১
আমার নাম কাজল
এই বাড়িতে আমি কবে এসেছি, জানি না।
জানি না, কবে থেকে আর কী সূত্রে এখানে আমি আছি, থাকি।
মহকুমা-শহর ছাড়িয়ে বাগানঘেরা মস্ত এই দোতলা বাড়িটির নাম মেহের মঞ্জিল! প্রাচীন বাড়ি। ভাঙাচোরা। বাইরের পেল্লায় বাগানটার বেশিটাই জঙ্গল হয়ে আছে। এক ঠিকে মালি এসে মাঝে মাঝে বাগানের কাজ করে দিয়ে যায়। অখিল নাম তার। আমার সঙ্গে কথা বলে না সে কখনও।
এ বাড়ির জনসংখ্যা আড়াই; মানে আমাকে ‘আধ’ ধরলে, কারণ আমার বয়স এখন দশ। তাই ধর্তব্যের মধ্যে পড়ি না বড় একটা।
আমার মা এ বাড়ির পরিচারিকা, চলতি কথায়, রাতদিনের ঝি।
মস্ত এই বাড়ির একতলার কোণের একটা ছোট ঘরে আমাদের ঠাঁই হয়েছে। সেখানেই কেরোসিন স্টোভে মা রান্না করে নেয় আমাদের দুজনের জন্যে। তবে আমি কিন্তু এ বাড়ির কোনও কাজ করি না, মানে আমি এ বাড়ির ‘কাজের মেয়ে’ নই। আমি ইস্কুলে পড়ি। ক্লাস ফাইভ। ‘তারিণীবালা অবৈতনিক বালিকা বিদ্যালয়’-এ বাড়ি থেকে হেঁটে দশ মিনিট। বাসরাস্তা দিয়ে নয়, আমি রোজ গ্রামের ভিতর দিয়ে দিয়ে চলতি পথে ইস্কুলে যাই আর ফিরি। না আমার কোনও গৃহশিক্ষক আছে, না আমি কোনও টিউশনে পড়তে যাই।
আমাদের ইস্কুলের নিভা দিদিমণি খুব ভালোবাসে আমায়। সে-ই আমার কথা শুনে শুনে এ গল্প লিখে দিয়েছে; নইলে আমি কি আর এত গুছিয়ে বাংলা লিখতে পারি? যদিও এবারের বার্ষিক পরীক্ষায় আমি বাংলায় তিয়াত্তর পেয়েছি (কিন্তু প্রথম দশজনের মধ্যে নেই)।
**
দেড়জনের হিসেব তো হল। বাকি একজন?
রোসো, রোসো। বলছি, বলছি। বলছি তাঁর কথা। তিনিই তো এ গল্পের নায়ক গো! এবং এ বাড়ির মালিক।
যদিও তাঁর নামটা কিন্তু আমি জানি না।
কী, অবাক হচ্ছ? যার গল্প বলতে চলেছি, তাঁর নামটাই জানি না?!
হতেই পারে।
নামে কী আসে যায়? কোন এক বিখ্যাত লোক নাকি বলে গিয়েছিলেন।
তাঁকে আমরা ‘হাকিমবাবু’ বলে জনান্তিকে উল্লেখ করি, যদিও সেটা করবার সুযোগ বেশি আসে না।
হেকিম বা হাকিম বলতে জজসাহেব বোঝায়, আবার ডাক্তারও বোঝাতে পারে শুনেছি।
তাহলে এবার বলি তাঁর গল্প।
হাকিমবাবুকে নিয়ে সবচেয়ে পুরনো যে স্মৃতিটা জাগ্রত হয়ে রয়েছে আমার মনে, সেটা তাঁর মস্ত ল্যাবরেটরিতে।
আমার বয়স তখন হয়তো বছর পাঁচ হবে।
এক প্রখর গ্রীষ্মের দুপুরে শিশু মেয়েটি একা একা খেলতে খেলতে দোতলার হলঘরে ঢুকে পড়েছিল। একটু বড় হয়ে জেনেছিলাম যে সেটাকে ‘ল্যাবরেটরি’ বলে এবং তার মধ্যে রাখা অনেক অনেক টেবিলের উপরে কাচের টিউব ইত্যাদিকে বিকার-বার্নার ইত্যাদি বলে।
পাঁচ বছরের বালিকাটি সারা দুপুর ধরে মস্ত এই বাড়িটায় একা-একা খেলে বেড়াত।
খেলে? কার সঙ্গে খেলেবে? কোনও সঙ্গী থাকলে তো।
দোতলার উত্তরের এই মস্ত ঘরটায়, মানে ল্যাবরেটরিতে, ঢুকে আনেমানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে।
হঠাৎ এক টেবিলে রাখা এক বার্নারের উপরে টগবগ শব্দ করে ফুটতে থাকা কিছু তরলের প্রতি তার দৃষ্টি পড়ে। ঘরের মধ্যেই আড়াই তলায় ওঠবার কাঠের সিঁড়িতে সে কোনোভাবে উঠে পড়েছিল, কাপড়ের তৈরি খুকি-পুতুলটিকে বগলদাবা করে।
শসপ্যানের মধ্যের তরলটির লাল থেকে গোলাপি থেকে বেগুনি থেকে সবুজ হয়ে যাওয়া খুব মজায় দেখছিল সে।
হঠাৎ গম্ভীর গলায় “তু-তুমি এখানে কী করছ?” শুনে চমকে হাত থেকে পুতুলটি পড়ে যায় আমার।
হাকিমবাবু! যাঁর অতিগম্ভীর গলার স্বরটিই তাঁর সিগনেচার। কথার মাঝে মাঝেই তোতলান। এবং সারাক্ষণ ঠোঁটের কোণে চুরুট (তখন অবশ্য জ্বলছিল না সেটা)। না থাকলেও সিগার গন্ধ!
কখন আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন উনি জানি না।
থতমত খেয়ে বলেছিলাম, “আমি… মানে মা ঘুমোচ্ছে…”
“হুমম, আমার হাতটা ধ্-ধরো।” বলে আমায় আড়াইতলার কাঠের সিঁড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে প্রায় নিজের কোলে বসিয়ে নিলেন সেই বছর ষাটেকের প্রৌঢ়।
দশাসই চেহারা। পরনে গাঢ় লাল রঙের ড্রেসিং রোব। সিল্কের। সেই প্রথম তাঁর সঙ্গে মোলাকাতের স্মৃতি আমার। শিশুবয়সে।
**
বছরখানেক আগেও ফকিরচাঁদ নামের এক গৃহভৃত্য ছিল এই বাড়িতে। তেঢেঙে লম্বা ছিল সে সেই বয়সেই। আমরা কখনও বলিনি; কিন্তু এ-বাড়িতে ফিরি করতে আসা মাছওয়ালা-সবজিওয়ালারা তাকে ‘নুলো-ফকির’ বলে ডাকত জনান্তিকে, কারণ বাম হাতটি তার দৈর্ঘ্যে অর্ধেক এবং অতীব সরু ছিল, আর কনুই এর নিচেই দু-তিনটে আঙুল ছিল মাত্র।
হাকিমবাবুকে পারতপক্ষে এই বাড়ি থেকে বেরোতে দেখিনি আমি। ওই ফকিরদাদাই তখন এ-বাড়ির টুকটাক বাজার-দোকান-হাট করত; থাকত সে আমাদের ঠিক পাশের ঘরটায়। আমার মাকে ডাকত ‘কমলাদি’।
এক সন্ধেবেলার কথা মনে পড়ে।
বৈশাখ মাস। সারাদিন অসহ্য গরম গেছে। বিকাল থেকেই তুমুল কালবৈশাখী ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।
একতলা থেকে দোতলায় ওঠার মস্ত চওড়া কাঠের সিঁড়ির বাঁকে যে বাহিরমুখী দেওয়ালটা— তাতে লাল-নীল-হলুদ-সবুজ নানান রঙচঙে কাঁচ বসানো আছে। বাইরে বিদ্যুৎ চমকালে তার যে নানান রঙের আলোকমালা সারা বাড়িতে ঝলকে ঝলকে এসে পড়ে, সেটা দেখা ছোটবেলা থেকেই আমার কাছে এক দারুণ মজার ব্যাপার ছিল।
সেই সন্ধের ঝড়বৃষ্টিতেও আমি ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নানান বর্ণের আলোর ঝলকানি দেখছি (পাঁচ-ছয় বছর বয়সের বালিকার পক্ষে এটা একটু বেশিই সাহসিকতার পরিচয়, নয় কি? সারা বাড়িটাই যেখানে ফাঁকা!), মায়ের মাথাধরাটা সেদিন বড্ড বেড়েছে, তাই কপালে অম্রুতাঞ্জন লাগিয়ে ঘরের মেঝেয় মাদুর পেতে শুয়ে ছিল।
হঠাৎ শুনি, দোতলার ল্যান্ডিং থেকে ঝুঁকে ঘাড় বাড়িয়ে বাজখাঁই গলায় ‘ফ্-ফ্-ফকির! ফকিরচাঁদ!’ বলে ডাকলেন গৃহকর্তা হাকিমবাবু।
শুনে পিলে চমকে গেল আমার।
পরক্ষণেই দেখি বলির পাঁঠার মতো কাঁপতে কাঁপতে সেই চাকর ফকিরচাঁদ ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মুখটায় এসে দাঁড়িয়েছে।
“কাজল, এই নে। এটা রাখ তো।” বলতে বলতে লাল কারে বাঁধা এক তাবিজ নিজের বাম বাহু থেকে খুলে আমার হাতে দিল সে, “দিদিকে এটা দিয়ে দিবি… আমি যদি আর না ফিরি…”
“তুমি আর ফিরবে না কেন, ফকিরদাদা? তুমি কোথায় যাচ্ছ এখন, বলো না?” বছর পাঁচ-ছয়ের বালিকা হলেও তখনই আমি টরটরে ছিলুম বেশ। বিশেষত, একজন আর ফিরবে না বলছে, সেটা যে একটা গুরুতর ব্যাপার সেটা বোঝবার মতো জ্ঞানগম্যি হয়ে গেছে আমার তদ্দিনে।
না, সেই সন্ধের পর থেকে প্রতিবন্ধী গৃহভৃত্য ফকিরচাঁদকে আর চর্মচক্ষুতে দেখিনি আমি।
পরের দিন সকালে মা-কে সব বলে হাতে তার সেই তাবিজটা দিতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল।
আমার অবশ্য সেটা দেখার সময় নেই তখন। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। গতরাতে দু-গাল মুড়ি ছাড়া আর কিছু জোটেনি। ভাত চড়ানোর জন্যে তাগাদা লাগালুম মা-কে।
২
দুই গবেষক
এই মহকুমা শহরের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে নদীর ধারে বিরাট মাঠটাতে এক বাৎসরিক মেলা বসে।
নকশবন্দীয়া পন্থের মরমি শেখ তাজুদ্দিনের উরস। নানান দিক থেকে হিন্দু-মুসলমান হরেক কিসিমের মানুষ আসেন এই মেলাতে, কারণ ঊনবিংশ শতাব্দীর ওই সুফি পিরের দোর সক্কলের জন্য খোলা থাকত।
শিলিগুড়ির ছেলে, বর্তমানে দিল্লির জে এন ইউ-তে বায়োটেকনলজির গবেষক দেবাদিত্য রাহা আর তার সিকিমি সহপাঠিনী শেরিং তামাং এ বছর বাবা তাজুদ্দিনের এই মেলায় এসেছে। তারা শুনেছে, বাবার বংশ পরম্পরায় বর্তমান প্রজন্ম সেই প্রাচীনকালের এক ধারা বজায় রেখেছেন। তাঁদের দেওয়া এক বিশেষ ‘জলপড়া’ খেলে নাকি মানুষের বয়স আর বাড়ে না, এক জায়গাতেই থেমে থাকে!
এমন আজগুবি কুসংস্কারাচ্ছন্ন গুলগল্প এক পার্সেন্টও মেনে নেবার কোনও কারণ ছিল না এই দুই বিজ্ঞানীর, যদি না এক জার্মান সাহেব গত বছর এই মেলায় এসে ‘পড়া’ সেই জলের কেমিক্যাল গুণাগুণ নিয়ে নামী এক জার্নালে দীর্ঘ নিবন্ধ লিখতেন। প্রফেসর উইলহেল্ম ওট-এর ‘সেল-কন্ট্রাকশন’-এর উপরে কাজ জগদ্বিখ্যাত; যিনি ‘ক্রিপটো-জুলজি’-কে আজগুবি বিদ্যা বলে নস্যাৎ করেন না। দেবাদিত্যরা তাই প্রফেসর ওটের বক্তব্য উড়িয়ে দিতে পারেনি।
তাই আজ ওদের আসা উত্তরবঙ্গের এই গ্রাম্য মেলায়।
**
মরহুম দাদাবাবার তাঁবু মোটেই খুঁজতে হয় না। সবুজ মখমলে মোড়া মস্ত তাঁবুটি, যার বাইরে দু-শ লোকের দীর্ঘ লাইন।
বাবা হাঁফানিরও জবরদস্ত এক ঔষধ দেন। শিশিতে বা পলিব্যাগে ছোট জ্যান্ত এক-একটা পুঁটি মাছ নিয়ে বহু মেয়েপুরুষ লাইন দিয়ে রয়েছে। বাবা তাঁর মন্ত্রপূত হলদে রঙের কাদা-কাদা ওষুধ পুরে দেন সেই জ্যান্ত পুঁটি মাছের মুখে। হাঁফানি রোগীকে তৎক্ষণাৎ গিলে ফেলতে হবে সেই কাঁচা মাছটিকে। আর তাতেই আশ্চর্য! অন্তত বছরখানেকের জন্যে হাঁফানি গায়েব! আবার পরের বছর আসবে।
এর পিছনের বৈজ্ঞানিক সত্য-মিথ্যার হিসাব কে রাখে? তবে হাজারে হাজারে গ্রাম্য রুগি এই দেশীয় টোটকায় উপকৃত হয়, তাই কাতারে কাতারে আসে। এবং ভালো হয়ে চলে যায়।
পায়ের সমস্যা আছে দেবাদিত্যের। জন্মগত। ক্রাচ নিয়ে চলতে হয় তাকে। বহু কষ্টে দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর পরে তারা জানতে পারল যে জলপড়া কেবলমাত্র একাদশীর দিনই দেওয়া হয়, অর্থাৎ আরও তিনদিন পরে আসতে হবে তাদের। সেদিন নিরম্বু উপবাসে থাকতে হবে ওই পড়া জল পান করা পর্যন্ত, এবং পরের একটা বচ্ছর পেঁয়াজ-রসুন ও হিং খাওয়া চলবে না।
বোঝো।
আর হ্যাঁ, ঘুম থেকে উঠে বাসি কাপড় ছেড়ে একটা ধোয়া কাঁচের বয়াম আনতে হবে, যাতে হুজুর ওই জলপড়া ধরে দেবেন।
শেরিং বলল, “দেবু, ডু ইউ থিংক দ্যাট দ্য ওয়াটারস্ পাওয়ার উইল রিমেইন ইনট্যাক্ট টিল উই রিচ দ্য ল্যাব?”
“প্রোফেসর ওটের ক্ষেত্রে তো তা-ই হয়েছিল, না? নইলে উনি সেই পড়া জলের গুণাবলী নিয়ে লিখলেন কী করে?”
“তা বটে। চলো তবে, আজ ফিরে যাই। তরশু ফের আসতে হবে।”
**
তাঁবু থেকে বেরিয়ে খানিকটা চলে এসেছে ওরা, পিছন থেকে “কত্তা একবার শোনেনই না” ডাক শুনে লুঙ্গি-গেঞ্জিপরা এক আধবুড়ো রোগাটে মানুষকে দেখতে পেল। টুলে বসে আছে, তাঁবুর বাইরে।
“আমাদের ডাকছেন?” দেবাদিত্য শুধোয়।
“আজ্ঞে হ্যাঁ, কত্তা। আপনাদেরকেই। শোনেন না একবার ইদিকে।”
“বলুন?”
“আপনারা তো আর সেই জলপড়া খেয়ে সত্যি সত্যি তন্দুরস্তি পেতে আসেন নাই, কী বলেন?”
“ওয়ট ডাজ দিস ওয়র্ড মিন?” শেরিং তামাং ‘তন্দুরস্তি’ শব্দের মানে জানে না।
“ইট মিন্স ভিগর,” বলে দিল দেবাদিত্য।
“সেটা আপনি কী করে বুঝতে পারলেন?” প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল দেবাদিত্য সেই লুঙ্গিপরা ব্যক্তিটির উদ্দেশ্যে।
বোঝা গেল, একটু আগে ওরা যখন তাঁবুতে ঢুকে মেজ হুজুরের সঙ্গে কথা বলছিল, এই ব্যক্তি সেটা শুনেছে মন দিয়ে।
“যায়, যায়, বোঝা যায়। আপানাদিগকে দেখলেই বোঝা যায় যে আপনারা লিখাপড়া জানা ইনসান!”
“হ্যাঁ, বলুন এবার, কী বলতে চান আপনি?”
“তন্দুরস্তির ঔষধ দাদাবাবাজির জলপড়া পেতে পেতে তো আপনাদিগের তরশু দিন হবে। ততদিনে বড়ে বুজুর্গসাহিবের কাছ থেকে একবার ঘুরে আসেন না। তিনি দানিশমন্দ্ মানুষ, আপনাদের কাজে আসবেন।” বলল সেই রোগাসোগা ক্ষয়াখপ্পুরে মনিষ্যিটি।
এইভাবেই দেবাদিত্যদের এই মেহের মঞ্জিলে নিয়ে আসে অখিল, বাড়ির বাগানের মালি।
সেই ‘দানিশমন্দ্’ অর্থাৎ পণ্ডিত মানুষটি আর কেউ নন, আমাদের পরিচিত বিজ্ঞানী হাকিমবাবু।
৩
গালিভার সুইফট্
সেই সকালে মেহের মঞ্জিলের দোতলায় আধঘণ্টা অপেক্ষা করবার পরে দেবাদিত্যদের মোলাকাত হয়েছিল হাকিমবাবুর সঙ্গে।
এর ফাঁকে অবশ্য কমলাদির বানানো কচুরি আর আলুরদম দিয়ে জবরদস্ত নাস্তা হয়ে গেছে তাদের।
দেবাদিত্য আর শেরিং তো এ বাড়ির আতিথেয়তায় মুগ্ধ!
ব্রেকফাস্ট শেষে এবার জানালার পর্দা সরিয়ে সরিয়ে দেওয়ালে ঝোলানো বড় বড় তৈলচিত্রগুলো দেখতে শুরু করে ওরা।
পেল্লায় একটা ছবি রয়েছে গালিভার আর লিলিপুটদের নিয়ে। সেই যে বিশালদেহী লেমুয়েল গালিভার সমুদ্রতটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে আর অসংখ্য লিলিপুট মানুষ দড়ি আর হুক দিয়ে বাঁধতে চাইছে তাকে। চেনা ছবি।
“ছেলেবেলা থেকেই, বুঝলে ভ্-ভাইটি, গালিভারস ট্রাভেলস্ ছিল আমার অতি প্রিয় ন্-নভেল,” ঘরের ভিতরের দিক থেকে গৃহস্বামীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল অতর্কিতে।
“তাই?” চমক কাটিয়ে দেবাদিত্য বলল, “জোনাথন সুইফট্। সপ্তদশ শতকের আইরিশ যাজক ও লেখক। উত্তর আয়ারল্যান্ডের আলস্টারে বসে উনি যখন এই ফ্যান্টাসি-কাম-স্যাটায়ার লিখছেন, বুঝলি শেরিং, আমাদের দেশে মহারাজ সওয়াই জয়সিংহ তখন যন্তর-মন্তর বানানো শুরু করেছেন জয়পুরে! আওরঙ্গজেব বাদশা দেহ রেখেছেন তার বছর কুড়ি আগে।” বলল দেবাদিত্য পাল, সেল-কন্ট্রাকশনের উপরে পিএইচডি করছে যে, আবার সাহিত্যেও যার অগাধ উৎসাহ।
কথাটা দেবাদিত্য ইংরিজিতে বলল বান্ধবীকে, কিন্তু হাকিমবাবুরও কান এড়ায়নি।
“ওয়েল। ইউ সিম টু বি কো-কোয়াইট ওয়েল ভার্সড…” বললেন প্রশংসার সুরে।
“কিন্তু স্যর, আপনি আমাদের সামনে দর্শন দিচ্ছেন না কেন বলুন তো?” প্রশ্ন দেবাদিত্যের।
ব্যাপারটা এই।
মেহের মঞ্জিলের দোতলার ল্যাবরেটরির লাগোয়া বড় এই যে বৈঠকখানার কৌচে এখন বসবার ঠাঁই হয়েছে দেবাদিত্য আর শেরিং-এর, সে কক্ষের জানালা-দরজাতে মোটা ভারী ভারী কালো পর্দা টাঙানো, আর সেকেলে মহিলাদের পর্দা করার মতো গৃহস্বামী নিজে বসে রয়েছেন এক চিকের আড়ালে। তাঁর অবয়ব দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মুখচ্ছবি স্পষ্ট নয়।
প্রত্যুত্তরে ব্যারিটোন স্বরে হো হো করে হেসে উঠলেন হাকিমবাবু।
“না হে, না, আমি কোনও প্-পর্দানশীন অওরত নই। আমার নিভৃতে থাকার কারণটি তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে।”
ফস করে দেশলাই জ্বালিয়ে এক চুরুট ধরিয়ে ফেললেন উনি। সে মুহূর্তে তাঁর মস্ত মুণ্ডিত মস্তকখানি কয়েক সেকেন্ডের জন্যে দেখা গেল চিকের আড়াল থেকে।
কড়া চুরুটের গন্ধে ভরে উঠল ঘর।
এরপর এ কথা সে কথায় গল্প করে করে নব্য আগন্তুক দুজনের সম্বন্ধে বেশ কিছু তথ্য জেনে নিলেন উনি।
যেমন, “তো-তোমার এই কুশ-পা টি নিশ্চয়ই জ্-জন্মগত?”
পর্দার আড়াল থেকে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ভেসে এল।
“আজ্ঞে হ্যাঁ,” দেবাদিত্যের উত্তর।
“জে এন ইউ-তে প্রফেসর ইরফান খান সাহেব এখনও পড়ান?” ইত্যাদি ইত্যাদি…
গল্প-টল্প শেষে প্রস্তাব দিলেন গৃহস্বামী— “তোমরা যদি সেই বাবার উরসে ফের আসতে চাও ত্-তরশু, তো তদ্দিন আমার এখানেই থেকে যাও না কেন? এ বাড়িতে তো আর ঘরের অভাব নেই। বে-বেকার বেকার ফের কেন সেই শিলিগুড়ি যাবে আবার ফিরবে? আমার গ্-গবেষণা নিয়েও বলব’খন তোমাদের। কথা বলবার লো-লোক পাই না আমি। আমিও তোমাদের লাইনের লোক বটি হে, বোঝলা শেরিং দি-দিদিমণি?” শেষে হেসে বললেন উনি।
সেই ব্যারিটোন ভয়েস।
**
চমৎকার এই বাগানঘেরা প্রাচীন বাড়িটির পরিমণ্ডল বেশ পছন্দ হয়ে গিয়েছিল নব্য দুই আগন্তুকের। তাই এখানেই দুদিন আউটিং-এর প্রস্তাবে মন উৎফুল্ল হয়ে উঠল ওদের।
“একটু যদি হিন্ট দেন, স্যর, কী নিয়ে গবেষণা আপনার…” শেরিং-এরই যেন বেশি উৎসাহ।
“বলব, বলব তোমাদের। নি-নিশ্চয়ই বলব। তার আগে এই পাশের লাইব্রেরিটি ঢুঁড়ে তোমরা ক্রেমলিন ড্রাগস্ নিয়ে কিছু প্-পড়াশুনো করে ফেলো দিকি।”
চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন হাকিমবাবু।
“ক্রেমলিন, মানে সেই রুশ প্রাসাদের কথা বলছেন তো আপনি?” দেবাদিত্যের অবাক প্রশ্ন, “তা সেই রাজপ্রাসাদে পলিটিক্সের চূড়ান্ত হত সে তো শুনেছি, কিন্তু সেখানে যে ঔষধও তৈরি হত তা তো জানতাম না!”
“পড়ো, প্-পড়ো , বাছা। পড়ে জেনে নাও। সবই কি আমি ব্-বলে দেব? লাইব্রেরি ঘরে ঢুকে ডান দিকের দ্বিতীয় তাকে দেখবে ম্-মন্টেফিওরের লেখা স্টালিনের জীবনীখানি রয়েছে। সাদা স্পাইনের মো-মোটা বই। তার পাশেই ক্যাসেটটা রয়েছে। মাইক্রোফিল্ম… ক্-কম্পুটরখানি খুলতে আমার পা-পাসওয়ার্ড লাগে না।”
কাষ্ঠ হেসে বলতে বলতে আসন ছাড়লেন উনি, “কমলা তোমাদের ঘ্-ঘর দেখিয়ে দেবে। নাওয়া-ধোওয়া ভো-ভোজন-বিশ্রাম করে নাও। সন্ধে সাতটায় ফের বসব আমরা। এখানেই।”
প্রাতঃকালীন বৈঠক সাঙ্গ হল।
৪
ক্রেমলিন ড্রাগস্
১৯৯১-তে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়া থেকে সে জমানার বহু বহু অজানা তথ্য মানুষের সম্মুখে ক্রমশ প্রকাশ হয়ে পড়তে থাকে। তার মধ্যে একটা হল ক্রেমলিনের সোভিয়েত নেতাদের শারীরিক সুস্থতা ও তন্দুরস্তি নিশ্চিত করার জন্যে ঔষধি গবেষণা। তার জন্যে তাই ডাক্তার ও গবেষকদের দল ছিল। ক্রেমলিন ড্রাগস্ বিশেষভাবে তৈরি হত ক্রেমলিনের কমিউনিস্ট নেতাদের জীবন ও সুস্থতার জন্যে।
সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ব্রেজনেভের সম্বন্ধে প্রায়-অবিশ্বাস্য তথ্য হল এই যে, ওঁর ‘ক্লিনিকাল ডেথ’ সন ১৯৭৬-এই হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ওই আশ্চর্য ক্রেমলিন ড্রাগস্ দিয়ে দিয়ে ডাক্তাররা তাঁকে সন ১৯৮২ পর্যন্ত ‘বাঁচিয়ে’ রেখেছিলেন। এর মধ্যে তিনি বহুবার পাবলিক মিটিং-এ উপস্থিতও হয়েছেন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতও নেড়েছেন জনতার উদ্দেশ্যে। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট চেরেনেঙ্কো তো…
বিকালবেলায় লাইব্রেরি ঘরে মাইক্রোফিল্মটি খুলে কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে এসব তথ্য পড়তে পড়তে হঠাৎ দেবাদিত্যের দিকে চোখ পড়ে যেতে শেরিং বলল, “তুই কিছু শুনছিস না, দেবু। কী ভাবছিস বল তো অত আনমনে?”
এত তন্ময় হয়ে ভাবছিল দেবাদিত্য যে, বান্ধবীর এই কথাটিও শুনতে পেল না। তার গায়ে আলতো ধাক্কা দিয়ে ফের জিজ্ঞাসা করাতে চমকে “হুঁ… হুঁ… কী?” বলে উঠল সে।
খানিক পরে কোন সুদূর থেকে যেন দেবাদিত্যের গলা ভেসে এল— “শেরিং শোন, এই লোকটাকে আমি যেন আগে কোথায় দেখেছি। ওর গলাটা আমার বড্ড চেনা চেনা লেগেছে। ওই ব্যারিটোন ভয়েস, ওই তুতলে তুতলে কথা বলা, ওই কড়া চুরুটের গন্ধ… বিশেষত ওই সোভিয়েত জমানার উল্লেখে…”
“কী!”
“আচ্ছা, তোর কি একটুও অবাক লাগছে না যে আমরা দুটো উটকো লোক কোত্থেকে এসে হাজির হলাম অপরিচিত এক লোকের বাড়িতে। আমাদের জামাই আদরে হঠাৎ রেখেছেই বা কেন, আর…”
ওদের কথায় বাধা পড়ল লাইব্রেরির দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে।
কমলাদি চা নিয়ে এসেছেন।
এক বড় ট্রে-তে করে একটা সুদৃশ্য টি-পট ও দুইটি পিরিচ ও পেয়ালা উপুড় করে রাখা রয়েছে। টি-পয়ের উপরে সেটা সাজিয়ে রেখে দু-পা পিছিয়ে গিয়ে দু-হাত সামনে জড়ো করে দাঁড়িয়ে রইলেন মধ্যবয়সি বিধবা মানুষটি। পরনে সাদা থান।
“দিদি, কুছ বোলেঙ্গি ক্যা?”
শেরিং তামাং-এর এই সামান্য কথায় ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল কমলাদি।
“ক্যা হুয়া, দিদি? ডিড আই হার্ট ইয়ু?” ব্যগ্র হয়ে শুধোয় তামাং।
“তুমলোগ ভাগো। নহি তো মর যাওগে।”
অশ্রুভেজা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল সে।
“কেন দিদি? আমরা কার কী ক্ষতি করেছি? কে আমাদের মারবে? কেন মারবে?” শুধোয় দেবাদিত্য।
“মারবে না। তোমাদের চুহা বানাকে রাখেগা। জিন্দা পুতলি বানায়গা। নৌকর বানায়গা— অঙ্গুঠি-প্রমাণ!” বলতে বলতে দৌড়ে পালালেন কমলাদি, “রাতে আমি আসব, দরজা খুলে রেখো।”
**
স্তম্ভিত হয়ে গেল দুই তরুণ গবেষক।
তাদের মেরে ফেলবে বলে এখানে ভুলিয়ে ভালিয়ে এনে ফেলেছে এই প্রাচীন অট্টালিকায়? কেন? তারা কার কী ক্ষতি করেছে? তাদেরই বা কেন?
এখানকার সব কিছুই যেন কেমন ধোঁয়াশাচ্ছন্ন।
দেবাদিত্য বলল, “শেরিং শোন। আমার একটু-একটু মনে পড়ছে… আমাদের গ্রাজুয়েশনের সময় সেলসিয়ান কলেজে ফিজিওলজি পড়াতেন প্রোফেসর দাশগুপ্ত। খুব জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। তাঁর বাড়িতে ওঁর মাস্টারমশায়ের সঙ্গে একবার আলাপ হয়েছিল আমার, যিনি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকতেন, পড়াতেন… ছুটিতে তখন বাড়ি এসেছিলেন। শুনেছিলাম, রিমার্কেবল কাজ করেছিলেন উনি মস্কোর পাট্রিক লুমুম্বা ইউনিভার্সিটিতে কোষ-বিভাজন নিয়ে… কিন্তু তিনি নাকি আর ফেরেননি।”
“তাতে কী হল?”
“কিছুই না। তাঁর নাম শুনেছিলাম কী যেন হাকিম… হাকিমসাহেব… পুরো নামটা… কিষেণগঞ্জের মানুষ ছিলেন। এই উত্তরবঙ্গেরই। তিনিই কি আজ এখন আমাদের সামনে…”
৫
ফাইনাল বেল রিঙ্গিং
ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং… গম্ভীর স্বরে কোনও গ্রান্ডফাদার ক্লকে সন্ধ্যা ছ-টা ঘোষণা করল।
ঘড়িটা এই দোতলারই কোথাও আছে নিশ্চয়ই।
আর ছ-টা বাজা শেষ হতেই ভারী পায়ের খটাস খটাস করে কাঠের খড়মের শব্দ নেমে আসতে লাগল তিনতলার ছাদের সিঁড়ি বেয়ে নিচে।
অদ্ভুত মানুষ এই গৃহকর্তা— ভাবল দেবাদিত্য। গায়ে পরেন ঘনরঙা সিল্কের গাউন, ফোঁকেন হাভানা চুরুট আর পায়ে প্রাচীন মুনিঋষিদের মতো কাঠের খড়ম!
লাইব্রেরিতে দুপুরের পাঠ সেরে আর বৈকালিক চা-পান করে ওরা ছাদে একটু পায়চারি করে আসবে ভেবে সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল। একটা হালকা কাঠের দোর দিয়ে সিঁড়ির পথ বন্ধ। ছোট্ট হুড়কোটা সরিয়ে ছাদে উঠে যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে ওই ছ-টার ঘণ্টা বাজা আর ভারী পদশব্দ।
চট করে দুজন পাশের দিকে সরে গেল। ওঁর সঙ্গে মুখোমুখি হতে হল না। চুরুটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আর গলা খাঁকরাতে খাঁকরাতে উনি ল্যাবের ভিতরে ঢুকে গেলেন। পিছন থেকে শেরিং আর দেবাদিত্য ওঁর অপসৃয়মাণ মূর্তিটি দেখতে পেল।
হঠাৎ শেরিং পিছন ফিরে দেখে ছোট্ট এক বালক তার ওড়নার শেষ প্রান্তটা ধরে টানছে। টেনে টেনে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে।
আচ্ছা! এ বাড়িতে কোনও বাচ্চা ছেলেও থাকে নাকি? বেশ তো!
“কী খোকা? কী চাও? কী বলছ?” তার দিকে সামান্য ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করল দেবাদিত্য।
সে এবার দূরের একটা ঘরের বন্ধ দরজার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে কী যেন দেখাতে চাইল। মুখে বাক্যি নেই। ছোট্ট ছেলে একটা। দেবাদিত্যের হাঁটুর সমান। পরনে হাফ প্যান্ট। আদুর গা। গোল মুখমণ্ডল। মাথায় একটাও চুল নেই। প্রতিবন্ধী বালক। বাম হাতটি তার অতীব শীর্ণ।
“কী খোকা? কিছু বলবে? কী চাও?” ভাঙা-ভাঙা বাংলায় শুধোয় শেরিং তামাং।
কিচ্ছুটি না বলে হে-হে-হে-হে করে কেমন এক ফ্যাকাশে শব্দহীন বেদনাময় হাসি হাসতে লাগল সে শিশু। একটাও দাঁত নেই সে মুখগহ্বরে। ফোকলা।
তারপর হঠাৎ কী যেন চোখে পড়তে আর কোনও কথা না বলে বোঁ করে দৌড়ে সেই ল্যাবরেটরি ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল।
দু-এক মিনিট কেমন একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে ওরা দুজনেও ঢুকল সেই ল্যাব-ঘরে।
গৃহস্বামীর ক্লাস অ্যাটেন্ড করতে হবে যে!
**
না, এ ঘরটি পাশের বৈঠকখানাটির মতো সোফাসেট দিয়ে সাজানো নয়। এপাশে ওপাশে বড় বড় টেবিল দু-তিনটে। তার উপরে কাচের নানান সরঞ্জাম— বিকার, ফানেল, টেস্টটিউব ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘরটি কম আলোকিত। উপরে কয়েকটি স্বল্প পাওয়ারের হলদেটে বাল্ব জ্বলছে।
দু-চারটে কাঠের টুল ইতস্তত ছড়ানো রয়েছে। তার দুটি টেনে আলগোছে বসে পড়ল শেরিং আর দেবাদিত্য।
কখন আসবেন উনি?
“তোমাদের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে যে কেন আমি তোমাদের আমন্ত্রণ করে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছি…” উপরের দিক থেকে কথাটা ভেসে এল। যেন কোনও লুকোনো সাউন্ড বক্স রয়েছে। গমগমে কণ্ঠস্বর, কিন্তু বক্তাকে দেখা যাচ্ছে না। অদ্ভুত কনফিডেন্স এবার গৃহস্বামীর কণ্ঠস্বরে। ব্যারিটোন ভয়েস তুতলোচ্ছে না এখন একটুকুও।
“আপনি কোথায়? আপনাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না কেন?” দেবাদিত্য প্রশ্ন করে।
“আমি বসে রয়েছি তোমাদের সামনেই।”
“সে কী?! আর ইউ এন ইনভিজবল ম্যান?” শেরিং-এর জিজ্ঞাসা।
“এচ জি ওয়েলস!” বলে উঠল দেবাদিত্য।
“না, বরঞ্চ জোনাথন সুইফট বলতে পারো,” বক্তার গলায় তরল পরিহাস।
“মানে?”
“ক্রেমলিন ড্রাগসের সম্বন্ধে পড়লে তো? তারও অনেক আগে, উনিশ-শ ত্রিশের দশকে, সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা স্টালিনের ক্লোন তৈরি করতে নিয়োজিত ছিল, জানো কি সেটা? সে চেষ্টা তাদের সফল হয়েছিল কিনা তা বলতে পারব না, কারণ আমি তার অনেক পরে সে দেশে যাই। সাইবেরিয়ান স্টেট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি। মঙ্গোলিয়ার দিকপানে দক্ষিণ-পশ্চিম সাইবেরিয়ার ছবির মতো সাজানো ছোট্ট শহর টোমস্ক। সেখানেই এই প্রাচীন ডাক্তারি ইস্কুল।”
“যেখানে ব্রেজনেভ-চেরনেঙ্কোর মতো বুড়ো বুড়ো সোভিয়েত নেতাদের দুরস্ত রাখতে ক্রেমলিন ড্রাগসের গবেষণা চলত?” বলল দেবাদিত্য। একটু আগেই মাইক্রোফিল্মটায় ওরা এই তথ্য পড়েছে, “তা, আপনি কি সেই প্রকল্পে…”
“তারই একটা সিস্টার প্রজেক্ট ছিল, নাম প্রজেক্ট লিলিপুট! অ-দরকারের সময়ে, যেমন যখন মানুষ ঘুমোচ্ছে বা ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে বা ফ্যামিলির সঙ্গে গল্পগুজব করছে… তখন তাকে লিলিপুট বানিয়ে ছোট করে রাখা। তাতে জীবনীশক্তির অপচয় কমবে। খাদ্য ও বাসস্থানের চাহিদা কমবে। নেতাদের জীবনের দৈর্ঘ্য বাড়বে! পরে আবার দরকার হলে… মানে… এই যেমন দেখো না, দরকার না পড়লে ঘরে কম পাওয়ারের আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়…”
“ডিয়ার স্যর, আপনি যেটা বলছেন সেটা কল্পবিজ্ঞানের গল্প হিসেবে চমৎকার মানায়, কিন্তু আপনি তো আর ঔপন্যাসিক নন, একজন বিজ্ঞানী, তাই না?” শেরিং তামাং বললে ধীরে ধীরে।
“তোমাদের ডান হাতে টেবিলের উপরে দেখো একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দেখতে পাবে…”
সেইটা তুলে নিয়ে সামনের টেবিলের উপরে ধরতে শিউরে উঠল ওরা দুজন! দেবাদিত্য এরই মধ্যে তার হাতের মোবাইল ফোনের টর্চটা অন করে আলো ফেলেছে সেখানটায়।
টেবিলের উপরে খোলা একটা ল্যাপটপের কি-বোর্ডে পা ঝুলিয়ে বসে আছে এক প্রায়-উলঙ্গ মানুষ। বাঁ পা-খানি তার টেবিলের উপরে আলগোছে রাখা। তার উপরে ডান-পা আড়াআড়ি করে রাখা। মুণ্ডিত মস্তক। সম্পূর্ণ উচ্চতা তার এক অঙ্গুলিপ্রমাণ হবে বড়জোর, বা তারও কম!
একটু আগেই চুরুট টেনে থাকবে সে ক্ষুদে মানুষ। কড়া গন্ধটি লেগে আছে। মুখটা সামনে এনে আরও ভালো করে তাঁকে নজর করতে গিয়ে গন্ধটা পেল তারা।
ওরা দুজন মুখ নিচু করে আরও সুতীক্ষ্ণ নজরে সেই লিলিপুটটিকে দেখতে যেতে সেই প্রাণী হাত নেড়ে তাদের ‘হাই’ করল!
“মিস্টার হোস্ট স্যার, আপনি বলতে চান এটা কোনও ম্যাজিক শো নয়? কোনও ট্রিক নেই এতে? মানে… এই যেমন এটি আপনি এখন দেখাচ্ছেন আমাদের।” দেবাদিত্য জিজ্ঞাসা করল।
দু-হাত দিয়ে নিজের কান চেপে ধরে সেই এক আঙুলের মানুষ বলল, “দূরে… দূরে চলে যাও ভাই। দূর থেকে বলো। এত তীব্র কণ্ঠস্বরে আমার কানের পর্দা ফেটে যাবে। দেখছ না, আমি তাই ব্লু-টুথ দিয়ে অ্যামপ্লিফায়ার ব্যবহার করছি, কারণ আমার এখনকার চিঁ চিঁ কণ্ঠস্বর তোমরা শুনতেই পেতে না।”
স্তম্ভিত হয়ে গেল দুই গবেষক।
“ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না বন্ধু… সত্যি বলছি কুস্তি করে তোমার সঙ্গে পারব না… এবার বলি, কেন তোমাদের প্রতি এই আমন্ত্রণ। আমার গবেষণালব্ধ ফল বলছে যে কোনও আজন্ম ত্রুটি থাকা মনুষ্যশরীরে এই ড্রাগ দ্বিগুণ তেজে কাজ করবে।
“কিন্তু কয়েক বছর আগে তেমন এক প্রতিবন্ধীর উপর প্রয়োগে কাঙ্ক্ষিত ফল পাইনি আমি। না তাকে ততটা ছোট করতে পেরেছি, না সে আবার পূর্বাবস্থায় ফিরতে পারছে। তাই আমি আবার… এই দ্যাখো না ভাই দেবাদিত্য, আমি এখন যে ইঞ্জেকশন নিয়েছি, তাতে আট ঘণ্টা পরে আমি পুরনো অবয়বে ফিরে যাব; কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে সেটা চার ঘণ্টাতেই ফলবে কারণ হল তোমার ওই কুশ-পা!”
“ডিজগাস্টিং!” লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হাত থেকে পড়ে গেল দেবাদিত্যের ক্রাচটা। আপনার সাহস তো মন্দ নয়! আপনি আমাকে গিনিপিগ পেয়েছেন?” রাগে থর থর করে কাঁপছে সেই তরুণ গবেষক।
“কিন্তু ভাই দেবাদিত্য, গত মাসে ফিজিওলজিক্যাল সোসাইটির জার্নালে তোমার সেল-কন্ট্রাকশনের উপরে অসাধারণ নিবন্ধটি পড়েই না তোমাকে ফ্রেন্ড-রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম ফেসবুকে। অ্যান্ড নাও উই আর ফেসবুক ফ্রেন্ডস! আর আজ ভোরে টোটোয় চড়ে তোমাদের দুজনকে দাদাবাবার মেলার দিকপানে যেতে দেখেই না মালি আকিলকে পাঠাই তোমাদের নেমন্তন্ন করে এ বাড়িতে আনতে। ভুল করেছি নাকি কিছু আমি?”
ল্যাপটপের কিনারায় বসে পা দুটি এপাশ ওপাশ করে নিতে নিতে নির্বিকারভাবে বললেন হাকিমবাবু। মুখে তাঁর কাষ্ঠহাসি।
রাগে কাঁপছে দেবাদিত্য— “লেটস্ গো।”
“যাবে? চলে যাবে বাবু গো? কিন্তু কী করে যাবে বলো তো? ওই দ্যাখো!”
অবাক বিস্ময়ে ওরা দেখল ওদের পায়ের কাছে টুলের তলা থেকে ঘরের বাইরে বেরোবার দরজা পর্যন্ত দশ ফুট বাই ছয় ফুট মেঝে জুড়ে থিকথিক করছে পিপড়ের মতো হাজারো প্রাণী।
বিস্ময়ের উপরে বিস্ময়— সেগুলো সবই মানুষ! আধ-আঙুল, এক-আঙুল প্রমাণ অসংখ্য প্রায়-উলঙ্গ মানুষের দল। সকলেই মুণ্ডিত মস্তক। জীবন্ত সব্বাই। দাঁড়িয়ে আছে। হাঁটছে। হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। চিঁ চিঁ করে কী সব বলছে তারা সমস্বরে, কিছু বোঝা যায় না।
হতবাক হয়ে গেল ওরা দুজন। এ কী দেখছে ওরা! না কি আসলে দেখছে না, আসলে সবই মায়া, সবই নকল? কোনও সিনেমার দৃশ্য যেন প্রজেক্টর দিয়ে মাটিতে ফেলা হয়েছে!
“যাও। যাও। মাড়িয়ে পিষে দিয়ে চলে যাও না গো এতজন মানুষকে। কে রুখবে তোমাদের? ধ্বংস হয়ে যাক আমার সৃষ্টি, আমার এত বছরের গবেষণার ফসল!” অ্যামপ্লিফায়ারে গম গম করে উঠল হাকিমবাবুর কণ্ঠস্বর।
“বাবু হে, পৃথিবীর মানুষের খাদ্য সমস্যা চিরতরে মিটে যাবে আমার এই প্রজেক্ট সফল হলে। শুধু সোভিয়েত নেতাদের মধ্যে এর সুফল আবদ্ধ না রেখে সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে একে ছড়িয়ে দিতেই না বহু কষ্টে ব্লাডিভোস্টক-জাপান হয়ে দেশে ফিরে এসেছিলাম আমি— মাথার মধ্যে আমার গবেষণালব্ধ ফল নিয়ে!”
বিভ্রান্ত হয়ে দেবাদিত্য শুধোয়, “এ… এ… আমরা কী দেখছি? এরা কারা… এত মানুষজন?”
“তিষ্ঠ, তিষ্ঠ, বৎস। এরা সকলে এ অঞ্চলেরই মানুষ, এ বাড়িরই বেশিরভাগ। নইলে ভাবো না, এত বড় বাড়ি তো আমার ঠাকুদ্দা বানিয়েছিলেন মানুষ থাকবে বলেই, না কি?”
“আর, সেসব মানুষকে ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়ে লিলিপুট বানিয়ে দিয়ে পুষছেন আপনি? আপনার তো জেল হওয়া উচিত। আমরা পুলিশে খবর দেব।” রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললে বিজ্ঞান-গবেষক দেবাদিত্য রাহা।
হে-হে-হে-হে হাসতে হাসতে সেই ‘আকাশবার্তা’ বলে উঠল, “কী চার্জে? কোনও মানুষকে তো মারিনি আমি। ডোয়ার্ফ বানিয়ে দেওয়া ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের কোন ধারায় দণ্ডনীয়, যদি একটু বলে দাও…”
পাক্কা শয়তান লোক একখানি, এই গৃহকর্তা!
৬
শেষ কথা ।। আমি কাজল
নিভা দিদিমণির কাছে ফের বসে আমার গল্পের বাকি অংশটুকু বলেছিলাম এই আমি, ‘কাজল সুন্দরী’।
উনি, দেখো, লিখে দিয়েছেন কেমন সুন্দর করে আমার এই গল্পটা। নাহলে আমি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী— পারতুম কি এত গুছিয়ে লিখতে?
**
মাসখানেক আগের ঘটনা।
দুটো অচেনা লোককে ধরে নিয়ে এসেছিল মালি অখিল। ছেলেটাকে কী সুন্দর দেখতে! ফরসা। এক মুখ দাড়ি। দোষের মধ্যে একটু খোঁড়া। দু-বগলে ক্রাচ নিয়েও হন হন করে হাঁটে। সঙ্গে এক চিনেম্যানের মতো দেখতে মেয়েও রয়েছে। চ্যাপটা-নেকো।
মা তাদের ঘরে বিকালের চা দিয়ে ফিরে এসে আমাদের ঘরের কোণে বসে একমনে কানে কী যেন লাগিয়ে শুনছে। এটা আমি আগেও মা-কে করতে দেখেছি।
শুধোই, “কী শুনছ, মা? রেডিও?”
‘শ্ শ্ শ্ শ্’ করে মুখে আঙুল দিয়ে মা আরও গভীর মনোযোগ দিয়ে কানে কী একটা ঠেসে ধরে শুনতে লাগল।
খানিক পরে সেটা মা তাকে তুলে রেখে দিতে বিকালের ম্লান আলোয় ঠাহর হল না যে সেটা কী ছিল। দড়ি লাগানো সেই জিনিসটা হাতে ধরে দেখতে যেতেই মা ধমকে উঠল আমাকে, “খবরদার এটায় হাত দেবে না। দাদাবাবার আশীর্বাদধন্য জিনিস এটি।”
বললেই কথা শুনব, আমি তেমনই শোধের-বোধের মেয়ে কিনা?
তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে এবার সেটার প্রতি দৃষ্টি হেনে বললুম, “আমার কাছে কী লুকোচ্ছ, মা? এ তো ফকিরদাদার সেই নুলো হাতের তাবিজটা। আমিই তো তোমাকে এনে দিয়েছিলুম এ বস্তু।”
“হ্যাঁ। অসীম শক্তি এ তাবিজের। ফকিরের সঙ্গে নিয়মিত মনোসংযোগে কথা বলতে পারি আমি এর মাধ্যমে। হঠাৎই একদিন তাবিজের এই ক্ষমতা আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম আমি। তারপর থেকে…”
সেই রাতেই সেই চ্যাপটা-নেকো মেয়েটির ঘরে যায় মা। এসে বলল আমায়।
“হে ঠাকুর! হে ভগমান! ওদের প্রয়াস যেন সফল হয়। এই নরপিশাচ হাকিমের হাত থেকে যেন মুক্তি পাই আমরা।”
জোড়হাতে মা প্রার্থনা করে।
**
সেই রাতেই, মাঝরাত তখন, হঠাৎ প্রচুর মানুষের কোলাহলে মুখর হয়ে উঠল মাঠের প্রান্তের সেই মেহের মঞ্জিল। ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠল। পাশের গ্রামের লোকজন অবাক হয়ে ছুটে এসেছে। এ বাড়ি তো মৃত্যুপুরী প্রায়। এখানে যে এত লোক থাকত, কে জানত তা!
শেরিং-এর গায়ের ওড়না টেনে টেনে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নুলো ফকিরচাঁদ হয়তো সেই গ্যাস-সিলিন্ডারেরই সন্ধান দিতে চেয়েছিল, যা স্প্রে করে হাকিমবাবু কখনও কখনও কোনও কোনও লিলিপুটদের ফের পূর্ণ-অবয়বে ফিরিয়ে আনেন তাদের খাঁচা থেকে। বোঝেনি শেরিং সেই ফোকলা ফকিরের কথা। কিন্তু কমলাদির তো বুঝতে বাধা নেই। তার কাছে তো সেই মন্ত্রপূত তাবিজ আছেই। যার মাধ্যমে অধীত বিদ্যাটি শেরিংকে শিখিয়ে বা চিনিয়ে দিয়ে আসে কমলাদি সন্ধেবেলা ওর ঘরে গিয়ে।
**
ভোর হবার আগেই শয়ে শয়ে গ্রামবাসী এসে ঘিরে ফেলে এ অট্টালিকা। লোকাল থানা থেকে পুলিশও এসে গেছে। এমনকী কোনও কোনও টিভি চ্যানেলের মুভি ক্যামেরাও।
ঘোরগ্রস্ত অন্তত জনা পঞ্চাশ ন্যাড়ামুণ্ডি মানুষের কথা শোনা পরিশ্রমের কাজ বটে। কে কী বলতে চাইছে ভিড়ের মধ্যে, বোঝা যাচ্ছে না কিছুই।
বেরোনোর সময়ে ফকিরদাদা অবশ্য সেই দাড়িওয়ালা খোঁড়া দাদাকে বলেছিল, “সবাই উদ্ধার হল, কিন্তু সেই হাকিম শয়তানই অধরা রয়ে গেল। পালায়নি সে কোথাও। কোথায় পালাবে? পালাতে পারবে? হয়তো সে কোনো হাই ডোজ ইঞ্জেকশন নিয়ে কড়ের এক গাঁট-প্রমাণের চেয়েও ছোট্ট হয়ে রয়েছে। চট করে চোখে তাই পড়ছে না। তবে ধরে ফেলবই তাকে। আজ নয় কাল। পালাবে কোথায় সে?”
ছবি – আশিস ভট্টাচার্য
Leave a Reply