রবীন্দ্রসঙ্গীত ও তার ব্যাপ্তি: এক অনন্য ধারা সৌরাংশু

সময়টা নব্বইয়ের শুরুর দিক, কান আর মন ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতি খাড়া হচ্ছে। সে সময়ই শুনলাম, প্রথমবার, রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট আধুনিক নন। রবীন্দ্রসঙ্গীত সেকেলে, ধীরগতির।

 

আসলে আমাদের জন্ম বেড়ে ওঠা যে পরিবেশে, সেখানে সবার আগে জোড়াসাঁকোর ওই বিশ্ববরেণ্যর গানই প্রথম কানে ঢোকে, মনে বাসা বাঁধে। তারপর অন্য কথা। তার উপর পাশ্চাত্য সঙ্গীত সম্পর্কে অজ্ঞতা তো ছিলই। স্বাভাবিকভাবেই, ঝটকা লেগেছিল। কিন্তু দরজা বন্ধ করে বসে থাকার সে সময় নয়। সবে বাংলায় আর্বান ফোক বা ব্যালাড কানে ঢুকছে। মন খুলছে। সেই খোলা মন নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করলাম।

 

ভদ্রলোক প্রায় সোয়া দু-হাজার গান ছাপার অক্ষরে লিখেছেন এবং হিসেব করে দেখলে প্রায় আটষট্টি বছর ধরে তিনি গান রচনা করেছেন। দীর্ঘজীবনের সুবিধা অবশ্যই পেয়েছেন। কিন্তু এটা দেখতে হবে তিনি যখন জন্মেছিলেন, তার কাছাকাছি বা বেশ কিছু পরে আরও চার গীতিকার ও সুরকার বাংলা গানে নিজেদের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত এবং নজরুল। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মিলে আজও এঁদের গান পঞ্চকবির গান হিসাবে গাওয়া হয়। এঁদের প্রত্যেকেই তাঁদের স্বীয় যোগ্যতায় বাংলা গানের জগতে অমরত্ব লাভ করেছেন। কিন্তু যে কানটাকে এতদিন ধরে শিক্ষিত করে তুলছি সে এখন রবীন্দ্রসঙ্গীতের মণিমুক্তোর আভাস পেতে শুরু করেছে। আসলে রবীন্দ্রনাথের গান ভাবাশ্রয়ী মূলত। অর্থাৎ সুরক্ষেপণ গানের কথার প্রকৃত অর্থের পরিপ্রেক্ষিতেই হয়ে উঠেছে।

 

কিন্তু সেই সুরক্ষেপণে এত বৈচিত্র্য, এ কি শুধুমাত্র দীর্ঘজীবন এবং বহুদিন ধরে গান রচনার কারণে? সে হিসাবে দেখতে গেলে নজরুলের গান রচনা রবীন্দ্রনাথের থেকেও বেশি। তবে? এই ‘তবে’টার জন্য আমাদের রবীন্দ্রনাথের আহরণ করার ক্ষমতাকে খুঁজতে হবে। সারাজীবন ধরে যে যে ধরনের গান তিনি শুনেছেন তা তাঁর কবিচেতনাকে কতটা উদ্বেলিত, আন্দোলিত এবং উন্মুক্ত করেছিল তা তাঁর সৃষ্টিগুলিকে শুনলেই বোঝা যায়।

জীবনের প্রথম গান বা অনেকের মতে রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রথম গানটিকেই ধরা যাক,

‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে,

তারকামণ্ডল চমকে মোতি রে…’

 

এই গানটি গুরু নানক রচিত ভজন, ‘গগন মে থাল রবি চন্দ্র দীপক বনে’র প্রায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে হুবহু অনুবাদ। মাত্র এগারো বছর বয়সে নানকের ভজন তিনি কোথায় শুনলেন? সেই যে বাবামশায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নিয়মিত ছোট্ট রবিকে নিয়ে উত্তরের হিমালয়ে ছুটি কাটাতে যেতেন। তারই পথে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে এই গান শুনে কিশোর রবি নিজের গান রচনা করেন।

এইভাবে ক্রমশ সারা বিশ্বের বিভিন্ন সঙ্গীত তাঁকে সময়ে সময়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বিশেষত পাশ্চাত্য সঙ্গীত। উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বেড়া টপকে রবীন্দ্রনাথের গান ও সুরক্ষেপণ সুদূরপ্রসারী হয়েছিল।

যদিও পাশ্চাত্য সঙ্গীত নিয়ে তাঁর স্বতন্ত্র মনোভাব ছিল। জীবন স্মৃতি গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করছেন, “আমি যথার্থই য়ুরোপীয় সঙ্গীতের রসভোগ করিয়াছি তখনই বারম্বার মনের মধ্যে বলিয়াছি ইহা রোমান্টিক ইহা মানবজীবনের বিচিত্রতাকে গানের সুরে অনুবাদ করিয়া প্রকাশ করিতেছে। আমাদের সংগীতে কোথাও কোথাও সে চেষ্টা নাই যে তাহা নহে, কিন্তু সে চেষ্টা প্রবল ও সফল হইতে পারে নাই।”

কেবল পাশ্চাত্য সঙ্গীত নয়; বরং পাশ্চাত্য যন্ত্রানুষঙ্গের সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে পারিবারিকভাবেই। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ মূলত দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “… পিয়ানো বাজাইয়া জ্যোতিদাদা নতুন নতুন সুর তৈরি করায় মাতিয়াছিলেন। প্রত্যহই তাহার অঙ্গুলি নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে সুরবর্ষণ হইতে থাকিত। … তাহার সেই সদ্যোজাত সুরগুলিকে কথা দিয়া বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টায় নিযুক্ত ছিলাম।”

 

আরেক জায়গায় বলছেন, “আমার মনে হয় রাত্রের জগৎটা আমাদের ভারতবর্ষের সংগীত, একটি বিশুদ্ধ করুণ গম্ভীর অমিশ্র রাগিণী। আমরা ভারতবর্ষীয়েরা সেই রাত্রির রাজত্বে থাকি। আমরা অখণ্ড অনাদির দ্বারা অভিভূত। আমাদের নির্জন এককের গান। আমাদের গানে শ্রোতাকে মনুষ্যের প্রতিদিনের সুখদুঃখের সীমা থেকে বের করে নিয়ে নিখিলের মূলে যে-একটি সঙ্গীহীন বৈরাগ্যের দেশ আছে সেইখানে নিয়ে যায়।”

রবীন্দ্রনাথের গানে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রভাব প্রসঙ্গে যদি কয়েকটি উদাহরণ আমরা দেখি।

 

ব্যারিস্টারি পড়তে প্রথম বিলেত যাত্রা রবীন্দ্রনাথের ১৮৭৮-এ। যদিও সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি, তবুও পাশ্চাত্য গানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় তাঁর সে সময়ই। আর তার প্রভাব দেখি বিলাতফেরত প্রথম গীতিনাট্যে। ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’র গানগুলিতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের অপূর্ব মিলন গানগুলির নাট্যমান উন্নত করেছে। ‘এনেছি মোরা এনেছি দেখ…’ গানটি ‘He’s a jolly good fellow’-র সুরের অনুকরণে বানানো।

জীবনস্মৃতিতেই দেখি বাল্মীকি-প্রতিভা নিয়ে তিনি লিখছেন, “বাল্মীকি-প্রতিভার অনেকগুলি গান বৈঠকী গান ভাঙা— অনেকগুলি জ্যোতিদাদার সুরে বসানো— এবং গুটিতিনেক গান বিলাতী সুর হইতে লওয়া।” কোনও কোনও গান আইরিশ মেলোডি থেকে ভাঙা, আবার কোনও গানের মূল আবার “কর্তাদাদামশায়ের মুখে শোনা ফার্সী গান…”

 

রবীন্দ্রনাথ জীবনের প্রথমভাগেই যখন ইউরোপে পড়তে গেলেন, তখন থেকে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হলেন। স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত কবি রবার্ট বার্নস রচিত বিখ্যাত গান Auld Lang Syne  রবীন্দ্রনাথের মানসপটে দাগ কাটল দারুণভাবে। এই গানটি এতটাই জনপ্রিয় যে, কেবল স্কটিশভাষীরা নন, বরং ইংরেজিভাষী দেশগুলোর নাগরিকরা মৃত্যুতে কিংবা সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কিংবা যে কোনও বিদায়ে গানটি গেয়ে থাকেন। এই গানটিই বহুল পরিচিত ‘পুরানো সেই দিনের কথা’র সুরের মূল। শুধু তাই নয়, Auld Lang Syne গানটির যে ভাবানুবাদ কবি করেন, তাতে যে সকল দৃশ্যকল্প ব্যবহার করেন, তা শুনে বোঝার উপায় নেই যে গানটি মৌলিক নয়। যদিও ভাবানুবাদের পরে গানটির উত্তরণ হয়েছে বলেই বিশ্বাস।

“Drink to me only with thine eyes,
And I will pledge with mine;
Or leave a kiss within the cup,
And I’ll not ask for wine.”

এই গানটি প্রখ্যাত ব্রিটিশ নাট্যকার বেন জনসনের ‘Song to Cella’ কবিতা অবলম্বনে রচিত। সুর ব্যবহার করলেন রবীন্দ্রনাথ, মূল ভাবটিও নিলেন কিন্তু লিখে ফেললেন,

“কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমারই চরণে দিব হৃদয় তুলিয়া”

 

এরপরে যে গানটি দেখব, সেটি ‘আহা আজি এ বসন্তে’। একই সুরে ‘ওহে দয়াময়’ বা কালমৃগয়া নাটকে ‘মানা না মানিলে’ গানদুটিও রচিত। ‘আহা আজি এ বসন্তে’ গানটি আইরিশ কবি থমাস মূরের রচনা ‘Go where glory waits thee’র ভিত্তিতে রচিত এবং সুরটি আইরিশ গান ‘Maid of the valley’ অনুকরণে রচিত।

আবার ‘Vicar of Bray’ গানের সুর ব্যবহার করে কাল-মৃগয়া নাটকের প্রথম দৃশ্যের গান ‘ও দেখবি রে ভাই আয় রে ছুটে’ বা ‘The British Grenadiers’-এর সুরের ভিত্তিতে তারই পরবর্তী গান ‘ও ভাই দেখে যা’ ইত্যাদি গানও রয়েছে। এছাড়াও ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা’, ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’, ‘প্রাণ চায় চক্ষু না চায়’ প্রভৃতি গানগুলি পশ্চিমী সুরাবলম্বনে গঠিত।

শুধু কি পাশ্চাত্য সঙ্গীত, সুরের খোঁজে রবীন্দ্রনাথ ভারতের বিভিন্ন স্থানেও খনন করেন। যেমন, কানাড়ি গান ‘সখী বা বা’-এর মতো করে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘বড়ো আশা করে এসেছি গো, কাছে ডেকে লও’ গানটি।  কবিগুরুর ‘কোথা আছ প্রভু’ গানে গুজরাটি সুর স্পষ্টরূপেই শ্রুত হয়। মাদ্রাজি গান ‘নিতু চরণমূল’-এর ধাঁচে লিখলেন, ‘বাসন্তী হে ভুবনমোহিনী’; তামিল সুরে লিখলেন, ‘বাজে করুণ সুরে’; দক্ষিণী গান ‘বৃন্দাবন লোলা’ অবলম্বনে ‘নীলাঞ্জন ছায়া’; মারাঠী গান ‘নাদবিদ্যা পরব্রহ্মা’ অনুসরণে ‘বিশ্ববীণা রবে’ ইত্যাদি। এছাড়াও কর্নাটকী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধারায় তিনি লিখলেন ‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’ গানটি।

আসলে রবীন্দ্রনাথকে যে গুণটি অন্যদের থেকে তাঁকে আলাদা করে রেখেছে, সেটি হল তাঁর আহরণ ক্ষমতা। মৌমাছির মতো তিনি নবনিত্যনূতনের পিছনে ছুটে বেড়িয়েছেন এবং যা কিছু নূতন দেখেছেন গ্রহণ করেছেন দু-হাতে। তা-ই যখন তাঁর গানের মধ্যে সুরের মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে, তখন তা কালজয়ী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

বাউল গানের ক্ষেত্রেও যদি দেখি, তাহলে বুঝতে পারব এই পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মাঝামাঝি অঞ্চলের আধ্যাত্মিক দেহতত্ত্বের এই গানকে জনপ্রিয় করার পিছনে রবীন্দ্রনাথের অবদান অপরিসীম। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে শিলাইদহতে জমিদারি দেখাশোনার সময় তিনি বাউল ধারার সংস্পর্শে আসেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধগুলিতে তিনি লিখছেন, “দেখেশুনে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথায় উল্লেখ করেছি যে, একেবারে পাড়া গাঁয়ে কিছু লোক নিজের মনে গান গেয়ে চলেছেন। এঁরা একটি গোত্রের লোক, বাংলার জনপ্রিয় এক সম্প্রদায়, যাঁরা বাউল নামে পরিচিত। তাঁদের কাছে কোনো মূর্তি নেই, মন্দির নেই, শাস্ত্র বা তা নিয়ে অনুষ্ঠান নেই। তাঁরা গানের মাধ্যমে মানুষের মধ্যকার দেবত্বকে প্রকাশ করে এবং সেই মানুষকে ভালোবাসার প্রতি এক তীব্র অনুভূতি ব্যক্ত করে।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউলগানের এই ‘লিরিক্যাল বিউটি অ্যান্ড টিউন’-এ গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বাউল দর্শনের আধ্যাত্মিক রোমান্টিসিজমে রবীন্দ্রনাথ এতটা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, তিনি নিজেকে রবীন্দ্র-বাউল বলে সম্বোধন করা শুরু করেন।

এই স্বল্প পরিসরে রবীন্দ্রনাথের ভাবধর্মী লিরিক এবং সুরের বিস্তারের বিপুলতাকে সামান্য মাত্র ছোঁয়ার চেষ্টা করেছি। যে সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান বাঁধতে শুরু করেছি, তার আগে এবং আশেপাশের সময়ের অন্যান্য বাংলা গানের ধারাগুলিকে যদি বিচার করে দেখি তাহলে দেখতে পাব, রবীন্দ্রসঙ্গীত তার বৈচিত্র্যের কারণেই স্বকীয়তাবোধে অনন্য।

ভাবধর্মী হবার জন্য তা কালজয়ী এবং পৃথিবীব্যাপী সুরের পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং তার সফল প্রয়োগের কারণেই সমসাময়িক গানের নিরিখে আধুনিক। এই প্রসঙ্গে একটি গানের কথা না উল্লেখ করে পারছি না, কেদার রাগে রচিত ‘কে দিল আবার আঘাত’ এই গানটির কথা। ভাব ছেড়ে রাগের সরগমে ডুবলে, প্রথম অন্তরায় ‘বহুকাল হল বসন্ত দিন এসেছিল এক অতিথি নবীন’ অংশে বসন্ত দিন ও এসেছিল-র মাঝে ফাঁক পড়ে না। সেক্ষেত্রে কথার মানেই বদলে যায়। একইভাবে যখন ‘আজি গোধূলিগগনে’ গানটিতে ‘সে আসিবে’ গাইতে যাই, তখন দেখি প্রথম দুইবারের বিশ্বাস বা ভরসা শেষবারে নিশ্চিতিতে বদলে যায় এবং সুরে তার প্রকাশও পায়।

 

এভাবে দেখতে শুরু করলে, রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভিন্ন অবস্থায় ব্যক্তিগত আবেগকে শব্দ ও সুরের মাধ্যমে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম। এবং তার সংখ্যা ও ব্যাপ্তির কারণে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোনও না কোনও গান আমাদের বৈতরণী পার করে দেবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে গানের ওপারে।

 

সেই যে বিরূপ মন্তব্যে ঝটকা খেয়ে রবীন্দ্রগান ছুঁয়ে দেখার পথ চলা শুরু হয়েছিল, তা প্রায় তিরিশ বছর পেরিয়ে এসেও নিরন্তর চলেছে।  আর এতদিন বাদে বিলক্ষণ টের পেয়েছি, গান শুনতে যেমন কান তৈরি করতে হয়, তেমনই অনুভব করতে মনকে প্রস্তুত করতে হয়। না হলে কোথায় কোন সুরের মোচড় হল আর না বুঝেই হৃদয় চমৎকৃত হল, এভাবেই গান শোনা সারা হবে আমাদের। রবীন্দ্রগান তার অননুকরণীয় ঘরানা নিয়ে আমাদের সম্মুখে যে বিশাল প্রাসাদ তুলে দাঁড়িয়ে আছে, তার অঙ্গসজ্জায় মণিমাণিক্যের গমক, দমক, চমক নেই। শুধু আছে অন্তর্মুখী এক সঙ্গীতের ফল্গুধারা, যা অনুভবের মাধ্যমে সাকার হয়ে ওঠে।

 

শেষে ১৮৮১-তে লেখা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত বিষয়ক প্রবন্ধ উদ্ধৃত করি।

“আমাদের দেশে সংগীত এমনি শাস্ত্রগত, ব্যাকরণগত, অনুষ্ঠানগত হইয়া পড়িয়াছে, স্বাভাবিকতা হইতে এত দূরে চলিয়া গিয়াছে যে, অনুভাবের সহিত সংগীতের বিচ্ছেদ হইয়াছে, কেবল কতকগুলা সুসমষ্টির কর্দম এবং রাগরাগিণীর ছাঁচ ও কাঠামো অবশিষ্ট রহিয়াছে; সংগীত একটি মৃত্তিকাময়ী প্রতিমা হইয়া পড়িয়াছে— তাহাতে হৃদয় নাই প্রাণ নাই।… সংগীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই, যাহাতে সে সমাজের বয়সের সহিত বাড়িতে থাকে, সমাজের পরিবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে, সমাজের উপর নিজের প্রভাব বিস্তৃত করিতে পারে ও তাহার উপরে সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত…।”

 

রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন ধরে সঙ্গীতকে বিমূর্ত প্রতিমা থেকে মূর্ত হৃদয়সম্বলিত এক মানবিক মননে পরিণত করতে নিরন্তর প্রয়াস করে গেছেন। ওস্তাদের গিটকিরিতে নয়, রবীন্দ্রগানের প্রকাশ তার আত্মার পরিস্ফুটনে। গান যে শুধু সুর আর লিরিক দিয়ে মানুষকে চমকে দেবার মতো কিছু নয়, প্রতিটি উপকরণকে সঠিক মাত্রায় মেশাতে পারলেই তা কালোত্তীর্ণ হয়, সে রবীন্দ্রনাথ আজ থেকে প্রায় সোয়া একশ বছরেরও বেশি আগে অনুধাবন করেছিলেন, এবং সারা জীবন ধরে তার সঠিক প্রকাশের প্রয়াস করে গেছেন। ফলে আজ তাঁর মৃত্যুর আশি বছর পরেও রবীন্দ্রসঙ্গীত তার নিজস্ব বহমানতা নিয়ে এখনও উজ্জ্বল, জীবন সুধায় পরিপূর্ণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.