নাহ! অনেক চেষ্টা করেও শেষরক্ষা হল না।

চোরবাগান থেকে খুব সাবধানে বেরোলেও রাস্তায় উঠেই একেবারে বাঘের মুখোমুখি।

বাঘই তো! ইন্সপেক্টর মল্লিক আর আব্দুল হাবিলদার একসঙ্গে হলে বাঘের চেয়ে কম কী!

ছোটটার তো গলা শুকিয়ে কাঠ, বড়োজনেরও প্রাণ উড়ে যায় আর কী।

“এদিকে আয় দুজন। দেখি হাতে ওটা কী লুকোচ্ছিস?” মল্লিকের বাজখাঁই গলা।

বড়জন হাত পিছনে লুকোয়, ছোটজন ফিসফিস করে বলে, “দাদা, দিয়ে দে, নয়তো খুব মারবে! আমরা আবার পরে পেড়ে আনব!”

ফিসফিস করতে দেখে মল্লিক আরও রেগে যায়, “তবে রে হতভাগা, আবার প্ল্যানিং হচ্ছে? দেখা কী লুকোচ্ছিস?”

বড়জন হাত সামনে এনে দেখায়। দু’হাতে দুটো করে ছোট সাদা ডিম।

“কী এগুলো? কীসের ডিম? কোথায় পেলি?”

“কাগের ডিম, খাব বলে পেড়েছি…” বড়জন বলল।

“ছ্যাহ! কাগের ডিম! নোংরা কোথাকার! ফেলে দে এখুনি।” মল্লিকের এক ঝাপটায় ডিমগুলো মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়। দুজন হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকে ভাঙা ডিমগুলোর দিকে।

“নাম কী তোদের? কোথায় থাকিস?” মল্লিক এত সহজে ছাড়বে না মনে হচ্ছে।

“আমার নাম কাগের ঠ্যাং আর ওর নাম বগের ঠ্যাং।”

“ফাজলামি হচ্ছে? এ রকম নাম হয় কারও?” মল্লিকের মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে, এই দিল বুঝি হাতের ডান্ডাটা চালিয়ে।

আব্দুল বাঁচায় ওদের, “হ্যাঁ স্যার, ওটাই ওদের নাম। ওদের বাবা নেই, দু’ভাই রেলের বস্তিতে থাকে, মা চার বাড়ি কাজ করে আর ঠাকুমা বড়ি পাঁপড় বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে।”

“হুম, চেনো তুমি ওদের?” মল্লিক শান্ত হয়।

“চিনি স্যার, আমার ছেলের ক্লাসেই পড়ত দুজন। এখন স্কুল যায় না বোধ হয়…”

আরও একটু ধমকধামক দিয়ে মল্লিক আর আব্দুল চলে যায়। দুই ভাইয়ের চোখ তখনও ভাঙা ডিমগুলোর দিকে। কত সাধ করে কত কষ্ট করে পেড়ে আনা…

“দাদা, আর একবার যাবি, যদি অন্য কোনও বাসায়…”

“না থাক। ইডলিও তো নেই সঙ্গে! কাল আসব আবার।”

সকালে ইডলি খাবার সময় মা-কে লুকিয়ে দুজন দুটো ইডলি জামার মধ্যে ভরে এনেছিল। সেগুলো দেখিয়ে বাসা থেকে কাকটাকে বাসা থেকে সরিয়ে, উফ, অনেক কাণ্ড করে তবেই জোগাড় হয়েছিল ডিমগুলো। মন খারাপ হয়ে যায় দুজনের।

বাড়ি ফেরার রাস্তায় দেখে নতুন দোকান খুলেছে, নাম ডমিনোস পিজ্জা। তার তলায় কত রকমারি ছবি!

দুই ভাই দাঁড়িয়ে পড়ে, কিছুক্ষণ দেখে।

“দারুণ খেতে হবে, না দাদা?”

“হ্যাঁ রে, ওপরে ওটা ক্রিম আর তাতে কত কী দেওয়া!”

“চল বাড়ি যাই, খিদে পাচ্ছে।” দু’ভাই বাড়ির দিকে হাঁটে।

ঢুকতে না ঢুকতেই মায়ের গলা, “এই ফিরলেন দুই ভাই রাজ্য জয় করে। আজও স্কুল যাসনি, তাই তো?”

বড়ভাই বলে, “নতুন প্যান্ট না পরে গেলে ঢুকতে দেয় না যে…”

“নতুন প্যান্ট কোথায় পাব আমি? ওই প্যান্টটা সেলাই করে দিলাম তো, আবার ছিঁড়েছিস?”

দুজন চুপ করে থাকে, গাছে উঠতে গিয়ে ছিঁড়েছে বললে খুব মার জুটবে।

ঠাকুমা আসে বাঁচাতে। “আহা ওরা সবে বাড়ি ফিরল, খিদে পেয়েছে কিনা দেখো, তা নয় বকাবকি আরম্ভ করল!”

ভরসা পেয়ে ছোটভাই ঠাকুমার কাছে ঘেঁষে আসে। “ঠাম্মা, তুমি পিজ্জা বানাতে পারো?”

ঠাকুমা একটু চুপ করে চিন্তা করেন। টিভিতে দেখেছিলেন বটেই, কিন্তু কীভাবে বানায়, সেটা তো… তা বলে হার মানবার পাত্রী নন তিনি। বলেন, “হ্যাঁ ভারী তো পিজা না গিজা, খুব জানি।”

দু’ভাইয়ের মুখ চকচক করে ওঠে, “আমাদের বানিয়ে দেবে ঠাম্মা?”

“কেন দেব না! কালই দেব। কয়েকটা সবজি আনতে হবে বাজার থেকে।”

দু’ভাই সারারাত পিজ্জা খাওয়ার স্বপ্ন দেখে।

 

পরদিন ঠাম্মা মোটা একটা ধোসার ওপর পেঁয়াজ ক্যাপসিকাম দিয়ে ভেজে দেন। বলেন, “এই নে তোদের পিজ্জা!”
বড়ভাই বলে, “এ কী ঠাম্মা! তুমি তো ধোসা ভেজেছ।”

“আরে তোরা জানিস না, এটাই পিজ্জা। খেয়ে নে তো এখন!”

ওরা খেয়ে নেয়, কিন্তু খুশি হয় না। পাড়ার দাদা পচাদাকে সব খুলে বলে।

পচাদা বলে, “কিন্তু পিজ্জা খেতে গেলে তো অনেক টাকা লাগবে, তোদের আছে?”

“কত টাকা? একশ?”

“আরও বেশি, তিনশ!”

“তি-ন-শ! কোথায় পাব অত টাকা!”

“আমার সঙ্গে আয়, ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

দু’ভাই যায়। কাজ হল রেললাইনের ধরে কয়লার গাড়ি থেকে যত কয়লার টুকরো পড়ে থাকে, সেগুলো কুড়িয়ে আনা। পচাদাকে দিলে পয়সা দেবে। সারাদিন দু’ভাই অনেক খেটে আড়াইশ টাকা পায়। পচাদা খুশি হয়ে বলে, “এই তো, রোজ আসবি বুঝলি? এর সঙ্গে যদি কোনও ট্রেনের দরজায় দাঁড়ানো যাত্রীর হাতে লাঠি দিয়ে মেরে এক-দুটো মোবাইল ফোন চুরি করতে পারিস, হাতে হাতে চারশ টাকা করে দেব। পারবি?”

চুরি! আবার সেই মল্লিক আর আব্দুল! ওরা রাজি হয় না। তাছাড়া পিজ্জা খাওয়ার টাকা তো এসেই গেছে।

সন্ধে হয়ে যায়। এখন না ফিরলে মা ভীষণ মারবে। তাই টাকাগুলো সাবধানে রেখে দু’ভাই বাড়ির দিকে চলে।

রাস্তায় দেখে একটা বাইকে একজন দাঁড়িয়ে, পিছনে একটা বাক্সের গায়ে লেখা ডমিনোস পিজ্জা! ওদের দেখে লোকটা ডাকে।

“এই, এদিকে আয় তো, ঠিকানাটা বলতে পারিস?”

বড়ভাই বুদ্ধি বার করে, “যদি বলে দিই, তুমি আমাদের ওই বাক্স থেকে পিজ্জা খাওয়াবে?”

“যাহ তা হয় নাকি! এগুলো তো অর্ডার দেওয়া, পৌঁছতে যাচ্ছি।”

“তাহলে একবার দেখতে দেবে? আমরা কোনওদিন পিজ্জা দেখিনি!”

লোকটা প্রথমে রাজি না হলেও পরে কী মনে হয়, বাক্স খুলে দেখায়। দুই ভাই প্রাণভরে দেখে, গন্ধ নেয় সেই অমৃত খাদ্যের।

“হয়েছে, হয়েছে,” বলে লোকটা বাক্স বন্ধ করে। “এই নম্বরে ফোন করলে তোমাদের বাড়িতেও পৌঁছে দেব। এখন বলো তো এই ঠিকানাটা।”

ফোন নম্বরটা লিখে নিয়ে তারা রাস্তা দেখিয়ে দেয়, লোকটাও তাদের দেখানো ঠিকানার দিকে এগোয়।

কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং এম মণিকন্দন অনুবাদ - প্রকল্প ভট্টাচার্য

 

বাড়ি ফিরে আজ দুজনে কোনও কথা বলে না। চুপচাপ খেয়ে শুয়ে পড়ে।

পরদিন বড়ভাই মা-কে অনেক বুঝিয়ে মায়ের সেলফোন থেকে ফোন করে। নম্বরে রিং হয়।

– হ্যালো, ডমিনোস পিজ্জা বলছি!

– হ্যালো, আমি কাগের ঠ্যাং বলছি।

– সে আবার কী! অমন নাম হয় নাকি!

– হ্যাঁ হয়। আমরা পিজ্জা খেতে চাই, আপনি পাঠিয়ে দেবেন?

– আচ্ছা, ঠিকানাটা বলো।

– ঠিকানা! রেলের বস্তি।

– রেলের বস্তিতে কাগের ঠ্যাং! মস্করা হচ্ছে!

ফোন কেটে যায়। ছোটভাই বলে, “না দাদা, এইভাবে হবে না, আমাদের নিজেদেরই যেতে হবে।”

– যদি ঢুকতে না দেয়? ইস্কুলে তো ঢুকতেই দেয় না ছেঁড়া প্যান্ট দেখে…

– আরে কিছু হবে না। আমাদের কাছে তো টাকা আছে, ঠিক ঢুকতে দেবে।

 

গুটিগুটি পায়ে দুজন পিজ্জার দোকানের সামনে যায়। দরজায় দারোয়ান আটকায়, “কী চাই তোদের?”

– আমরা, মানে, পিজ্জা খাব।

– পিজ্জা খাবি? পয়সা আছে? দাম জানিস?

– হ্যাঁ টাকা আছে, এই তো!

বড়ভাই দেখায়।

দারোয়ান বিপদে পড়ে। এই পোশাকের ছেলেদের ঢুকতে দিলে তার চাকরি চলে যাবে, অথচ এদের কাছে পয়সা আছে। ভেবেচিন্তেই বলে, “এই পোশাক পরে ঢোকা যাবে না। ভালো পোশাক পরে আয়।”

ছোটজন প্রতিবাদ করে, “কেন? পোশাকের কী অসুবিধা? আমরা তো পয়সা দিয়েই কিনব অন্যদের মতো, কেন ঢুকতে দেবে না?”

দারোয়ান রেগে যায়। রাস্তায় কিছু লোক দেখছে তাদের। কথা না বাড়িয়ে সে ছোটজনের গালে এক চড় মারে। “তবে রে, আবার মুখের ওপর কথা!”

বড়ভাই দারোয়ানকে এক ধাক্কা দেয়। বলে, “এখুনি চলে যা, নয়তো পুলিশ ডাকব।”

পুলিশের নাম শুনে দু’ভাই থেমে যায়। ধুলো ঝেড়ে চলে যায় আস্তে আস্তে।

ভিড়ের মধ্যে ছিল এক সাংবাদিক। সে দোকানে ঢুকে মালিকের সঙ্গে দেখা করে সব জানায়। এটাও বলে, ওইভাবে দুটো ছেলের গায়ে হাত তুলে তার দারোয়ান অন্যায় করেছে। সে যদি তার রেকর্ড করা ভিডিও চ্যানেলে দেখায়, দোকানের সর্বনাশ হয়ে যাবে।

দোকানদার প্রথমে শুনতে চায় না। পরে বলে, “তো এখন আমাকে কী করতে হবে?”

“বেশি কিছু না, এই লাখদুয়েক টাকা দিন, তাহলে এই ভিডিও আপনারই থাকবে। নয়তো চ্যানেলকে বিক্রি করে দেব আমি।”

“দু’লক্ষ টাকা! পাগল নাকি আপনি! বেরিয়ে যান, এক্ষুনি।”

লোকটা বেরিয়ে যায়। যেতে যেতে বলে, “ভুল করলেন, খুব ভুল করলেন আপনি।”

বাড়ি ফিরে দু’ভাই মনমরা হয়ে শুয়ে থাকে, খেতেও চায় না, খেলতেও চায় না। মা বেরিয়েছেন, ঠাম্মা অনেক সাধ্যসাধনা করেন। কিন্তু ওরা কিছুই বলে না। বিকেলবেলা হঠাৎ ওদের বাড়ির সামনে অনেক লোক জমা হতে থাকে। কী ব্যাপার, না ওদের নাকি টিভিতে দেখিয়েছে! তার একটু পরেই একটা গাড়ি আসে। এলাকার কাউন্সিলার নিজে এসে দু’ভাইয়ের খোঁজ করেন। ব্যাপারটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ি করে ওদের নিয়ে যাওয়া হয় সেই পিজ্জার দোকানে। তার সামনে এখন অনেক লোক। টিভি ক্যামেরার সামনে মালিক নিজে এগিয়ে এসে ওদের জড়িয়ে ধরে বলে, “কী নাম ভাই তোমাদের?”

– কাগের ঠ্যাং আর বগের ঠ্যাং।

নাম শুনে হো-হো হাসিতে ফেটে পড়ে সবাই। মালিক বলে, “তোমরা পিজ্জা খেতে চাও? খাবে?”

– কিন্তু, পয়সা আনিনি যে…

– আরে না না, পয়সা লাগবে না। তোমরা তো এখন সেলিব্রিটি! এসো এসো, তোমাদের জন্যে স্পেশাল পিজ্জা বানিয়েছি।

সত্যিই সকলের সামনে টেবিল চেয়ারে ওরা বসে। একটা বাক্সে গরম পিজ্জা আসে। নিজের হাতে মালিক আর কাউন্সিলার ওদের মুখে পিজ্জার টুকরো তুলে দেন। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ হয়, হতভম্ব দুই ভাইয়ের আর মালিকের ছবি তোলা হয় নানা ভঙ্গিতে। ভিড়ের মধ্যে ওদের ঠাম্মা আর মা-ও ছিলেন, খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন না জানি কী অমঙ্গল কামনায়। তাঁরা আঁচলে চোখের জল মোছেন।

সব সেরে বাড়ি ফিরতে রাত হয়। বস্তির ছেলেরা আসে অভিনন্দন জানাতে। হই-হট্টগোল মিটলে মা জিজ্ঞেস করেন, “তাহলে শেষমেশ পিজ্জা খাওয়া হল তো? এখন খুশি?”

– হ্যাঁ হল, কিন্তু জানো মা, এটা তেমন ভালো না। যা ভেবেছিলাম, তার মতো মোটেই না। সেদিন ঠাম্মা যে পিজ্জাটা বানিয়ে দিয়েছিল, সেটাই বেশি ভালো ছিল।

এই বলে দুইভাই ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে।

ঠাম্মার দু’চোখ জলে ভরে আসে।

 

ছবি – অরিজিৎ ঘোষ

এম মণিকন্দন (জন্ম ১৯৬৯) প্রসিদ্ধ তামিল লেখক, সিনেমাটোগ্রাফার ও চলচ্চিত্র পরিচালক। ‘কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং’ গল্পটির মূল তামিল গল্প ‘কাকা মুট্টাই’ অবলম্বনে নির্মিত ছায়াছবিটি শ্রেষ্ঠ শিশু চলচ্চিত্রের জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে।

 

প্রকল্প ভট্টাচার্যের এই অনুবাদটি টগবগ উৎসব সংখ্যা ১৪২৪-এ প্রথম প্রকাশিত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.