মেরি কুরি রেডিয়াম আবিষ্কার

“It was like a new world opened to me, the world of science, which I was at last permitted to know in all liberty.” – Marie Curie

 

মেরির ছোটবেলা কেটেছে নানান প্রতিকূলতা আর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে। সেসব কথা তোমরা অনেকেই পড়েছ। পুরো নাম মারিয়া সালেমি স্কলদোভস্কা (১৮৬৭-১৯৩৪)। সারা পৃথিবীর কাছে এই মেয়েটিই একদিন মাদাম কুরি বা মেরি কুরি নামে পরিচিত হয়ে উঠবে। ১৮৯১ সালের কথা। মেরির তখন চব্বিশ বছর বয়স। যে সময়ের কথা তখন মেরির মাতৃভূমি পোল্যান্ডে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছিল না। তাই ফ্রান্সে চলে এলেন উচ্চশিক্ষার জন্যে। হাতে টাকাপয়সা খুব সামান্য। তার মধ্যে ঘরভাড়া, খাওয়াদাওয়া। তাই বিদেশে পড়তে এসেও খুব দারিদ্র্যের সঙ্গেই জীবনযাপন করতে হয়েছে মেরিকে। এমনও হয়েছে অর্ধেক দিন খাওয়া জোটেনি। শীতকালের উপযুক্ত পোশাক পর্যন্ত ছিল না। যাই হোক, এভাবে জীবন সংগ্রাম করে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৯৩ সালে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার অফ সায়েন্সে প্রথম স্থান অর্জন করলেন মেরি। টাকা ছিল না বলে ওই একই বছর গণিতের পরীক্ষায় বসা হল না। তাই পরের বছর গণিতের পরীক্ষা দিলেন। দ্বিতীয় স্থান পেয়ে পাশ করলেন।

কৃতিত্বের সঙ্গে মাস্টার অফ সায়েন্স ডিগ্রি অর্জন করে মেরি ঠিক করলেন পিএইচডি-র জন্যে গবেষণা শুরু করবেন। গবেষণার বিষয় নিয়ে এবার ভাবনা শুরু হল মেরির। এর মধ্যে তরুণ পদার্থবিদ পিয়ের কুরির সঙ্গে পরিচয়, ভালোবাসা এবং বিয়ে (১৮৯৫)। পদার্থবিদ হিসেবে স্বামী পিয়েরের ফরাসি দেশের বিজ্ঞান মহলে তখন ভালোই নামডাক। জন্ম নিয়েছে বড় মেয়ে আইরিন (১৮৯৭)।

মেরি যখন গবেষণা শুরু করতে যাচ্ছেন, তার ঠিক কয়েক বছর আগে বিজ্ঞানের জগতে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার রীতিমত আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। ১৮৯৫ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে জার্মানিতে উইলিয়াম রয়েন্টগেন নামের একজন পদার্থ বিজ্ঞানী অভিনব একটি রশ্মি আবিষ্কার করলেন। তিনি ওই রশ্মির নাম দিয়েছেন ‘এক্স রে’। এমনই অভিনব সেই রশ্মি যে মানুষের শরীরের ওপর দিয়ে পাঠালে, শরীর ভেদ করে হাড়ের ছবি ওঠে।

এক্স-রে আবিষ্কারের কয়েকমাস পরের কথা। ফরাসি পদার্থবিদ হেনরি বেকরেল ইউরেনিয়াম-এর এক ধরনের লবণ নিয়ে গবেষণা করার সময় হঠাৎ লক্ষ করেন সেখান থেকে এক ধরনের অদৃশ্য রশ্মি বের হয়। অন্ধকারে রাখা ফোটোগ্রাফিক প্লেটের সংস্পর্শে ওই রশ্মি ফোটগ্রাফিক প্লেটকে কালো করে দিতে পারে। তবে ইউরেনিয়াম থেকে নির্গত ওই রশ্মি যে রয়েন্টগেন আবিষ্কৃত এক্স-রে-র থেকে আলাদা চরিত্রের, তা তিনি অনুমান করতে পারলেও, ইউরেনিয়াম-রশ্মির চরিত্র নিয়ে তখনই নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারলেন না। তিনি এর নাম দিলেন ‘বেকরেল রশ্মি’। একই সময়ে অন্য আর একটি আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের ভাবনাকে আলোড়িত করল। সেটি হল, ১৮৯৭ সালে ব্রিটেনে জে জে থমসনের ইলেকট্রন আবিষ্কার। এই সব ক-টি আবিষ্কারই পদার্থের প্রকৃতি ও ধর্ম জানার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী হয়ে ওঠে।

মেরি ঠিক করলেন ইউরেনিয়াম থেকে নির্গত হওয়া বেকরেল রশ্মির প্রকৃতি ও ধর্ম জানার জন্যে গবেষণা শুরু করবেন। কাজটি যে রীতিমত দুরূহ আর চ্যালেঞ্জিং তা জানতেন মেরি। সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয়। না আছে এ নিয়ে কোনও বই, না আছে পরিমাপ করার কোনও যন্ত্রপাতি বা এ বিষয়ের কাজে অভিজ্ঞ কোনও বিজ্ঞানী। তবু অদম্য মনের জোর আর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে শুরু হল গবেষণার পরিকল্পনা।

কিন্তু মেরিকে গবেষণা করার জায়গা কে দেবে? অবশেষে পিয়ের কুরি তাঁদের বিভাগের কর্মকর্তাদের অনুরোধ করে একতলায় অব্যবহৃত ছোট্ট এক ফালি স্যাঁতস্যাঁতে গুদামঘরের মতন পরিত্যক্ত ও দীর্ঘকাল অব্যবহৃত একটি চালাঘরের মতন জায়গার ব্যবস্থা করতে পারলেন। ওখানে আগে ডাক্তারি ছাত্রদের শব-ব্যবচ্ছেদ শিক্ষার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হত। সেখানেই শুরু হবে মেরি কুরির কাজ।

মেরি ভাবলেন, ইউরেনিয়াম ছাড়া আর কোনও ধাতু থেকে কি এরকম রশ্মি বের হয়? ঠিক করলেন আরও বিভিন্ন পদার্থের মধ্যেও খোঁজ চালাবেন। দেখবেন সেখান থেকে এই জাতীয় কোনও রশ্মি বের হয় কি না।

কিন্তু মেরিকে যে শুধু গবেষণাগারে থাকলে চলবে না। বাড়িতে আছে ছোট্ট মেয়ে আইরিন, আছেন বৃদ্ধ শ্বশুরমশাই। সব দায়দায়িত্ব সামলে তাঁকে গবেষণায় আসতে হয়। যদিও শ্বশুরমশাই বাড়িতে আসার পর থেকে এবং একজন নার্সের ব্যবস্থা হওয়ায় মেয়ের দেখাশোনার ব্যাপারে অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছেন মেরি ও পিয়ের।

খোঁজ মিলল অবশেষে। থোরিয়াম নামের এক ধরনের ধাতু থেকেও অদৃশ্য রশ্মির বিকিরণ দেখতে পেলেন মেরি। অদৃশ্য এই বিকিরণের নাম দিলেন মেরি— ‘রেডিও-অ্যাকটিভিটি’। বাংলায় যাকে আমরা ‘তেজস্ক্রিয়তা’ বলে থাকি। বেকরেলের তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করেন মেরি। চমকপ্রদ কয়েকটি ফল দেখতে পেলেন মেরি। তিনি দেখাতে সক্ষম হলেন তেজস্ক্রিয়তা কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়া নয়, তা আসলে পদার্থের বিশেষ কোনও ভৌত ধর্ম। পিয়েরও নিজের গবেষণার কাজ শেষ করে মেরির সঙ্গে যোগ দিলেন।

মনে রাখতে হবে যে তখনও আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের উপস্থাপনা হয়নি। অর্থাৎ, পরমাণু নিউক্লিয়াসের ধারণা তখনও আসেনি। তবে এটা ঠিক যে বেকরেল-রশ্মির আবিষ্কার পরমাণুর অন্দরমহলের গঠন সম্পর্কে সে সময়ের কয়েকজন অগ্রগামী বিজ্ঞানীদের চিন্তা ভাবনাকে আলোড়িত করে তুলেছিল। বিশেষত পরমাণু যে আর ভাঙা যায় না, বিজ্ঞানীদের সেই ধারণার পরিবর্তন হল।

মেরি ও পিয়ের ঠিক করলেন খনিজ পদার্থ ‘পিচব্লেন্ড’ থেকে শুরু করবেন। পিচব্লেন্ডের মধ্যে মূলত ইউরেনিয়ামই (অক্সাইড ফর্মে) থাকে। সঙ্গে অন্য পদার্থও মিশে থাকে। যেহেতু মূলত ইউরেনিয়ামই থাকে সব চেয়ে বেশি, তাই ‘ইউরেনাইট’ নামে পরিচিত ছিল পিচব্লেন্ড। খনিজ পিচব্লেন্ডের মধ্যে ইউরেনিয়াম ছাড়া আরও অন্য তেজস্ক্রিয় মৌল থাকার সম্ভাবনার কথা মেরির ভাবনাতে ছিল। প্রথমেই বেশ কয়েক টন পিচব্লেন্ড নিয়ে আসার ব্যবস্থা হল। পিচব্লেন্ডের মধ্যে মিশে থাকা কত ধরনের মৌল আছে, তার মধ্যে থেকে অজানা কাঙ্ক্ষিত রেডিও-অ্যাকটিভ মৌলকে আলাদা করা যে কী কঠিন কাজ ছিল সে সময়ে, তা সত্যিই আমাদের ধারণার বাইরে। তখন না ছিল প্রয়োজনীয় উন্নত মানের কোনও যন্ত্রপাতি, না ছিল উপযুক্ত পরিকাঠামো। তাঁদের এই কাজ যেন ছিল অনেকটা খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মতন অসাধ্য সাধন।

পিয়ের কুরি যখন পাইজো ইলেক্ট্রিসিটি নিয়ে গবেষণা করতেন, তখন ‘ইলেকট্রোমিটার’ নামে একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। ওই যন্ত্রটিকে আরও উন্নত ও সংবেদী করে নেওয়ার পরে সেটি তেজষ্ক্রিয়তা পরিমাপের জন্যে উপযোগী করা হল। এবার একের পর এক নানান যৌগ আর খনিজ পদার্থ নিয়ে দেখা, তাদের মধ্যে বিকিরণ শক্তি আছে কি না। বিশুদ্ধ ইউরেনিয়ামের বিকিরণ ক্ষমতা পরীক্ষা করলেন। থোরিয়াম পদার্থের মধ্যেও তেজোরশ্মির খোঁজ পেলেন। পিচব্লেন্ড থেকে ইউরেনিয়াম ও অপরাপর বেশ কয়েকটি মৌলকে পৃথক করার পরেও যে ‘বাই-প্রোডাক্ট’ ফেলে দেওয়া হত, তার মধ্যে ইউরেনিয়ামের থেকেও অনেক বেশি তেজস্ক্রিয়তার সন্ধান পেলেন তাঁরা। আরও বিশ্লেষণের পরে নিশ্চিত হলেন, দুটি নতুন তেজস্ক্রিয় মৌলের উপস্থিতির জন্যেই এটা হচ্ছে। কী এই মৌল? এর উত্তর খুঁজে পেতেই হবে। উত্তেজনা আর ঔৎসুক্য দুজনের চোখে মুখে। বুঝতে পারছেন সাফল্যের দরজার একদম কাছে এসে গেছেন।

যেখানে এই গবেষণার কাজ চলছে সেই শেডের মতন জায়গাটির কথা আগে বলেছি। আর একটু দেখি কী ভাবে কাজ হচ্ছে সেখানে। পাইন কাঠের কয়েকটি পুরনো টেবিল। আছে ফারনেস আর গ্যাস বার্নার। সেখানে কোনও চিমনির ব্যবস্থা নেই, যাতে করে বিষাক্ত ধোঁয়া ও গ্যাস ওই ঘরটি থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। গরমকালে তীব্র গরম আর শীতে তেমনই জমে যাওয়ার মতন ঠান্ডা। একদম শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছে। কোনও আর্থিক অনুদান ছাড়াই এত বড় কাজে হাত দিয়েছেন ভাবতে আশ্চর্য লাগে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ওই পরিস্থিতির মধ্যে কাজ চলছে।

 

সেই শেড, যেখানে পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম নিষ্কাশনের কাজ শুরু হয়েছিল
সেই শেড, যেখানে পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম নিষ্কাশনের কাজ শুরু হয়েছিল

 

খনিজ পদার্থের মধ্যে থাকা বিভিন্ন মৌল পদার্থ আলাদা করার কাজ বা নিষ্কাশন প্রক্রিয়া। ভাঙা, গুঁড়ো করা, তরলে গোলা, বিশাল পাত্রে ফারনেসে ফোটানো, ঠান্ডা করা, ফিলটার করা। কখনও অধক্ষেপ ফেলে আলাদা করা। অ্যাসিড ঢেলে আসিডে দ্রবীভূত অংশ পৃথক করা। পাত্রে ফোটানোর সময় লোহার একটি লম্বা রড দিয়ে সেই উত্তপ্ত দ্রবণ ক্রমাগত নাড়িয়ে যাওয়ার কাজ। মেরি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ফুটন্ত দ্রবণ নাড়ানোর জন্যে যে লোহার রডটি ব্যবহৃত হত, লম্বায় সেটি তাঁর উচ্চতার কাছাকাছি। সাত টন পিচব্লেন্ডের স্ল্যাগ দিয়ে শুরু হয়েছে কাজ। এই ভাবে ধাপে ধাপে বিশুদ্ধ মৌল খোঁজার প্রক্রিয়া চলে।

দিন রাত এক করে কাজ চলছে। ১৮৯৮-এর জুলাই মাসে সফলতার সন্ধান মিলল। পিচব্লেন্ড থেকে পৃথক হতে হতে দুটি বিশেষ তেজস্ক্রিয় অংশ (ফ্রাকশেন) আলাদা করা গেছে। যাদের একটির রাসায়নিক ধর্ম বিসমাথ এবং দ্বিতীয়টির বেরিয়াম-এর সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে। সম্পূর্ণ নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল, যা ‘বিসমাথ ফ্র্যাকশেন-এর মধ্যে চিহ্নিত করেছেন, আবিষ্কৃত সেই মৌলটির নাম দিতে হবে। কী নাম হবে? মাতৃভূমি পোল্যান্ডের কথা মনে রেখে নাম রাখা হল ‘পোলোনিয়াম’। সন্দেহাতীতভাবে নতুন মৌলের অস্তিত্বের কথা প্রকাশ করলেন তাঁরা। সঙ্গে এও লিখলেন, নতুন তেজস্ক্রিয় মৌলকে বিসমাথের থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করা না গেলেও অতি শীঘ্র তা সম্ভব হবে।

এর মাস ছয়েকের মধ্যে, বেরিয়ামের সঙ্গে মিল থাকা দ্বিতীয় মৌলটির অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন তাঁরা। দ্বিতীয় মৌলের তেজস্ক্রিয় ক্ষমতা একই পরিমাণ ইউরেনিয়ামের তুলনায় প্রায় তিন হাজার গুণ বেশি। মৌলটির নাম রাখলেন রেডিয়াম। ল্যাটিন ‘রেডিয়াস’, যার অর্থ রশ্মি, সেখান থেকে এই নাম।

এরপর দুটি মৌলের চরিত্র ও ধর্ম নির্ণয়ের কাজ আর পাশাপাশি পরিশুদ্ধ রেডিয়াম পৃথক করার কাজ শুরু হল। দিন রাত এক করে নতুন মৌল রেডিয়াম পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা চলতে থাকল। অত ধকল শরীর নিতে পারছে না। মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়েন মেরি। তবু এসব কিছুকে সঙ্গে নিয়েই বিরামহীন গবেষণা চলতে থাকল।

১৯০২ সাল। দিনটি ছিল ২০ এপ্রিল। সন্ধে পর্যন্ত কাজ করে পরিশ্রান্ত হয়ে রাত নটায় ঘরে ফিরেছেন মেরি ও পিয়ের। বাড়ি ফিরে মেয়ের জামা সেলাই করতে বসেছেন মেরি। মন কিন্তু পড়ে আছে ল্যাবরেটেরিতে। খুব ভালো করেই জানেন লক্ষ্যের খুব কাছে চলে এসেছেন তাঁরা। কিছুতেই মন বসছে না ঘরে। আর পারলেন না। অস্থির হয়ে শেষে পিয়েরকে নিয়ে ওই রাত্রেই আবার ফিরে গেলেন ল্যাবরেটরিতে। গিয়ে যা দেখলেন তা অপূর্ব এক দৃশ্য। আত্মজীবনীতে লিখেছেন সে রাত্রের সেই অভিজ্ঞতার কথা।

দেখলেন সারা ঘর অপরূপ এক নীলাভ উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে রয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হল না, এই উদ্ভাসিত দ্যুতি আসলে বিশুদ্ধ রেডিয়ামের দীপ্তি। এক টন পিচব্লেন্ড থেকে মাত্র ১ ডেসিগ্রাম ওজনের বিশুদ্ধ রেডিয়াম পৃথক করতে পেরেছেন তাঁরা। পারমাণবিক ওজন নির্ণয় করলেন, যা বেরিয়ামের থেকে অনেক বেশি। দেখলেন নতুন মৌলের স্পেকট্রা (বর্ণালী)। এইবার নিশ্চিত হলেন। এর পরের অধ্যায় আমাদের অনেকেরই জানা। রেডিয়াম আবিষ্কার খুলে দিল বিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত।

এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ লিখে জমা দিলেন পিএইচডি থিসিস। ১৯০৩ সালের জুন মাসে অর্জন করলেন পিএইচডি-ইন-সায়েন্স। আর ওই বছরই ডিসেম্বরে রেডিও-অ্যাকটিভিটি আবিষ্কারের জন্যে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান বেকরেল এবং মেরি ও পিয়ের কুরি।

 

হেনরি বেকরেল, পিয়ের কুরি এবং মেরি কুরি (বাঁদিক থেকে ডান দিক)
হেনরি বেকরেল, পিয়ের কুরি এবং মেরি কুরি (বাঁদিক থেকে ডান দিক)

 

ইতিমধ্যেই তাঁরা পরীক্ষা করে দেখতে পান যে রেডিয়াম থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয় রশ্মি জীবন্ত কোশ নষ্ট করে দিতে পারে। সেখান থেকেই বুঝতে পারলেন ক্যানসার রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে রেডিয়াম কার্যকরী হয়ে উঠবে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে রেডিয়াম আবিষ্কারের জন্যে তাঁরা পেটেন্ট নিতে অস্বীকার করেছেন। যদি পেটেন্ট নিতেন, বিশাল সম্পত্তির অধিকারী হয়ে উঠতে পারতেন অচিরেই। গবেষণা তাঁদের ব্রত, তাঁদের আবিষ্কারের ফল মানুষের উপকারে লাগবে— এইটাই তাঁদের মূলমন্ত্র।

একটা কথা এখানে জেনে রাখা দরকার। যেহেতু পোলোনিয়ামের হাফ-লাইফ পিরিওড মাত্র ১৩৮ দিন। তাই ওই কম সময়ের মধ্যে তেজস্ক্রিয় পোলোনিয়াম নিষ্কাশন করতে সক্ষম হচ্ছিলেন না মেরি। অন্যদিকে রেডিয়ামের হাফ লাইফ পিরিয়োড ১৬০০ বছর। তাই খুব ধীরে ধীরে বিকিরণ (ionising radiation) হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে পারমাণবিক ওজন নির্ণয় করেন। বস্তুত রেডিয়াম আবিষ্কার রসায়ন বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক নতুন যুগের সূচনা হল।

মেরি সম্পর্কে আলবার্ট আইন্সটাইনের কথা দিয়ে শেষ করছি এই লেখা— “সমস্ত বিখ্যাত মানুষের মধ্যে মেরি কুরি ছিলেন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব; যশ ও খ্যাতি যাকে কখনও আদর্শচ্যুত করতে পারেনি।”

 


আলোকসাগর পারে (সৃষ্টিসুখ প্রকাশন, ২০১৯) বইতে মেরি কুরি, পিয়ের কুরি এবং তাঁদের নোবেলজয়ী কন্যা আইরিন জুলিয়েট কুরিকে নিয়ে তিনটি আলাদা আলাদা লেখা রয়েছে। সময় করে লেখাগুলিও পড়ে নিও, তাহলে তাঁদের জীবনের আরও অন্যদিক এবং অবদানের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.