ভারত তখন ইংরেজ শাসকদের অধীনে। শাসনব্যবস্থা চালাতে সারা দেশে প্রচুর ভারতীয়কে তারা নিজেদের সেনাবাহিনীতে চাকরি দিয়েছিল। সেইসব সেনাদের থাকার বন্দোবস্ত, তাদের ছেলেমেয়েদের জন্যে স্কুলের ব্যবস্থা সবই করেছিল ইংরেজরা। এমনই এক স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন রামজি শকপাল নামের এক সেনা। আমরা যে সময়ের কথা বলছি, তখন মধ্যপ্রদেশের মৌ নামের এক ছোট্ট শহরে রামজি তাঁর পরিবার নিয়ে থাকতেন। সেনাবাহিনীর কাজে তাঁকে ভারতের নানা জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। বেশ কিছু ছেলেমেয়েও হয়েছিল। কিন্তু তাদের অধিকাংশই রোগে ভুগে মারা যায়। শেষমেশ ১৮৯১ সালের ১৪ এপ্রিল রামজির স্ত্রী ভীমাবাঈ এক সুস্থ সবল ছেলের জন্ম দিলেন। গোলগাল চেহারা, মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল। যে দেখে, সে-ই আদর করতে চায়। মায়ের নামে নাম মিলিয়ে সে ছেলের নাম রাখা হল ভীমরাও, সঙ্গে যোগ হল বাবার নাম আর পদবি— ভীমরাও রামজি শকপাল।
ভীমের যখন তিন বছর বয়স, তখন রামজি সেনাবাহিনীর কাজ থেকে অবসর নিলেন। তাঁদের পরিবার মৌ ছেড়ে মহারাষ্ট্রের পাহাড়ি অঞ্চলের একটা ছোট জনপদ সাতারায় নতুন করে বসবাস শুরু করল। টালির চালে ছাওয়া পাকা বাড়ি। সামনে বেশ কিছুটা খেলার জায়গা। ভাইবোনদের সঙ্গে হেসেখেলে দিন কাটছিল ভীমের। জন্মের পর থেকেই তার মায়ের শরীর ভালো যাচ্ছিল না। ভীমের যখন পাঁচ বছর বয়স, তার মা চলে গেলেন। রামজির সংসারের হাল ধরতে এক মাসি এসে ভীমরাও আর তার ভাইবোনদের দায়িত্ব নিলেন।
ছোটবেলা থেকেই বইপত্রের প্রতি ভীমের দারুণ আগ্রহ ছিল। দাদা-দিদিদের বই নেড়েচেড়ে দেখত সে। তাই একদিন তার বাবা যখন স্কুলে ভরতি করার কথা শোনালেন, আনন্দে তার মনটা নেচে উঠল।
অত উৎসাহ নিয়ে স্কুলে গিয়ে প্রথমদিনই কিন্তু একটা বড়সড় ধাক্কা খেতে হল তাকে। আর সব ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সে বসতে যাচ্ছিল। একজন ভারিক্কি চেহারার মাস্টারমশাই এসে তাকে ঘরের একটা কোণ দেখিয়ে দিলেন— “ওখানে বোস তুই। আর শোন, এই মাদুর তোর জন্যে নয়। কাল থেকে একটা বস্তা আনবি বাড়ি থেকে। সেটাতেই বসবি। ইস্কুল ছুটি হয়ে গেলে সেটা নিয়ে আবার বাড়ি চলে যাবি। তোর আসন রেখে আমি ক্লাসঘর অপবিত্র করতে পারব না।”
ছোট্ট ভীম তখন কিছুই বুঝতে পারল না বটে। কিন্তু পরে তার মাসিকে জিজ্ঞাসা করে বুঝল, তারা আসলে নিচু জাতের মানুষ। মাহার। তার বাবার বাবার বাবা বা তারও আগের চোদ্দো পুরুষ রাস্তাঘাট সাফ করত। তাই তাদের ছুঁলে উঁচু জাতের মানুষরা অপবিত্র হয়ে যাবে। তাদের ছোঁয়া যায় না, তাই তারা অস্পৃশ্য।
এই অস্পৃশ্যতার অভিশাপ এরপর ছোট ভীমের মন কুরে কুরে খেয়েছে। স্কুলে টিফিনের সময় খেলে-টেলে সবাই ক্লান্ত হয়ে এসে স্কুলবাড়ির বারান্দার এককোণে রাখা জলের কুঁজো থেকে জল খাচ্ছে। ভীম হাত বাড়াতে যাবে, এমন সময় কোত্থেকে তেড়ে এল স্কুলের পিওন— “এই যে, তুমিও এর থেকে জল নিয়ে খাবে নাকি! তুমি ছুঁলে আর কারও জল খাওয়া হবে না।” ভীম থতমত খেয়ে পিছিয়ে গেল। পিওনের মনে খানিক দয়া হল মনে হয়। তাই বলল, “দাঁড়াও। আমি জল ঢেলে দিই, তুমি খাও।” একটা ছোট বাটি করে জল নিয়ে একটু উঁচ থেকে ভীমের হাতে সে জল ঢালতে লাগল আর ভীম সেই জল হাতের তালুতে ধরে চুমুক দিয়ে খেতে লাগল। তৃষ্ণার জলের ব্যবস্থা এভাবেই হল। একদিন সেই পিওন কোনও কাজে ব্যস্ত ছিল। বেচারা ছোট্ট ভীম গ্রীষ্মের সেই দুপুরে একফোঁটাও জল খেতে পেল না।
আর একটু বড় হতে সে ক্লাসের এক মাস্টারমশাই আম্বেদকর স্যরকে জিজ্ঞাসা করল— “স্যর, আপনি যে আমাদের কবীর আর নামদেবের কথা পড়ান। তাঁরা তো বলেছেন সব মানুষ সমান। তাহলে আমি আর সবার সঙ্গে বসতে পারি না কেন? আর সবার সঙ্গে একসঙ্গে জল খেতে পারি না কেন? কোনও নাপিত কেন নিচু জাত বলে আমার চুল কেটে দেয় না?” আম্বেদকর স্যর ছোট ভীমের মনের যন্ত্রণা বুঝলেও নিরুপায়। তিনি ভীমকে আর সবার সঙ্গে বসতে দিলে উঁচু জাতের মানুষরা তাদের ছেলেমেয়েদের ওই স্কুলে পাঠাবে না আর। স্কুল বন্ধ করে দিতে হবে। তাই ভীমের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “ঠিক আছে, আমি তোমার পদবি শকপাল বদলে স্কুলের খাতায় আমার পদবি বসিয়ে দিচ্ছি। এতে হয়তো লোকে তোমার সঙ্গে অন্য রকম ব্যবহার করবে।” একটু থেমে বললেন, “তবে বাবা, পড়াশোনা করে বড় হলে তুমি এই নিচু জাতের লোকগুলোর জন্যে কিছু কোরো।”
ভীমের নতুন নাম হল ভীমরাও রামজি আম্বেদকর। পদবি বদলে বিশেষ কিছু লাভ হল না যদিও, সবাই আগের মতোই তার ছোঁয়াচ এড়িয়ে চলত। কিন্তু আম্বেদকর স্যরের ওই কথাটা তার মনে ধরেছিল— পড়াশোনা করে বড় হতে হবে। নিচু জাতের লোকগুলোর জন্যে কিছু করতে হবে।
ভীমের বয়স যখন নয়, তখন ভীমের বাবা কোরেগাঁও নামের অন্য একটা শহরে ইংরেজ সরকারের নতুন একটা চাকরি পেলেন। রামজি ততদিনে নতুন বিয়েও করেছেন। ভীমের সৎমাকে নিয়ে তিনি চলে গেলেন কোরেগাঁওতে। ভীমরা তাদের মাসির সঙ্গে সাতারাতেই থেকে গেল। এরপর গরমের ছুটিতে রামজি তাঁর ছেলেদের ডেকে পাঠালেন একসঙ্গে ছুটি কাটাতে। নির্দিষ্ট দিনে সাজগোজ করে চার ভাই ট্রেনে চেপে রওনা হল। তাদের নামতে হবে মাসুর স্টেশনে। সেখান থেকে রামজি এসে নিয়ে যাবেন তাদের কোরেগাঁও।
কিন্তু স্টেশনে নেমে তারা পড়ল বিপদে। বাবা আসেননি। হয়েছে কী, যাত্রার দিনক্ষণ জানিয়ে রামজিকে যে চিঠি ভীমের বড়দা লিখেছিল, সেটা ঠিক সময়ে তাঁর হাতে পড়েনি। অফিসের এক সহকর্মী চিঠিটা তাঁকে দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। এদিকে সন্ধে হতে চলল, কোথায় যাবে তারা?
চারটে বাচ্চা ছেলেকে অনেকক্ষণ প্ল্যাটফর্মে বসে থাকতে দেখে স্টেশন মাস্টার এসে খোঁজ নিলেন— “কে বাবা তোমরা? দেখে তো ভদ্রঘরের ছেলে মনে হচ্ছে। তা এখানে কেন?” রামজির দাদা তাঁকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলল। তিনি প্রশ্ন করলেন, “কোন বাড়ির ছেলে তোমরা?” রামজি সটান উত্তর দিল— “আমরা মাহার।” মুহূর্তে বদলে গেল স্টেশন মাস্টারের চেহারা। এতক্ষণ বাবা-বাছা করে কথা বলছিলেন, এবার রীতিমত বিরক্ত হয়ে বললেন, “তাহলে তোরা কোরেগাঁও যাবিই বা কী করে? স্টেশনের বাইরের কোনও গাড়িই তো তোদের নিয়ে যাবে না।” সত্যিই বিপদের কথা! চার ভাই যখন হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসবে ভাবছে, এমন সময় স্টেশন মাস্টারই একজন লোককে নিয়ে এলেন সঙ্গে করে।
“শোন, তোরা গরুর গাড়ি চালাতে পারিস?”
বড়দা মাথা নাড়ল।
“একে দ্বিগুণ ভাড়া দিলে তোদের গাড়িতে উঠতে দেবে। তোরা চালাবি, ও পাশে পাশে যাবে।”
মাহারদের সঙ্গে এক গাড়িতে বসে যেতে আপত্তি সেই গাড়িওয়ালার। অবশ্য ভাড়া নিতে বাধা নেই তাতে। তাও আবার দ্বিগুণ।
যাই হোক, চার ভাই সেভাবেই চলতে শুরু করল। কিছুদূর গিয়ে এক গ্রামের কাছে পৌঁছে গাড়িওয়ালা বলল, “আমার খিদে পেয়েছে। আমি খেতে চললাম। তোমাদের কাছে কিছু থাকলে খেয়ে নাও। জল খেতে চাইলে ওদিকে নালা আছে।” ভীমদের বাড়ি থেকে টিফিন কৌটো করে খাবার দিয়েছিল তাদের মাসি। এক ভাই জলের খোঁজে দেখিয়ে দেওয়া নালার দিকে গেল। কিন্তু ফিরে এল খালি হাতে। গ্রীষ্মে নালা শুকিয়ে শুধু কাদাজল। মুখে দেওয়া যায় না। জলের অভাবে না খেয়েই রইল তারা। একসময় গাড়িওয়ালা ফিরে এলে আবার যাত্রা শুরু হল।
অনেকটা পথ চলার পরে দূরে একটা আলো দেখিয়ে গাড়িওয়ালা বলল, “আর যেতে পারব না। আমাদের ওখানেই রাত কাটাতে হবে।” সেই জায়গাটা ছিল টোলের একটা অফিস। এখন যেমন রোড ট্যাক্স নেওয়ার জন্যে টোল বুথ থাকে, তেমনই। খিদেয় তেষ্টায় কাতর ভীম জিজ্ঞাসা করল, “ওখানে জল পাওয়া যাবে?” গাড়িওয়ালা একটু ভেবে বলল, “তোমরা যে মাহার, সেটা বোলো না। মুসলমান বোলো। জল দিলেও দিতে পারে।”
ভীম বেশ সাহসের সঙ্গেই এগিয়ে গেল। সে মুসলমানদের মতো কথা বলতে পারবে বইকি। স্কুলে তো সে উর্দু পড়ছে। নিচু জাত বলে সংস্কৃত পড়ার অনুমতি পায়নি। টোলের অফিসারকে গিয়ে জল চাইল। পরিচয়ে জানাল সে মুসলমান। কিন্তু সেখানেও ফল হল না। তেরিয়া হয়ে সেই অফিসার জবাব দিলেন— “এখানে জল-টল কিছু নেই। মুসলমানদের জন্যে কি জল নিয়ে বসে আছি আমরা? ওই পাহাড়ের ওপরে একটা গ্রাম আছে। ওখানে পেয়ে যাবে।”
সামনের উঁচু কালো পাহাড়টা অন্ধকারে দৈত্যর মতো দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে চড়ার মতো সাহস কারও হল না। খালি পেটে বিনা জলে দীর্ঘ রাত কাটল চার ভাইয়ের। পরদিন সকালে বাবার কাছে পৌঁছে হু হু করে কেঁদে ফেলল তারা।
নিচু জাতের মানুষ হওয়ার সেই অপমান সারা জীবন ভুলতে পারেনি ভীম। তৃষ্ণার জলটুকু এগিয়ে দেয়নি কেউ।
খুব মন দিয়ে এরপর পড়াশোনা করতে লাগল ভীম। স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে গিয়ে ভরতি হল বোম্বের এক কলেজে। সেখানে দারুণ ভালো রেজাল্ট করার জন্যে বরোদার মহারাজ তাকে স্কলারশিপ দিয়ে পাঠালেন আমেরিকার কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি। অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করে ভীমরাও রামজি আম্বেদকর পাড়ি দিলেন লন্ডনে। সেখানে গবেষণা শেষ করে ফিরে এলেন ভারতে।
ইংরেজদের থেকে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার লড়াইয়ের পাশাপাশি তিনি লড়তে লাগলেন অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধেও। নিচু জাতির মানুষদের কী ধরনের অবিচার ভোগ করতে হয়, তা সবাইকে জানাতে তিনি প্রকাশ করলেন ‘বহিষ্কৃত ভারত’ নামের এক সংবাদপত্র। মহদ নামের এক গ্রামের একটা পুকুর থেকে নিচু জাতের মানুষরা জল নিতে পারত না। ভীমরাও শয়ে শয়ে অস্পৃশ্য মানুষদের নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সেই পুকুরের জল পান করলেন। এই ঘটনাকে মহদ সত্যাগ্রহ বলা হয়।
পরে দেশ স্বাধীন হলে ভীমরাও স্বাধীন ভারতের প্রথম আইন ও বিচার মন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত হন। তাঁর অধীনে ভারতের সংবিধান লেখা হয়। তাতে অস্পৃশ্যতা দূর করে ভারতের সমস্ত নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সারাজীবন অত্যাচারিত নিচু জাতের মানুষের জন্যে লড়াই করেছেন, তাই সারা বিশ্বে ভীমরাও রামজি আম্বেদকরকে আজও অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়।
ছবি – রোকু
Leave a Reply