শান্তিনিকেতনের নাম তোমরা সকলেই শুনেছ। সেখানকার গোড়ার দিকের ছাত্রদের একটা মস্ত পাওনা ছিল এই যে, স্বয়ং রবিঠাকুরও তাঁদের ক্লাস নিতেন। সে ভারী আনন্দের ব্যাপার। কেননা ক্লাসেই চলত নানারকম মজার খেলা। তার মধ্যে একটা ছিল ছড়া বা কবিতা লেখার। তিনি পড়ুয়াদের একটা পঙক্তি দিয়ে দিতেন। এবার তার সঙ্গে মিল দিয়ে এবং অর্থ বজায় রেখে বাকিটা লিখতে হবে; এই হল খেলা; পড়ুয়ারা সকলেই মেতে উঠত। যখন তারা থই পেত না, অর্থাৎ, মিল কিংবা অর্থ নিয়ে যখন টানাটানি পড়েছে, তখন গুরুদেব নিজেই এসে হাল ধরতেন। প্রমথনাথ বিশী নামে তাঁর এক ছাত্র এরকম একটা কবিতার কথা মনে করে লিখেও গিয়েছেন, সেটি ছিল এরকম—
সে কি পাড়ি দিল এই ভাদ্দরে?
ও বাবা! কার সাধ্য রে!
ভেবে দেখো, কী মজাই না পেয়েছিলেন; বড় হয়েও এই দুটি ছত্র তাই ভোলেননি। অবশ্য এই মিলের খেলাটা রবিঠাকুর নিজেও ভোলেননি। তাঁর মাস্টারমশাই সাতকড়ি দত্ত মশায় তাঁকে ঠিক এরকমই খেলা দিতেন। যেমন একবার সাতকড়িবাবু দুটো পঙক্তি দিয়েছিলেন—
রবিকরে জ্বালাতন আছিল সবাই,
বরষা ভরসা দিল আর ভয় নাই।
বালক রবীন্দ্রনাথ এর সঙ্গে মিল দিয়ে বাকি দুটি পঙক্তি লিখল—
মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে
এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে।
এই মিলের খেলাটি তাঁর এত মনে ধরেছিল যে, অনেক পরে নিজের জীবনী লিখতে বসেও সে কথা তিনি লিখে গিয়েছেন। আর, নিজে যখন মাস্টারমশাই হয়েছেন, তখন তাঁর ছাত্রদের মধ্যেও সেই মজার খেলা ছড়িয়ে দিয়েছেন।
এখন, তোমরা ভাববে, এ আবার কেমন ক্লাস! যেখানে শুধু মজার খেলা হয়! পদ্য লেখার হোমটাস্ক আসে! ঠিক তা নয়; গুরুদেব অন্যান্য বিষয়ও পড়াতেন। তবে সত্যি বলতে কী, খুব নিয়মে বাঁধা পণ্ডিতমশাইটি হওয়ায় তাঁর বেশ আপত্তিই ছিল বলা যায়। যা কিছু নিয়মকানুন বা হয়েই থাকে বলে আমরা জানি, সেই গণ্ডি বাঁধা ভাবনাকে তিনি কোনোদিন মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। একবার বিশ্বশ্রুত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সঙ্গে একটা গুরুগম্ভীর বিষয়ে রবিঠাকুরের দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। দুজনেই জ্ঞানী মানুষ; তাঁরা মীমাংসা করছিলেন যে, কোনও একটা জিনিসের থাকা বা না-থাকার সঙ্গে আমাদের জানা-বোঝা বা ধ্যানধারণার যোগাযোগটা ঠিক কী রকম। বা আদৌ তা আছে কিনা! রবিঠাকুরের বিশ্বাস করতেন, আমাদের চেতনার রঙেই চুনি রাঙা হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, চুনি যদি রাঙা হয়, তবে সে আমরা বলছি বলেই। ফলত যা কিছু নিয়ম বা বেঁধে দেওয়া সত্যি বলে বলা হয়, তা যে একেবারে ধ্রুবসত্য এমনটা না-ও হতে পারে। ধরো না কেন, আমরা যাকে আকাশ বলি সে তো নদীও হতে পারে। যেমন রবিঠাকুর লিখলেন—
স্বপ্নে দেখি নৌকো আমার
নদীর ঘাটে বাঁধা;
নদী কিম্বা আকাশ সেটা
লাগল মনে ধাঁধাঁ।
এ-ও একরকমের আকাশগঙ্গা হল না কি! যদিও স্বপ্নে; কিন্তু এমন করে ভাবতে শিখলে, আমরা সহজেই বলতে পারি, ‘রাতের বেলা দুপুর যদি হয়/ দুপুর বেলা রাত হবে না কেন?’ এ প্রশ্নের উত্তর বড়রা আজও দিতে পারেননি। এদিকে রাতদুপুর কথাটা কে না শুনেছে! আমাদের যাবতীয় জানা-বোঝা-চেনাও যে একটা নিয়মের মধ্যে আটকে আছে, গণ্ডিতে ঠেকে যাচ্ছে, এ কথা যেন রবিঠাকুর আমাদের বারবার করে বলে দিতে থাকেন।
কারণ, এই যা-কিছু নিয়মকানুন, তার হালচাল দেখে তাঁর চিন্তাই হয়। তোমরা অনেকেই সুকুমার রায়ের একুশে আইন সম্পর্কে জানো। ঠিক সেরকমই রবিঠাকুর বলেন,
মহারাজা ভয়ে থাকে
পুলিসের থানাতে,
আইন বানায় যত
পারে না তা মানাতে।
চর ফিরে তাকে তাকে—
সাধু যদি ছাড়া থাকে
খোঁজ পেলে নৃপতিরে
হয় তাহা জানাতে,
রক্ষা করিতে তারে
রাখে জেলখানাতে।
তাহলেই বোঝো, নিয়মের কী গেরো! এখন এই নিয়ম যদি অহরহ মানতে হয়, তবে তো মুশকিল। রবিঠাকুর তাই বলেন, ভাবনা থেকে নিয়মের দড়িদড়া সব খুলে রাখতে। নিজের মতো করে ভাবতে, বুঝতে, কল্পনায় আমাদের চারপাশকে ছুঁয়ে থাকতে।
এই যেমন ধরো,
যদি খোকা না হয়ে
আমি হতেম কুকুর-ছানা—
তবে পাছে তোমার পাতে
আমি মুখ দিতে যাই ভাতে
তুমি করতে আমায় মানা?
মায়ের কাছে খোকা যখন প্রশ্ন করে যে, যদি সে কুকুরছানা বা টিয়াপাখি হত, তবে তাকে মা কী কী মানা করত? কিংবা, যদি সে চাঁপার গাছে ফুল হয়ে ফুটত, তাহলে? এখন, তোমরা হয়তো ভাববে, এরকম শখ হওয়ার কারণই বা কী! মানুষ কি আর কুকুরছানা কি চাঁপাফুল হতে পারে? পারে না নিশ্চয়ই। কিন্তু কল্পনাতে হতেই বা দোষ কোথায়! তোমরা সবাই নিশ্চয়ই শকুন্তলার গল্প পড়েছ। সেই যে আশ্রমকন্যা, আশ্রমের গাছপালাই যার বন্ধু, তাদের সঙ্গে সে কথাও বলত। হরিণশিশুটি তার এমন বন্ধু ছিল যে, সে যখন শ্বশুরবাড়ি যাবে, তখন আঁচল টেনে পথ আটকাচ্ছিল; আসলে আমাদের তপোবন এমনই ছিল। সেখানে মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি কেউ কাউকে আলাদা ভাবত না। রবিঠাকুর ছোটবেলায় এই কালীদাসের আমলকে মনে মনে খুব ভালোবেসেছিলেন। তাঁর একটা খাতা ছিল, নাম দিয়েছিলেন ‘মালতীপুথি’। সেখানে মন দিয়ে তিনি কালীদাসের কাব্যের সংস্কৃত শ্লোক তর্জমা করতেন, আর তাঁর দাদা সেগুলো শুধরে দিতেন। যাই হোক, ছোটবেলা থেকে এই সব পড়ার ফলেই তপোবন বিষয়টি তাঁর মনকে আজীবন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। আর তাই, বর্তমান দিনকালে কুকুরছানা কি টিয়াপাখির জন্য নির্ধারিত আলাদা নিয়ম তাঁর কবিতার এই খোকাটিকে ভাবিয়েছে। নিজেকে তাই ওদের জায়গায় বসিয়ে মাকে একটার পর একটা প্রশ্ন করে গেছে যে, সত্যিই সে কুকুরছানা হলে মা তার প্রতি আলাদা ব্যবহার করত কি না! এই যে মানুষ, পশু, ফুল গাছপালা সব মিলিয়েই আমাদের জগৎ, আমরা কেউ কারুর থেকে আলাদা নয়, আলাদা করে দেখলেই বরং ভেদাভেদ বাড়ে— এই কথাটিই কি তিনি আমাদের এভাবে বলে দিয়ে যাননি!
এই রকম করে ভাবতে পারলে দেখব, সম্ভব-অসম্ভবের সীমানা কেমন করে যেন মুছে যায়। যা কিছু নিয়ম বলে মনে হয়, তার বাইরেও কী সুন্দর একটা পৃথিবী আমরা ভাবতে পারি। এই যেমন রবিঠাকুর ভাবতে পারেন—
এমন সময় হঠাৎ দেখি,
দিক্সীমানায় গেছে ঠেকি
একটুখানি ভেসে-ওঠা
ত্রয়োদশীর চাঁদা।
“নৌকোতে তোর পার করে দে”
–এই ব’লে তার কাঁদা।।
স্বপ্নে কি কল্পনায় যা হয়, তা যে সত্যি হতেই হবে, এমনটা নয়। কিন্তু আমরা ভাবতে তো পারি— রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা/এমন কেন সত্যি হয় না আহা! এই ভাবনাটুকুই আসলে সেই দুনিয়ায় পৌঁছনোর পাসপোর্ট।
এখন এই সম্ভব-অসম্ভবের ভাবনায় সর্বদা যে নিয়ম মেনে সব ঠিক হবে, তারও কোনও মানে নেই। যেমন—
ভোলানাথ লিখেছিল,
তিন-চারে নব্বই—
গণিতের মার্কায়
কাটা গেল সর্বই।
এরকম হলে তো এমনিতে মহাবিপদ; কিন্তু কী আর করা যাবে! বরং এমন ভাবাই ভালো যে,
তিন চারে বারো হয়,
মাস্টার তারে কয়;
“লিখেছিনু ঢের বেশি”
এই তার গর্বই।
এ যদিও মজা করে বলেছেন, তবে নির্ঘাত, ছোটদের এমন ভাবনায় বড়রা বেজায় দোষ ধরবেন। তা তাঁরা কথায় কথায় ধরেনও বটে। এমনিতেই পদে পদে ছোট ছোট নিষেধের ডোর। আর, তা না-মানলেই দোষ ধরা। রবিঠাকুর এর একটা উত্তর তাই দিয়েই গিয়েছেন, এই বলে—
জিরাফের বাবা বলে,–
“খোকা তোর দেহ
দেখে দেখে মনে মোর
ক’মে যায় স্নেহ।
সামনে বিষম উঁচু,
পিছনেতে খাটো,
এমন দেহটা নিয়ে
কী করে যে হাঁটো।”
খোকা বলে, “আপনার
পানে তুমি চেহো,
মা যে কেন ভালোবাসে
বোঝে না তা কেহ।”
অবশ্য আর একটা কথাও তিনি এইসঙ্গে শিখিয়ে দিচ্ছেন আমাদের। অন্যের দোষ ধোরো না। আগে নিজের দিকে তাকাও। এ খুবই জরুরি বিষয়। সত্যি বলতে, কোনটায় আমার দোষ হচ্ছে এটুকু বিচার করতে শিখে গেলেই আর দোষ করার ফাঁদে আমরা পা দিই না। তাই অন্যরকম ভাবতে যেমন হবে, তেমন ভাবনা আর বাস্তববোধের একটা যোগাযোগও থাকা চাই বইকি। নইলে তিনি কেনই বা বলবেন,
আইডিয়াল নিয়ে থাকে, নাহি চড়ে হাঁড়ি।
প্র্যাকটিক্যাল লোকে বলে, এ যে বাড়াবাড়ি।
শিবনেত্র হল বুঝি, এইবার মোলো—
অক্সিজেন নাকে দিয়ে চাঙ্গা ক’রে তোলো।
ভাবনাটাই এখানে অক্সিজেন; যে ভাবনা সকলের সঙ্গে সকলকে মিলিয়ে রাখে, শুধু নিয়ম মানতে শেখায় না। তোমরা যারা সহজপাঠ পড়েছ, আর একবার খেয়াল করে দেখো, স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণের হাত ধরে কত মানুষের সেখানে আনাগোনা। কতরকমের কাজ করে তারা। কেউ একটু সরল, কেউ বা কঠিন কাজে দক্ষ; এই সমস্তটা মিলেই আমরা। শুধু একটা বাড়ি কি একটা স্কুল মিলে আমাদের পৃথিবী নয়। ভাবনাটাকে নিজেদের মতো করে বাড়িয়ে নিতে পারলেই আমরা নতুন করে অক্সিজেন পাব।
সেই একইরকম অক্সিজেন রবিঠাকুর নিজেও খুঁজে নিয়েছিলেন। তাঁর ছোটবেলাটা খুব যে মনমতো কেটেছিল তা নয়; বেশিরভাগ সময়েই বন্দি হয়ে, চাকরবাকরদের শাসনে দিন কাটত বালক রবির। অল্পবয়সে মাকে হারিয়েছিলেন। এই সবকিছু নিয়ে মনে তাঁর খেদ ছিল ঠিকই। কিন্তু তিনি একটি উপায় ভেবে বের করেছিলেন। ছড়া আর কবিতার ভিতর দিয়ে তিনি এমন একটা পৃথিবী তৈরি করেছিলেন, যেখানে তাঁর ছোটবেলার ইচ্ছেগুলো যেন পূরণ হয়। যেন এটাই তাঁর আর একরকমের ছোটবেলা। আমাদেরও ছোটবেলায় নানারকমের আপশোস থাকে। সবকিছু ঠিক মনের মতো হয় না। কিন্তু তা নিয়ে দুঃখ করে কী লাভ! বরং আমরাও রবিঠাকুরের ছড়ার হাত ধরে এরকমই একটা সম্ভব-অসম্ভবের পৃথিবী কল্পনা করে নিতেই পারি, যেখানে বয়সের নিয়মকানুনটাও ঠিক টেকে না, অর্থাৎ, ছোটবেলাটাই আর ফুরোয় না।
অলংকরণ – সুমিত রায়
Leave a Reply