সালটা ১৯৪১। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। ইউরোপের মধ্যেই মূলত চলছে যুদ্ধ। জার্মানি, ইতালি আর জাপান একদিকে। তাদের নাম অক্ষশক্তি। তারা যুদ্ধ করছে ব্রিটেন, ফ্রান্স আর রাশিয়ার সঙ্গে। তারা মিত্রশক্তি। পৃথিবীর আর একটা বড় দেশ আমেরিকা কিন্তু ইউরোপের এই যুদ্ধের বাইরে বসে, তখনও লড়াইয়ে নামেনি। কিন্তু কেমন যেন মনে হচ্ছে, সে লড়াই করলেও করতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে সবাই জানে, আমেরিকা যদি যুদ্ধ করেই শেষ পর্যন্ত, তবে মিত্রশক্তির পক্ষ নিয়েই লড়বে। তাই জাপান বসল হিসাব করতে। জাপান মূলত দ্বীপ-রাষ্ট্র। পাঁচটি দ্বীপ নিয়ে একটা দেশ— হোনসু, হোক্কাইডো, কিউসু, শিকোকু আর ওকিনাওয়া। এর মধ্যে হোনসু সবথেকে বড়। জাপানের রাজধানী টোকিও এই দ্বীপেই অবস্থিত। জাপানের পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর আর তার ওপারে আমেরিকা। জাপানের লক্ষ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জয় করা। আর এই কাজে সবথেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে আমেরিকার নৌবহর। বিশেষ করে আমেরিকা যখন যুদ্ধের আসরে নামলে প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের চলাচল অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে। জাপান তাই ঠিক করল আমেরিকা কিছু করার আগেই তার বিষদাঁতটা ভেঙে দেওয়া যাক। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবার তখন আমেরিকার নৌবহরের একটা বড় ঘাঁটি। ১৯৪১-এর ৭ ডিসেম্বর জাপানের ৩৫৩টি যুদ্ধবিমান পার্ল হারবার আক্রমণ করে।
আন্দাজ নব্বই মিনিট লাগাতার বোমাবর্ষণ চলে। আমেরিকার নৌ সেনা, স্থল সেনা, সাধারণ মানুষ মিলিয়ে ২৪০৩ জন মারা যান, আহত হন ১১৪৩ জন। পাঁচটা যুদ্ধজাহাজসহ মোট ১৮টি জাহাজ হয় ডুবে যায়, নয়তো দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পার্ল হারবারের বিমানঘাঁটির ৩৪৭টি যুদ্ধবিমান পুরোপুরি ধ্বংস বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধে অংশ না নেওয়া একটা দেশে এমন আকস্মিক আক্রমণ নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় কাজ। কিন্তু এই আক্রমণের পেছনে প্রশান্ত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারের পাশেই জাপানের অন্যতম লক্ষ্য ছিল এভাবে নৈবহর ধ্বংস করে আমেরিকার মনোবল ভেঙে দেওয়া। কিন্তু ফল হল উলটো। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট পরদিনই, অর্থাৎ ৮ ডিসেম্বর জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। অক্ষশক্তির জার্মানি এবং ইতালি আমেরিকার বিরুদ্ধে ১১ ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণা করে। অবশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার প্রবেশ ঘটল। এবং প্রথম দিন থেকেই আমেরিকার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল পার্ল হারবারের প্রতিশোধ নেওয়া।
প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর খতিয়ে দেখা গেল আমেরিকার নৌবহরের খুব বড় ক্ষতি হয়নি। পার্ল হারবার ছাড়াও অন্যত্র তাদের যুদ্ধজাহাজ ছিল। বিশেষ করে জাপানের ওপর যদি প্রতিশোধ নিতেই হয়, তাহলে দরকার যুদ্ধবিমান বয়ে নিয়ে যেতে পারে এমন সব এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার জাহাজ। এই এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার প্রশান্ত মহাসাগর পার করে জাপানের উপকূলের যতটা কাছাকাছি সম্ভব পৌঁছবে। তারপর তার থেকে যুদ্ধবিমানগুলো টেক অফ করে জাপানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে গিয়ে বোমা ফেলে আসবে। ২১ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট জাপানের ওপর এই আক্রমণে সরকারি সিলমোহর লাগিয়ে দিলেন। বেছে নেওয়া হল সেই সময়ের সবথেকে বড় আমেরিকান এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার ইউ এস এস হরনেটকে। এই জাহাজটা মাসতিনেক হল আমেরিকার নৌবহরে যুক্ত হয়েছে। এর সঙ্গেই নেওয়া হল আরেক এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার ইউ এস এস এন্টারপ্রাইজকেও। সামিল করা হল দুটো ক্রুজার জাহাজ, তিনটে ডেসট্রয়ার এবং জ্বালানি বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে একটা ফ্লিট অয়েলার। পুরো অভিযানের দায়িত্বে রইলেন লেফটানেন্ট কর্নেল জেমস ডুলিটল। যাঁর নামেই এই জাপানে এই আক্রমণের নাম পরে ‘দ্য ডুলিটল রেড’ হিসাবে বিখ্যাত হয়ে থাকবে।
হরনেট থেকে উড়াল দেওয়ার জন্যে বিভিন্ন বিমানের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হল B-25 প্লেন। কারণ সেই সময় সম্ভাব্য মডেলের মধ্যে B-23 বাতিল হল তার লম্বা ডানার কারণে। ক্যারিয়ার জাহাজে সেগুলো আঁটানো সম্ভব নয়। B-26 বাতিল হল তার লম্বা রানওয়ার কারণে। ক্যারিয়ার জাহাজ থেকে ওড়ার সময় অতটা লম্বা রানওয়ে পাওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু B-25-কে বেছে নেওয়া হলেও অচিরেই বোঝা গেল জাপানে আক্রমণের পরে B-25 প্লেনকে আবার এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ারের ওপর ল্যান্ড করানো সম্ভব হবে না। কারণ যে গতিতে প্লেনগুলো ফিরবে, তাতে ওই সংক্ষিপ্ত রানওয়েতে তাদের থামানো সম্ভব নয়। তাই ঠিক হল, জাপান থেকে প্লেনগুলো গিয়ে ল্যান্ড করবে চিনে। এ ব্যাপারে চিনের সঙ্গে আগেভাগেই সমঝোতা করতে শুরু করল মার্কিন সরকার। কিন্তু পুরো অভিযান গোপন রাখতে চিন সরকারকে শুধুমাত্র আমেরিকান বিমানের ল্যান্ডিং সম্পর্কেই জানানো হল। তারা কোথা থেকে আসবে বা কীতাদের উদ্দেশ্য, কিছুই জানানো হল না। স্থির হল জাপানের উপকূল থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরত্বে পৌঁছে হরনেট থেকে প্লেনগুলো যাত্রা শুরু করবে। টোকিওতে বোমাবর্ষণের পরে তারা রওনা দেবে চিনের দিকে। মোট ৩৮০০ কিলোমিটারের যাত্রা। পুরো উড়ানটাই হবে খুব কম উচ্চতায়, যাতে কোনও রাডারে তারা ধরা না পড়ে। ডুলিটল তাঁর সাথিদের বারবার বোঝাতে লাগলেন, কোনোভাবেই কোনও অসামরিক লক্ষ্যে বোমা না পড়ে। হাসপাতাল, স্কুল, সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি— এগুলো তাঁদের অভিযানের লক্ষ্য নয়। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, কিছুতেই জাপান সম্রাটের প্রাসাদ না ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৪০-এ জার্মান বিমানবাহিনী তাদের এক অভিযানে বাকিংহাম প্যালেসে বোমা ফেলে এই ভুল করেছিল। সেই আক্রমণ ব্রিটেনের সাধারণ মানুষকে এক করে দিয়েছিল। জাপানে সেই ভুল করতে তাঁরা রাজি নন। বরং জাপানের মানুষকে এই আক্রমণে বিভ্রান্ত করতে হবে। জাপানে বিমান আক্রমণ হতেই পারে না— সরকার থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনী, সবাই একই বিবৃতি দিয়ে গেছেন। আমেরিকার এই আক্রমণে তাঁদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হবেই। যুদ্ধে বিপক্ষের মনোবল ভেঙে দেওয়া একটা বড় অস্ত্র। ১৯০৮-এ মার্কিন নৌবাহিনীর একটা দল জাপানে গিয়েছিলেন। তাঁদের জাপান সরকার বিশেষ শান্তি পদক দিয়েছিলেন। ডুলিটল সেই পদকগুলো পাঁচটা বোমায় বেঁধে দিলেন। জাপানের শান্তি পদক পার্ল হারবারের অশান্তির জবাবে তাদের কাছেই ফেরত দেওয়া হচ্ছে।
জাপানে ডুলিটলদের এই আক্রমণের তারিখ ঠিক হয়েছিল ১৯৪২-এর ১৯ এপ্রিল। সেই মতো ১৭ এপ্রিল মার্কিন জাহাজের বাহিনী জাপান উপকূলের ১৬০০ কিলোমিটারের মধ্যে গিয়ে হাজির হল। ১৮ এপ্রিল তাদের দেখে ফেলল জাপানি নৌবাহিনীর একটি জাহাজ নিত্তো মারু। মুহূর্তে আমেরিকান জাহাজের উপস্থিতির খবর পৌঁছে গেল জাপানে। যদিও নিত্তো মারুকে বোমাবর্ষণ করে ডুবিয়ে দেওয়া হল, তবু সিদ্ধান্ত নেওয়া হল আর দেরি নয়। নির্দিষ্ট সময়ের দশ ঘণ্টা আগেই পূর্ব নির্ধারিত জায়গার আরও ৩০০ কিলোমিটার পেছন থেকে ১৮ এপ্রিল শুরু হল ডুলিটলদের অভিযান। সত্যি বলতে কী, মার্কিনদের জাহাজগুলো পার্ল হারবার ছেড়ে যাত্রা শুরুর সময়ই জাপান খবর পেয়েছিল। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কারোরই কোনও ধারণা ছিল না। তবুও সতর্কতা হিসাবে উপকূল থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে অপেক্ষা করছিল জাপানের যুদ্ধজাহাজ। দরকার পড়লে অতর্কিতে আক্রমণ করে মার্কিন জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া ছিল তাদের লক্ষ্য। কিন্তু জাপানিরা ভাবতেও পারেনি উপকূল থেকে হাজার কিলোমিটার দূরেই থমকে দাঁড়াবে তাদের শত্রু আর সেখান থেকেই শুরু হবে বিমান আক্রমণ। সত্যি বলতে কী, এমন ভাবনা আমেরিকানদেরও ছিল না। এই দীর্ঘ উড়ানের অন্যতম ঝুঁকি ছিল জ্বালানির সম্ভাব্য ঘাটতি। দূরত্ব বেড়ে গিয়ে সেই বিপদ আরও বাড়ল। ডুলিটলের নেতৃত্বে ষোলোটি B-25 বিমান হরনেট থেকে ওড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিমানে সওয়ার সৈন্যরা বুঝে গিয়েছিলেন টোকিওর আক্রমণের পরে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানো হয়তো সম্ভব হবে না।
পাঁচটা দলে বিভক্ত হয়ে উড়ছিল বিমানগুলো। প্রথম দলে ছিলেন ডুলিটল স্বয়ং। তাঁদের লক্ষ্য টোকিওর উত্তরাঞ্চল। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দলের লক্ষ্য যথাক্রমে টোকিও কেন্দ্র এবং দক্ষিণভাগ। চতুর্থ দলের দায়িত্বে ছিল কানেগাওয়া, ইয়োকোহোমা এবং ইয়োকোসুকা। পঞ্চম দলের আক্রমণের লক্ষ্য নাগোয়া, ওসাকা এবং কোবে। প্লেনগুলো টেক অফের সঙ্গে সঙ্গেই মার্কিন জাহাজগুলো ফিরতি রওনা দিল পার্ল হারবারের উদ্দেশ্যে। ডুলিটলরা এবার উড়ে চললেন শত্রুভূমির দিকে। প্লেনগুলোতে কিছু কিছু পরিবর্তন করা হয়েছিল সেগুলোর পক্ষে যাতে দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু ওড়ার কিছুক্ষণ পরেই টের পাওয়া গেল তাড়াহুড়োতে করা এই বদলে কিছু না কিছু সমস্যা থেকেই গেছে। কোনও বিমানে জ্বালানির ট্যাংকে থেকে গেছে সমস্যা, সেখান থেকে তেল চুঁইয়ে পড়ছে। কোথাও হাইড্রলিক্সের সমস্যা। আবার কোথাও অটো পাইলটে।
রওনা দেওয়ার প্রায় চার ঘণ্টা পরে স্থানীয় সময় দুপুর বারোটার কাছাকাছি মার্কিন বিমানগুলো তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছাল। নিত্তো মারুর সতর্কবার্তা সত্ত্বেও জাপানের বিমানবাহিনী প্রস্তুত ছিল না। তাই আমেরিকার আক্রমণ ঠেকাতে তাদের প্লেনগুলো যখন আকাশে উড়ল, তখন আমেরিকান প্লেনগুলো পৌঁছে গেছে তাদের নির্ধারিত জায়গায়। শুরু হল বোমাবর্ষণ। পরিকল্পনামাফিক তৈলাধার, ইস্পাত, গ্যাস এবং রাসায়নিক কারখানায় একের পর এক বোমা ফেলে চলল বিমানগুলো। তাদের তাড়া করা জাপানি বিমানগুলোর তিনটে ধ্বংস হল পালটা গুলিতে।
টোকিওর মানুষ তখন দিশেহারা। সেদিন সকালেও রেডিও বার্তায় তাঁদের বলা হয়েছে কোনও শত্রুবিমান জাপানের ৫০০ মাইলের মধ্যে আসা সম্ভব নয়। জাপানিরা নির্বিঘ্নে বসন্ত উপভোগ করতে পারেন। কিন্তু বাতাসে তখন সদ্য ফোটা চেরির গন্ধের বদলে গাঢ় কালো ধোঁয়া। বোমাবর্ষণে টোকিওর মারাত্মক কোনও ক্ষতি না হলেও জাপানের আত্মবিশ্বাসে ঘা দেওয়ার কাজটা ডুলিটলরা খুব ভালোভাবেই করেছিলেন। এবার উড়ে চলা চিনের উদ্দেশ্যে। তাঁদের অভিযানের শেষ এবং সবথেকে কঠিন অধ্যায়।
প্লেনগুলোর জ্বালানির সমস্যার সঙ্গেই যোগ হয়েছিল চিনের বাজে আবহাওয়া। ষোলোটার মধ্যে মাত্র একটা বিমান ঠিকঠাক গন্তব্যে পৌঁছেছিল। দশটা বিমান ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করেছিল। চারটে বিমানের পাইলট এবং সৈন্যরা পূর্ব চিন সমুদ্রে তাঁদের বিমান ছেড়ে প্যারাসুট নিয়ে ঝাঁপ দিতে বাধ্য হন। আর একটা বিমান ল্যান্ড করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। পুরো অভিযানে তিনজন আমেরিকান সৈন্য প্রাণ হারান। পরে জাপানিদের হাতে ধরা পড়েন আটজন, যার মধ্যে চারজন মারা যান।
পার্ল হারাবারের প্রতিশোধে টোকিওতে এই বিমান আক্রমণ আমেরিকার আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই একটা ছোট সাফল্য আমেরিকার মানুষকে যুদ্ধজয়ের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিল। সঙ্গে এটাও প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল জাপান শত্রু হিসাবে অবধ্য নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের শুরুতেই শত্রুপক্ষের থেকে একধাপ এগিয়ে যাওয়ার জন্যে ‘ডুলিটল রেড’ মার্কিন সামরিক ইতিহাসে তাই উল্লেখযোগ্য একটা ঘটনা।
Leave a Reply