কবি গায়ক অরফিয়াসের কাহিনি অমিতাভ কুণ্ডু

গ্রিস দেশের উপকথার গল্প শুরু করা যেতে পারে যে কোনও জায়গা থেকে। তার সুনির্দিষ্ট কোনও শুরুর দরকার পড়ে না। কারণ গল্পগুলি পরস্পর জালের মতো সংলগ্ন। সুতোর খুঁট ধরে এক গল্প থেকে আর এক গল্পে গিয়ে পড়া যায়। এইসব গল্পের একটা সাধারণ উৎস হল হোমারের ইলিয়াড। আগেকার দিনে চারণ কবিরাই গল্প বলতেন। আদি চারণ কবি ছিলেন হোমার। যিনি এক বিশাল গল্প রচনা করে গেছিলেন — এক মহাকাব্য। সেই মহাকাব্য ইলিয়াড। এই মহাকাব্য সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া হত। সেই আদিকালে তাই ছিল রীতি। গায়কদের কথা তাই এইসব প্রাচীন গল্পের সূত্রে এসেই পড়ে। এখন আমি সেই পুরাকালের আদি গায়কের কথা বলব। তাঁর নাম অরফিয়াস।

অরফিয়াসের মা ছিলেন একজন কলালক্ষ্মী বা মিউজ। তাঁর নাম কালিওপে। আর তাঁর পিতা আপোল্লন অর্থাৎ সূর্যদেব। রোমানরা তাঁকে ডাকত অ্যাপেলো নামে। তিনি দুনিয়ার সুন্দরতম পুরুষ আর শিল্পকলা ও ভবিষ্যদ্বাণীর দেবতা। তাঁর পুত্র আমাদের এই গল্পের চারণ অরফিয়াস ভারী সুন্দর বীণ বাজাতেন। এই বীণটি তিনি পেয়েছিলেন তাঁর পিতা আপোল্লনের কাছ থেকে। অরফিয়াসের গানে, বীণার সুরে সারা জগত মুগ্ধ হত। সেই সুর শুনলে গাছেরা তাদের শাখা আন্দোলিত করত, পশুপাখিরা তাঁর কাছে এসে চারিদিক ঘিরে দাঁড়াত। মাছেরা নদী আর সাগরের উপরিতলে ভেসে তীরের দিকে সাঁতর কেটে আসত। এমনকী পাথরও সমুদ্রের তলদেশ থেকে উপরে ভেসে উঠত। মানুষের কথা আর না-ই বা বললাম। অরফিয়াসকে দুনিয়া জানে সুরের প্রথম জাদুকর হিসাবে।

এই অরফিয়াস একদিন একটি মেয়েকে দেখে ভালোবাসে ফেললেন। ভালোবাসলেন তাঁর সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে। মেয়েটিও মুগ্ধ তাঁর রূপে, তাঁর গানে, তাঁর বীণার জাদুতে। তাই তাঁরা বিয়ে করে ঘর বাঁধলেন। এরপর কিন্তু একটু মুসকিল হল। কারণ অরফিয়াস আর ইউরিডিসি ছাড়া অন্য কারোর জন্য গান গাইতেন না বা বাজাতেন না। হ্যাঁ, অরফিয়াসের স্ত্রীর নাম ছিল ইউরিডিসি। একদিন কোনও একটা কাজে অরফিয়াস বাইরে গেছেন আর ইউরিডিসির তখন কোনও কাজ ছিল না। তাই তিনি দূরে একটা মাঠে ফুল তুলতে গিয়েছিলেন। ইউরিডিসির মন ছিল খুব কোমল। তাই ফুল তোলার আগে খুব সন্তর্পণে ফুলের উপর ঝুঁকে দেখতেন যে, মৌমাছি আগে তার থেকে মধু সংগ্রহ করে নিয়ে গেছে কিনা। না নিয়ে গেলে সেই ফুল তিনি তুলতেন না, মৌমাছির মধু সংগ্রহের জন্যে ছেড়ে দিতেন। ফুল তুলতে তুলতে যখন তিনি একটু দূরে গেছেন, তখন হঠাৎ দেখলেন একটি লোক তাঁর দিকে ছুটে আসছে। এই লোকটি ছিল আরিস্টায়োস। সে প্রথম মৌমাছি পালন আবিষ্কার করে এবং সেই সূত্রে স্বর্গে দেবতাদের জন্য মধু সরবরাহ করত। আরিস্টায়োসকে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ইউরিডিসি ভয় পেলেন। কারণ আরিস্টায়োসের মাথার ওপর চাপানো ছিল একটা জাল, মৌমাছিদের দূরে রাখার জন্য, কিন্তু ইউরিডিসি তা জানতেন না। ভয় পেয়ে লঘু পায়ে আরিস্টায়োসের বিপরীত মুখে ছুটলেন তিনি। ছুটন্ত অবস্থায় তাঁর পা পড়ল একটি সাপের গায়ে। সাপটি কামড়ে দিল তাঁর গোড়ালিতে। অরফিয়াস বাড়ি ফিরে দেখলেন ইউরিডিসি মৃত। ভীষণ দুঃখে খুব কাঁদলেন তিনি। তারপর তিনি দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করলেন। তিনি জানতেন, দক্ষিণে পেলোপনিয়ার কাছে, যেখানে স্পার্টা আর এথেন্সের যুদ্ধ হয়েছিল, সেখানে এক জায়গায় আছে পাতালে মৃতদের রাজ্যে প্রবেশের পথ।
ইউরিডিসিকে খুঁজতে অরফিয়াস প্রবেশ করলেন মৃতদের রাজ্যে। তাঁর জন্য গান গাইতে গাইতে তিনি অন্ধকারে প্রবেশ করলেন। প্রবেশের পথে পড়ে স্টুক্স নদী। তার খেয়ার মাঝির নাম হল কারোন। কোন জীবিত সেই নদী পার হতে পারে না। কারোনের হৃদয়, যেটুকু হৃদয় সেই ছায়ার রাজ্যে অবশিষ্ট ছিল, সেই হৃদয় অরফিয়াসের গান শুনে গলে গেল। ভিজে গেল মৃতের রাজ্যের রাজা হেডিস আর তাঁর রাণী পারসেফোনির হৃদয়। রানী পারসেফোনি নিজে হেডিসকে অনুরোধ করলেন ইউরিডিসির জীবন ফিরিয়ে দিতে। ইউরিডিসি তখন ছায়াদেহ নিয়ে হেডিসের রাজসভায় এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি তাঁর প্রিয় অরফিয়াসকে দেখতে পাচ্ছেন। দৌড়ে আসতে গেলেন অরফিয়াসের দিকে। কিন্তু হেডিস তাঁকে বারণ করলেন। তিনি জানালেন, একটি শর্তে তিনি অরফিয়াসকে তাঁর প্রার্থিত ইউরিডিসিকে ফিরিয়ে দিতে পারেন। ফিরে যাবার সময় অরফিয়াসের পিছনে পিছনে চলবেন ইউরিডিসি। কিন্তু অরফিয়াস একবারও পিছন ফিরে তাকাতে পারবেন না। পিছনে তাকালেই তিনি চিরকালের জন্য হারাবেন ইউরিডিসিকে। অরফিয়াস রাজি এই শর্তে। তাঁরা ফিরে চললেন। দীর্ঘ পথ। সেই পথে চলছেন ইউরিডিসি অরিফিউসকে অনুসরণ করে। কঠিন পথে ইউরিডিসি যেন ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছেন। তবু অন্ধকার রাজ্য একসময় শেষ হয়ে এল। বাইরে অরফিয়াস দেখতে পেলেন সূর্যের সুন্দর আলো। কিন্তু তাঁর মনে ভয় এল। রাজা হেডিস তাঁর সাথে কোনও ছলনা করেননি তো? ইউরিডিসি তাঁকে অনুসরণ করছেন তো? আছেন তো তিনি পিছনে? চঞ্চল হল তাঁর মন। নিজের অজান্তেই পিছন ফিরে তাকালেন তিনি। আর আর্ত এক চিৎকার করে ইউরিডিসির ছায়ামূর্তি চিরতরে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। চিরতরে তাঁকে হারালেন অরফিয়াস। তাঁর হৃদয় দুঃখে ভেঙে পড়ল।

পৃথিবীতে ফিরে এলেন অরফিয়াস। মানুষের থেকে বহুদূরে সরে গেলেন তিনি। শুধু তরুণ একদল ভক্ত পরিবৃত হয়ে থাকতেন তিনি। অগণিত মানুষ কাছে আসতে চাইত। কিন্তু অরফিয়াস কাউকে সেভাবে পাত্তা দিতেন না। শেষে অরফিয়াসের আচরণে আর প্রত্যাখানে ক্ষুব্ধ আর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল অনেকে। ক্রোধের উন্মাদনায় একদিন তারা অরিফিউসকে নদীর ধারে পেয়ে তাকে হত্যা করল। তিনি তখন গান গাইছিলেন। টুকরো টুকরো করে ফেলল তাঁর দেহ। তারপর তাঁর মাথা তাঁর বীণার ওপর গেঁথে বীণাটিকে ভাসিয়ে দিল নদীর জলে। নদীর জলের স্রোতে নিম্নগামী হয়ে ভেসে চলল অরফিয়াসের মাথা। কিন্তু তাঁর কণ্ঠে তখনও গান। সে গান ভেসে যাচ্ছে নদীর দুই পাড়ের দিকে, আকাশের সূর্যের দিকে। সমুদ্র পানে বহুদূরে ভেসে সেই মাথা তারপর পৌঁছল লেসপস দ্বীপের কাছে। তাঁর পিতা সূর্যদেব আপোল্লন তাঁকে গান থামাতে বললেন। তাঁর গান স্তব্ধ হল। চিরকালের জন্য।
আমাদের এই গল্পের সাথে যুক্ত আছে আর একটি গল্প। অরফিয়াসকে নদীর ধারে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানেই কিছুদিন পর জন্ম হল এক অন্ধ শিশুর। সেই শিশু হয়ে উঠল পুরাকালের এক মহান চারণ কবি, দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ এক মহাকবি। তাঁরই নাম হোমার। তিনিই এই সমস্ত পুরাকাহিনিগুলি লিপিবদ্ধ করে যান। অরফিয়াস যে গান গেয়েছিলেন, তাঁর সব বাণী গেছে হারিয়ে। কিন্তু হোমারের গান আজও বেঁচে আছে — গ্রিক মহাকাব্য ইলিয়াড ও ওডিসি।

 

[চিত্রসূত্র — অরফিয়াসের ছবিটি ‘মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস, বস্টন’-এর ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া হয়েছে।]

Leave a Reply

Your email address will not be published.