‘স্ট্যাচু ক্রুজে’র ভিড়ে ঠাসা ডেক থেকেই ছোট্ট তান্নির চোখের বড় বড়, গোল গোল তারায় ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল সেই প্রবাদপ্রতিম ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র সবুজশ্যামল প্রতিবিম্ব। ক্লাসে যখন জর্ডনরা ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ নিয়ে গল্প করে, ও তখন চুপচাপ এক কোণে বসে থাকে। আজ নয় বছরের একজোড়া অবাক চোখের ঝকমকে আয়নায় সেই আকাশ ছোঁয়া মূর্তিখানি ফুরফুরে খুশিতে যখন উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে। ছোট্ট তান্নির এবার নিশ্চিত হয়ে গেছে, এরপর স্কুলের স্যোশাল স্টাডিজ ক্লাসে মিস লেজলি ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র ওপর কোনও প্রশ্ন করলে সবার আগেই যার হাত উঠবে, সে তান্নি ছাড়া আর কেউ নয়।
বাবার অফিস প্রজেক্টের সুবাদে আজ মাসখানেক হল তান্নিরা নিউ ইয়র্কে। আর আজ শনিবার ছুটির ফুড়ুত ফাঁকে বাবা, মা আর তান্নি তিনজনেই সটান এসে হাজির হয়েছে লিবার্টি আইল্যান্ডের ঐতিহাসিক ঘেরাটোপে! আপার নিউ ইয়র্ক উপসাগরের ব্যস্ত কোল জুড়ে জেগে থাকা ছোট্ট এক টুকরো পাথুরে দ্বীপের আনাচেকানাচে তখন নতুন সকালের সোনালি রোদ্দুর হাত-পা মেলে একটু গড়িয়ে নিচ্ছে। সেই নরম রোদের গলানো সোনা গায়ে মেখে ওরা তিনজনে যখন ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র পাদদেশে, ইতিহাসের ছাত্রী মায়ের গলা দিয়ে তখন উপচে পড়ছে এক অদ্ভুত ভালোলাগা। “জানিস তান্নি। মুক্তি, স্বাধীনতার প্রতীক ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ আসলে বন্ধুরাষ্ট্র ফ্রান্সের তরফ থেকে বন্ধুত্বের প্রতীকস্বরূপ এক অনন্য উপহার, যা ১৮৭৬ সালে আমেরিকার স্বাধীনতার শতবর্ষ উপলক্ষে তার ঠিক দশ বছর পর অর্থাৎ ১৮৮৬ সালে ফ্রান্স তুলে দিয়েছিল আমেরিকার হাতে এবং যা পরে আমেরিকার জাতীয় সৌধ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। রোমান স্বাধীনতার দেবী ‘লিবার্টাসে’র আদলে তৈরি এই দেবীরও পরনে ভারী, ঢোলা পোশাক। ফরাসি ভাস্কর ফ্রেডেরিক অগস্ত বারথোল্ডির তৈরি এই ‘লিবার্টি এনলাইটেনিং দ্য ওয়ার্ল্ড’ পেডিস্টাল থেকে ১৫১ ফুট উঁচু, যার পায়ের তলায় পড়ে রয়েছে ভাঙা শিকল যা আসলে মুক্তির জয়গান গেয়ে চলেছে।”
তান্নির উচ্ছ্বসিত বড়বড় চোখের দিকে তাকিয়ে মা বলতে থাকেন, “ভালো করে তাকিয়ে দেখ তান্নি। লোহার কাঠামোর ওপর তামার পাতে মোড়া লিবার্টি মূর্তির বাম হাতে ধরা রয়েছে আইনের বই, যাতে রোমান হরফে খোদাই করা আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসের তারিখটি। ৪ঠা জুলাই, ১৭৭৬। আর ডান হাতে স্বাধীনতার জ্বলন্ত মশাল। মূর্তির মাথায় মুকুটের সাতটি রশ্মির মতো অংশগুলো আসলে সাতটি মহাসাগর ও মহাদেশের প্রতীক। স্বাধীনতার প্রতীক এই ‘লিবার্টি এনলাইটেনিং দ্য ওয়ার্ল্ড’ সাদরে স্বাগত জানিয়েছিল ১ কোটি ২০ লক্ষেরও বেশি সেইসব বহিরাগতদের যারা ১৮৯২ থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যে উন্নত ভবিষ্যতের আশায় আমেরিকায় প্রবেশ করেছিল।”
“জানো মা, আমার ক্লাসে না অ্যাবিগেইল বলে একটি মেয়ে আছে, ওদের সবাই মিলে ইজরায়েল থেকে ১৯৫০ সালে এখানে চলে এসেছিল।” তান্নি তরতরিয়ে বলে ওঠে, মায়ের কাছ থেকে তো ও রোজই গল্প শোনে। আজ স্কুলের গল্প মায়ের কাছে উজাড় করে দেওয়ার পালা।
মা চোখে মুখে কৌতূহলের ছটা ছড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন, “তাই বুঝি?”
“হ্যাঁ, তারপর একসময় ওরা ক্রিকসাইড আপ্যার্টমেন্টের কাছাকাছি বাড়ি কিনে সেটেলড হয়ে যায়। ওরা যখন ব্রিস্টল থেকে এখানে উঠে আসে, তখন ছিল ক্রিসমাসের সময়, ওদের পাশের বাড়িটাতেই থাকত ব্রেন্ডা। ব্রেন্ডারা ক্রিশ্চিয়ান। ব্রেন্ডাও আমাদের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে, শুধু অন্য সেকশনে। একদিন কী হয়েছে জানো, ক্রিসমাসের দিন সকালবেলায় ব্রেন্ডা আর ওর মা একটা ক্রিসমাস ট্রি আর কেক নিয়ে নতুন প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপ করতে এসেছে। গল্প, আলাপ পরিচয়ের পর ব্রেন্ডার মা ওই ক্রিসমাস ট্রি যখন অ্যাবিগেইলের মাকে দিতে যাবে, অ্যাবিগেইলের বাবা তখন বাধা দিয়ে বলেন, ‘আমরা তো ইহুদি, আমরা ক্রিসমাস পালন করি না। এই ক্রিসমাস ট্রি আমরা নিতে পারব না।’ আসলে ইহুদিরা তো হানুকা পালন করে, ওই সময় ওরা বাড়িতে মোমবাতি জ্বালায়। এদিকে উপহার দিতে এসে অপ্রস্তুত হয়ে ব্রেন্ডা আর ওর মায়ের চোখমুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে।”
“তারপর, তারপর?” মা আগ্রহভরে প্রশ্ন করেন।
“তারপর বন্ধুর চোখমুখ শুকিয়ে গেছে দেখে অ্যাবিগেইল বাবার কাছে আবদার করল, ‘ক্রিসমাস ট্রি-টা রেখে দাও না বাবা, আমরা কাউকে জানাব না, তুমিই তো একদিন বলেছিলে, কেউ ভালোবেসে কিছু দিতে এলে তাকে ফেরাতে নেই।’ অ্যাবিগেইলের কথা শুনে ওর বাবা রাজি হলেন ক্রিসমাস ট্রি-টা অ্যাকসেপ্ট করতে। সেই থেকে ক্রিসমাসের সময় অ্যাবিগেইল গিয়ে ব্রেন্ডাদের বাড়িতে ক্রিসমাস ট্রি সাজাতে সাহায্য করে, আর হানুকার সময় ব্রেন্ডা এসে অ্যাবিগেইলের বাড়িতে এসে মোমবতি জ্বালাতে সাহায্য করে।”
“বাঃ! খুব ভালো। এভাবেই তো মিলেমিশে থাকতে হয় তান্নি। তোমাদের কলকাতার স্কুলে স্বামী বিবেকানন্দের একটি বাণী শেখানো হয়েছিল না, ভগবান সকলেরই হৃদয়ে বিরাজ করছেন। যা আমাদের উপলব্ধি করতে শেখায় যে, প্রত্যেককে তার পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদা দিতে হয়। সমস্ত বিভেদ ভুলে ভালোবেসে হাতে হাত মিলিয়ে পথ চলতে হয়।” তান্নির গল্পের দুনিয়ায় বাবা-মা দুজনেই ইতিমধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলেন। দুপুরের রোদ্দুরটাকে কড়া চোখে তাকাতে দেখে বাবা এবার তাড়া লাগালেন, “চলো চলো, এবার আমাদের লিবার্টির পেডিস্ট্যালে প্রবেশ করার পালা, এখনও অনেক কিছু দেখার আছে, অনেক কিছু জানার আছে।”
পেডিস্ট্যাল বা বেদীর অভ্যন্তর থেকে ১৫৪টি ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে তান্নিরা এবার এসে পৌঁছল লিবার্টি ক্রাউনে। যেখানে ২৫টি ক্রাউন উইন্ডো দিয়ে নিউ ইয়র্ক শহরের অবাধ দৃশ্য কয়েক মুহূর্তের জন্য ওদের সকলকেই যেন চুপ করিয়ে দিল। আবার সিঁড়ি বেয়ে ওরা নেমে এল নীচে। ফোর্টউড লেভেল আর সুদৃশ্য মিউজিয়াম ঘুরতে ঘুরতেই ওরা খেয়াল করল, কখন যেন দুপুরের সুয্যিমামা তেতেপুড়ে ওদের মাথার ঠিক উপরে উঠে বসে উন্মত্ত রাগী চোখে আগুন ছড়াতে শুরু করে দিয়েছেন।
লিবার্টি আইল্যান্ডের ‘হট ফুড সেকশনে’ বসে টার্কি স্যান্ডউইচ, বার্গার, চিকেন নাগেটস দিয়ে দুপুরের খাবারটা কিন্তু মোটেই মন্দ লাগল না তান্নির। পায়ের কাছে অকুতোভয়ে নাচানাচি করে বেড়ানো সিগালগুলির উচ্ছল আনন্দ উপভোগ করতে করতেই তান্নি দেখল দুপুরের খটখটে রোদ্দুরটা কেমন জানি ক্লান্ত হয়ে হাই তুলতে শুরু করেছে। একসময় ‘স্ট্যাচু ক্রুজে’র ফিরতি ফেরি ওদের পৌঁছে দিল ঐতিহাসিক ব্যাটারি পার্কে, যেখান থেকে ওদের লিবার্টি আইল্যান্ডে যাওয়ার টিকিট দেওয়া হয়েছিল। দূরে আরও দূরে নীল সীমানায় ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যেতে থাকা ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র মূর্তিটির উপরে ডানা মেলে নিশ্চিন্তে উড়ে বেড়ানো মুক্ত স্বাধীন সিগালগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ছোট্ট তান্নির মনে হচ্ছিল, এভাবেই লিবার্টির স্বাধীন ছত্রছায়ায় মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে কত শত অ্যাবিগেইল আর ব্রেন্ডার ভিন্ন দুনিয়া, এভাবেই মিলে গেছে উন্নত জীবনের আশায় আমেরিকায় এসে আশ্রয় নেওয়া কত শত মানুষের রঙিন স্বপ্নের স্রোত!
চিত্রসূত্র – ডেনিস জ্যাকবসেন
Leave a Reply