রবীন্দ্রনাথের কাজ নিয়ে যেমন কথার শেষ নেই, তেমনই অন্ত নেই ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কথকতারও। প্রথম যেদিন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি যাই, দেখেছিলাম একটা ছোট্ট ঘরে উনুন পাতা। গাইড বলেছিলেন, এ নাকি ছিল রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব রান্নাঘর। স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে শখের রান্নায় উৎসাহ দেওয়াই হোক বা রাতবিরেতে খাবার বানানোর আবদার, সবই মেটাত ওই ছোট্ট ঘর। মনে পড়ে গেছিল কবির উদ্ভট রান্নার এক্সপেরিমেন্ট আর কবিপত্নীর মানকচুর জিলিপি কিংবা দইয়ের মালপো বানানোর গল্প। আর মনে পড়েছিল নবনীতা দেবসেনের লেখায় তাঁর পোলাও বানানোর সহজ ফর্মুলা। ছোটবেলায় উত্তরায়ণে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে ছোট্ট নবনীতা বলে উঠেছিলেন, এ কেমন নেমন্তন্ন! পোলাও নেই! অমনি পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে হুকুম জারি করেন কবি, তক্ষুনি পোলাও রান্নার। সাদা ভাতের সঙ্গে কমলালেবুর কোয়া মিশিয়ে পোলাও রান্নার রেসিপিও বাতলে দিয়েছিলেন তিনিই।

‘ছেলেবেলা’-য় লিখেছেন, নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর খাওয়ানোর শখ মিটত তাঁকে দিয়েই। স্কুল থেকে ফিরে এলে যেদিন চিংড়ির চচ্চড়ির সঙ্গে মেখে দিতেন পান্তা ভাত অল্প লংকার আভাস দিয়ে, সেদিন আর কথা ছিল না। সমবয়সি ভাগনি ইরাবতীর প্রসঙ্গে দিয়েছেন কাঁচা আম আর শুলপো শাক খাওয়ার লোভনীয় বর্ণনা। বড় বয়সে তাঁর খাদ্যাখাদ্য বিষয়ে শখের গল্প অবশ্য অন্যদের কথাতেই বেশি শোনা গেছে। কোনও খাবারের প্রতি বাড়াবাড়ি আকর্ষণ না থাকলেও একরকম জিনিসের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল, তা হল চই। যশোরে হত, কচি বাঁশের গুঁড়ি। প্রতিমা দেবী আড়ালে হেসে বলতেন, বাবামশায়ের শ্বশুরের দেশের জিনিস কিনা, তাই তাঁর এত ভালো লাগে।

রানী চন্দ লিখেছেন বারবার বাড়ি বদলের মতো খাওয়া নিয়েও রবীন্দ্রনাথের পরীক্ষানিরীক্ষার গল্প। একঘেয়েমির প্রতি তাঁর বরাবরের বিরাগ। সাধারণত তাঁর জন্য দুপুরে হত দিশি ধরনের রান্না, আর রাতে থাকত বিলিতি খাবার। একবার এক পণ্ডিত অতিথি কথায় কথায় শাস্ত্র পুরাণের অনুষঙ্গ টেনে বললেন, আমাদের দেশে হবিষ্যান্নই একমাত্র উপযুক্ত আহার। অমনি লোক ছুটল হাটে, কুমোরের ঘর থেকে এল সদ্য-পোড়া লাল মাটির মালসা। এবেলা ওবেলা নতুন মালসায় রান্না হবিষ্যান্ন খেয়ে গুরুদেব খুব খুশি হয়ে বললেন, এই এতদিনে ঠিকটি হল।

কিছুদিন পর এক বিদেশি বন্ধু জানালেন, ডিমে আছে সবরকমের খাদ্যগুণ। পরদিন থেকে চাল কাঁচকলা সরে গেল, গুরুদেব কাঁচা কাঁচা ডিম ভেঙে পেয়ালায় ঢালেন, নুন গোলমরিচ মিশিয়ে চুমুক দেন তাতে। আবার কবে এলেন আর একজন, আয়ুর্বেদ চর্চা করেন তিনি, আর তাঁর সঙ্গেই এল নিমপাতার রস। রানী চন্দের কথায়, “সে কি একটু আধটু? বড়ো একটা কাঁচের গ্লাসভর্তি রস, সবুজ রঙের থকথকে রস দেখে আর নিমপাতার তেতো গন্ধে আমাদের গা গুলিয়ে উঠত। গুরুদেব তা হাতে নিয়ে চুমুক দিতেন, যেন পেস্তাবাটা শরবত খাচ্ছেন।”

সেবাগ্রাম থেকে একজন এসে জানালেন, গান্ধিজি রোজ রসুন খান, বৃদ্ধদের পক্ষে তা খুবই উপকারী। সুতরাং বাটা রসুনের ডেলা ডেলা বড়ি দুবেলাই খাওয়া শুরু করে দিলেন রবীন্দ্রনাথও।

এক বিদেশি ডাক্তার জানালেন, আগুনের তাতে খাবারের সব গুণ নষ্ট হয়ে যায়। অতএব আবার বদলের পালা এল। গুরুদেব নিজেই তালিকা করে দিলেন কী কী সবজি চাই। সেই সব সবজি কুচিয়ে দেওয়া হল তাঁকে, এমনকী আলু পর্যন্ত। নুন লেবুর রস মিশিয়ে খানিকটা তিনি নিজে খেলেন, আর কিছুটা যথারীতি ভাগ করে দিলেন প্রিয়জনদের মধ্যে।

খেতে ভালোবাসতেন, খাওয়াতেও। রানী চন্দ লিখেছেন, অত্যন্ত মিতাহারী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সব মিলিয়ে খেতেন দু-তিন চামচ। কিন্তু তাই বলে কম করে খাবার দিলে ভারী অসন্তুষ্ট হতেন। পাশে যাঁরা থাকতেন, তাঁদের ফেলে কি তিনি খেতে পারেন? কিন্তু এক গুজরাটি অতিথির কথা শুনে যখন ক্যাস্টর অয়েলের পরোটা খাওয়া ধরলেন গুরুদেব, তখন আর খাওয়ার সময়ে ধারেকাছে বিশেষ কাউকে পেতেন না তিনি।

রবীন্দ্রনাথের খাওয়া ও খাওয়ানো দুয়েরই বর্ণনা দিয়েছেন বনফুল, তাঁর ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ বইয়ে। প্রথমবার শান্তিনিকেতনে দুজনের দেখা হওয়ার দিনেই বনফুলকে বিকেলে চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ করছেন রবীন্দ্রনাথ, “তোমার লেখা পড়ে মনে হয় তুমি ঝাল খেতে ভালোবাস। বিকেলে বড়ো বড়ো কাবলে মটরের ঘুগনি করলে কেমন হয়? ঘুগনির মাঝখানে একটা লাল লঙ্কা গোঁজা থাকবে।”

আর একবার খুব ভোরে শান্তিনিকেতনে পৌঁছেছেন বনফুল। অন্ধকার কাটেনি তখনও, ঠান্ডাও খুব। অথচ অনতিবিলম্বে স্নান করে ব্রেকফাস্টের টেবলে হাজির রবীন্দ্রনাথ। আটাত্তর বছর বয়সি রবীন্দ্রনাথের প্রাতরাশের একটি ছবির মতো বর্ণনা দিয়েছেন বনফুল— “নীলমণি খাবার নিয়ে প্রবেশ করল। দেখলাম প্রকাণ্ড একটি কাঁসার থালার মাঝখানে রুপোর বাটি দিয়ে কী যেন ঢাকা রয়েছে। আর তার চারপাশে তরকারির মতো কী যেন সাজানো রয়েছে সব। কোনওটাই পরিমাণে বেশি নয়, কিন্তু মনে হল সংখ্যায় অনেকগুলো। বারো-চোদ্দ রকম।”

বাটিটা তুলতেই বেরিয়ে পড়ল অনেকখানি ক্রিম। অন্য জিনিসগুলো নানারকম ডাল আর ফল ভেজানো। বনফুল লিখেছেন, “লক্ষ করে দেখলাম মুগের ডাল, ছোলা, বাদাম, পেস্তা, কিসমিস, আখরোট তো আছেই, আরও নানারকম কী আছে, একটা তো উচ্ছের বিচির মতো দেখাচ্ছিল। … নীলমণি দুটো কাঁচা ডিম ভেঙে একটা ডিশে করে দিয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ নিজে তাতে গোলমরিচের গুঁড়ো আর নুন দিয়ে নিলেন। নীলমণি দু’টুকরো মাখন-মাখানো রুটিও আনল।

“রবীন্দ্রনাথ প্রথমেই ডিশে চুমুক দিয়ে ডিমটা খেয়ে নিলেন। তারপর টেবিলের ড্রয়ার থেকে দুটো শিশি বার করলেন। একটা দেখলাম মার্কের গ্লুকোজ আর একটা স্যানাটোজেন। দুটো থেকেই দু’চামচ বার করে মেশালেন ক্রিমের সঙ্গে। তারপর কিসমিস পেস্তা সহযোগে খেতে লাগলেন সেটা। পরক্ষণেই কফি এল। কাপে নয়, কেতলিতে। কফি ‘ব্রু’ করার যে বিশেষ ধরনের কেতলি থাকে— তাতে।” এরপর রুটি দুখানায় পড়ল মধু, বনফুল দেখলেন সেটা অস্ট্রেলিয়ার আমদানি। মুখ মিষ্টি হয়ে গেছে বলে এল মুড়ি আর কুসুমবীজ ভাজা। তারপর টাটকা খেজুর রস।

রবীন্দ্রনাথের প্রাতরাশের উপকরণ যতই খুঁটিয়ে দেখুন না কেন, বনফুলের চোখের মতো মুখও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ততক্ষণে। এ কথা তিনি লিখতে ভোলেননি, তাঁর জন্য তখন টেবলে হাজির হয়েছিল ফুলকো লুচি, আলুর ছেঁচকি, গরম শিঙাড়া, কচুরি, সন্দেশ। তা ছাড়া কেক, বিস্কুট, আপেল, কলা। সঙ্গে চায়ের সরঞ্জাম।

 

রবিঠাকুরের ভোজনবিলাস রণিতা চট্টোপাধ্যায়

 

কবির পাশে বসিয়ে খাওয়ানোর ছবি উজ্জ্বল হয়ে ছিল লীলা মজুমদারের মনেও। আত্মজীবনী ‘পাকদণ্ডী’-তে তিনি লিখেছেন, “উনি খেতে বসলেন, আমি ওঁর পাশে বসে দেখতে লাগলাম। বনমালী খাবার দিল। মীরাদি আসেননি, প্রতিমাদি অসুস্থা। এরকম মাঝে মাঝে হত, উনি একা খেতেন। সেদিন নিজের ছোট কোয়ার্টার-প্লেটখানি আমার সামনে ঠেলে দিয়ে, নিজের হাতে পাত থেকে লুচি তরকারি সন্দেশ তুলে আমাকে দিলেন আর কত যে গল্প করলেন। তারপর প্রণাম করে চলে আসবার সময় বললেন, ‘দাঁড়াও, দক্ষিণা দিতে হবে না?’ বলে গলা থেকে ফুলের মালাটি খুলে আমার হাতে দিলেন।”

নিজের লেখায় যেমন, তেমনই অন্যদের স্মৃতিচারণে হদিশ মেলে কবির ভোজনরসিক মনটির। খাদ্যবিলাসের সঙ্গে সেখানে মিশে থাকে ঠাকুরবাড়ির সূক্ষ্ম সুন্দর রুচিবোধ। ঠাকুরবাড়িতে বাড়ির ভিতরের ছাদ ছিল মেয়েদের দখলে, পিতলের গামলা ভরা কলাইবাটা নিয়ে টপটপ করে বড়ি দিত তারা, কাঁচা আম ফালি করে কেটে কেটে আমসি শুকোনো হত, নানা আকার আকৃতির কাজ-করা কালো পাথরের ছাঁচে আমের রস থাকে থাকে জমিয়ে তোলা হত, রোদ খাওয়া সর্ষের তেলে মজে উঠত ইঁচড়ের আচার। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর কাদম্বরী দেবীর বিয়ের পর ছাদের ওপর আসর বসত দিনের শেষে, রুপোর রেকাবিতে ভিজে রুমালে বেলফুলের মালা, পিরিচে বরফ দেওয়া জলের গ্লাস আর ছাঁচি পান নিয়ে। আর দুপুরবেলা যখন কাছারিতে যেতেন জ্যোতিদাদা, তাঁকে খাবার পাঠানোর বর্ণনাও দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, “বউঠাকরুন ফলের খোসা ছাড়িয়ে কেটে কেটে যত্ন করে রুপোর রেকাবিতে সাজিয়ে দিতেন। নিজের হাতের মিষ্টান্ন কিছু কিছু থাকত তার সঙ্গে, আর তার উপরে ছড়ানো হত গোলাপের পাপড়ি। গেলাসে থাকত ডাবের জল কিংবা ফলের রস কিংবা কচি তালশাঁস বরফে-ঠাণ্ডা-করা।” এমন স্মৃতিগুলোই হয়তো ছাপ ফেলে গেছে তাঁর লেখাতেও। মনে পড়ে ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসে রুপোর থালায় বেলফুল রাশ করে পান সাজিয়ে দেওয়ার কথা, কিংবা ‘চোরাই ধন’ গল্পে বরফ দেওয়া ফলসার শরবতের পাশে রুপোর থালায় গোড়ে মালা বা আইসক্রিমের যন্ত্রে জমানো শাঁসে-রসে মেশানো তালশাঁস আর পিরিচে একটিমাত্র সূর্যমুখীর যুগলবন্দি। পরবর্তীকালে তাঁর চা খাওয়ার গল্প শুনিয়েছেন রানী চন্দ, “চীনে চা’-ই পছন্দ করতেন তিনি। সে চা’ও শুকনো বেল, যুঁই-এর। গরম জলে পড়লেই শুকনো পাপড়িগুলি খুলে ফুলের আকার নিত, আমরা দেখে চিনতাম এটা যুঁই, এটা বেলি। কখনো থাকত শুধুই চন্দ্রমল্লিকা খুদে খুদে আকারের। শুকনো ফুল, গুরুদেব বোধ হয় এই ফুলকেই বলতেন সেঁজুতি।”

Leave a Reply

Your email address will not be published.