ভাঙবে তবু মচকাবে না! অমিয়র কথা বলছি।

হোস্টেলের তিনতলায় আমাদের ঘরে থাকত অমিয়। কথাটা হল, তার বেজায় ভূতের ভয়, কিন্তু কিছুতেই সেটা স্বীকার করবে না।

প্রথমে বলি, তার যে অমন ভূতের ভয় সেটা আমরা জানলাম কী করে।

সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠলে প্রথমেই মুখোমুখি পরে ক্যান্টিন। ক্যান্টিনের দু-পাশে পাঁচটা পাঁচটা করে দশটা ঘর, এক সারিতে, পাশাপাশি, সামনে লম্বা টানা বারান্দা। আর ক্যান্টিনের উলটোদিকে সিঁড়ির একপাশে বাথরুম, অন্যপাশে কমন রুম— যেখানে টিভি, ক্যারম বোর্ড ইত্যাদি ইত্যাদি আছে। ক্যান্টিনের পুবদিকে ৩০৫ নম্বর ঘর ছেড়ে ৩০৪-এ অমিয়কে নিয়ে থাকি আমরা চার বন্ধু। পাশের ঘর ৩০৫-এর ঠিক উলটোদিকে, বারান্দার ওপারে বাথরুম।

বারান্দা থেকে আমাদের ঘরে ঢোকার দরজার পাশেই একটা ছোট জানালা, জানালার পাশের বেডে থাকে সিধু। আর উলটোদিকে দেয়ালজোড়া জানালার নিচে পাশাপাশি তিনটে বেড— একপাশে আমি, মাঝখানে ফেলু আর অন্য কোণে অমিয়। ঘরের মধ্যে আসবাব বলতে চারটে লোহার বেড ছাড়া প্রত্যেকের একটা করে টেবিল, আর একটা করে বেঁটে টিনের আলমারি— যাকে আমরা বলি লকার।

অমিয়র চেহারাটা ফরসা রোগা তালঢ্যাঙা লিকলিকে সুপুরি গাছের মতো, ঝাঁকড়াচুলো মাথাটা অ্যাত্তো বড়ো, আর পায়ের পাতা দুটোও হাঁসের মতো চ্যাটালো আর বিশাল বিশাল। আমরা বলি, ‘পা তো নয়, যেন বইঠা!’ অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে, বোঝা যায় ছোট থেকে বাপ-মায়ের আদরে মানুষ। বিচিত্র একটা অভ্যেস ছিল তার। রাত্রে যদি কখনও ঘুম ভেঙে যায়, জলতেষ্টা পেল কি বাথরুম যাওয়ার দরকার পড়ল, কখনোই সে চোখ খুলবে না, চোখ বন্ধ রেখেই হাতড়ে হাতড়ে আন্দাজে বাথরুম যাবে। একবার চোখ খুললেই নাকি তার ঘুম চটকে যাবে, তারপর আর কিছুতেই ঘুম আসবে না সারারাত! তাই এই ব্যবস্থা।

তা, একদিন হল কী— সেদিন ছিল শনিবার, পরদিন কলেজ ছুটি, আর এক হপ্তা পরেই পুজোর ছুটিও পড়ে যাবে, সবাই বেশ ফুর্তিতে তাই। সে মাসের মেস ম্যানেজার দিলুদা রাত্তিরে বেশ জমকালো খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল— লুচি, পাঁঠার মাংস, চাটনি, মিষ্টি আর সবশেষে কোল্ড ড্রিঙ্কস। খেয়েদেয়ে ঘরে ঘরে অনেক রাত অবধি জমিয়ে আড্ডা চলল। তারপর একে একে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল সবাই। রাত তখন গভীর, তিনটে সাড়ে-তিনটে হবে, হোস্টেল নিঃঝুম। হঠাৎ বারান্দায় এক বিকট শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড় করে উঠে বসে দেখি ঘরের দরজা খোলা, বাইরে বারান্দা থেকে অমিয় আঁ-আঁ করে চিৎকার করে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বারান্দায় বেরিয়ে দেখি, মেঝেয় গড়াগড়ি যাচ্ছে অমিয় আর ‘ভূত, ভূত’ করে পরিত্রাহি ডাক ছাড়ছে, পাশে পড়ে আছে একটা টিনের লকার। হয়েছে কী, একটা বাতিল জং ধরা পুরনো লকার কেউ ঘর থেকে বার করে বারান্দায় আমাদের ঘরের বাইরেই রেখেছিল, অমিয় বাথরুম যাবে বলে চোখ বন্ধ অবস্থায় বেরিয়ে ওতে সটান ধাক্কা খেয়ে লকার-টকার সবশুদ্ধু নিয়ে মেঝেয় পড়ে গড়াচ্ছে। ততক্ষণে অন্যান্য ঘর থেকেও সবাই বেরিয়ে এসেছে চটপট, বারান্দা আর ঘরগুলোর আলো জ্বলে উঠেছে সব। অমিয়কে ধরাধরি করে তোলা হল টেনে, কিন্তু তখনও সে ‘ভূত, ভূত’ বলে চিলচিৎকার করেই যাচ্ছে, থামার নাম নেই, আর এত কাণ্ডের পরও তার চোখ তখনও বন্ধ।

“ওরে, চোখ খোল, ভূত কোথায়? এই লকারটায় ধাক্কা খেয়ে তো পড়লি! অমন ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচাচ্ছিস কেন?” বলল ফেলু। কে শোনে কার কথা! অমিয় চোখ খোলার পাত্রই নয়, ঘুম চটে যাবে না? অগত্যা সেই চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ওকে ধরে ধরে বাথরুম থেকে ঘুরিয়ে এনে জল-টল খাইয়ে ফের ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হল।

অথচ, কী বেইমান, ও যে ভূতের ভয় পায়, পরদিন সকালে অমিয় সেটা বেমালুম অস্বীকার করে বসল! সবাই মিলে ছেঁকে ধরা হয়েছিল ওকে।

“ভ্যাট, ভূতের ভয় পাব কেন? আমি কি বাচ্চা ছেলে? এখানে এই হোস্টেলে ভূত আসবে কোত্থেকে?” বলল অমিয়।

“বটে! তাহলে অমন ভূত-ভূত করে বাড়ি মাথায় করছিলি কেন?” চেপে ধরল বগাদা।

“চ্যাঁচাচ্ছিলাম তো ব্যথায়! লকারটা পায়ের পাতার ওপর উলটে পড়ল কিনা! এই দ্যাখো কেমন কালশিটে পড়ে গেছে!”

“অ! ব্যথা লাগলে লোকে বুঝি ভূত-ভূত বলে চ্যাঁচায়!”

“আরে, রাত্রে জম্পেশ একটা ভূতের স্বপ্ন দেখছিলাম। প্রায় ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে গেছি, এমন সময় লকারের ধাক্কায় ভেস্তে গেল অমন সুন্দর স্বপ্নটা!”

মোট কথা, কিছুতেই অমিয় মানল না সে ভূতের ভয় পেয়েছিল। বগাদাও সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। মিচকি হেসে আমাদের ফিসফিস করে বলল, “হুমম, রাত্রে বাথরুম যাওয়ার সময় অমিয় চোখ খোলে না কেন বুঝতে পারছিস এবার? ঘুম চটে যাবে না ছাই!” তারপর গম্ভীরভাবে অমিয়কে বলল, “এখানে ভূত আসবে কোত্থেকে মানে? এই হোস্টেল কতকালের পুরনো তুই জানিস? খোঁজ রাখিস এর ইতিহাসের? বলে ভূত আসবে কোত্থেকে! ওরে, এই হোস্টেলবাড়ির আনাচে কানাচে ভূত, গিজগিজ করছে ভূতে! রাত্রে চোখ খোলা রাখলে তো দেখতে পাবি! আমি তো কতবার দেখেছি তার ঠিক নেই! তবে ভয় পাইনি। ভয়ের কী আছে? তেনারাও আমাদেরই মতো, শুধুমুধু ঝামেলা করে না। অবশ্য তোর মতো যারা ভয় পায় তাদের আরও বেশি বেশি ভয় দেখায়, ভয় দেখিয়ে মজা পায়।”

বগাদার কথা শুনে ফেলু উৎসাহে লাফিয়ে উঠল, “তাই নাকি বগাদা? ভূত আছে এখানে? দেখাবে আমাদের? আমার খুব ভূত দেখার শখ, ছোটোবেলা থেকে। সবাই দেখব আমরা।”

বগাদা আমাদের থেকে দু-বছর সিনিয়র, আমরা সবে ফার্স্ট ইয়ার। গম্ভীরভাবে বলল, “দেখাতেই পারি, না দেখানোর কী আছে? তবে তোরা আবার অমিয়র মতো ভয়ে অক্কা যাবি না তো?”

“না না, অমিয়ও দেখবে। ও তো বলছে ভূতের ভয় পায় না। ও কি বাচ্চা ছেলে!” চোখ টিপে বলে ফেলু, “তাই তো অমিয়?”

“না না, মানে, ভ-ভয় পা-পাব ক্-কেন!” আমতা আমতা করে বলে অমিয়, চোখ দুটো তার তখনই গোল গোল হয়ে গেছে, চুল খাড়া, “এ হোস্টেলের ইতিহাসের কথা ক্-কী বলছিলে বগাদা?”

“সে অনেক কথা,” বগাদা গম্ভীরভাবে বলল, “সময় নিয়ে গুছিয়ে বলতে হবে। পুজোর ছুটি কাটিয়ে হোস্টেলে ফিরে আয় সব, বলব এক রাতে। ভূতও দেখিয়ে দেব।”

 

সুতরাং, পুজোর ছুটির পর কলেজ যে দিন খুলল সেদিনই রাত্রে বগাদার ঘরে আমাদের গোপন মিটিং বসল, অবশ্যই অমিয়কে বাদ রেখে। অমিয়কে ভূত দেখানোটাই আমাদের আসল উদ্দেশ্য কিনা!

“এক কাজ করলে হয়,” বলল সিধু, “রাত্তিরে চার-পাঁচজন মিলে সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে বাথরুমে লুকিয়ে থাকব, হাত দুটো উঁচু করে। বাথরুমে ঢুকেই অমিয়র হয়ে যাবে!”

“দূর!” বলল ফেলু, “অমিয় তো চোখ বন্ধ করে বাথরুমে যায়, দেখবে কী করে আমাদের?”

“তাছাড়া, সে কখন বাথরুমে যাবে, আদৌ যাবে কিনা, কে জানে! সারারাত বাথরুমে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাব নাকি?” বলল বগাদা।

“তা ঠিক,” বললাম আমরা সবাই, “তা হলে?”

“আমার মাথায় একটা আইডিয়া আছে, পুরো ছুটিটা বসে বসে ভেবেছি,” ষড়যন্ত্র করার ভঙ্গিতে চাপা স্বরে বলল বগাদা। আমরা আরও কাছাকাছি ঘনিয়ে এলাম।

জব্বর এক ফন্দি এঁটেছে বটে, মানতেই হল সকলকে!

 

পরিকল্পনামাফিক পরদিন রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর আমাদের ঘরে এসে আড্ডা জমিয়ে বসল বগাদা। অমিয়ও হাজির ঘরে। একথা সেকথা চলতে চলতে হঠাৎ বগাদা বলে উঠল, “সামনের পূর্ণিমায় ভূত দেখার একটা সুবর্ণ সুযোগ আছে এখানে। দেখবি নাকি অমিয়?”

“পূর্ণিমায় ভূত! ভূত তো শুনি অমাবস্যায় বেরোয়!” বলল অমিয়।

“তোর মাথা!” বলল বগাদা, “ভূতের আবার পূর্ণিমা-অমাবস্যা কী? সবসময়ই আছে তারা, আমাদের আশেপাশেই, এমনকি দিনের বেলাতেও। অমাবস্যার অন্ধকারে আমরা নিজেরাই ভয় পাই, সেই সুযোগে ওরাও বেশি বেশি দেখা দেয়, ভয় দেখায়। অন্য সময় অত খেয়াল করি না, ওরাও পাত্তা দেয় না। তাছাড়া, জন্মদিন সেলিব্রেট করতে ভূতেরা বাধ্য, সেদিন ওরা দেখা দেবেই, সে অমাবস্যাই হোক কি পূর্ণিমা।”

“ভূতের জন্মদিন! মানে?” আমরাও খুব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করি।

“আরে বাবা, কোনও মানুষের যেদিন মৃত্যুদিন, তার ভূতের সেদিন জন্মদিন, ঠিক কিনা? এই নভেম্বর মাসের পূর্ণিমা তিথিতে প্রতি বছরই দুজন ভূতকে এই হোস্টেলের ছাদের ওপর দেখা যায়। জন্মদিন সেলিব্রেট করতেই আসে ওরা, কিংবা মৃত্যুদিন, যেভাবেই বলিস না কেন! ওই তিথিতেই দুজন বেঘোরে মরেছিল কিনা! দুজনের একজন আবার সাহেব ভূত!”

“সাহেব ভূত! মানে ইংরেজ? এই হোস্টেলের ছাদে?” কৌতূহল যেন বাধ মানে না আমাদের!

“তবে আর বলছি কী! এ কলেজের বয়স কি কম হল? স্বাধীনতার প্রায় নব্বই বছর আগে প্রতিষ্ঠিত। আমাদের হোস্টেল বাড়িটাও তো ইংরেজ আমলের। বলছিলাম না, এর ইতিহাসের কতটুকু জানিস তোরা! সবে তো ফার্স্ট ইয়ার!”

“উফফফ, সাহেব ভূত! ভাবা যায় না! অবশেষে আমার ছোটোবেলার স্বপ্ন পূর্ণ হবে!” উৎসাহে টগবগ করে উঠল ফেলু।

“বেশ, সবাই মিলে তৈরি থাকিস। প্রতি বছর ওই বিশেষ তিথিতে এক রোমহর্ষক নাটকের শেষ দৃশ্য অভিনীত হয় আমাদেরই হোস্টেলের ছাদে। গত দু-বছর দেখেছি আমি, এবার তোদেরও দেখিয়ে দেব,” গম্ভীরভাবে বলল বগাদা, “কী রে অমিয়, ভয় পাবি না তো?”

অমিয় কিছু বলার আগেই সাততাড়াতাড়ি আমরা সবাই একসঙ্গে বলে উঠলাম, “না না, ভয় পাবে কেন? ও কি বাচ্চা ছেলে? তাও ওকে না হয় আমরা চারদিক থেকে ঘিরে থাকব সবাই!”

 

অবশেষে সেই পূর্ণিমা এল। আর তর সইছিল না আমাদের। রাত্তিরে তাড়াতাড়ি খেয়ে এসে বগাদার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “বগাদা, কখন?”

“দাঁড়া, এখনই কী! ঠিক রাত বারোটার সময়। সাড়ে এগারোটায় হোস্টেলের ঘর-বারান্দার সমস্ত আলো নিভিয়ে দিতে হবে।”

বারোটা বাজল। বগাদার নেতৃত্বে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে তিনতলা থেকে চারতলা পেরিয়ে ছাদের দিকে উঠতে শুরু করলাম আমরা। আমরা মানে তিনতলার প্রায় সবাই, কেবল দিলুদা, নব আর দু-একজনকে চারপাশে কোথাও দেখা গেল না, হয়তো আগেই ছাদে উঠে গেছে। অমিয়কে অবশ্য সন্ধে থেকেই চোখে চোখে রেখেছি সবাই, এখনও চারদিক দিয়ে ঘিরে সঙ্গে নিয়ে চলেছি।

বগাদা আগে থেকেই বলে দিয়েছে, কোনও কথাবার্তা নয়, শব্দ নয়, একেবারে চুপিসারে এগোতে হবে। সিঁড়ি উঠতে উঠতেও মুখে আঙুল দিয়ে চুপ থাকার ইঙ্গিত করছে বার বার।

ছাদের দরজা দেখি এত রাতেও হাট করে খোলা। বাইরে জ্যোৎস্না ফটফট করছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি। ঠান্ডা পড়ে গেছে বেশ। চারদিক নিস্তব্ধ। কোথাও কোনও শব্দ নেই। না, ভুল বললাম। আছে! একটা খট খট শব্দ আসছে না জানি ছাদের কোথা থেকে, টানা চলছে শব্দটা। কিন্তু দরজা দিয়ে ছাদে বেরিয়ে কোথাও তো কাউকে চোখে পড়ল না! ছাদ ফাঁকা। কেউ কোত্থাও নেই।

সবাই ছাদের মাঝখানে জড়ো হবার পর সিঁড়ির ঘরের দিকে ফিরে দাঁড়াল বগাদা, তারপর ইশারায় সে ঘরের একপাশে দেখাল। সেদিকে আমাদের জলের ট্যাঙ্ক, সিমেন্টের বাঁধানো ট্যাঙ্ক, বেশ বড়। তার ওপর চোখ পড়তেই দেখা গেল দুজনকে।

ট্যাঙ্কের মাথায় ডুয়েল লড়াই চলছে… এক সাহেব, কালো কোট-প্যান্ট পরনে, কোমরে চওড়া বেল্ট, মাথায় হ্যাট… আর এক সেপাই, তার পোশাক ইংরেজ আমলের ভারতীয় পুলিশের মতো, মাথায় লাল পাগড়ি… দুজনের হাতেই খোলা তলোয়ার, চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে… সেই দুই তলোয়ারের ঠোকাঠুকিতেই আওয়াজ উঠছে… ঠক ঠক।

তুমুল লড়াই চলছে। একবার তলোয়ার ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে যাচ্ছে সাহেব, পরক্ষণেই প্রতি-আক্রমণে তেড়েফুঁড়ে সাহেবকে পিছু হঠতে বাধ্য করছে সেপাইটি। এবার আস্তে আস্তে তাদের মুখের সংলাপও কানে এল…

সাহেব বলছে, “তবে রে পামর! আয় তবে লড়া যাক সম্মুখ সমর।”

সেপাই বলল, “হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ, ব্যাটা ম্লেচ্ছ! আজ তোর মুন্ডু লইয়া আমি গেন্ডুয়া খেলিব।”

এমন সময় সাহেবের দিকে ট্যাঙ্কের পেছনের অন্ধকার থেকে কাউকে যেন ফিসফিস করে বলতে শুনলাম, “ইংলিশ, ইংলিশ!” সঙ্গে সঙ্গে সাহেব দ্বিগুণ উদ্যমে তলোয়ার ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে এল, “ইউ ডার্টি নিগার! আই উইল ফর্দাফাই ইউ, কাট ইউ টু পিসেস, কুচি কুচি করিয়া…”

অমিয়র দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ-টোখ উলটে যাবার জোগাড়, মাথার চুলগুলো সটান খাড়া হয়ে একেবারে সজারুর মতো দেখাচ্ছে, সিধুকে জাপটে ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। লড়াই দেখার উত্তেজনায় আমরা সবাই নিজেদের অজান্তেই গুটি গুটি ট্যাঙ্কের ঠিক নিচে এসে দাঁড়িয়েছি তখন।

ওদিকে বীর বিক্রমে সেপাইটি ফের সাহেবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, “ওরে ব্যাটা লালমুখো, আজ তোর একদিন কি আমারই একদিন। তোর তিন বোতল রক্তে আমি গোসল করব আজ…”

 

হোস্টেলের ভূত তাপস মৌলিক

 

তার ক্ষিপ্র অসিচালনায় সাহেবের তলোয়ারটা হাত থেকে বেমালুম ছিটকে গেল, আর ছিটকে গিয়ে পড়বি তো পড় সটান এসে প্রথমে লাগল অমিয়র পিঠে, তারপর ঠকাস করে ছাদের মেঝেয়। অমিয় তো মুখে ‘আঁ আঁ’ আওয়াজ করে মেঝেয় শুয়ে পড়ল। আমি তলোয়ারটা হাতে তুলে দেখি সেটা রাংতা মোড়ানো একফালি কাঠ, লড়াইয়ের ধকলে জায়গায় জায়গায় রাংতা ছিঁড়ে গেছে।

এদিকে তলোয়ারহীন নিরস্ত্র সাহেবকে বেকায়দায় পেয়ে সেপাই তখন একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছে। সেপাইয়ের আস্ফালনে পেছোতে পেছোতে সাহেব নিজেও ট্যাঙ্কের ওপর থেকে পা ফসকে পড়ল নিচে আমাদের ঘাড়ে-মাথায়। তাকে তুলে ধরে কোট-প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে দিতে দিতে আমরা যখন জিজ্ঞেস করছি, “লাগেনি তো বেশি?” হঠাৎ অমিয় উঠে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাহেবের গায়ে— “আমার ব্লেজার! আমার ব্লেজার! তুই আমার ব্লেজার কোথায় পেলি?”

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সাহেবরূপী নব ফস করে বলে বসল, “সিধু দিয়েছে।”

আর যায় কোথা! অমিয় একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল, নবর কোটটা দু-হাতে খামচে ধরে বলে উঠল, “তবে রে! আমার এত দামি কোটটা পরে তোমরা নকশা করছ? ভূত সাজা হয়েছে! সাহেব ভূত! খোল বলছি, এক্ষুনি খোল। জানিস এটা আমার কত পয়া ব্লেজার? এটা পরে আমি সব বড় বড় পরীক্ষা দিয়েছি, কলেজের অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েছি! কোন সাহসে আমার লকার থেকে এটা বার করেছিস, সিধু?”

অতঃপর তুমুল হৈ-হট্টগোল সহযোগে আমরা সবাই মিলে ছাদ থেকে নেমে এলাম তিনতলায়।

 

পরদিন সকাল থেকে যথারীতি অমিয় বুক বাজিয়ে বলে বেড়াতে লাগল সে মোটেই ভয় পায়নি।

“দূর দূর, ভূত না ঘোড়ার ডিম! ওসব গাঁইয়া যাত্রাপালা দিয়ে আমায় ভড়কানো যাবে ভেবেছিস!”

বগাদা আড়ালে বলল, “ভালোই চলছিল ব্যাপারটা। ব্যাটা অন্ধকারের মধ্যেও নিজের ব্লেজারটা চিনে ফেলাতেই সব গুবলেট হয়ে গেল!”

দিলুদা বলল, “আমাকে কিন্তু কেউ চিনতে পারেনি। এন সি সি-র ড্রেস পরে কেমন মেক আপটা নিয়েছিলাম বল! লাল গামছা দিয়ে বানানো পাগড়ি! হুঁ হুঁ বাবা, পাড়ায় রেগুলার নাটক করতাম!”

বগাদা বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতের মুঠো দিয়ে একটা ঘুষি মেরে বলল, “দাঁড়া, অমিয়র হচ্ছে! ব্যাটা স্বীকার করবে না মানে? ভূত ওকে দেখিয়েই ছাড়ব আমি। একবার চটকে গেছে তো হয়েছেটা কী, এক মাঘে শীত যায় না।”

সুতরাং ক্লাস, পড়াশুনো এবং আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত আমাদের আলোচনা চলতে থাকল… গুজগুজ, ফিসফাস… কীভাবে অমিয়কে জব্দ করা যায়।

 

পাঁচ-ছ-দিন পর। রাত্রে খেয়েদেয়ে ঘরে এসে খাটে বসে জমিয়ে একটা রহস্য উপন্যাস পড়ছি। অমিয়ও নিজের খাটে শুয়ে শুয়ে কী একটা পড়ছে। সিধু আর ফেলু ঘরে নেই, কোন ঘরে গিয়ে আড্ডা মারছে কে জানে! বেশ শীত-শীত পড়ে গেছে, ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে বাইরে। ঘরের জানালাগুলো সব বন্ধ তাই, দরজাটাও ভেজানো। এমন সময় ফটাস করে সেই ভেজানো দরজা ঠেলে প্রচুর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হঠাৎ বগাদার প্রবেশ, হাতে একটা পাতলা বই।

“এই তো অমিয়! বীরপুঙ্গব! খুব যে ঘটা করে চারদিকে বলে বেড়াচ্ছিস তুই সেদিন ভয় পাসনি, ভয় না পেলে ছাদের মেঝেয় শুয়ে অমন আঁ-আঁ করে চিৎকার করছিলি কেন শুনি?” সটান অমিয়কে চেপে ধরল বগাদা।

“ভয় পাব কেন? সেই তলোয়ারটা পিঠে এসে পড়ল বলেই তো ব্যথায় চিৎকার করছিলাম,” অমিয়র উত্তর, “একেবারে সোজা এসে মেরুদণ্ডে লাগল যে, এখনও একটু টনটন করছে।”

“বটে! বেশ বেশ! তার মানে তোর ভূতের ভয় নেই, তাই তো? খুব ভালো। এই তো চাই!” উঠে বসা অমিয়র কাঁধে আলতো দুটো উৎসাহবর্ধক চাপড় মেরে বাকিদের দিকে ঘুরে বলল বগাদা, “বেশ, আজ তাহলে এই ঘরেই বসা যাক! কী বলিস?” তারপর আমার দিকে হাতের পাতলা বইটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “এটাতে প্ল্যানচেটের নিয়মকানুন সব লেখা আছে। ছবি দেখে একটা টেবিল ঠিকঠাক সাজিয়ে ফেল, তুই আজ মিডিয়াম হবি।”

সেরেছে! আমাকেই কিনা মিডিয়াম হতে হবে! প্ল্যানচেটের বিন্দুবিসর্গ তো কিছু জানি না ছাই। একটু গাঁইগুঁই করার চেষ্টা করলাম, তাতে বগাদা বলল, “আরে দূর, এতে হাতিঘোড়া আছেটা কী! যার ভূত নামাব তার কথা চোখ বুজে মন দিয়ে একটু ভাববি, তাহলেই চড়চড় করে নেমে আসবে। মিডিয়ামকে কী করতে হবে সে পাতাটা পড়ে নে চটপট।”

অতএব একটা টেবিল রাখা হল ঘরের মাঝখানে, তার চারদিক ঘিরে সবার বসার ব্যবস্থা হল। অমিয়র দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ তখনই গোল গোল হতে শুরু করেছে, মাথার দু-চারটে চুল এর মধ্যেই অ্যান্টেনার মতো খাড়া হয়ে উঠেছে। খুব ঘুম পাচ্ছে বলে প্ল্যানচেটের আসরটা অন্য ঘরে বসাবার জন্য আমতা আমতা করে একবার বলার চেষ্টা করল, তাতে বগাদা ফের তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “আরে ঘুমোবি ঘুমোবি! অত তাড়া কীসের? আগে ভূতবাবাজির সঙ্গে একটু দেখাসাক্ষাৎ করে নে, তাহলে হয়তো ফের একটা জম্পেশ ভূতের স্বপ্ন দেখতে পারিস।”

প্রস্তুতি সব সারা। দরজা বন্ধ করে ঘরের আলো নিভিয়ে দেওয়া হল, টেবিলে মোমবাতি জ্বালানো হল একটা। আমার হাতে বগাদা একটা সাদা পাতা আর একটা পেনসিল ধরিয়ে দিল। জিজ্ঞেস করলাম, “কার ভূত নামাবে ঠিক করেছ?”

“নামা না একজনকে। আচ্ছা… ক্লাইভ লয়েডকে নামাই চল।”

“ক্লাইভ লয়েড! ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যাপটেন? সে তো এখনও বেঁচে আছে!”

“সরি সরি, ক্লাইভ লয়েড নয়, লর্ড ক্লাইভ, লর্ড ক্লাইভ… নবাব সিরাজের সঙ্গে যে যুদ্ধ করেছিল, ওই একই হল আর কী!”

অগত্যা আমি চোখ বুজে স্কুলের ইতিহাস বইয়ে দেখা লর্ড ক্লাইভের ছবিটা এক মনে ভাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। বাকি সবাই চুপ, ঘরে কোনও আওয়াজ নেই। বাইরেও সব নিস্তব্ধ। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। শীতের রাতে এই সময় চারদিক চুপচাপ হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

পাঁচ মিনিট হয়েছে কি হয়নি, দড়াম করে একটা আওয়াজ হল। আওয়াজটা ঘরের মধ্যে হয়নি। ঘরের বাইরের দিকে পাশাপাশি যে দুটো জানালা আছে, তার একটার পাল্লায় বাইরে থেকে কেউ ধাক্কা দিল মনে হল। তাজ্জব! তিনতলার জানালায় বাইরে থেকে ধাক্কা দেবে কে? ওদিকে তো কিছুই নেই, খাড়া দেয়াল নেমে গেছে নিচে হোস্টেলের পেছনে। সেদিকে নিচে কিছু ঝোপঝাড় আর গাছপালা আছে বটে, কিন্তু সে সব গাছের কোনোটাই আমাদের তিনতলা সমান উঁচু নয়।

এসব সাতপাঁচ ভাবতে না ভাবতে আবার সেই ধাক্কা… ধড়াম। এবার পরিষ্কারই বোঝা গেল, সত্যিই বাইরে থেকে কেউ জানালার পাল্লায় ধাক্কা মারছে।

বগাদা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ওই এসে গেছেন, ক্লাইভ লয়েড এসে গেছেন, ধুত্তোর… লয়েড নয়, লর্ড ক্লাইভ…”

অমিয়ও দাঁড়িয়ে পড়েছে, মেঝেতে নয়, একেবারে খাটের ওপর! ড্যাবা ড্যাবা চোখ মেলে তাকিয়ে আছে জানালাটার দিকে। ওটায় তখন একের পর এক ধাক্কা আছড়ে পড়ছে বাইরে থেকে। ধড়াম… ধড়াম… মোমবাতির আলোয় দেখি অমিয়র চুলগুলো সব একদম খাড়া, সজারুর কাঁটার মতো।

বগাদা নিচু গলায় গম্ভীরভাবে বলল, “জানালাটা খুলে দে দিলু। সাহেবকে ভেতরে আসতে দে। জানালা বন্ধ রাখলে সাহেব ভেতরে ঢুকবেন কীভাবে!”

অমনি অমিয় আঁ আঁ করে চিলচিৎকার করে উঠল, “ওরে বাবা গো! না না, জানালা খুলো না!”

বগাদা একই সুরে চাপা গলায় বলল, “কেন অমিয়? সাহেব আমাদের মাননীয় অতিথি। আমরাই তাঁকে আহ্বান জানিয়েছি, আমন্ত্রণ করেছি। উনি আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন, অশরীরে এসেছেন। এখন জানালা না খুললে ব্যাপারটা চরম অভদ্রতা হবে না কি? দিলু, তুমি জানালা খোলো।”

দিলুদা ধীরে ধীরে জানালাটার সামনে এগিয়ে গেল। ধাক্কা তখনও অবিরাম চলেছে। দুটো ধাক্কার ফাঁকে চট করে ছিটকিনিটা খুলে জানালার পাল্লা দুটো হাট করে বাইরে মেলে দিয়েই তড়িৎগতিতে একপাশে সরে গেল দিলুদা। তারপর যে দৃশ্যটা দেখলাম সেটার কথা ভাবতে গিয়েই আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে! খোলা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে এল বিশাল একজোড়া কালো বুট, ব্যাপারটা বুঝতে না বুঝতে ফের বেরিয়েও গেল জানালা দিয়ে।

অমিয় তখন “ওরে বাবা! ভূত, ভূত” বলে পরিত্রাহি চিৎকার জুড়েছে। সে সময় ফের একবার ঘরের ভেতর ঢুকে এল সেই বুটজোড়া। দেখি অমিয়র কথা বন্ধ হয়ে গেছে হঠাৎ, ড্যাবড্যাব করে সে চেয়ে আছে সেই বুটজোড়ার দিকে। মুহূর্তের মধ্যে অবশ্য ফের জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেছে বুটজোড়া, একটু পরেই ঢুকেছে আবার। এবার হঠাৎ অমিয় ‘আমার বুট, আমার এন সি সি-র বুট’ বলে প্রাণপণে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই বুটজোড়া লক্ষ্য করে, জাপটে ধরল সে দুটো, তারপর টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলল নিজের খাটের দিকে। দেখি বুটজোড়ার সঙ্গে বাঁধা একগাছা নাইলনের দড়ি আলগা হয়ে ঢুকে এসেছে ঘরের ভেতর!

“ভূত না মুন্ডু! ছাদের ওপর থেকে দড়িতে বেঁধে আমার বুটজোড়া দুলিয়ে দুলিয়ে কেউ জানালায় ধাক্কা দিচ্ছিল! আমার সঙ্গে চালাকি!” রেগেমেগে বলল অমিয়।

বগাদা চাপা গলায় বলল, “ধুত্তোর! সিধুটা এবারেও কেঁচিয়ে দিল। নিলি তো নিলি, অমিয়র বুটজোড়াই নিতে হল তোকে? হোস্টেলে আর কারও কি এন সি সি-র বুট ছিল না?”

ঘরের আলোটা জ্বেলে আমি বললাম, “অমিয়র বুটজোড়াই সবচেয়ে বড়ো সাইজের কিনা, তাই হয়তো নিয়েছে। তবে অমিয় কিন্তু ভয় পেয়েছিল, ভূত-ভূত বলে চ্যাঁচাচ্ছিল, আমরা সবাই সাক্ষী।”

বগাদা বলল, “সে তো সবাই শুনেছি, কিন্তু বেইমানটা কাল সকালেই আর কিচ্ছু স্বীকার করবে না দেখবি। ব্যাপারটা হতে হতেও হচ্ছে না ঠিক!”

এমন সময় হঠাৎ ঘরের বন্ধ দরজায় দুম দুম ধাক্কা, বাইরে ফেলুর উত্তেজিত চিৎকার, “ওরে, শিগগির দরজা খোল, সর্বনাশ হয়ে গেছে! ছাদের রেলিঙে ঝুঁকে পড়ে দড়িতে বাঁধা বুটজোড়া দোলাচ্ছিল সিধু, দড়ির টানে টাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে গেছে! চারতলার ছাদ থেকে একদম নিচে। অত জোরে দড়ি ধরে টানে কেউ? এরকম তো কথা ছিল না!”

বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল আমার। মেরুদণ্ড বেয়ে যেন ঠান্ডা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল একটা। এক লহমায় দরজাটা খুলে দিলাম আমি, “বলিস কী!” ঘরের বাকিরাও কয়েক মুহূর্তের জন্য একেবারে নিঃস্পন্দ হয়ে গেল। সবারই মুখ শুকিয়ে গেছে। বগাদা প্রথম মুখ খুলল, “সর্বনাশ! শিগগির নিচে চল সব। টর্চ আছে কারও কাছে?”

সবাই মিলে দুড়দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে ছুটলাম নিচে। অমিয়ও আছে সঙ্গে। হোস্টেলের পেছনটা আগাছা আর ঝোপঝাড়ে ভর্তি, দু-তিনটে মাঝারি গাছও আছে— একটা আমগাছ, একটা বকুল, একটা নিম ইত্যাদি। কোথায় পড়েছে সিধু? সবে পাঁচ-ছ-দিন আগে পূর্ণিমা গেছে, চাঁদের আলো বেশ জোরালো তাই। সে আলোয় একজায়গায় ঝোপঝাড়ের আড়ালে কেউ উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে আছে মনে হল। হুড়মুড়িয়ে ছুটলাম সব সেখানে। টর্চ ফেলে দেখা গেল একটা প্যান্ট আর একটা জ্যাকেট মাটিতে পড়ে আছে সেখানে। পোশাকগুলো যে সিধুরই সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু সিধু কোথায়? তাজ্জব ব্যাপার হল, প্যান্ট আর জ্যাকেটটা এমনভাবে পড়ে আছে যেন উপুড় হয়ে কেউ শুয়ে আছে মাটিতে, অথচ জামাকাপড়গুলোর ভেতরে কেউ নেই!

বগাদা বলে উঠল, “যাব্বাবা! সিধু গেল কোথায়?”

বলে সিধুর নাম দরে উঁচু গলায় ডাকাডাকি শুরু করল। অমিয় হঠাৎ দেখি ডাইভ দিয়ে পড়েছে সিধুর সেই জামাকাপড়গুলোর ওপর, পড়েই বুকফাটা এক আর্তনাদ করে উঠল, “সিধু রে! কোথায় গেলি রে তুই, ভাই আমার!”

এমন সময় হঠাৎ পাশের আমগাছটার ওপর থেকে একটা খোনা গলার আওয়াজ কানে এল, “আঁমাঁকেঁ ওঁখাঁনেঁ পাঁবিঁ নাঁ রেঁ অঁমিঁয়ঁ, আঁমিঁ এঁখঁন সূঁক্ষ্মঁদেঁহঁ ধাঁরঁণ কঁরেঁছিঁ।”

তাকিয়ে দেখি আমগাছের একটা নিচু ডালে পা ঝুলিয়ে কে একজন বসে আছে, আপাদমস্তক সাদা চাদরে মোড়া। অমিয় চকিতে সেদিকে ঘুরে তাকাল, আর তারপরই “আঁ আঁ, ভূত, ভূত, বাবা গো!” বলে এক বিকট চিৎকার করে সোজা মূর্ছা গেল মাটিতে!

জড়ানো চাদরটা খুলে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে হাসতে গাছ থেকে নেমে এল সিধু। নেমেই গাছের তলা থেকে একটা বালতি তুলে নিয়ে অমিয়র দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, “ছাদ থেকে নামার সময় তিনতলার বাথরুম থেকে ঠান্ডা জল নিয়ে এসেছি এক বালতি, জানি কাজে লাগবে।”

বগাদা একটা লম্বা হাঁফ ছেড়ে চোখ পাকিয়ে বলল, “ব্যাটা হতচ্ছাড়া, পাজি!”

সিধু ততক্ষণে গবগব করে ঠান্ডা জলের বালতিটা খালি করে দিয়েছে অমিয়র ওপর।

 

অলংকরণ – সুমিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published.