রবিঠাকুরকে ভারী ভারী কথা তো তোমরা সবাই জানো। যত বড় হবে আরও পড়বে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রশান্তকুমার পালেরা তাঁর দারুণ দারুণ সব জীবনী লিখেছেন। এখন এই ঘরবন্দি সময়ে বরং তাঁকে নিয়ে মজার কিছু ঘটনা বলি। মন ভালো করা। এসব গল্পও সেকালের মানুষরা তাঁদের ডাইরি, খেরোর খাতা, বইতে লিখে গেছেন। ভাগ্যিস লিখেছিলেন বল! নইলে আমরা জানতাম কী করে?
লীলা মজুমদার তাঁর খেরোর খাতায় দারুণ মজার একটা গল্প লিখেছেন। রবিঠাকুরের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশ বোস। তখন দুজনেরই বয়স হয়েছে, একটু ভুলো হয়েছেন দুজনেই। একদিন গুরুদেব তাঁর বৌমা প্রতিমা দেবীকে বললেন “কাল কিন্তু আমার জন্য রান্না কোরো না। জগদীশের বাড়ি আমার নেমতন্ন।” পরদিন যথাসময়ে সেজেগুজে জগদীশ বসুর বাড়ি হাজির। সবাই তো তাঁকে দেখে আহ্লাদে আটখানা। বসার ঘরে চলল খোশগল্প। কিন্তু গুরুদেব দেখলেন সময় বয়ে যায়, কেউ খাওয়ার কথা উচ্চারণ অবধি করে না। তাঁর সন্দেহ হল জগদীশ নেমতন্নের ব্যাপারটা ভুলেই গেছেন। অগত্যা খানিক বাদে উঠে পড়লেন। জগদীশ বসু সিঁড়ি অবধি বিদায় দিতে এসে হঠাৎ তাঁর কিছু একটা মনে পড়ল। ঝুঁকে পড়ে বললেন “শোনো, কাল দুপুরে তুমি আমার এখানে খাবে, মনে আছে তো?”
রবীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, “এই দ্যাখো, আমারও ভুলো মন। কাল একটা জরুরি কাজ এসে গেছে। আসতে পারব না। সেটা বলতেই এসেছিলাম।” পরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সঙ্গীকে বললেন, “দেখলে তো, কেমন কাটিয়ে দিলাম। বেচারা বিলকুল ভুলে গেছে।” কে যে ভুলে গেছে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে অবশ্য!
তবে নিদারুণ প্র্যাকটিক্যাল জোক করতেও রবিঠাকুরের জুড়ি ছিল না। কয়েকটা গল্প বলি।
মরিস সাহেব শান্তিনিকেতনে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা পড়াতেন। একদিন তিনি তাঁর ছাত্র প্রমথনাথ বিশীকে বললেন, “গুরুদেব সুগার বা চিনি বিষয়ে একটা গান লিখেছেন। গানটা খুবই মিষ্টি হয়েছে।” প্রমথনাথ বিশী বললেন, “সুগার নিয়ে লিখলে তো মিষ্টি হবেই। গানটা কী রকম একটু গেয়ে শোনান তো!” মরিস গাইতে লাগলেন, “আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী…” প্রমথনাথ বিশী হেসে ফেললেন, “গানটাতে বেশ ক-চামচ চিনি দিয়েছেন গুরুদেব। তাই একটু বেশি মিষ্টি হয়েছে। তবে এই চিনি যে সুগার সেটা আপনাকে কে বলল?” “কে আবার। স্বয়ং গুরুদেব আমাকে বলেছেন, মরিস শোনো, আমি সুগার নিয়ে একটা গান লিখেছি।” এরপর আর কী-ই বা বলার থাকতে পারে।
ঠিক এমনটাই তিনি করেছিলেন আচার্য যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সঙ্গে। কবির সেবার পঞ্চাশ বছর হল। শান্তিনিকেতনে এক ঘরে সভা বসেছিল। সিঁড়ি দিয়ে ওঠামাত্র যতীন্দ্রমোহন পষ্ট শুনতে পেলেন গুরুদেব গাইছেন, “এখনো তারে চোখে দেখিনি, শুধু কাশি শুনেছি।” তিনি তো অবাক! গুরুদেব নিজেই নিজের গান ভুল গাইছেন! বাঁশিকে কাশি বলছেন! ভয়ে ভয়ে সভায় থাকা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার হে?” সত্যেন দত্ত মুখ টিপে হেসে বললেন, “ও গান তোমার জন্য গাওয়া। সিঁড়িতে তোমার কাশির শব্দ শুনেই গুরুদেব তোমাকে চিনেছেন।”
তবে এই প্র্যাকটিক্যাল জোকের ঠেলা প্রমথনাথ বিশীকে যেভাবে ভোগ করতে হয়েছে তেমন বোধ করি আর কারও বেলায় হয়নি। একদিন সকালবেলায় রবীন্দ্রনাথ জলখাবার খেতে বসেছেন। প্রমথনাথ এসে তার পাশে বসলেন। উদ্দেশ্য, গুরুদেবের খাবারে ভাগ বসানো। ফল, লুচি, মিষ্টি সবকিছুরই ভাগ পেলেন তিনি। কিন্তু তাঁর নজর একগ্লাস সোনালি রঙের সরবতের দিকে যেটা তাকে দেওয়া হয়নি। গুরুদেব তাঁর ভাব লক্ষ করে বললেন, “কী হে এই সরবত চলবে নাকি?” প্রমথ তাতে খুব রাজি। অমনি গুরুদেব বড় এক গ্লাসে সেই সরবত প্রমথকে দেওয়ার আদেশ দিলেন। বড় গ্লাস ভর্তি হয়ে সেই সোনালি সরবত এল। প্রমথনাথ এক চুমুক খেয়েই বুঝলেন সেটা চিরতার সরবত। না পারছেন সেই অত্যধিক তেতো সরবত গিলতে, আবার চেয়ে আনা সরবত… ফেলতেও পারছেন না। এদিকে গুরুদেব তাঁর মুখের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছেন। ভাবখানা এমন– “কেমন জব্দ!”
মাঝে মাঝে গুরুদেবের দোসরও জুটত তেমনই। তাঁরা আরও এককাঠি সরেস। এঁদেরই একজন কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলের মাথাভরা ঝাঁকড়া চুল, এদিকে দাড়িগোঁফ কামানো। এক ঘরোয়া আসরে রবিঠাকুর তাই হেসে বললেন, “কাজী নজরুল, করিয়াছে ভুল, দাড়ি না রাখিয়া রাখিয়াছে চুল।” কিন্তু নজরুল কি চুপ করে থাকার মানুষ? হাজির জবাবে তিনিও দক্ষ। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, “মুখভরা জঙ্গল, না রাখাই মঙ্গল।”
তবে নিজের এই লম্বা সাদা দাড়ি নিয়ে নিজেও মশকরা করতেন তিনি। সেবার জোড়াসাঁকোর জলসায় বিখ্যাত গাইয়ে গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছেন গাইতে। তাঁর গান শেষে সবাই রবিঠাকুরকে চেপে ধরলে। তাঁকেও গাইতে হবে, নইলে ছাড়া যাবে না। বিব্রত রবিঠাকুর আর না পেরে বললেন, “কেন বাপু? গোপেশ্বরের পরে কি এবার দাড়িশ্বরের পালা?”
হাজির জবাবে জুড়ি ছিল না রবিঠাকুরেরও। এক সাহিত্য সভায় রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত ছিলেন। সেই সভায় সাহিত্যিক বনফুল অর্থাৎ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ও উপস্থিত ছিলেন। সেই সাহিত্য আসরে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় একটি অসম্ভব ভালো বক্তৃতা দিলেন। সভায় উপস্থিত সবাই তাঁর বক্তৃতার খুব প্রশংসা করতে লাগল। রবীন্দ্রনাথ তখন বললেন, “বলাই তো ভালো বক্তৃতা দেবেই কারণ বলাই তো ওর কাজ।”
এর কিছুদিন বাদেই কালিদাস নাগ ও তাঁর স্ত্রী জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথ মৃদুহাস্যে নাগ-দম্পতিকে প্রশ্ন করলেন, “তোমরা দুইজনে তো এলে, কিন্তু শিশুনাগদের কোথায় রেখে এলে?” কালিদাস বাবু বেচারা-বেচারা মুখ করে কাষ্ঠহাসি হাসলেন।
আর একবার এক ঘরোয়া আসর জমেছে। সবাই হাসি গল্পে মশগুল। রবীন্দ্রনাথ বললেন, “এ ঘরে একটা বাঁদোর আছে।” সবাই এ-ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। গুরুদেব কাকে বাঁদর বললেন? রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়ে দিলেন, “এ ঘরে দুটো দরজা বা দোর। একটা ডান দিকে অন্যটা বাম দিকে। তাই বলছিলাম এ ঘরে একটা বাঁদোর রয়েছে।”
ঠিক একইভাবে রবীন্দ্রনাথ একবার এক ভদ্রলোককে বললেন, “আপনাকে আমি দণ্ড দেব।” ভদ্রলোক তো ভীষণ বিব্রত। না জানি কী অপরাধ হয়েছে তার। বললেন “কেন, আমি কী অপরাধ করেছি?” রবীন্দ্রনাথ বললেন, “গতকাল আপনার লাঠি মানে দণ্ডটা আমার এখানে ফেলে গিয়েছিলেন। এই নিন আপনার দণ্ড।” বলে তাঁর দিকে লাঠিটা বাড়িয়ে ধরলেন।
জীবনের শেষের দিকেও রবিঠাকুরের এই মজা করার স্বভাব একই রকম ছিল। সেটা দিয়েই শেষ করি। তখন রবীন্দ্রনাথ একটু সামনের দিকে ঝুঁকে উবু হয়ে লিখতেন। একদিন তাঁকে ওভাবে উবু হয়ে লিখতে দেখে তাঁর এক শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁকে বললেন, “আপনার নিশ্চয় ওভাবে উপুড় হয়ে লিখতে কষ্ট হচ্ছে। বাজারে এখন এরকম অনেক চেয়ার আছে যেগুলোতে আপনি হেলান দিয়ে বেশ আয়েশের সঙ্গে লিখতে পারেন। ওরকম একটা আনিয়ে নিলেই তো পারেন।” লোকটার দিকে খানিকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ জবাব দিলেন, “তা তো পারি। তবে কী জানো, এখন উপুড় হয়ে না লিখলে কি আর লেখা বেরোয়! পাত্রের জল কমে তলায় ঠেকলে একটু উপুড় তো করতেই হয়।”
অলংকরণ – সুমিত রায়
Leave a Reply