সাতরঙা এক পাখি। পাখিটার রঙ সবুজ, লাল, হলুদ, বেগনি, নীল, কমলা, খয়েরি… সব মেশানো। এমন পাখি চোখে পড়ে না বড় একটা। বনমালী সাধু পাখিটাকে দেখছে ক’দিন ধরে। দুপুরে এসে তাদের বাড়ির পেছনের বাগানে বড় নিমের ডালে বসে বিশ্রাম নেয়। আবার বিকেলের একটু আগে উড়ান দেয়। পাখিটা খুব বড় নয়। কিন্তু ছোটও বলা যায় না। বকের মতো হবে প্রায়। বনমালী সাধু এখন বুড়ো হয়েছে। বাড়িতে বসে বসে খায়। তার দুই ছেলে গঞ্জে ব্যবসা করে। মাঝে মাঝে টাকা পাঠায় বাবাকে। বনমালী ছিল ফরেস্ট গার্ড। বনে বনে ঘুরত। কত পাখি চেনে, কত প্রাণী দেখেছে সে বনের ভিতর, মেটে খরগোস থেকে মস্ত হাতি পর্যন্ত। হেলে সাপ থেকে অজগর পর্যন্ত। জঙ্গলের ভিতরে বয়ে যাওয়া নদীর স্বচ্ছ আয়নার মতো জলে চকচকে রুপোর মতো মাছ, হাতি আর বাঘের জল খেতে আসা। নুন খেতে আসত হাতি। এইসব নিয়েই জীবন কেটেছে বনমালী সাধুর। এখন যে গ্রামে তার বাড়ি, সেই কুসুমগ্রাম, কুসমা থেকে জঙ্গল বেশি দূরে নয়। অন্য জনা পাঁচ বনরক্ষী আছে। বনমালীর কাছে তারা আসে মাঝেমধ্যে। সেদিন বনমালী সাধুর ঘরে বেশি করে রান্না চাপে। হ্যাঁ, বনমালী সাধু একা থাকে। তার বউ বছর দুই আগে মারা গেছে এক মানুষখেকো বাঘের কামড়ে। এমন কেন হয়েছিল তা বনমালী আজও বুঝে পায় না। আর সেই ঘটনার পর তার দুই ছেলে গঞ্জে পাকাপাকি চলে যায়। গঞ্জে থেকেই ব্যবসা করতে থাকে। তারা আর আসবে না বলেছে এই গ্রামে। খুব চেষ্টা করেছিল বাবাকে হলদিগঞ্জে নিয়ে যেতে। বনমালী যায়নি। চাকরি ছেড়ে দিল বটে, কিন্তু জঙ্গল ছেড়ে যেতে চায়নি যেমন, তেমনই কোন বাঘ তার বউকে মেরে দিল ঠিক দুপুরে এসে, তা খুঁজে বের করবে। কিন্তু কী করে খুঁজবে? বনের জন্তু বনে চলে গেছে। তার খোঁজ কে দেবে? বনমালীর দুই ছেলে, যদু আর মধু বলেছে, তাদের বাবা যতই বলুক, বনের প্রাণীরা সব অহিংস, দরকার ছাড়া জীব হত্যা করে না, তা মোটেই সত্যি না। তাহলে তাদের মা মরল কেন?
বনমালীর সঙ্গে তো বনের প্রাণীদের বিরোধ ছিল না কোনও। তাহলে সেই প্রাণীটা এল কেন বনের বাইরে বনমালীর বাড়ি? বনমালী তারই জন্য এই বাড়ি ছেড়ে গঞ্জে যায়নি। তার মনে হিংসা নেই। কিন্তু সে বসে আছে প্রাণীটির জন্য। শুধু জিজ্ঞেস করবে, তার ছেলেদের মা কী করেছিল যে তাকে মেরে দিয়েছিল সে? বনমালীর মনে হয় সে আসবে। আসবেই। হত্যাকারী একবার ফিরে আসে অকুস্থলে, কথাটা তাকে বলেছিল রেঞ্জার সায়েব। “সে আবার আসবে বনমালী, তুমি সাবধান থেকো, না হয় তুমি গঞ্জে চলে যাও।” বনমালী সাধু যায়নি। নিজে রেঁধে খায়। ভাত, আলু করলা সেদ্ধ, ডাল। এই তার খাদ্য। মাছ যদি পায়, তবে খায়। গ্রামের মানুষ যদি পুকুরে জাল ফেলে, বনমালীকে মাছ দিয়ে যায়। বন-মুরগি বা মেটে খরগোস বনমালী খায় না। বনরক্ষীর কাজ করতে করতে সে ওইসব ত্যাগ করেছে। ছেলেরা তাকে ত্যাগ করেছে, অথচ বনমালী জানে সে কোনওদিন হিংসা করেনি। এই বনের বাঘ মানুষখেকো হয় না, তবু কেন হল? তার বউ সুধাময়ীকে মেরে দিল। দুঃখে বনমালী কাজ ছেড়ে দেয়। কাজ ছেড়ে দেওয়ার দু’মাস বাদে বনের ভিতরে আবার দুটি লোক মরেছিল বাঘের থাবায়। সেই খবর পেয়েছিল বনমালী। ইস, জঙ্গল কি হিংসায় ভরে যাবে? আগে তো এমন হত না।
বনমালী দেখছে পাখিটা বসে আছে নিমডালে। গাছটি অনেক বড়। এই বসন্তের সময় ফুল ফুটিয়েছে। সন্ধেবেলায় নিম ফুলের গন্ধ ছেয়ে থাকে এই বাড়ি। বাড়ির ইটের দেওয়াল, সিমেন্টের মেঝে আর টালির চাল। বনমালী সাধু বারান্দা থেকে উঠে উঠোনের দক্ষিণ কোণে গেল। পাখিটাকে দেখবে ভালো করে। বনের কাজ সে দু’বছর ছেড়েছে মাত্র। সে গাছতলায় গিয়ে দাঁড়ায়। হাঁ করে পাখিটাকে দেখতে থাকে। এমন পাখি তো বনের ভিতর দ্যাখেনি কখনও। অদ্ভুত। সে যেন বনমালীকে চেনে। জানে বনমালী কেমন মানুষ। তাই ভয় পাচ্ছে না। উড়ে যাচ্ছে না। বনের পাখিদের সঙ্গে তার এমনই ভাব ছিল। কিন্তু বনে কত রকম কত পাখি। সবাই কি তাকে চিনত? কেউ কেউ তো উড়াল দিত বনরক্ষী বনমালী সাধুকে দেখে। হাজার হলেও মানুষ তো। মানুষকে কি বিশ্বাস করা যায়। কত রকমে পাখি ধরে, পাখি মারে। ফাঁদ আছে, গুলতি আছে, জাল আছে। বনমালী পাখিদের এসব কথা জানত। পাখিদের অনেক কথা ধরতে পারত। জঙ্গলে ঘুরত বলে এমন পারত সে। এখন ভুলে যাচ্ছে।
বনমালী বলল, “হুস হুস।”
অন্য পাখি হলে উড়ে যেত। কিন্তু এই পাখি ঘাড় নামিয়ে তাকে দেখল। তারপর আবার দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে। বনমালী তখন ঘরে যায়। মুড়ি আর বিস্কুটভাঙা এনে ছড়িয়ে দিল উঠোনে। পাখি আবার দেখল, কিন্তু নেমে এল না। বনমালী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কী করবে বুঝতে পারে না। তার উঠোনে এই একটিই বড় গাছ। বাড়ির পিছনে বাগান। জামরুল, পেয়ারা, আম, আতা, নোনা, করমচা। কিন্তু কোনও ফলই বনমালীর জন্য নয়। আগে যদিও খেত সিজিনের আম, পেয়ারা, জামরুল বা করমচা, এখন খায়ই না। পাখিদের জন্য দিয়ে দিয়েছে। পাখিরাই খায়। আরও নানা রকম ফল আছে। বনমালীর বাড়ির পিছনে তাই পাখিদের কলকাকলি লেগেই থাকে। কোনও পাখি শিস দেয়, কোনও পাখি গান গায়, কোনও পাখি ডানায় তালি দিয়ে দিয়ে নাচে। এসব বনমালী বুঝতে পারে। এই পাখি কিন্তু ফলের বাগানে না গিয়ে এই গাছে এসে বসে। নিমফল এখনও জন্মাতে দেরি আছে। সবে ফুল ফুটেছে। বনমালীর কী মনে হল, পাখিটার কোনও উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্য না হলে সব দিন ঠিক পথ চিনে তার বাড়ির নিম গাছে এসে বসে? অবশ্য পাখিরা এমন। আকাশে ওড়ে দিক ঠিক করে। তাদের পথ চিনতে অসুবিধে হয় না। বনমালী চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিল, তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এই পাখি, তুমি এখানে এসে বসো কেন প্রত্যেকদিন?”
পাখি মাথা নিচু করে বনমালীকে দেখল। মনে হল যেন হাসল তার লম্বা গোলাপি চঞ্চু ঘুরিয়ে। উত্তর দিল না। কিন্তু বনমালী বোঝে পাখি তার কথা বুঝেছে। না বুঝলে মাথা নিচু করে হাসত না। বনমালী বলল, “আমি বসে আছি সেই খুনিটার জন্য, যে আঁচড়ে কামড়ে আমার বউ সুধাময়ীকে মেরে গিয়েছিল। সুধাময়ী কত ভালোবাসত জঙ্গল আর তার প্রাণীদের। কীট-পতঙ্গকেও ভালোবাসত।”
পাখিটা আচমকা গম্ভীর গলায় কী যেন বলে উঠল, বনমালী শুনল, “আমিও বসে।”
“তুমি কে?” বনমালী জিজ্ঞেস করে।
পাখি আর উত্তর দেয় না। বনমালী জিজ্ঞেস করল, “বুঝলাম না।”
পাখি গম্ভীর গলায় বলল যা, তা আন্দাজ করে বনমালী, বুঝল, পাখি বলছে, “তারা আসুক।”
“কারা তারা?” বনমালী জিজ্ঞেস করল।
“তারা আসবে।” পাখি বলল।
“কিন্তু তুমি কে বলো দেখি সত্যি করে?” বনমালী আবার জিজ্ঞেস করে।
পাখি বলল, “আমি তাদের চিনি।”
অবাক হয়ে গেল বনমালী। কী শুনল সে। সুধাময়ীর হত্যাকারীর জন্য পাখিটা তার মতো বসে আছে। “পাখি পাখি, তুমি কে?”
পাখি বলল, “আমি পাখি, আমার নাম সাতরঙা চন্দনা। তুমি আমাকে চন্দনা বলো।”
“চন্দনা কি এত বড় হয়, আমি তোমাকে তো বনের ভিতর দেখিনি।”
পাখি বলল, “আমি পাহাড়ি চন্দনা, সেই উত্তরের পাহাড়ে থাকি, হিমগিরি, সেখেনে সব বরফে ঢাকা, বরফের উপর সূর্যকিরণ পড়ে সাদা রঙ বিচ্ছুরিত হয়ে সাতরঙ আমার গায়ে লেগে এমনি হয়ে গেছে, আগে আমি বরফের মতো সাদা ছিলাম, শ্বেত চন্দনা, সেদিন উড়ে যাচ্ছিলাম আকাশ দিয়ে, দেখি একজন আমাকে ডাকছে, এই পাখি, এই পাখি, আয় আয়, আয় না রে পাখি।”
কিছুই জানে না বনমালী। সুধাময়ীর সঙ্গে এই পাখির খুব ভাব হয়েছিল। তখন কার্তিক মাস। মাঠে পাকা ধান। উত্তরের হিমালয়ে খুব শীত। উপর থেকে পাখিরা তখন নেমে আসে সমতলে। তেমনই এসেছিল সে। উড়ে যাচ্ছিল দূর দক্ষিণে, যে দেশে শীত কম। বড় বড় জলাভূমি, সরোবর। সরোবরে গা ডুবিয়ে ভেসে থাকায় খুব আরাম। সেই দিকেই উড়ে যাচ্ছিল সে। যেতে যেতে মাঠের হলুদ ধান দেখে ইচ্ছে হয়েছিল একটু খেয়ে আবার উড়ে যায়। তখন এই বাড়ি থেকে ডাক এসেছিল, “ও পাখি, সাতরঙা পাখি, আয় না রে পাখি আয় না, আমায় দেখে যা না।”
চন্দনা তখন তার সাতরঙ নিয়ে নেমে এসেছিল ঠিক দুপুরে। সে নামতেই এই উঠোন সাত রঙে আলো হয়ে গেল। সুধাময়ী কী খুশি! কিন্তু তা যদি হয়, এখন তো সাতরঙের আলো হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? পাখি বলল, রঙ সে লুকিয়ে রাখে। রঙের বিচ্ছুরণ হতে দেয় না। রঙের আলো দেখে তারা এসেছিল তাকে ধরতে। তারা কারা?
পাখি বলল, “গুহি আর দহি, দুই স্যাঙাত।”
“গুহি দহি, চিনি না তো!” বনমালী অবাক।
“তারা হাতির দাঁত, হরিণের চামড়া, আর রঙিন পাখি — এই নিয়ে ব্যবসা করে।” পাখি বলল।
“আমি কি সত্যিই চিনিনে তাদের, বনের ভিতরে তো ঢুকতে হবে তাদের, নাহলে হাতির দাঁত পাবে কোথায়, হরিণের চামড়াই বা আসবে কোথা থেকে?” বনমালী বলল। একটু ভেবে দেখল। তার এলাকায় হরিণ মেরেছিল কেউ? মনে পড়ে না। হরিণ না মারলে তার চামড়া পাবে কোথা থেকে? হাতি মরেছিল? হাতি মরে গেলে তবে না তার দাঁত কেটে নেয় পোচাররা। তবে হাতি তো নির্জনে গিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে। কেউ জানে না জঙ্গলের কোন গভীরে গিয়ে সে শুয়ে পড়ে আকাশের নিচে। অপেক্ষা করে কখন মৃত্যু আসবে। খোঁজ রাখে পোচাররা। মানে যারা হাতির দাঁত মরা হাতির মুখ থেকে কেটে নেয়, তারাই খোঁজ রাখে দলছাড়া হাতি কোথায় গিয়ে শুয়ে পড়ছে মৃত্যুর জন্য।
পাখি বলল, সেদিন সাত রঙের আলোয় ভরে গিয়েছিল এই উঠোন। তার জন্য ভাত আর বারোমেসে পাকা পেয়ারা, পাকা টম্যাটো খেতে দিয়েছিল বনমালীর বউ সুধাময়ী। সে যখন খাচ্ছে, তখন গুহি-দহি দুই শয়তান যাচ্ছিল বনের দিকে। তাদের হাতে পাখি ধরার জাল ছিল। তারা দেখল বনমালী সাধুর বাড়ির উঠোনে সাতরঙের আলো। আলো দিন-দুপুরেই ঝলমল করছে। তারা বনমালীকে খুব ভয় করে। পাখি ধরার জাল হাতে ধরতে পারলে কোমরে দড়ি বেঁধে চালান করে দেবে। তারা দেখল বনমালী নেই। তবু গুহি নামের রোগা টিংটিঙে লোকটা এসে জিজ্ঞেস করল, “বনমালীভাই আছে গো সুধাদিদি?”
“সুধাদিদি বলল?” অবাক হয়ে যায় বনমালী।
“হ্যাঁ, তাই বলল, তখন সুধা-মা বলল, তিনি তো বনে গেছেন।
“সুধা-মা কথাটা বলা মাত্তর জাল নিয়ে ছুটে এল আর এক দুর্জন দহি। ‘আরিব্বাস, কী সুন্দর পাখি। লাখ টাকায় বিক্রি হবে।’ বলতে বলতে জাল ছুঁড়ে দিল আমার উপর। আমি আটকা পড়ে গেলাম। তারা আমাকে ধরে ফেলেছে। জাল গুটিয়ে নিতে লাগল। আর তাই দেখে সুধা-মা ছুটে ঘরে গিয়ে কাটারি নিয়ে এল, ‘তোরা ওরে ধরলি শয়তান!’ তিনি জাল কেটে দিতে লাগলেন। তখন দহি আর গুহি দুজনেই ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর উপর। তাদের হাতে লম্বা বাঁকানো নখ। নখে থাবা মারল জন্তুর মতো। লম্বা আর বাঁকানো নখ দিয়ে তারা মেরেছিল সুধা-মা-কে। আমি আবার এসেছি তার জন্য। ঠুকরে মেরে ফেলব দুই শয়তানকে।”
বনমালী সাধু মনে করতে চাইল কে দহি, কে গুহি। মনে তো পড়ে না। লম্বা নখ! নখ নয়, বাঘনখ। বাঘের থাবায় যেমন থাকে, তেমন ধারালো নখ। কামার জানে। কামারের বাড়ি গেলে জানা যাবে কে তৈরি করেছিল অমন। কামারের নাম গণেশ। গণেশকে জিজ্ঞেস করবে সে। তাহলে বনের জন্তু নয়, বনের বাইরে বাস করা জন্তু। খুব রোগা? খুব রোগা কি কেউ আছে এই গ্রামে? পাখি উড়ে গেল বনের দিকে। বনের ভিতরে এক নদী আছে, সেই নদীতে ভেসে থাকে সে। সে চলে যেতে বনমালী ঘরে তালা দিয়ে গণেশ কামারের ঘরে গেল, সে তখন হাপর টানছে চুল্লির। লোহা লাল টকটকে করে বাঁকিয়ে দা, কুড়োল তৈরি করছে। বনমালীকে দেখে তার মুখ অন্ধকার, বলল, “এসো সাধুভাই, কী লাগবে বলো।”
বনমালী বলল, “কিছু লাগবে না, আমি গাছ কাটি, না মানুষ মারি? হ্যাঁ কামারভাই, তুমি বাঘের মতো নখ তৈরি জানো, বাঁকানো নখ?”
গণেশ জিজ্ঞেস করল, “কেন গো?”
“যা জিজ্ঞেস করছি বলো।” বনমালী বলে।
গণেশ বলল, সে জানত না, দুটো লোক ছবি এঁকে নিয়ে এসেছিল, তারা জানে, ছবি দেখে লোহা নখের মতো বাঁকিয়ে বাঘনখ করে দিয়েছিল।
“দুটো লোক কারা?”
গণেশ বলল, “আমি জানিনে ভাই, তারা দামও দেয়নি।”
“সত্যি বলছ?” বনমালী জিজ্ঞেস করে।
“সত্যি সত্যি সত্যি।” গণেশ বলল, “পরে দিয়ে যাবে বলেছিল, কিন্তু আর আসেনি।”
“তাদের খোঁজ চাই আমার।” বনমালী বলে।
গণেশ বলল, “তুমি গঞ্জে যাও, সুরেন সামন্ত আমার মাসতুতো ভাই হয়, তাকে জিজ্ঞেস করো, তার পরিচয়েই এসেছিল।”
পরদিন সকালে বনমালী গেল গঞ্জে। ছেলেরা থাকে। তারা সব শুনে বলল, “বাবা, আর কী হবে, মা আমাদের গেছে, পাখিটা না এলে এমন হত না।”
“পাখির কী দোষ!” বনমালী রাগ করল।
দুই ভাই বলল, “পাখি না এলে কি এমন হত?”
বনমালী কোনও কথা বলল না। গেল সুরেন সামন্তর বাড়ি। সুরেন শুনে বলল, তাদের তো সে চেনে না, তারা এসেছিল জিতেন কুন্ডুর কাছ থেকে। কুন্ডুর মুখোশের ব্যবসা, কুন্ডুর কাছ থেকে মুখোশ কিনত তারা, কুন্ডুর কাছে গিয়ে খোঁজ করতে হবে তারা কারা।
জিতেন কুন্ডুর কাছে গেল বনমালী। জিতেন লোকটা বেঁটে আর কালো। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছে। নিজে নিজে মুখোশ বানায়। বাঘ, সিংহ, হাতি, রাক্ষস, গণেশ ঠাকুর — এমনি কত। কতরকম মানুষের মুখ। সে সব শুনে বলল, হ্যাঁ, দুটি লোককে সে পাঠিয়েছিল বটে সুরেন সামন্তর কাছে, তার কাছে এসেছিল তারা মুখোশ কিনতে। কী মুখোশ? না মানুষের মুখোশ, বাঘের মুখোশ, সিংহের মুখোশ। তারা তখন জিজ্ঞেস করেছিল কামারের কথা। সে জানত সুরেন সামন্তর মাসতুতো ভাই কামারের কাজ করে। দু’বছর আগে রথের মেলায় তার কাছ থেকে সে ছুরি কিনেছিল মুখোসের শোলা কাটার জন্য।
বনমালী জিজ্ঞেস করল, “তারা কি এমনি এসেছিল?”
“না, তাদের পাঠিয়েছিল যাদব আর মাধব সাধু, তারা বিদেশে মুখোশ পাঠায় তার কাছ থেকে কিনে।”
“যাদব-মাধব, যদু-মধু?”
“হ্যাঁ, এখনও নেয় তারা দুইজন, আমেরিকা ইংল্যান্ড কত দূরের দেশে মুখোশ পাঠায়।”
বনমালী ছেলেদের বাসায় এসে জিজ্ঞেস করল, “ওদের তোরা চিনলি কী করে যদু-মধু?”
যদু-মধু চুপ। তারপর যদু বলল, সে চিনত গুহিরামকে, সঙ্গে এসেছিল দহিরাম, তারা সাহায্য নিতে এসেছিল। কীসের সাহায্য? না, একজনের খুব অসুখ, তাই টাকা তুলে বেড়াচ্ছে। পরে জেনেছিল সব মিথ্যে। তারা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল মুখোশ কোথায় পাওয়া যায়। বুঝল সব বনমালী। ছেলেরা কিছুই জানত না, কিন্তু অজান্তে সাহায্য করেছে দুই খুনিকে। তারা তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মুখোশ আর বাঘনখ কিনে বনে যাওয়া শুরু করেছিল। চোখে জল এসে গেল বনমালী সাধুর। তার দুই ছেলে খুব ভালো। তারা জানে না তাদের মায়ের মৃত্যুর জন্য তারাও দায়ী। সেই দুজনকে না সাহায্য করলে, মুখোশ কিনতে না পাঠালে এসব কিছুই হত না। এখন খুঁজে বের করতে হবে দুজনকে। যদু মধু বলল, “বাবা, তুমি কী করে জানবে, তারা দুজন কেউ বেঁচে নেই।”
“কী করে?” বনমালী জিজ্ঞেস করে, “তোদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল?”
“না বাবা, কিন্তু তারা দুজনেই তো বাঘ নখ কিনেছিল, সেই নখ দুজনে দুজনের গায়ে বসিয়ে দিয়েছিল বাবা, আমরা বুঝলাম এখন।”
“তাই!” বনমালী বলল, “বনের ভিতরে ঝিমি নদীর তীরে?”
“হ্যাঁ বাবা, বাঘ দুটো লোককে মেরে গিয়েছিল, তুমি জানো না?”
“জানি তো, তোর মায়ের মৃত্যুর দু’মাস পর, আমি চাকরি ছেড়ে চলে আসতেই হয়েছিল।”
যদু বলল, “সেই গুহি আর দহি, বাঘ মারেনি, হাতির দাঁতের ভাগ নিয়ে গোলমাল লাগতে ওই হয়েছিল বাবা।”
“তোরা বুঝেছিলি?” বনমালী জিজ্ঞেস করে।
“না, এখন বুঝলাম, তারা বনে গিয়েছিল হাতির দাঁত আনতে।” মধু বলল, “তারপর একে অন্যকে ফাঁকি দিতে গেল লোভে পড়ে, তাই বাঘনখ নিয়ে অন্ধকার রাতে দুজনে দুজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, বিষ মাখানো বাঘনখ!”
বনমালী সাধু মন খারাপ করে ফিরে এসেছিল পরদিন। সারাদিন উঠোনে নিম গাছের নিচে বসে ছিল পাখিটার জন্য। কিন্তু সেই সাতরঙা পাখি আর ফিরে আসেনি। আসেনি বটে, কিন্তু বনমালী জানে বসন্তকালের পর গ্রীষ্ম এলে, পাতা ঝরার পর জঙ্গলের গাছে গাছে কচি পাতা জন্মালে পাখি হিমগিরির দিকে যাত্রা করবে। ফিরে যাওয়ার পথে নিশ্চয় তার সঙ্গে দেখা করে যাবে।
ছবি – অরিজিৎ ঘোষ
গল্পটি টগবগ উৎসব সংখ্যা ১৪২৪-এ প্রকাশিত
Leave a Reply