আমরা ‘কথা বলা’ বলতে যে রকম বুঝি, সেরকমভাবে যে গাছ কথা বলে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু একটি গাছ অন্য গাছের সঙ্গে সংযোগ আর সম্পর্ক রক্ষা করে। একে অন্যকে সাহায্য করে। আগাম বিপদ আশংকার খবর প্রতিবেশী এমনকী দূরের গাছের কাছে সে সংবাদ পাঠাতে পারে। প্রতিবেশী গাছের খাবার কমে গেলে ওদের খাবার দিয়ে সাহায্য করে। এসব কথা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি। বিগত কয়েক দশকের উন্নত গবেষণার ফলাফল থেকে এমন সব তথ্য জানা সম্ভব হয়েছে আজ।
মনে পড়ল, ছোটবেলায় ‘গাছেরও প্রাণ আছে’ বলে একটা লেখা পড়তে হত সে সময়। আজ থেকে প্রায় একশ কুড়ি বছর আগে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুই প্রথম শুনিয়েছিলেন এরকম অভাবনীয় কথা। যদিও তিনি ‘গাছের প্রাণ আছে’— ঠিক এরকমভাবে বলেননি। তিনি বলেছিলেন অন্য প্রাণীদের মতন বাইরে থেকে উত্তেজনা প্রয়োগ, আঘাত, পরিবেশের তারতম্য বা নানান পরিবর্তনে সাড়া দেয় গাছ। তাপমাত্রার তারতম্য বা রাসায়নিক পদার্থের প্রয়োগে উদ্ভিদের বিভিন্ন জীবনক্রিয়া যেমন সালোক সংশ্লেষণ, রস-সঞ্চালন ইত্যাদি প্রক্রিয়াগুলি প্রভাবিত হয়। প্রয়োজনীয় নানান সূক্ষ্ম যন্ত্রাদির সাহায্যে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে গাছের এই সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন। বস্তুত এ এক যুগান্তকারী আবিষ্কার।
তবুও উদ্ভিদ আর প্রাণীদের মধ্যে এত পার্থক্য যে, গাছেরও প্রাণ আছে— এমন কথা মানতে পারা যায় না। আমরা যেমন হাঁটাচলা করি। কথা বলি। শুনতে বা দেখতে পাই। গাছেদের তো আমাদের বা অপরাপর প্রাণীদের সঙ্গে কোনও কিছুই মেলে না। তাই, গাছেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে বা সংযোগ স্থাপন করে— এমন কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। তবে আক্ষরিক অর্থে কথা না বললেও, গাছেরা কিন্তু নিজেদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। কীভাবে এই অভাবনীয় ব্যাপার সংঘটিত হয়, সেই কথাই বলব এখানে।
২০১৫ সালে সমগ্র পৃথিবীর ভূখণ্ডে থাকা মোট প্রায় তিন লক্ষ কোটি গাছের ম্যাপিং করা হয়েছে। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের তিরিশ শতাংশ জায়গা জুড়ে রয়েছে যাবতীয় অরণ্যগুলি। আর এই বিপুল সংখ্যক গাছ কীভাবে বেঁচে থাকে? এমন জিজ্ঞাসা বিজ্ঞানীদের কৌতূহলী করে তুলেছে বিভিন্ন সময়ে। গত শতাব্দীর ষাটের দশক নাগাদ বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, গাছের বৃদ্ধির ব্যাপারে fungus বা ছত্রাকের কোথাও একটি ভূমিকা রয়েছে। একটু একটু করে জানা যায় গাছের সঙ্গে ফাংগাসের পারস্পরিক সংযোগ ও সম্পর্কের বিষয়ে। তবে এসব কিছু মাটির ওপরে নয়, এই বিপুল কাণ্ডকারখানা চলে মাটির নিচে। এ ব্যাপারে মাটির নিচে থাকা ‘ফানজাই’ (fungi হল fungus-এর বহুবচন) বা ছত্রাকপুঞ্জের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। ছত্রাকপুঞ্জের আন্তর্জাল ব্যবহার করে একটি গাছ অন্য গাছের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। একে অন্যকে সাহায্য করে। তাই ছত্রাকদের ‘পৃথিবীর ন্যাচারাল ইন্টারনেট’ বলা হয়ে থাকে। আমাদের মতন গাছেদেরও ইন্টারনেট ব্যবস্থা আছে। আছে ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ (WWW), যা হল ‘Wood Wide Web’। এই সংযোগের ক্ষেত্রে মাটির গভীরে বিভিন্ন গাছের শিকড়েরও খুব বড় ভূমিকা।
ছত্রাকরা গাছের শিকড়ে শিকড়ে যথাযোগ্য জায়গায় স্থায়ীভাবে আস্থানা গেড়ে বসে। অতীব সরু সূতোর মতো জিনিস দিয়ে তৈরি ছত্রাক। যাকে ‘মাইসেলিয়াম’ বলে। এই মাইসেলিয়ামের জালিকা বিস্তার করে থাকে মাটির নিচে। যা আবার বিভিন্ন গাছের ভূগর্ভস্থ শিকড়ের মধ্যে সংযুক্ত। গাছেদের সঙ্গে ছত্রাকদের এই যে সংযোগ ও সম্পর্ক, বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘মাইকোরিজ্যাল’। ফাংগাসের গ্রিক শব্দ fungus (myk’os) এবং root (riza)। এই সংযোগের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট গাছের মধ্যে তৈরি হওয়া কার্বোহাইড্রেট (চিনি জাতীয় খাদ্য) ছত্রাকদের সরবরাহ করে গাছ। তার বিনিময়ে ছত্রাকরা গাছকে সাহায্য করে পটাসিয়াম এবং নাইট্রোজেন মৌলিক পদার্থসহ বিভিন্ন অত্যাবশ্যক পুষ্টিকর পদার্থ দিয়ে। যা মাইসেলিয়ার ও গাছের শিকড়ের মাধ্যমে জলের সঙ্গে শুষে নিতে পারে গাছ। এভাবেই যার যাতে ঘাটতি, তা বিনিময় হয় গাছ এবং ছত্রাকের মধ্যে।
এছাড়াও গাছেদের অনাক্রমতা ব্যবস্থাকে (ইমিউন সিস্টেম) উদ্দীপিত করে সংশ্লিষ্ট ফাংগাল নেটওয়ার্ক। বিস্তীর্ণ গভীর অরণ্যের গাছগুলি মাটির নিচের ছত্রাক জগতের সঙ্গে এভাবেই পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বেঁচে থাকে। চলে নানান তড়িৎ রাসায়নিক ও হরমোন্যাল সিগন্যাল আদান প্রদান। এভাবে গাছেদের খবর পাঠায় তাপমাত্রার ওঠাপড়া কিংবা বৃষ্টি ঝড়ের পূর্বাভাস। কোনও অনিষ্টকারী গাছের উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারলে, সংশ্লিষ্ট ছত্রাকের কাছে খবর যায়। শত্রুগাছকে বিনষ্ট করার জন্যে ফাংগাস তৈরি করে উপযুক্ত টক্সিন অর্থাৎ বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। আর এভাবেই অবাঞ্ছিত গাছের মোকাবিলা করা সম্ভব হয়। মনে রাখতে হবে বিভিন্ন গাছের মধ্যে কোনও প্রতিযোগিতা চলে না সেখানে। ডারউইনের ‘সারভাইভেল অফ দ্য ফিটেস্ট’-এর তত্ত্ব সেখানে অচল।
সারা পৃথিবীর মাটিতে রয়েছে প্রায় তিন লক্ষ কোটি গাছ। মাটিতে থাকা গাছগুলির মধ্যে নব্বই শতাংশ গাছ পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করে মাটির নিচের ছত্রাক জালিকার সহায়তায়। প্রত্যেকটি গাছের আছে শতাধিক ছত্রাক পার্টনার। শুধু একই জাতীয় গাছ নয়, অন্য প্রজাতির গাছের মধ্যেও স্থাপিত হয় এই সংযোগ। সেই জন্যে একটি অরণ্যের প্রতিটি গাছের সঙ্গেই প্রতিটি গাছের সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। যেন একজন আরেকজনের প্রতিবেশী। যেন স্বজন বন্ধু। এই মিথোজীবী সম্পর্ক বজায় রেখেই ওরা বেঁচে থাকে।
সব মিলিয়ে আনুমানিক পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ লক্ষ প্রজাতির ফাংগাস রয়েছে। যারা কাছে দূরে বিভিন্ন গাছের শিকড়ে শিকড়ে বিছিয়ে রাখে নেটওয়ার্ক । বস্তুত এই যে যোগাযোগ ব্যবস্থা— তা মূলত কেমিক্যাল, হরমোন্যাল এবং ইলেক্ট্রো-কেমিক্যেল সিগন্যালের মাধ্যমে সংঘটিত হয়।
মাটির ওপরে থাকা আংশিক গাছের কথাই আমরা ভাবি। অথচ মাটির নিচে যে লক্ষকোটি বন্ধু ছত্রাকের এই বিপুল অজানা সাম্রাজ্য আর গাছের সঙ্গে তাদের সহবস্থান ও সম্পর্ক, তা আমাদের অবাক করে তোলে। শুধু অবাক করাই নয়। এই আশ্চর্যময় ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃতি পরিমণ্ডল ও পরিবেশের ক্ষেত্রে এক বিরাট রক্ষাকবচ।
ছবি — লেখক
Leave a Reply