদ্রাসন, মোদ্দিখানে সীতা দাঁড়িয়ে উঠে নত হয়ে সূর্যপ্রণাম আসন। স্বামী রামদাস করতেন হাজারবার দিনে। ঠিক নমাজের স্টাইলে। নমাজ মানে জানো? বৈদিক ‘নমস্’ থেকে উত্তর-পশ্চিম ভারতের মাটির উচ্চারণে নমাজ। দেব নমস্কার। ওইয্যা আগে পরে একাকার হয়ে গেল। যাগ্গে বলেই তো নেমেছি।
কৌশল্যার রান্নাবাড়িতে কাশী-কোশলের তিন-চারটে পদ লাড্ডু এবং নমকিন রান্না করে দশরথ-রাম-লক্ষণ-ভরত-শত্রুঘ্ন সবার মন কেড়েছে। কেকয়ের রাজকন্যা কৈকেয়ী অসাধারণ সুন্দরী ও অদ্ভুত নার্স। ওঁর কাছে সেবা শিখেছে সুভদ্রাকে হার মানানো। যত রকমের ব্যান্ডেজ, গিট, ওষুধ, মালিশ, পুলটিস সেঁক, মাসাজ সব। মন্থরার মাথা ধরলে, প্রায়ই ধরে, এমন মাথা টিপে দেয় যে ঘুম এসে যায়। মন্থরা ঘড়র-ঘাই ঘড়র-ঘাই নাক ডাকায়।
অযোধ্যার আরোগ্যনিকেতনে মাঝে মাঝে ডাক পড়ে রাজবধূ সীতার। রোগ যদিও প্রায় নেই বললেই চলে, তবু অভিমান, বন্ধুতে-বন্ধুতে আড়ি-ভাব-মানভঞ্জন, ফলে মাথা-ধরা, পায়ে-ধরা এসব সামলাতে ও ছাড়া আর কে?
কাজেই মুহূর্তের ভুলে রাম-সীতা-লক্ষ্মণের বনবাস যদি হয়েও থাকে, মন্থরাই কৈকেয়ীকে বলে-কয়ে হাতে-পায়ে ধরে ওদের ফেরত আনার জন্যে পীড়াপীড়ি করেছে। কৈকেয়ী বলেছেন, “ও কী করে, এত তাড়াতাড়ি? একটু সবুর কর, নইলে প্রজাদের কাছে মানের দফা গয়া যাবে যে।” দশরথ কাঁদতে-কাঁদতে হাসতে-হাসতে বলছেন, “সোত্তি, তুমি না—”
বাচ্চা বলল, “তার মানে অন্ধ-মুনির শাপ ফলল না। অন্ধ বাপ-মায়ের অন্ধের নড়ি একমাত্র ছেলেটি মারা গেল, কিন্তু দশরথ দিব্বি ড্যাংড্যাং ড্যাংড্যাং করে বেঁচে রইলেন। তা হবে না দিদা, ছেলেটিকে বাঁচিয়ে দাও। আমি ওর সঙ্গে খেলব।”
“আচ্ছা রে আচ্ছা। তক্ষুনি দশরথ তিরবেগী হাওয়ায় ছোটে এমন ঘোড়া এক-পল্টন পাঠালেন। অযোধ্যা থেকে শল্যবিদ, ডাক্তার, সহকারী-ডাক্তার, অচেতক মানে অ্যানাসথেটিস্ট, কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড, ওষুধ, তাঁবু, ছুরি-কাঁচি, সরঞ্জাম সব চলে এল।” দশরথ বললেন, “যত রক্ত লাগে আমিই দেব।”
ডাক্তার মনে মনে বললেন, এই রে! তার মানে রাজাকে বাঁচাতে আর এক দঙ্গল লোক লাগবে। প্রকাশ্যে বললেন, “আপনার থেকে তো নেবই, অতিরিক্ত কয়েক বোতল আনিয়ে নিয়েছি। কাজ শুরু করে দিই তাহলে?” সবার সারারাতের প্রাণপণ পরিশ্রমে ছেলেটি বাঁচল।
“তারপর শোনো রিকাইয়া। রাক্ষস পালামি প্রায় সম্পূর্ণ লোপাট করে মারীচের মায়ামৃগ ছদ্মবেশ ধারণের অদ্ভুত কৌশলে রাম-লক্ষ্মণ একটু দূরে যাওয়ার পরই, ‘ভিক্ষাং দেহি’ বলে রাবণ তো হাঁক পেড়েছে। ছদ্মবেশে মাঝখান থেকে রাবণের লোভী চোখদুটো সীতা ধরে ফেলেছিল ফলে, যেন লক্ষ্মণের গণ্ডি পেরোচ্ছে ছল করে এক লম্বা লাফ দিয়েই রাবণকে চিৎপটাং করে ফেলে জটায়ু-কাকার মিনি-মোবাইলে ‘বিপদ’ শব্দটি উচ্চারণ করা মাত্রই তাঁর প্রচণ্ড আজানুলম্বিত হাত-ডানার ঝাপটে নাক-চঞ্চু দিয়ে ওই চোখ খুবলোতে-খুবলোতেই রাম-লক্ষ্মণ এসে হাজির। এবং মারীচও রামের গলা নকল করতে করতে – নকল করার ওব্বেস কি সহজে যায়? রামের চেহারাটা ভালো করে দেখে, ভোলাতে ব্যস্ত ছিল তো, এখন নিজেই মুগ্ধ-মোহিত-সম্মোহিত হয়ে, ভুলে রাবণকেই ভ্যাংচাতে-ভ্যাংচাতে এসে হাজির হল, ওই রবি গায়েনের ‘মায়াবনবিহারিনী হরিণী’ গানটা হরিণী ছন্দে-মুদ্রায় নাচতে-নাচতে লাফাতে-লাফাতে। তারপর একবার চিৎপটাং হয়ে হাত-পা ছোঁড়া রাবণকে, একবার সীতাকে সোনার ছালটা দেখাতে দেখাতে বলল, এইতেই ভুললে? রাক্ষস-স্বভাব তো যায় না মলে! তাই ‘ন’ যোগ করল না। এমনকী এইতেই ভুললি? এও বলতে পারে! হায় হায় সবই যে চুরি বা ধার! সমুদ্র থেকে মুক্তো-প্রবাল, কোকিলের চোখ থেকে চুনি, পণ্ডিচেরীর বাসবজিতের খামারে তৈরি ঘাস থেকে সবুজ পান্না, নিমডির ভেলভেট পোকাদের হাতে-পায়ে ধরে টুকুটুকে লাল রক্তমুখী নীলা।”
বাবু হয়ে ধৈর্য ধরে শুনতে শুনতে রিকাইয়া বলল, “তার মানে রামায়ণ হচ্ছে না? সব গল্প মাঠে মারা যাচ্ছে! তুমিও তো দেখছি ওই মায়া-মৃগটার পাল্লায় পড়ে—”
“না রে বাপু, না। দেখ না কদ্দূর যায় গপ্পোটা।”
“ওই খুবলোনো-চোখ সীতার জড়িবুটিতে আর শুশ্রূষায় ভালো হল, রাম-লক্ষ্মণ হাত লাগালেন। পঞ্চবটীতেই আর একটা বড় কুটির বাঁধা হল – একেবারে পেল্লায় চৌকি, পাল্লা দেওয়া। জটায়ু রইলেন পাহারায়। যাতে না পালায়।”
“এদিকে রাবণ? সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় জর্জর লঙ্কেশ্বর? জনস্থান-মধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরির তলায় গদগদ নদী গোদাবরীর অকৃত্রিম বনস্থলীতে সুরম্য তপোবন পঞ্চবটীর খোলা হাওয়ায় তিনদিন মর্নিং ওয়াক করতে করতে যেন অন্য মানুষ। নটা মুন্ডু সদ্যগাঁথা দেওয়ালের আড়ালে কুলুঙ্গিতে লুকিয়ে ফেলে, আসল মুন্ডুটা সলজ্জভাবে বের করে, প্রাতরাশের মৃত্তিকাবেদিতে বসে মধু-কলা-দুধ আর বাসি হরিণ-মাংস খেতে খেতে বলল, ‘রামভাই, যদি অনুমতি করেন তো, আপনাদের অযোধ্যা রওনা হওয়ার আগে একটু লঙ্কা ঘুরিয়ে আনি। ভেবেছিলুম কী অপূর্ব জিনিসই না বানিয়েছি। কিন্তু কৃত্রিম শোক-ভোলানো অশোককানন কি আপনাদের ভালো লাগবে?’
‘কেন লাগবে না?’ রাম বললেন, ‘প্রায় চোদ্দো বছর অকৃত্রিমের পর কৃত্রিমই তো ভালো লাগবে। শুনেছি দেখবার মতো বানিয়েছেন।’
রাবণ রেঙে রুমাল বের করে একাক্কার। সেই অবসরে রাম চুপিচুপি সীতাকে বললেন, ‘টানা-হ্যাঁচড়া করে নিয়ে গেলে সেখানেই তো তোমায় রাখত রাবণ, কী বলো?’
রাম সীতা চোখাচোখি হাসলেন।
পুষ্পক রেডি। র্যাডার চালিত নয়, স্বয়ংক্রিয় এরোপ্লেন। নাতিশীতোষ্ণ সর্বোর্তুক, মানে সব ঋতুর উপযোগী। এয়ারকন্ডিশনড। কর্তা ইচ্ছায় চালিত। এক্ষেত্রে কর্তা রাম। রাবণ পাইলট। জটায়ুও চড়লেন। হ্যাঁ সোত্তি। দেখবার মতো। জোবা-লায়েক। চিরবসন্ত। বনস্পতি, ফুল-লতা-পাতা-অর্কিড জলটুঙ্গি-ঘর-সেতু। কোনওটা রাজস্থানি কায়দায়, কোনওটা জাপানি কায়দায় তৈরি। রাজমালী সুমালীর নির্দেশে।”
“দিদা হনুমান?”
“অ্যাঁ! সীতা-হরণই হল না, হনুমান কোত্থেকে পাব?”
“না দিদা হনুমান চাই, সেতুবন্ধও চাই।”
দিদার মনে পড়ল, উদয়শংকর বহুকাল আগে একবার গড়ের মাঠে ছায়া-নাটক দেখিয়েছিলেন। সে কী লাফ! খোলা মাঠে সমস্ত পর্দা জুড়ে। এখনও দক্ষিণ-এশিয়া জুড়ে দলং মানে অধিকারীরা ওই ছায়া-নাটক করে রামায়ণযাত্রা দেখায় আবালবৃদ্ধবনিতাকে। সেখান থেকেই শেখা। সোত্তি। হনুমান বাদ দিলে আর রামায়ণ কী? মহাবীর রামের উপযুক্ত, দক্ষিণের মহাবীর পুরুষ।
দুনিয়ার সেরা। ভারোত্তোলনে, লংজাম্পে, পোলভল্টে। সাঁতারে বুলা চৌধুরীকে হার-মানানো। আর সেই সঙ্গে দুর্জনের ঘরে আগুন লাগাতে অ-পিছপা। বজরঙ্গ বলী। যেমন দেহে তেমনই মনে বলবান সাহসী। তাহলে আবার পিছু হাঁটতে বলছিস?
সেই যে রাম ক্রুদ্ধ হয়ে সমুদ্রকে ধনুর্বাণ দেখাচ্ছেন, মারেন আর কী—
“ছাড়বিই না? তবে শোন। মহাবীর হনুমান এখনও আছেন। সবল বাহুবলী রামসেনাদের বল জোগাচ্ছেন। দেশদ্রোহী বুদ্ধিজীবী চিমেশ মিত্তিরদের ডক্টরেটে আগুন লাগাচ্ছেন। তাঁর দৌত্যে রামে-সুগ্রীবে উত্তর-দক্ষিণে মিতালিও হয়েছিল, লঙ্কার রাক্ষস-সংস্কৃতি নয়, সুসভ্যতার প্রতীক রাবণকে ধ্বংস করতে। কেননা রাবণ দক্ষিণ ভারতে ক্রমশ বাহু বিস্তার করছিল, উন্নততর সংস্কৃতির বৈদিক ঋষিদের শান্ত-আশ্রম পদ-বিধ্বস্ত করতে। ঠিক যেমন ইঙ্গ-মার্কিন রাজনৈতিকরা এখন যা করছে উন্নততর এশিয়া-আফ্রিকার সংস্কৃতিকে সুচতুর ভাবে বিভ্রান্ত উদ্ভ্রান্ত করতে।”
“এত শক্ত শক্ত কথা বোলো না দিদা! সাগরে সেতু বেঁধে রাম-রাবণের যুদ্ধ হয়েছিল কিনা বলো।”
“চুপ। বললাম, সেতুবন্ধ তো নির্ঘাত হয়েছিল। নইলে এতদিন পরে উপগ্রহবিদ বৈজ্ঞানিকরা ওপর থেকে দেখলেন কী করে ভারত-লঙ্কার মাঝখানে পাথরের বানানো সেতু? আর লোককথাবিদরাই বা মাটির কথা গবেষণা করতে গিয়ে দেখলেন কী করে মহাবীর রামের প্রবল অস্তিত্ব? যাঁর বীর্যবলে, অরণ্য-যুগ পেরিয়ে ক্রমশ খেতে-গ্রামে-নগরে-গৃহে-কুটিরে-প্রাসাদে বেদি, মন্দির বানিয়ে কৃষিজীবী সুখী প্রজারা দক্ষিণের অরণ্যে মাংসাশী আবার বন্যফলমূলভোজী অকৃষিবল প্রজাদের সঙ্গে এক হতে শুরু করল।”
“বা রে। রাবণ কি শুধু মাংস খেত? গানবাজনা-নাচের সমঝদার ছিল না? তুমিই তো দেখিয়েছ মীরা মুখার্জ্জি-দিদার বই- ‘বিশ্বকর্মার সন্ধানে’। তাহলে?”
“কী করব বল। মহাকবি বাল্মীকি যে হাজার হাজার বছর এক করে তাঁর মহা-কল্পনার ভিত আর শোলোক গেঁথেছেন। সময়- বটিকা। তোরা বলিস টাইম-মেশিন। ওঁরা কথা-কাহিনি দিয়েই সব বলে দিয়েছেন। তাই রামায়ণ-মহাভারত আমাদের ইতিহাসও বটে, কাব্যও বটে। বুঝ লোক, যে জান সন্ধান।”
রিকাইয়া মেঝেতে কাটাকুটি খেলতে খেলতে বলল, “আর যুদ্ধ? যুদ্ধ হয়েছিল হল কিনা বলবে তো?”
“হ্যাঁ। যুদ্ধ হল। দক্ষিণের আর লঙ্কার মানুষরা পরস্পর যুদ্ধ করল। অনেকে মারাও গেল। তবে যুদ্ধ কেবল ড্র হতে লাগল। অবশেষে রাম-রাবণে শর্তাধীন সন্ধি হল। তার ফলে সজ্জন ভাই বিভীষণকে লঙ্কারাজ্য ছেড়ে দিয়ে রাবণকে ব্রহ্ম-উপদ্বীপে যেতে হল নির্বাসনে। সেখানেও সে রাজ্য বিছিয়ে বসেছিল। ষষ্ঠ শতাব্দী-র মানচিত্রে দেখবি ব্রহ্মে লঙ্কাসুরের রাজ্য আঁকা। এদিকে হিমালয়েও দেখবি রাবণ-তাল এক তাল-তলাও, তড়াগ, সরোবর। শিবভক্ত রাবণ কৈলাস সমেত শিবকে উঠিয়ে আনতে চেয়েছিল। এলোরার শিল্পীরা উৎকীর্ণ করেছেন সে দৃশ্য। স্তব-কবচমালাতে আছে রাবণের শিবতাণ্ডবস্তোত্র। জটাটবী-গলজ্জল-প্রবাহ-পাবিত-স্থলে। পঞ্চচামর ছন্দে লেখা। একটা হ্রস্ব, একটা দীর্ঘ এই রকম করে অক্ষরগুলো তৈরি। সে তো তুই জানিসই।”
মাঝখানে ছবি আঁকতে শুরু করেছিল রিকাইয়া। গভীর অরণ্য। হরিণ। একটা-দুটো রাক্ষস। দশভুজা দুর্গা। পাখি। ফুল। মৌমাছি। পাহাড়। সমুদ্র।
গল্প শেষ করতে গিয়ে দেখি হাতের মুঠোয় চক। ঘুমিয়ে পড়েছে।
কৃতজ্ঞতা – রোহিণী ধর্মপাল
ছবিঃ সপ্তর্ষি দে
গল্পটি টগবগ উৎসব সংখ্যা ১৪২২-এ প্রকাশিত।
Leave a Reply