কেউ ডাক্তার হলে মানুষের বড়ো উপকার হয়। কেউ যদি ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হয়ে ছেড়ে দেয়? কখনও কখনও এতেও মানুষের উপকার হয়। তোমরা বলবে, এ তো হিংসুটের মতো কথা হল। সত্যি যদি হয় তোমাদের অভিযোগ, শাস্তি মাথা পেতে নেব। আর যদি না হয়?
স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরা। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে এই শহরে তৈরি হয়েছিল এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়। কাজেই এতদিনে যে সমস্ত নামকরা মানুষ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, তার হিসেব দেওয়া সহজ নয়। এঁদের নাম যদি লিখি, তোমাদের একজনেরও অচেনা লাগবে না। এডিনবরার মেডিসিন বিভাগ পৃথিবীর সেরা মেডিসিন বিভাগগুলির একটা। সেখান থেকে ডাক্তারি পাশ করেছেন ডারউইনের দাদু। পাশ করেছেন ডারউইনের বাবা। ডারউইন খানিকটা চাপে পড়ে গেলেন। গিয়ে ভর্তি হলেন ডাক্তারি পড়তে। কিছুদিন যাবার পর বুঝলেন, এ বিদ্যে রপ্ত করা তাঁর কম্মো নয়। ছেড়ে দিলেন ডাক্তারি পড়া। জাহাজে করে সমুদ্র অভিযানের সুযোগ এল। হাড়গোড় ফসিল বস্তার পর বস্তা পুরে জাহাজে তুললেন। হাতে ড্রয়িং বুক। যা দেখছেন, তার ছবি আঁকছেন। তারপর সময় এল নতুন কথা বলবার। বললেনও নতুন কথা। সারা পৃথিবী জুড়ে হইচই পড়ে গেল। ধর্মের জগতে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠল। অপমান লাঞ্ছনা অনেক সইতে হল তাঁকে। আজ আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, যিনি বলেছেন পৃথিবীতে মানুষ কী করে এসেছে, সেই ডারউইন আমাদের প্রাণসখা, আমাদের চিরকালের বন্ধু। তিনি একজন ডাক্তার হলে কি পৃথিবীর এর চেয়ে বেশি উপকার হত?
জগদীশচন্দ্র বসু। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পাশ করে লন্ডনে গেলেন। মনে একবার ইচ্ছা জেগেছিল আই সি এস হবেন। বাবা আপত্তি করলেন। জগদীশচন্দ্র তখন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হলেন। শরীর ভালো যাচ্ছিল না। ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিলেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হলেন। তিনখানা ডিগ্রি পেলেন জগদীশচন্দ্র। কেমব্রিজের ট্রাইপস ডিগ্রি। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বি এস সি ডিগ্রি। কেমব্রিজের এম এ ডিগ্রি। দেশে ফিরে জগদীশচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। বেতার তরঙ্গ গবেষণায় পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীদের তিনি হতবাক করে দিয়েছিলেন। উদ্ভিদের প্রাণ আছে, একথা আমরা অনেককাল ধরেই জেনে এসেছি। জগদীশচন্দ্র একের পর এক পরীক্ষা করে দেখালেন, নানা উত্তেজনায় উদ্ভিদ কেমন করে সাড়া দেয়। বেতার তরঙ্গের প্রথম আবিষ্কর্তা মার্কনি না জগদীশচন্দ্র, বহু বছর বিতর্ক থাকলেও এখন আর বিতর্ক নেই। এই আবিষ্কারের জয়মাল্য যে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের, একথা পৃথিবীর গবেষক মহল মেনে নিয়েছে। জগদীশচন্দ্রের জন্য আমরা যে গর্ব অনভুব করি, তিনি একজন ডাক্তার হলে আমরা কি এর চেয়ে বেশি গর্বিত হতাম?
সুবোধচন্দ্র মহলানবীশ। প্রশান্তচন্দ্র তাঁর ভাইপো। একই বাড়িতে দুজনে মিলে কাণ্ড ঘটিয়ে গিয়েছেন। সুবোধচন্দ্রই প্রথম, আমাদের দেশের কলেজে শারীরবিদ্যা পড়ানো শুরু করেন। প্রশান্তচন্দ্রও কম যান না। জ্যেঠামশাইয়ের মতো তিনিও এই দেশে প্রথম একটি বিষয় পড়াতে শুরু করেন। সেই বিষয়ের নাম তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ। পরিসংখ্যানবিদ্যা। বরানগরের আই এস আই বা ‘ইন্ডিয়ান স্টাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট’ প্রশান্তচন্দ্রের নিজ হাতে গড়া। এমন গৌরব বাংলাদেশের আর কোনও বিজ্ঞান পরিবারের আছে কি?
সুবোধচন্দ্র ছিলেন ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান। বাবা গুরুচরণ মহলানবীশ ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করলেন। ছোটবেলায় তাই সুবোধচন্দ্র ব্রাহ্মদের তৈরি অ্যালবার্ট স্কুল ও সিটি স্কুলে পড়াশোনা করেন। বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র কিছুকাল অ্যালবার্ট স্কুলে পড়েছিলেন, অ্যালবার্ট স্কুল থেকেই তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেছিলেন।
সিটি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন সুবোধচন্দ্র। এই পরীক্ষার মান এখনকার মাধ্যমিক পরীক্ষার মানের সমান। এখন যেমন উচ্চমাধ্যমিক, তখন ছিল ‘ফার্স্ট আর্টস’ বা এফ এ পরীক্ষা। জেনারেল এ্যাসেম্বলি ইনস্টিটিউশন থেকে সুবোধচন্দ্র এফ এ পাশ করেন। তারপর তিনি ডাক্তারি পড়তে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন। ভালো লাগছিল না তাঁর ডাক্তারি পড়তে। পালিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন। পড়াশোনা ছাড়বেন নাকি তাই বলে? কক্ষনও না। চলে গেলেন পড়তে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে বিজ্ঞানী ডারউইনের বাবা ও দাদু ডাক্তার হয়েছেন, কিন্তু ডারউইন ডাক্তার হননি। সুবোধচন্দ্র এডিনবরায় গিয়ে শারীরবিদ্যায় বি এস সি পাশ করেন। ভালো ফল করলেন। এবার তিনি চাইলেন গবেষণায় মন দিতে। এডিনবরার ‘রয়াল কলেজ অফ ফিজিসিয়ানস্’–এর গবেষণাগারে গবেষণার সুযোগ পেলেন। ১৬৮১ খ্রিস্টাব্দে একুশজন মানুষ মিলে এই প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। সব থেকে বেশি সময় দিয়েছিলেন রবার্ট সিবাল্ড (১৬৮১-১৭২২)। তিনি ছিলেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একজন ডাক্তার। এডিনবরা বোটানিক্যাল গার্ডেন যে দুজন মানুষের হাতে তৈরি, রবার্ট তাদের একজন। ভাবতে অবাক লাগে, যিনি ছিলেন একজন ডাক্তার, তিনি সেদেশের ‘জিওগ্রাফার রয়াল’ পদ পেয়েছিলেন। তাঁর সে সময় মনে হয়েছিল, ডাক্তার হয়ে শুধু মানুষের চিকিৎসা করলেই সব কাজ শেষ হয় না। গবেষণা করতে হবে নিয়মিত। অসুখ-বিসুখের জগতে আজও অনেক কিছু অজানা রয়েছে। গবেষণা না করলে সেসব আমরা জানতে পারব না। না জানতে পারলে চিকিৎসার কাজও ভালোভাবে হবে না। একথা ভেবেই রবার্ট তাঁর কুড়িজন বিশিষ্ট বন্ধুকে নিয়ে ‘রয়াল কলেজ অফ ফিজিসিয়ানস্’ গড়ে তুললেন। কত বিষয়ে যে রবার্ট লিখে গিয়েছেন, তা ভাবলে কুল-কিনারা পাওয়া যায় না। তো যাই হোক, শুরু থেকেই এঁরা ভালোভাবে কাজ করতে শুরু করলেন। ১৬৯৯ প্রথম স্কটিশ ফার্মাকোপিয়া ছাপা হল। ফার্মাকোপিয়া কী? ডাক্তারদের পথনির্দেশিকা বলা যায়। ফার্মাকোপিয়া ছাড়া চিকিৎসা জগত এক পা-ও চলতে পারে না। এতকাল আগে সাধারণ মানুষের চিকিৎসার হাল ছিল খুব খারাপ। যাদের হাসপাতালে ভর্তির দরকার নেই, তাদের জন্য একটা ডিসপেনসারি খোলা হল। সেখানে রোগীদের দেখে ওষুধ তৈরি করে দেওয়া হত। পৃথিবীর এতসব গবেষণা কীসের জন্যে? মানুষের জন্যেই তো। তবে ‘গবেষণা’ বললেই তো আর ‘গবেষণা’ শুরু করা যায় না। কিছু কিছু বিষয় হয়তো একটা যন্ত্র ও কিছু কাগজ কলম থাকলে শুরু করে দেওয়া যায়। চিকিৎসাবিদ্যার গবেষণায় জটিলতা বেশি। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ গবেষণাগারের কাজ শুরু হয়েছে। আজ তার ডালপালা বহুদূর ছড়ানো। পৃথিবীর বহু দেশের গবেষক সেখানে গবেষণা করতে যায়। বহু দেশ থেকে নানারকম নমুনা পাঠানো হয় গবেষণাগারে। মানুষের কল্যাণে সেখানে গবেষণা হয়। স্কটল্যান্ড জুড়ে তার বহু শাখা তৈরি হয়েছে। নইলে সামাল দেওয়া যাবে কেমন করে? সোসাইটির যেমন ‘ফেলো’ থাকে, এই কলেজের তেমন ‘ফেলো’ রয়েছে। প্রথমদিক থেকে এমনটাই নিয়ম। শুধু আর একটা খবর তোমাদের দিয়ে আমরা সুবোধচন্দ্রের কথায় ফিরে যাব। রয়াল কলেজের ‘ফেলো’ এখন বারো হাজারের মতো। সারা পৃথিবীর ছিয়াশিটি দেশে এই ফেলোরা রয়েছেন। বিজ্ঞানের যে কোনও সীমানা থাকে না, সে ভাবনা তাঁরা কখনও কাউকে ভুলতে দেননি। সময়ের দিকে তাকালে তোমরা বুঝতে পারবে, রয়াল কলেজের গবেষণাগার যখন সবে কুঁড়ি মেলতে শুরু করেছে, তখনই সেখানে সুবোধচন্দ্র গবেষণা শুরু করেন। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে নাগাদ তিনি গবেষণা শুরু করেছিলেন। ওই গবেষণাগারের বয়স তখন ১৪-১৫ বছর, ওকে কোনও ‘বয়স’ বলে না!
সব মিলিয়ে এডিনবরায় সুবোধচন্দ্র সাত বছর কাটিয়েছেন। নিজে লিখেছেন একসময়, ‘এডিনবরার সাতটি বছর’। এডিনবরায় সুবোধচন্দ্র স্যামন মাছের উপর গবেষণা করেন। মাছের গঠন, দেহের কথায় কী রকমের কোষকলা রয়েছে, এই নিয়ে তাঁর সে সময়ের গবেষণা খুবই প্রশংসা লাভ করেছিল। তাঁর কাজ যে খুব উঁচুমানের ছিল, তার বড়ো প্রমাণ, ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে সুবোধচন্দ্র এডিনবরা রয়াল সোসাইটির ফেলো মনোনীত হন। একটা কথা তোমাদের জানানো হয়নি। বাবা গুরুচরণ মহলানবীশের অবস্থা খুব সচ্ছল ছিল না। ছেলেকে বিদেশে সামান্য টাকা পাঠাতেন। সুবোধচন্দ্র ছোটোখাটো নানা কাজ করে বাকি খরচের পয়সা তুলে নিতেন। ছাত্র পড়াতেন। ছবি তুলতেন। এইসব।
১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়েছিল ‘রয়াল সোসাইটি অফ এডিনবরা’। বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস সব শাখার মানুষ এই সোসাইটিতে ফেলো মনোনীত হতেন। রয়াল মাইক্রোস্কোপিক সোসাইটি লন্ডন শহরে তৈরি হয়েছিল ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে। গোড়ায় কোনও পেশাদার এই সোসাইটির সদস্য ছিলেন না। সতেরোজন মিলে সোসাইটি গড়ে তুলেছিলেন। অ্যান্টিসেপটিক সার্জারির জনক যোসেফ লিস্টারের বাবা যোসেফ জেকসন লিস্টার ছিলেন ওই সতেরোজনের একজন। আমরা বলতে ছাইছি একটাই কথা। ইউরোপের এগিয়ে থাকা বিজ্ঞানীরা যে সোসাইটিগুলি সেদিন তৈরি করেছিলেন, তিরিশ বছর পেরোনো সুবোধচন্দ্রের গবেষক হিসেবে সেখানে সমাদর ছিল। সুবোধচন্দ্র এরপর চাকরি খুঁজছিলেন। পড়ানোর চাকরি। গবেষণার চাকরি। ওয়েল্স-এর কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়। যাঁরা প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির সুপারিশ করেছিলেন, তাঁরা গোড়া থেকে বলেছিলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতন্ত্র পড়ানো চলবে না। মেয়েদের ভর্তি করতে হবে। ধর্মের ভিত্তিতে কারও ভর্তি বারণ করা চলবে না। আমরা তো সকলে তাই চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা মুক্ত ও উদার না হলে আমরা তাকে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ বলব কেন? প্রথম দিকের কয়েকটি বছর কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছাত্ররা পরীক্ষা দিত। কার্ডিফের কথা বলতে আরও ভালো লাগছে এই জন্যে যে, গ্রেট ব্রিটেনের প্রথম মহিলা অধ্যাপক মিলিসেন্ট ম্যাকাঞ্চি কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। ব্রিটেনের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সেনেটে প্রথম মহিলা সদস্য তিনিই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদিও শারীরবিদ্যা আগে আলাদা কোনও বিভাগ ছিল না, ‘জীববিদ্যা’ বিভাগ ছিল, সেই বিভাগে শারীরবিদ্যা পড়ানো হত। সুবোধচন্দ্র দরখাস্ত করেন। ইন্টারভিউ দিয়ে তিনি পড়ানোর চাকরিটা পেয়েও যান। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয় অধ্যাপক। তিন বছর পড়ালেন। তিনি গোটা দুই-তিন ছোটোখাটো যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিলেন। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফিরে এলেন। কলকাতায় শারীরবিদ্যা পড়াবেন কোথায়? কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পড়ানো হয়, তা তিনি জানেন। সে পড়ানো তো ডাক্তারিতে যেমনটা লাগে, তেমন। তিনি চাইছেন বিষয়ের আরও গভীরে যেতে। চাইছেন শুধু এই বিষয়েরই ছাত্র ও গবেষক তৈরি করবেন। তার সুযোগ তিনি পেয়ে গেলেন। কীভাবে পেলেন, সেকথাই বলছি।
স্যার জন উডবার্ন তখন বাংলার গভর্নর। ব্যারাকপুরে জন্মেছিলেন তিনি। ব্রিটিশ ভারত তাঁর জন্মভূমি। আর্য এ্যাকাডেমিতে ছোটবেলায় পড়েছেন। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে উডবার্ন সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়ে ভারতে ফিরে এলেন। বহু উঁচুপদে কাজ করেছেন। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার গভর্নর হলেন। তাঁর কাছে গিয়ে আবেদন করেন সুবোধচন্দ্র। প্রেসিডেন্সি কলেজে শারীরবিদ্যা পড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হোক। কথাটা মনে ধরেছিল গভর্নরের। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে শারীরবিদ্যা বিভাগ খোলার অনুমতি পেলেন। ইম্পিরিয়াল এডুকেশন সার্ভিসে চাকুরি পেলেন না। প্রভেনসিয়াল এডুকেশন সার্ভিসে চাকুরি পেলেন। সরকারি ফাইলের বিচারে প্রথমটি বেশি মর্যাদার, পরেরটি খানিকটা কম। অবশ্য ও দিয়ে মাস্টারমশাইদের সম্মান পরিমাপ করা যায় না। শারীরবিদ্যা পড়ানো হত যেমন, উদ্ভিদবিদ্যাও পড়ানো হত। তখন এফ এ ক্লাস ছিল। বি এ ক্লাস ছিল। বি এস সি ক্লাস চালু হয়নি। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এফ এ পরীক্ষায় শারীরবিদ্যার সিলেবাস তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিল। মহা উৎসাহ নিয়ে তিনি তা তৈরি করে দিয়েছিলেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে সুবোধচন্দ্র শারীরবিদ্যায় অনার্স পড়ানো শুরু করে দিলেন। প্রথম তিন বছর শিক্ষক বলতে তিনি একা। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য নামে একজন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র শারীরবিদ্যায় অনার্স নিয়ে পাশ করেছিল। তিনি ওই বিভাগে অধ্যাপনার কাজ পেয়ে গেলেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের ডিগ্রি শুরু হল। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে বিভাগে এম এস সি পড়ানো শুরু করেন সুবোধচন্দ্র।
১৯১২ খ্রিস্টাব্দে বেকার ল্যাবরেটরি তৈরি হল। শারীরবিদ্যা বিভাগ চলে এল নতুন জায়গায়। কার্ডিফকে ভুলবেন কেমন করে সুবোধচন্দ্র? কার্ডিফে শারীরবিদ্যা বিভাগের যেমন আদল ছিল, সেই আদলে নতুন জায়গায় বিভাগ গড়লেন। তারপরের ইতিহাস তো এগিয়ে চলার ইতিহাস। হাতে কলমে কাজ না করলে বিজ্ঞানী হওয়া যায় না। নতুন নতুন বিষয়ে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস শুরু করেন তিনি। ছাত্রদের শিখিয়ে দিলেন, রক্তে কতটা ক্যালসিয়াম আছে কেমন করে জানতে হয়, প্রোটিনের নাইট্রোজেন ছাড়া আর কতটা নাইট্রোজেন আছে কেমন করে বের করতে হয়, রক্তে ইউরিয়া ও গ্লুকোজের পরিমাণ কেমন করে জানতে হয় এইসব। তাঁর ছাত্রেরা নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। রসায়নবিদ্যার বেলায় যে ভূমিকা পালন করেছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, শারীরবিদ্যার বেলায় একই ভূমিকা দেখা গিয়েছে সুবোধচন্দ্রের বেলায়।
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সুবোধচন্দ্র ষাট বছরে পা দেন। সরকারি কলেজ থেকে অবসর নিতে হবে। পঞ্চাশ বছর বয়সে অবসর নিয়ে প্রফুল্লচন্দ্র এসেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সুবোধচন্দ্র ষাট বছর বয়সে অবসর নিয়ে কারমাইকেল কলেজের (আর জি কর কলেজ) শারীরবিদ্যা বিভাগে প্রধান অধ্যাপক পদে যোগ দেন। পঁচাত্তর বছর পর্যন্ত কাজ করেছেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর কোথায় তাঁর? ব্রাহ্মসমাজের তৈরি সিটি কলেজের আহ্বান উপেক্ষা করতে পারেননি তিনি। সেখানে যতদিন শরীর দিয়েছে, পড়িয়েছেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে যখন তিনি মধ্যগগনে, প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস ও গবেষণার জন্য পুরো বিভাগের বরাদ্দ ছিল মাত্র আঠারোশ পঞ্চাশ টাকা। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তৈরি করেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি’। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে তেমনই তৈরি হল ‘দি ফিজিওলজিক্যাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’। দিনটি আমাদের মনে পড়ে। ১৩ জুলাই ১৯৩৪। কারা ছিলেন সব সেই সোসাইটি গড়বার প্রথম দিনে? স্যার নীলরতন সরকার, স্যার কেদারনাথ দাস, স্যার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর মতো লব্ধ প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসকরা। সুবোধচন্দ্র মহলানবীশ, নরেন্দ্রমোহন বসু, বিজলী বিহারী সরকারও ছিলেন। ভারতে জীবরসায়নের প্রতিষ্ঠাতা বীরেনচন্দ্র গুহ ছিলেন। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন সুবোধচন্দ্র মহলানবীশ।
এখন শারীরবিদ্যা আর আগের জায়গায় নেই। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরবিদ্যা বিভাগ শুরু হয়। এখন আর শুধু শারীরবিদ্যা নাম নেই। ‘মানবশারীরবিদ্যা’ বিভাগ হিসাবে তার নতুন পরিচয়। বিজ্ঞানের নানা শাখার সম্মিলন ঘটেছে এই বিদ্যায়। যিনি কলকাতায় এই বিষয়ে প্রথম ভিত গেঁথেছিলেন, সেই সুবোধচন্দ্র বেঁচে থাকলে দেড়শ বছর পূরণ করবেন। দেড়শতম বছরে তাঁকে আমাদের প্রণতি জানাই। তাঁর মতো নতুন কিছুর সন্ধানে পরিশ্রমী হবার শপথ নিই।
এবার তোমাদের বলার পালা। তোমরাই বলো, সুবোধচন্দ্র যদি ডাক্তার হতেন, আমরা কি বেশি গর্বিত হতাম? তবে সবশেষে একটা বিষয় তোমাদের বলে দিই। যাদের ডাক্তার হতে ইচ্ছে করবে, তারা কিন্তু ডাক্তারি পড়বে। আমি কি বলতে চেয়েছি, নিশ্চয়ই তোমরা বুঝতে পেরেছ। ভালোলাগার বিষয় ছেড়ে অন্য বিষয় পড়বার কথা ভাববে না।
Leave a Reply