গভীর রাত। সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। অন্ধকার আকাশের গায়ে মিটিমিট করে জ্বলছে তারারা। একফালি শরীর নিয়ে চাঁদ একাই যেন রাতপাহারা দিচ্ছে। গাছপালা-নদী-পাহাড় সব শান্ত।
হঠাৎই যেন থরথর করে কেঁপে উঠেলন মা বসুমতী। অনেকের ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম জড়ানো চোখেই টের পেল মাটি যেন কাঁপছে। আর খানিক বাদে বাদেই কানে এল আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করা তীব্র চিৎকার।
বাইরে বেরিয়ে এল তারা। সবারই মনে ভয়! কান পেতে বোঝার চেষ্টা করছে কোনদিক থেকে আসছে চিৎকারটা। শুনতে পেল পশ্চিমের ডায়না নদীর ওপার থেকেই ভেসে আসছে যেই চিৎকার। নদীর ওপারের ঘন জঙ্গলের শান্ত গাছপালাগুলো হঠাৎই যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বনজঙ্গল ভেঙে কোনও কিছু যেন ধেয়ে আসছে দ্রুত গতিতে। তারা ভয়ে দিশেহারা হয়ে চিৎকার করে উঠল, “মহাকাল, মহাকাল। মহাকাল আস্তিসে।”
হঠাৎই গোটা এলাকাই জেগে উঠল। তারা প্রস্তুতি নিতে ছুটল মহাকালের মোকাবিলার। পঞ্চানন রায় আর শক্তি মণ্ডল এই ঘটনা লক্ষ রাখছিল। পঞ্চানন চিৎকার করে উঠল, “ওরে এক হাঞ্জা মহাকাল আস্তিছে, এক হাঞ্জা। তরা সব তৈয়ার হ। বাঁশ নিয়া আয়, সড়কি নিয়া আয়, লাকড়ি জ্বালা।” শক্তি মণ্ডল বলল, “খড়ি জ্বালা, টিন পেটা, শলকাঠি জ্বালা।” বলে তারা ছুটে গেল। অনেকেই লাকড়ি, মানে গাছের শুকনো ডাল জোগাড় করে আগুন জ্বালাল। খড়ি হল জ্বালানি কাঠ। যার বাড়িতে যত কাঠ আছে, নিয়ে এসে জ্বালাল। দেখতে দেখতে যেন আগুনের একটা রেখা তৈরি হয়ে গেল নদীর এপারে। তারপর শুরু হল তেলের টিন পেটানো। ঢ্যাং ঢক, ঢ্যাং ঢক শব্দে যেন মেতে উঠেছে গোটা এলাকাটা। অনেকে আবার মুঠো মুঠো শলকাঠি মানে পাটকাঠি জ্বালিয়ে উঁচু করে ধরে নাড়াতে লাগল মশালের মতন।
ততক্ষণে নদীর জলে খলবল খলবল শব্দ উঠে গিয়েছে। ধীরে ধীরে কালো কালো মেঘের মতন অতিকায় হাতির দেহগুলো স্পষ্ট হতে লাগল। পৃথিবীর বুক কাঁপিয়ে তারা এদিকে ধেয়ে আসছে। সেই সঙ্গে কাঁপতে শুরু করেছে এলাকার লোকজনের বুকও। তারা বুঝতে পারল আজ তাদের ঘোর দুর্দিন। পঞ্চানন রায় কপালে হাত দিয়ে বসে পড়ল। বিঘা দুই জমিতে ধান চাষ করেছিল সে। এমনিতেই এ বছর বৃষ্টি কম হয়েছে। মহাজনের কাছেও রয়েছে অনেক দেনা। আজই সব শেষ! সে হায় হায় করে উঠল।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের লোকেরা হাতিকে মহাকাল বলে। তারা দেবতা জ্ঞান করে হাতিকে। আমরা যেমন দুর্গা ঠাকুর, কালী ঠাকুরের বড় বড় মূর্তি বানিয়ে পুজো করি, এখানকার মানুষেরাও ‘মহাকাল দেব’-এর মূর্তি বানিয়ে পুজো করে বিভিন্ন তিথিতে। এক হাঞ্জা মহাকাল মানে এক দল হাতি। তারা এখন আসছে এলাকায় লুঠপাট চালাতে। এরকম মাঝেমাঝেই আসে।
পঞ্চাননের জমি নদীর পাশেই। সে দেখল, নদী থেকে পাহাড়প্রমাণ দেহের গোটা চোদ্দো হাতি তার খেতের শিষ-লাগা ধানগাছ দুমড়ে মুচড়ে এগিয়ে আসছে গ্রামের দিকে। তারা তাদের লম্বা শুঁড় দিয়ে গোছা গোছা ধানগাছ তুলে মাটিতে আছড়ে গাছের গোড়ার মাটি ঝেড়ে ফেলে একেবারে মুখে পুরে দিচ্ছে। আর তীক্ষ্ণ চিৎকারে কাঁপিয়ে তুলছে দিগ্বিদিক। এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে একটা মাদি হাতি আর তার পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করছে একটা শিশু হাতি।
শক্তি মণ্ডল কয়েক কাঠা জায়গা জুড়ে কোয়াশের চাষ করেছিল। কোয়াশ হল কাঁচা পেঁপের মতন এক ধরনের ফল, তরকারি করে খেতে হয়। এই অঞ্চলের লোকেরা খুব খায় এই সবজি। সে দেখল, হাতির দল তার কোয়াশের খেতে ঢুকে কিছু কোয়াশ খেল আর বেশিরভাগটাই দলাইমালাই করে দুমড়েমুচড়ে ফেলল। বিপিন রায়ের কলাবাগানে ঢুকে কলাসমেত গাছ তুলে মুখে পুরল বেশ কিছু। আর বাকিটুকু লন্ডভন্ড করে ফেলল। নেপাল দাসের টিনের চাল ছাওয়া কাঠের কুঁড়েটা দাঁড়িয়ে ছিল জামগাছের তলায়। এমনিতে টিন জিনিসটাকে হাতিরা ভয় পায়। কিন্তু অন্ধকারে হাতির শুঁড়ের ধাক্কায় নেপালের কুঁড়েটা কাত হয়ে পড়ল।
হাতির দল এইভাবে লুঠপাট আর ভাঙচুর চালিয়ে যাচ্ছে। আর মাঝেমধ্যেই জোরে জোরে ডাক ছেড়ে জানাচ্ছে তাদের বিজয়োল্লাস। এটা শুঁড় দিয়ে আছড়ে দিচ্ছে, ওটা পা দিয়ে পিষে ফেলছে। আগুন, টিন পেটানো কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করছে না তারা।
খবর পেয়ে শোলকাপাড়া বিট অফিসার কয়েকজন বনকর্মী নিয়ে এসে হাজির। তাঁরা প্রথমে পটকা ফাটিয়ে চেষ্টা করলেন হাতির পালকে বনে ফিরিয়ে দেওয়ার। কিন্তু পারলেন না। অনেক চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে বিট অফিসার হাত-মাইকে ঘোষণা করলেন, “জঙ্গলের দিকটা ফাঁকা রেখে হাতে আগুন, টিন নিয়ে সবাই মোটামুটি ঘিরে দাঁড়ান। এবার আমরা শূন্যে ফায়ার করব। তাতে ওরা ভয় পেয়ে বনে ফিরে যেতে পারে। আপনারা তৈরি হন।” সবাই বিট অফিসারের কথা মতন দাঁড়িয়ে পড়ল। ব্যাপারটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে, ততটা সহজ নয় মোটেই। এভাবে দাঁড়ানো মানে হল সাক্ষাৎ যমরাজেরই রথের চাকার নিচে বুক পেতে দেওয়া। কিন্তু তাদের দাঁড়াতে হবেই— অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে যে।
কিছুক্ষণ পর বিট অফিসার শূন্যে গুলি করার নির্দেশ দিলেন। শূন্যে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়ার পর ব্যাপারটা হিতে বিপরীত হয়ে গেল। ভয়ে হোক বা রাগে, ফেরার পথ ধরার বদলে পথ পালটে হাতির পাল উত্তরের দিকে রওয়ানা দিল। সেদিকটাতে রয়েছে বেশ কয়েক ঘরের বাস। হাতিদের গতি বেড়েছে আরও। বিট অফিসার বলে উঠলেন, “সর্বনাশ!”
খেতের ফসল, গাছপালা দলাইমালাই করে চলতে চলতে তাদের চলার পথেই পড়ে গেল ভুবন রায়ের মাটির ঘরটা। ভুবন নিজে হাতি তাড়ানোর জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে এলেও তার বউ দুধের শিশুটাকে নিয়ে বেরোতে পারেনি। তার বউ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে মহাকালদেবের নাম করছিল। কিন্তু যে ভয়টা হচ্ছিল, সেটাই হল। উন্মত্ত হাতির পাল ভুবনের বাড়িতে আক্রমণ চালাল। মাথা দিয়ে আর শরীর দিয়ে ধাক্কা মারল মাটির দেওয়ালে। ফলে ঘরটা কেঁপে উঠতে লাগল বারবার। ভুবনের বউ ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। এবার দলনেত্রী এক ধাক্কায় দরজাটা ভেঙে ফেলল। সবাই হায় হায় করে উঠল। ভুবন আর থাকতে না পেরে জ্ঞান হারাল। এদিকে দলনেত্রী ঘরের ভেতরে ঢুকে দ্যাখে ভুবনের বউ বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার দিকে তাকিয়ে আছে আর কাঁপছে। অসহায় চোখ দুটো থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল। দলনেত্রী তার লম্বা শুঁড়টা বাড়িয়ে দিল বাচ্চাটার দিকে। ভুবনের বউ বাচ্চাটাকে আরও চেপে ধরল। নেত্রী ফোঁস ফোঁস করে তার শুঁড়টা কয়েকবার বুলিয়ে নিল বাচ্চাটার গায়ে। এরপর পায়ের কাছে থাকা নিজের শিশুটার গায়েও বুলিয়ে নিল শুঁড়। তারপর বাইরে বেরিয়ে এসে এক তীক্ষ্ণ চিৎকারে কাঁপিয়ে তুলল রাতের আকাশ। এই চিৎকারে বোধ হয় ছিল শান্তির সংকেত। হঠাৎ করেই ম্যাজিকের মতন সব হাতি একসঙ্গে শান্ত হয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে জঙ্গলের পথ ধরল। বিট অফিসার ঘোষণা করলেন, “ওরা ফিরে যাচ্ছে জঙ্গলে। কেউ ওদের বিরক্ত করবেন না। ওরা শান্তভাবেই চলে যাবে।”
ততক্ষণে ভুবনের জ্ঞান ফিরেছে। সে ঘরে গিয়ে বউ আর বাচ্চা ঠিক আছে দেখে খুব খুশি হল। খুশি হল প্রতিবেশীরাও।
হাতির পাল জঙ্গলে ফিরে গেলে বিট অফিসার এলেন ভুবনের বাড়িতে। এসে দ্যাখেন মায়ের কোলে বাচ্চাটা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। তিনি ভুবনের বউয়ের কাছ থেকে সব শুনে বললেন, “এমনিতেই হাতির খুব মায়া। তার ওপর মাদি মহাকাল তো, আরেক মায়ের কোলে শিশুকে দেখে তার মায়া হয়েছে। তাই আর বাড়াবাড়ি না করে শান্ত হয়ে জঙ্গলে ফিরে গেল।”
ছবি — আশিস ভট্টাচার্য
Leave a Reply