হাজারির বাড়ি সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

চারপাশের নির্জনতাকে ভেঙে দিচ্ছিল দুজনের গলার আওয়াজ। আসলে তর্কটা জমে উঠেছিল। পল্লব আর রিকি এক জায়গায় এলেই এমন হয়। তর্কের পারদ বাড়তে থাকে। ক্রিকেট, ফুটবল, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা, রেলের বাজেট এমনকী টিনটিনের কাল্পনিক কাজকর্ম নিয়েও ওরা কখনও একমত হতে পারে না। টিটোর জন্মদিনের পার্টিতে তো তর্ক করতে করতে রীতমত ঝগড়াই বাধিয়ে দিয়েছিল ওরা। অথচ যেখানেই যাওয়া হোক কেউ কারও সঙ্গ ছাড়বে না ওরা। পাশাপাশি থাকবে আর বাদানুবাদ চালিয়ে যাবে।

এবারের তর্কের বিষয়টা ভারী অদ্ভুত। কুসুমপুরের জমিদার বাড়িটা আছে কি নেই। মজা এই যে ওই জমিদার বাড়ির কাছাকাছি রিকির মামারবাড়ি। আর সেখানেই আমরা সবাই, মানে আমি, রিকি, পল্লব, হেনা, টিটো আজই দুপুরে এসে পৌঁছেছি। ওর মামারবাড়ি বড় দিঘিতেই কাল সকালে আমাদের মাছ ধরতে যাবার কথা। বেশ বড় সাইজের মাছ ওখানে খাবি খায়। দেখা যাক আমাদের ভাগ্যে তারা ধরা দেয় কিনা। আজ রাতে এখানেই থাকছি আমরা।
সন্ধেবেলা টাটকা মৌরলা মাছ ভাজা আর ওমলেটের সঙ্গে ট্রেতে করে কাপ ভর্তি কফি দিয়ে গিয়েছিল জগদীশদা। উনি এখন আর ঠিক এ বাড়ির শুধুমাত্র কর্মচারী নন। অনেকদিন থাকতে থাকতে সবার অভিভাবক হয়ে গিয়েছেন। পূর্ণিমার রাত। সন্ধে থেকেই আকাশে বেশ বড়সড় ডিনার প্লেটের মতো চাঁদ উঠেছে। আড্ডার রসভঙ্গ করেই পল্লব সেই সন্ধের সময় গ্রাম ঘুরতে বেরিয়ে গিয়েছিল। কারও বারণ শোনেনি। ও নাকি পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় গ্রাম দেখবে।
রিকি অবশ্য যায়নি। ওই বরং পল্লবকে বলেছিল, “যাচ্ছিস যা। তুই যা বীরপুরুষ। এক্ষুনি ফিরে এসে যেন বলিস না, তোদের গ্রামের কুকুরগুলো খুব ডেঞ্জারাস। এমন ঘেউ ঘেউ করল, ফিরে আসতে বাধ্য হলাম।”

জবাবে সবকিছু নস্যাত করার একটা ভঙ্গি করে কাঁধ ঝাঁকিয়েছিল পল্লব। সন্ধের একটু পরেই বেরিয়েছিল ও। ফিরেছে ঘণ্টা তিনেক বাদে। তখন খাবার ঘরে ডাক পড়েছিল আমাদের। কথাবার্তা তেমন কিছু হয়নি। রাতে গেস্টরুমের ঢালাও বিছানায় শুয়েই কথাটা তুলল রিকি। মামারবাড়িতে এসেও আমাদের সঙ্গেই শুয়েছে ও।

পল্লবের দিকে ও ঘুরে বসতেই আমরা ভাবলাম এই তর্ক শুরু হল বোধ হয়। আসলে হয় কী, পল্লবকে দেখলেই ও, আর ওকে পেলে পল্লব উসখুস করতে থাকে। একদম সাধারণ ভাবেই কথা শুরু করে ওরা। ক্রমশ বাদানুবাদ হতে হতে ওরা পৌঁছে যায় তর্কে। রিকির মামারবাড়িতে সে পর্বটা এড়াতে চাইছিলাম আমরা। কিন্তু ওরা শুনলে তো।

ধাঁ করে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন পল্লবকে ছুঁড়ল রিকি। “কী রে বীরপুরুষ, রাতের কুসুমপুরে এক্সট্রা কী দেখে এলি?”

পল্লব খুব নিরীহ ভাবেই তাকাল ওর দিকে। “না তেমন কিছু দেখিনি। তবে তোদের জমিদার বাড়িটা বেশ লাগল।”

“মিথ্যে বলিস না। জমিদারবাড়ি মানে? এখানে তো সেরকম কোনও প্যালেস-ট্যালেস নেই।”

পল্লব হাসে, “তোর মামারবাড়ির দেশে তোকে আর কী চেনাব বল। ওই যে বড় মাঠটা আছে না, সকালে আসতে আসতে যেটাকে পলাশপুরের মাঠ বললি। ওই মাঠের একেবারে শেষপ্রান্তে সাদা রঙের প্রকাণ্ড বাড়িটা। ওটাই তো।”

“মানে? ওখানে তো ওরকম কোনও বাড়ি নেই।”

“আছে রে বাবা, আছে। চাঁদের আলোয় দেখলাম নেমপ্লেটে লেখা আছে ‘শ্রী সদানন্দ হাজারি’। আমি তো ভেতরেও ঢুকেছি। আসলে কী হল জানিস, সাইকেলে যেতে যেতে দূর থেকে পূর্ণিমার আলোয় বাড়িটাকে যেন তাজমহলের মতো দেখাচ্ছিল। তাই মাঠ ক্রশ করে সোজা পৌঁছেছিলাম ওখানে।”

“গুল মারার জায়গা পাসনি? সকালে আমরা এলাম না ওই মাঠের পাশ দিয়ে। কোনও বাড়ি তো নজরে আসেনি।” জুনা রিকিকে সমর্থন করেই বলে কথাটা।
সাধারণত ওদের কথায় আমরা থাকি না। তবে না উত্তর দিয়ে আর পারি না। এক্ষুনি তর্ক শুরু হয়ে যাবে তো। বলি, “রিকি, গাড়িটা ষাট মাইল স্পিডে চলছিল। পলাশপুরের মাঠ ছাড়া আর কিছু নজর করা মোটেই পসিবল ছিল না। তবে তুই যদি আলাদা ভাবে দেখাতিস, তবে হয়তো দেখতে পেতাম।”
রিকি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, “আমি জানলে তো দেখাব। আমার মামারবাড়ির জায়গা। ছোটবেলা থেকেই আসছি। পলাশপুরের মাঠের পাশে কোনও নকল তাজমহল আছে বলে তো জানি না।”

“আলবাত আছে।” পল্লব তর্কটা শুরুই করে দেয়। “ওই বাড়িতে ঢুকেছি আমি। এখন বাড়ির মালিকরা সব কলকাতায় গেছেন তো। কেয়ারটেকার নিবারণদা আমাকে জল পর্যন্ত দিয়েছে। একতলাটা ঘুরে দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু রাত হয়ে গেছে বলে ফিরে এলাম। ঠিক আছে। কাল সকালেই চল সবাই। চক্ষু কর্ণের বিবাদভঞ্জন করে আসি।”

টিটো তাড়াতড়ি বলে ওঠে, “সকালে তো মাছ ধরার প্রোগ্রাম আছে। তাছাড়া তাজমহল রাতের চাঁদের আলোয় দেখাই তো ভালো।”
সত্যি! মাঠটা অনেক দূরে। সবার জন্য তো সাইকেল পাওয়া যাবে না। রোদের মধ্যে অতদূর গিয়ে ফিরে এসে আবার মাছ ধরা। পরিশ্রমে পোষাবে না। জনাটা ভীষণ পেটুক। ও সোজা প্রস্তাব দেয়, “ঠিক আছে। আমরা সবাই সাক্ষী। বাজিটা ধরেই ফেল তোরা। বাড়িটা থাকলে ফিরে গিয়ে আমাদের সকলকে এগরোল খাওয়াবে রিকি। তখন তো এটা প্রমাণ হয়ে যাবে নিজের মামারবাড়ির দেশের কোনও খবরই রাখে না ও।”

“আর বাড়ি না থাকলে পল্লব খাওয়াবে তো? ও যা কিপটে। কথা রাখলে হয়।” রিকির মন্তব্যে পল্লব তেড়ে যাচ্ছিল আর কী। আমরা থামিয়ে দিই। রাতদুপুরে এমনিতেই যথেষ্ট গোলমাল করা হয়েছে। আর চেঁচামেচিতে শান্তিভঙ্গ করে কোনও লাভ নেই। কিছুক্ষণ আগে জগদীশদা পর্যন্ত চলে এসেছিলেন গোলমালের কারণ জানতে। তাকে উলটোপালটা বুঝিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ঠিক হয় পরের দিন সন্ধেবেলাতেই আমরা সবাই মিলে চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করে আসব। উপরি পাওনা এগরোল। যেই হারুক, আমাদের খাওয়া হচ্ছেই।

 

# # #

 

সকালটা হই হই করে কখন কেটে গেল টেরই পেলাম না। জগদীশদার বানানো মোক্ষম চার নিয়ে বসা হয়েছিল দিঘিতে। শুধু পল্লবই একটা দু কেজির কাতলা ধরতে পেরেছে। জুনা বাঁকা হেসে বলেছেও একবার, “দিনটা পল্লবের ফেভারেই যাবে মনে হচ্ছে।”

ওই দিঘিতেই ধরা একটা পাঁচসেরি কাতলা মাছের ডালনা, ভাজা আশ মিটিয়ে খাওয়া হল দুপুরে। তাছাড়াও রিকির মামিমার হাতের পাঁঠার মাংসের কোর্মা, পায়েসও ছিল। সব মিলিয়ে ভূরিভোজ কিছু কম হয়নি। খেয়েদেয়ে একচোট ঘুমোনোর পর উঠে শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছিল। কারোরই আর হেঁটে অতটা রাস্তা যাবার ইচ্ছে হচ্ছিল না। তবে জগদীশদার বানানো তাজা কফি, কাজু, বিস্কুট আমাদের ক্লান্তি দূর করে দিল।
জগদীশদা বলছিলেন, “ঠাকুর গরম গরম কচুরি ভাজুক, খানকতক করে তোমরা এখনই খেয়ে নাও।”

জুনা বলতে গেল, “আমরা যে…” ইশারায় ওকে থামিয়ে দিল রিকি। “ওসব আমরা রাতেই খাব। এখন সবাই মিলে একটু ঘুরপাক খেয়ে আসি। দুপুরের খাওয়াটা হজম করতে হবে তো।”

জগদীশদা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকান। “কোনদিকে যাবে?”

“এই সামনেই।” রিকি আর বাড়তে দেয় না কথাটা। আমরাও বেরিয়ে পড়ি।

 

###

 

অতদূর হাঁটতে হবে জানলে কেডস পরে আসতাম। মাঠের মুখোমুখি পৌঁছতেই অনেক ঘাম ঝরল আমাদের। বর্ষাকাল। অথচ জোরে বৃষ্টি হয়ে গরম কমছে না। টিপটিপ বৃষ্টিতে, ভ্যাপসা গরমে এতটা পথ হাঁটা খুব কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। জুনার আবার সকালে পায়ে কাঁটা ফুটেছিল। ব্যথা আছে এখনও। তবু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে আমাদের সঙ্গে।

রিকির মামারবাড়ি থেকে রওনা হতে দেরি হয়েছিল। তাই মাঠের কাছে এসে যখন পৌঁছলাম, সন্ধে নেমেছে। আকাশের গায়ে লেগে থাকা এক টুকরো কালো মেঘ বাড়তে বাড়তে কখন যে বড়োসড়ো আকার নিয়েছে, খেয়াল করতে পারিনি। গায়ে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তেই চমকে গেলাম। পূর্ণিমার পরের দিন। অথচ আকাশ মেঘে ঢাকা থাকায় চাঁদের আলো নেই কোথাও। তাই আবছা অন্ধকারে বাড়িটা ঠিক নজরে আসেনি।

পল্লব আঙুল তুলে দেখাল, “ওই দ্যাখ। দূরে সাদা মতন দেখছিস না? ওটাই হাজারিদের বাড়ি।”

মাঠ পেরিয়ে বাড়িটার কাছে পৌঁছে যাব ভাবছি, ঠিক তখনই তেড়ে এল বৃষ্টিটা। আমরা সঙ্গে সঙ্গে দৌড় লাগিয়েছি। লক্ষ্য ওই বাড়ি।
হাজারদের কাজের লোক নিবারণদা মানুষটা বেশ ভালো। আমাদের গা-মাথা মোছার জন্য পরিষ্কার তোয়ালে এনে দিল। বাইরের ঘরে জুত করে বসার পর চা-বিস্কুটও এল আমাদের জন্য। এমনিতে সবসময় চা না খেলেও বৃষ্টিতে গরম চা পেয়ে বেশ ভালোই লাগল।

রিকিই তুলল কথাটা। “এতবড় বাড়ি ফাঁকা থাকে কেন?”

“ফাঁকা থাকে না তো। কর্তা-গিন্নি থাকেন। আজই ওনারা কলকাতা গেছেন। ছেলে-বউ নাতির সঙ্গে দেখা করতে। এই এলেন বলে। তোমরা একটু বসলেই দেখা হয়ে যাবে।” নিবারণদা হাসেন।

বেশ বড় বৈঠকখানা। মাথার ওপরে বিজলি বাতির বিশাল ঝাড়লণ্ঠন। দেওয়ালে পুরনো আমলের কিছু অয়েল পেন্টিং। পুরো ঘরের সাজসজ্জায় একটা বনেদিয়ানা। আধুনিকতা আর প্রাচীনতা যেন একে অপরের হাত ধরেছে। নরম গদিওলা বড় বড় সোফায় অর্ধেক ডুবে বসেছি আমরা। পল্লব আর রিকি বসেছে মুখোমুখি।

টিটোই তুলল কথাটা। “বাজিটা আর একটুই বড়োসড়ো ধরলে ভালো হত। নেহাতই এগরোলের ওপর দিয়ে গেল।”
রিকি কটমট করে তাকাল ওর দিকে। আমি থামাবার চেষ্টা করি। “আঃ! ছাড় না। তোদের ঝামেলা না বাধালে চলে না। লোকের বাড়ি এসেও রেহাই দিবি না?” কথা চালাচালি হয়তো আরও কিছুক্ষণ চলত। যদি না বড় একটা ট্রে নিয়ে নিবারণদা ঢুকত ঘরে। ট্রেতে সারসার অনেকগুলো প্লেট। দুটো বড় বড় রাজভোগ আর কিছু কুচো নিমকি, পাঁপড় ভাজা সাজানো রয়েছে প্রত্যেকটা প্লেটে। আমরা সমস্বরে বলে উঠি, “এসব আবার কী? এইমাত্র খেয়ে এলাম। না, না এসব নিয়ে যান।” নিবারণদা হাসে। “আরে ছেলেমানুষ তোমরা। তাছাড়া অতিথিসেবা না করলে বুড়ো বয়সে গিন্নিমার বকুনি খেয়ে মরতে হবে।”

আড়চোখে তাকিয়ে দেখি জুনা ততক্ষণে একটা পাঁপড়ে কামড় বসিয়েছে। ছেলেটা এমনই। খাবার জিনিস সামনে এলে অপেক্ষা করা ওর ধাতে নেই।
বাইরের ঘরেই জমিয়ে বসেছি আমরা। কিছুক্ষণ এখানেই কাটাতে হবে তো। বৃষ্টি ঝেঁপে এসেছে। তার সঙ্গে প্রচণ্ড হাওয়ার দাপটে পরিবেশটা বেশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। সঙ্গে ছাতাও আনিনি। হয়তো ভিজে ভিজেই ফিরতে হবে। তবে এই দুর্যোগে এক্ষুনি ফিরতে হলে বিপদ ঘটতে পারে। তাই অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই।

বসে থাকাটা ক্রমশ একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল। নিবারণদাকে বললাম, “আমরা বাড়ির ভেতরটা একটু ঘুরে দেখতে পারি?”

“সিংহী বাড়ির নাতির বন্ধু তোমরা। ও বাড়ির সঙ্গে বহুকালের যোগাযোগ এ বাড়ির। নিশ্চয়ই ঘুরে দেখবে বাড়িটা।” নিবারণদা হাসে আবার। রিকি অবাক হয়।

“আমার মামাদের চেনেন?”

“কেন? কালই তোমার বন্ধু ওনাদের কথা বলল তো। এখানের সব পুরনো বাসিন্দাদেরই চিনি আমরা। তবে দাঁড়াও। একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে আনি। এখানে বড় লোডশেডিং হয় তো।”

 

###

 

নিবারণদার পিছুপিছু আমরা বাড়ির ভেতরে ঢুকি। পেতলের কারুকার্য করা হ্যারিকেন ঝুলছে নিবারণদার হাতে। তার অবশ্য দরকার ছিল না। বড় বড় টিউব লাইটের আলোয় চারদিক ঝলমল করছে। তবে অস্বস্তির কারণ ঘটল একটা। ভেতরে ঢুকতেই ইয়া লম্বা এক এ্যালসেশিয়ান অভ্যর্থনা জানাল আমাদের। জুনার কুকুরে মারাত্মক এলার্জি আছে। ও আমার হাতটা শক্ত চেপে ধরে। মুখ ভয়ে সাদা। বিশালদেহী জীবটা আমাদের পালা করে শুঁকছিল তখন।
নিবারণদা সেই মোক্ষম কথাটাই উচ্চারণ করে। “আরে ভয় পেও না। ডোনা তোমাদের কিছু করবে না।”

ভয় একটু করছিল বৈকি। তবে ভালো করে শুঁকে-টুঁকে যেমন এসেছিল, তেমনই নিঃশব্দে চলে গেল কুকুরটা। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

বাড়িটা দোতলা। একতলায় বসার, খাওয়ার, রান্নার ঘর ছাড়াও একটা ঘরে কাঠের নিচু চৌকির ওপর সাদা ফরাস পাতা আছে দেখলাম। আমাদের উৎসুক দৃষ্টির উত্তরে নিবারণদা জানায়, “এ ঘরে আগে জমিদারির কাজকর্ম হত। এখন বাবুর বন্ধুরা এসে গল্পগুজব করেন।”

দোতলায় ঘরগুলোর সামনে টানা বারান্দা। মেঝে চমৎকার সাদা মার্বেলের। পুরনো হলেও দিব্যি চকচক করছে। একদম শেষপ্রান্তের দরজা খুলে আমাদের ছাদ দেখাল নিবারণদা। নজরে এল বাহারি ফুলের টবে সাজানো আধখোলা ছাদ। বৃষ্টির দাপট চলছে তাই বাইরে যাবার প্রশ্ন নেই।

শোবার তিনটি ঘর ছাড়া লাইব্রেরি ঘর আছে একটা। দেওয়ালের বড় বড় আলমারিতে বিভিন্ন ভাষার বিখ্যাত সব লেখকদের বই। মনে হয় কয়েক পুরুষের সংগ্রহের ফল। বাদবাকি সাজসজ্জা অবস্থাপন্ন বাড়ির মতোই। বাড়তির মধ্যে কয়েকটি বেশ বড় মাপের আয়না, বারান্দার দেওয়ালে সার সার টাঙানো। নিবারণদা জানায় এসব বাবুর ঠাকুরদার আমলের, আসলে বেলজিয়াম কাচের।

হাওয়ার বেগ ক্রমশ বাড়ছিল। হঠাৎ কানে এল কুকুরটা চিৎকার করতে করতে বাইরের দিকে ছুটছে। নিবারণদা আতঙ্কিত গলায় বলে, “ডোনা অমন চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটল কেন? ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে। বাবুরও তো আসার সময় হল।”

সিঁড়ি দিয়ে নিবারণদার পিছু পিছু নেমে আসি আমরা। অদ্ভুত! এত বড় বাড়িতে আর কোনও কাজের লোক নেই? নীচের বারান্দায় নেমে আসার পর দেখি সদর দরজাটা হাট করে খোলা। হ্যারিকেনটার আলো কমিয়ে দেওয়ালের একপাশে রাখা। দূরে কুকুরটা দৌড়চ্ছে। পেছন পেছন ছুটছে নিবারণদা। আমরা নীরব দর্শক। বৃষ্টিতে মাথা বাঁচাতে আমরা এক অপরিচিত বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছি।

হঠাৎ দপ করে নিভে যায় আলোগুলো। লোডশেডিং হবার আর সময় পেল না। ভাগ্যিস হ্যারিকেনটা রেখে গিয়েছে নিবারণদা। আমরা সবাই ছটফট করছিলাম। আসলে বোঝা যাচ্ছিল ভয়ানক কিছু একটা ঘটেছে। নাহলে বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও কেউই ফিরছে না কেন? রিকি বলল, “বৃষ্টিতে ভিজলে বাড়ি গিয়ে স্নান করে নেব। চল গিয়ে দেখি কী হল। মানুষটা কোথায় গেল?”

বাইরে পা রাখতেই ঝড়ো হাওয়ায় হ্যারিকেনটা গেল নিভে। অন্ধকার মাঠে হাত ধরাধরি করে আমরা এগোতে থাকি। তবে বেশি দূর যেতে হল না।
ঝড়বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল তখন। মাঝে মাঝে তার সাদা আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠছিল চারপাশ। তারই আলোয় হঠাৎ ঝলসে উঠল সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য।

দূরে একটা গাড়ি কেমন যেন বেখাপ্পা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কুকুরটা ঘুরছে তার চারপাশে। নিবারণদাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। শুধু কুকুরটার বীভৎস গোঙানির আওয়াজ বলে দিচ্ছে একটা বিরাট অঘটন ঘটে গিয়েছে।

আমরা এগোতে যেতেই টিটো আপত্তি করে। “থাক না। এই অন্ধকারে…”

যদিও ওর কথা শুনি না আমরা। বিপন্ন মানুষগুলোকে সাহায্য না করাটা ভীষণ অমানবিক হবে। ঘন অন্ধকারে ওই দিকটা লক্ষ্য করে এগোচ্ছিলাম তখন। পুরোটা যেতে হয়নি। আবার চমকে ওঠা বিদ্যুতের আলোয় নজরে এল কিছুই নেই কোথাও। একদম ধূ ধূ করছে ফাঁকা মাঠ। কে জানে? হয়তো মনের ভুল। অবাক হয়ে পেছন ফিরি আমরা। দ্রুত হাঁটতে থাকি বাড়িটার দিকে। এই বৃষ্টিতে একটা আশ্রয় চাই তো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজা ভীষণই অসম্ভব।

ওই তো বাড়িটা। সাদা ধবধবে শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটার একদম কাছাকাছি আসতেই অদ্ভুত কাণ্ড হয় একটা। ঝুরঝুর করে ওটার শরীর খসে পড়তে থাকে। আর আস্তে আস্তে আমাদের চোখের সামনেই মাটির সঙ্গে মিশে যায় সম্পূর্ণ বাড়ি। সে এক ভয়ানক দৃশ্য। আমরা বুঝতে পারি শরীর মন দুইই কেমন আলাগা হয়ে আসছে। তারপর কী হয়েছিল কারোরই তেমন মনে নেই। পরদিন সকালে আমাদের ঘুম থেকে ডেকে তোলেন জগদীশদা। ওঁরা নাকি রাতে খুঁজতে খুঁজতে মাঠে আমাদের হদিশ পান। স্নান সেরে আমরা জিনিস গুছিয়ে নিতে থাকি। রওনা দিতে হবে। জগদীশদা দু-তিনটে টিফিনকৌটোয় আমাদের খাবার গুছিয়ে দেন। পথে জমিয়ে খাওয়া যাবে।

 

###

 

বেরোবার আগে খেতে বসে ডাইনিং টেবিলেই উঠল কথাটা। রিকির মামা বললেন, “কাউকে কিছু না বলে এভাবে অতদূর যাওয়াটা ঠিক হয়েছিল কি?”
আমরা চুপ করে থাকি।

“কী হয়েছিল আমাকে বলবে? বৃষ্টি থেমে যাবার পরও তোমরা ফিরছ না দেখে জগদীশ আমাকে খবর দেয়। গাড়ি নিয়ে খুঁজতে বেরোই তোমাদের। শেষে খুঁজতে খুঁজতে দেখি পুবের দিকে, হাজারিদের মাঠে, পাশাপাশি শুয়ে আছ তোমরা। কাদায় জলে মাখামাখি। জ্ঞানও ছিল না তখন। শেষে ডাক্তার ডেকে… কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড বাধিয়েছিলে বলো তো।”

আমাদের তখনও মুখে কোনও কথা নেই। শুধু জুনা বলে ওঠে, “জগদীশদা ওই মাঠের নাম হাজারির মাঠ হলো কেন? হাজারি বলে কেউ ছিল নিশ্চয়ই ওখানে।”

জগদীশদা ভ্রু কুঁচকে তাকায় আমাদের দিকে। “কেন? তোমরা কিছু শুনেছ নাকি?”

“না, না। মামাই নামটা তো করলেন এইমাত্র।” রিকি সামলায় ব্যাপারটা।

“ছিল বৈকি। এ গ্রামের জমিদারই তো ছিল ওরা। বিশাল সম্পত্তি। প্রাসাদের মতো বাড়ি… একদিনের এক দুর্ঘটনায় সব শেষ হয়ে গেল।”

“দুর্ঘটনা?” চমকে উঠি আমরা।

“ওসব শুনতে-টুনতে হবে না। তোমরা তাড়াতাড়ি নাও তো। অতদূর যাবে।”

অগত্যা উঠে পড়ি আমরা। যা জানার তা তো জস্নসি হয়ে গেছে।

ফেরার সময় ওই মাঠের পাশ দিয়েই আসতে হল। ওদিকে তাকিয়ে জুনা বড় করে শ্বাস ফেলে একটা।

আমি বলি, “কী হল?”

ও হাসে। “ভেবেছিলাম কলকাতায় ফিরেই এগরোল খাব। পুরোটাই ভেস্তে গেল।”

টিটো বলে, “কেন? এক্ষেত্রে দুজনেরই তো রোল খাওয়ানো উচিত। আমরা নিজের চোখে দেখেছি বাড়িটা ছিল। আবার এখন তো বলতেই হবে বাড়িটা নেই।”

রিকি ফিসফিসিয়ে ড্রাইভারের কান বাঁচিয়ে বলে, “আচ্ছা কাল রাতের ব্যাপারটা কেমন দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে না?”

পল্লব জবাব দেয়, “না। দুঃস্বপ্ন মানুষ একা দেখে। আমরা সবাই পুরো ঘটনাটার সাক্ষী তো!”

 

ছবি – সুমিত রায়

গল্পটি টগবগ-এর সরল দে সংখ্যায় প্রকাশিত

Leave a Reply

Your email address will not be published.