সেদিন…

চর থেকে আচমকা ভেসে এল হই-হট্টগোলের শব্দ। রবীন্দ্রনাথ বজরার ডেকে বসে একদৃষ্টে পদ্মার জলের দিকে চেয়ে কিছু ভাবছিলেন। এই গন্ডগোলে তাঁর চিন্তার সুতো ছিঁড়ল। তিনি বিরক্ত হয়ে ডাকলেন, “বিপিন! বিপিন!”

বিপিন হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, “আজ্ঞে কত্তামশাই?”

“ডাঙায় এত হল্লা কীসের?”

বিপিন সর্বসময়ের ভৃত্য। কর্তামশাই বজরায় থাকলে সে বজরা ছেড়ে অন্যত্র নড়ে না। তবে কোথাও গোলমাল কিছু হলে তার কারণ জানতে সে অবশ্য খুবই উৎসুক। এক্ষেত্রেও সে বোট থেকে দেখে যতটা সম্ভব বোঝার চেষ্টা করেছে। তবে বোধ হয় খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি। সে আমতা-আমতা করে বলল, “ঠিক বুঝলাম না কর্তামশাই। মনে হয় কচ্ছপ নিয়ে কিছু…”

“কচ্ছপ?” রবীন্দ্রনাথ অবাক।

বর্ষার পরে পদ্মা নদীর জল এখন অনেক নেমে গেছে। এই সময় কচ্ছপ উঠে বালির চরের উপর ডিম পাড়ে। জগদীশচন্দ্র বসু শিলাইদহে আসেন মাঝে মাঝে। তখন কচ্ছপের ডিম আনাতে হয়। জগদীশচন্দ্র কচ্ছপের ডিম খেতে খুব ভালোবাসেন। কলকাতা ফেরার সময় সঙ্গে করে কিছু ডিম নিয়েও যান তিনি। তাই কচ্ছপের কথা উঠতেই জগদীশচন্দ্রকে মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের। আনমনে হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন তিনি। বিপিনকে বললেন, “কই চল তো! দেখে আসি কী হয়েছে।”

পদ্মার এই চরটা শিলাইদহ কুঠিবাড়ির থেকে কিছু দূরে। লেখার চাপ যখন খুব বেড়ে যায়, তখন রবীন্দ্রনাথ বোট নিয়ে পদ্মার এমনই কোনও জনহীন অজানা চরের দিকে চলে আসেন। তারপর সেখানেই থাকেন দু-তিনদিন। এমন সময় অন্য কোনও বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে তাঁর বেজায় অনীহা। তবে সামান্য কচ্ছপ নিয়ে কী এমন ঝামেলা পাকিয়ে তুলেছে সবাই সেটা জানতেও আগ্রহ হচ্ছে।

 

রবীন্দ্রনাথ জটলার কাছাকাছি পৌঁছতেই সব নিমেষে শান্ত হয়ে গেল।

বছর দশ-বারোর একটা ছেলেকে ঘিরেই যত ঝামেলা। এক বরকন্দাজ শক্ত করে তার হাত ধরে রেখেছে। আদুল গা, পরনে কেবল একটা খাটো কাপড়। গালের রং দেখে মনে হচ্ছে ইতিমধ্যেই অল্পবিস্তর শাস্তি পাওয়া হয়ে গিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, “কী হয়েছে? এত হইচই করছিস কেন তোরা?”

জমিদারবাবু স্বয়ং এসে পড়বেন, কেউ বোধ হয় ভাবেনি। সবাই থতমত খেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

রবীন্দ্রনাথ আবার বললেন, “ছেলেটি কে? ওকে তোরা ধরে রেখেছিস কেন? কী হয়েছে?”

ওই দলে ছিল বাবুর্চি গফুর। সে একটু গলা ঝেড়ে আড়ষ্ট ভাবে বলল, “হুজুর, এই ছেলেটা কচ্ছপের দাগ মুছে নষ্ট করে দিচ্ছে।”

কচ্ছপের দাগ?

প্রখর রৌদ্রতাপ না পেলে কচ্ছপের ডিম ফোটে না। তাই কচ্ছপরা নদী ছাড়িয়ে যতটা সম্ভব উঁচু ডাঙার দিকে চলে যায়। তারপর বালি সরিয়ে ডিম পেড়ে গর্তগুলোকে আবার বালি দিয়ে সমান ভাবে চাপা দিয়ে যায় যাতে অন্য কোনও প্রাণী সেই ডিমের খোঁজ না পায়। কিন্তু এত করেও শেষরক্ষা হয় না। শুকনো বালির উপর কচ্ছপের পায়ের দাগ বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। সেই এঁকে-বেঁকে চলা সার-বাঁধা পায়ের চিহ্ন ধরেই সবাই গর্তের মধ্যে কচ্ছপের ডিম খুঁজে বের করে ফেলে। অনেক সময় ডিমের খোঁজ করতে গিয়ে মা কচ্ছপের ও সন্ধান পাওয়া যায়। ডাঙার উপর সে অসহায়। পালানোর উপায় নেই। তাকে উলটে দিয়ে সহজেই তুলে নিয়ে আসা যায়।

এই ছেলেটা সেই কচ্ছপের পায়ের দাগ মুছে দিয়েছে। জটলার অনেকেই বোধ হয় জগদীশচন্দ্রের মতোই কচ্ছপ খেতে ভালোবাসে। তাই তাদের খুব রাগ হয়েছে। সম্ভবত অনেকদিন ধরেই এই কম্মো করে চলেছে ছেলেটা। আজ গিয়ে ধরা পড়েছে।

 

আসমানদারের বন্ধু অর্ক পৈতণ্ডী

 

পুরো ব্যাপারটা ভেবে রবীন্দ্রনাথের হঠাৎ খুব হাসি পেল। হাসি চেপে তিনি বললেন, “দেখ, বালির দাগ মোছার জন্য তো কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। তাছাড়া ওকে দেখে মনে হচ্ছে যথেষ্ট শাস্তি ও এরই মধ্যে পেয়েও গেছে। এবার ওকে ছেড়ে দে। আমি ওর সঙ্গে কিছু কথা বলি।”

যে বরকন্দাজ ছেলেটার হাত ধরে রেখেছিল সে হাত ছেড়ে একটু সরে দাঁড়াল। আর সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা উলটোদিক ফিরে দিল এক দৌড়। বরকন্দাজরা ওকে ধাওয়া করবে কিনা বুঝে ওঠার আগেই সে চর পেরিয়ে ডাঙায় উঠে গেল। রবীন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছেলেটার মিলিয়ে যাওয়া দেখলেন। তারপর মুচকি হেসে ধীরে ধীরে বোটে ফিরে গেলেন।

 

পরদিন…

ব্রহ্মমুহূর্তে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেসটা রবীন্দ্রনাথের অনেকদিনের। উদীয়মান সূর্য যখন পদ্মার জলে ঝিলিক দিচ্ছে, তখন তিনি উপাসনা করে সামান্য জলযোগ সেরে বোট থেকে চরে নেমে এলেন। তারপর গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে এগোলেন উঁচু ডাঙার দিকে। ছোটখাটো চেহারার এক পাইক লাঠি হাতে তাঁকে অনুসরণ করতেই তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, “তুই আবার আমার পিছন-পিছন কেন আসছিস, মেছের? যা, তুই ফিরে যা। আমি একাই বেড়াব।”

মেছের সর্দার থমকে দাঁড়াল। রবীন্দ্রনাথ আবার গান গাইতে গাইতে চললেন তীরের পাশের সবুজ মাঠের দিকে। ঘাসের উপর শিশির পড়ে ঝলমল করছে। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে শিরশির করে। চর ছাড়িয়ে উঁচু ডাঙায় উঠে রবীন্দ্রনাথ পাদ্মার দিকে ফিরলেন। সাদা পাল তুলে নৌকোগুলো এখনও পদ্মার বুকে ছড়িয়ে পড়েনি। পৃথিবী এখনও কত শান্ত। রবীন্দ্রনাথ আবার হাঁটতে লাগলেন মাঠের দিকে।

 

চর ধরে কিছুদূর এগোতেই রবীন্দ্রনাথ ছেলেটাকে দেখতে পেলেন। বালিতে হামাগুড়ি দেওয়ার মতো করে বসে পরম যত্নে হাত দিয়ে কচ্ছপের পায়ের দাগ মুছে দিচ্ছে। বেশি কাছে গেলে ছেলেটা ভয় পেয়ে পালাতে পারে। রবীন্দ্রনাথ একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। বেশ মজা লাগছে দেখতে।

আচমকাই ছেলেটা পেছন ফিরল আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন ছেলেটা এবার দৌড় দেবে। কিন্তু তেমন কিছু হল না। ছেলেটা ওই অবস্থাতেই বসে মিটিমিটি তাঁকে দেখতে লাগল। তারপর সটান দাঁড়িয়ে পড়ে একগাল হেসে বলল, “হুজুর!”

রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিন্ত হয়ে একটু এগিয়ে এলেন। বললেন, “হুজুর তো বুঝলাম, কিন্তু তুই এই সাতসকালে এখানে কী করছিস? কচ্ছপের পায়ের ছাপ মুছছিস?”

ছেলেটা একগাল হাসে। ধরা পড়ে যাওয়া লজ্জা-লজ্জা হাসি।

রবীন্দ্রনাথ আরেকটু এগিয়ে এসে ছেলেটার কাঁধে হাত রাখলেন, “কচ্ছপের জন্য এত মায়া কেন তোর? কেন করছিস এসব?”

“পাশের গেরামের পিরসাহেব কইসেন হুজুর। কইসেন একখান আসল জানোয়ারের পরান বাঁচাইলে ভগবান আমারে একখান সোনার জানোয়ার দিবেন।”

রবীন্দ্রনাথের কাছে এবার সব পরিষ্কার হয়ে গেল। এই ছেলেটা সরল-সিধে। পিরসাহেবের কথাগুলোকে গভীরভাবে নিয়েছে। একনিষ্ঠভাবে তা পালন করতে গেলে তার কপালে দুর্ভোগ যে সীমাহীন তাতে সন্দেহ নেই। বরকন্দাজদের হাতে শাস্তি পাবার মতো ব্যাপার-স্যাপারের মধ্যে দিয়ে ছেলেটাকে হয়তো প্রায়ই যেতে হবে।

“একটা কথা কই হুজুর?” ছেলেটা বলে, “মাঝে-মইধ্যে মনি হয় জন্তু-জানোয়ারে যদি আমার কথা বোঝতে পারত তো কত ভালো হইত। অদের ডাইক্যা কইয়া দিতাম এই চরে আইস্যা ডিম পাড়বা না, মানুষজন তোমাদের মাইরবার জইন্য ঘুইরা বেড়াইতাসে, অইন্য চরে যাও। তাইলে আমারে আর পইড়্যা-পইড়্যা লোকের হাতে মাইর খাইতে হইত না।”

ছেলেটার কথা শুনে মনে মনে হেসেই ফেললেন রবীন্দ্রনাথ। জন্তু-জানোয়ার তো দূর, মানুষই কি সবসময় মানুষের কথা বোঝে? একটা পুরনো স্মৃতি ঝলক দিয়ে গেল তাঁর মনে। কয়েক বছর আগের কথা। গ্রীষ্মকাল। গ্রামে তীব্র জলকষ্ট। রবীন্দ্রনাথ গ্রামের লোকেদের ডেকে বললেন, “তোরা কুয়ো খুঁড়ে দে, আমি বাঁধিয়ে দেব।” কিন্তু প্রজারা ভাবলে এ বোধ হয় মাছের তেলে মাছ ভাজার চেষ্টা। তারা কুয়ো খুঁড়ে দিলে জমিদারবাবু স্বর্গে গিয়ে একাই সেই পুণ্যফল ভোগ করবেন। কুয়ো গেল বিশ বাঁও জলে। জমিদারবাবুর সঙ্গে স্বর্গে পুণ্য ভাগাভাগি করার চেয়ে ইহজন্মে জলকষ্ট ভোগ করা অনেক ভালো।

তবে এই প্রথমবার ছেলেটার সঙ্গে তিনি কিছুটা একাত্মও বোধ করলেন। বললেন, “এরকম কি তুই মাঝে মধ্যেই করিস?”

ছেলেটা আবার হাসে, “হ্যাঁ হুজুর। গেল মাসে পাখমারদের হাত থেইক্যা একখান ডাক পাখি বাঁচাইয়া দিসি। তাইতে পাখমারদের ছেলে রাইগ্যা গিয়া এমন একখান ঢেলা মারল আমারে… এই দ্যাহেন…” বলে ছেলেটা চুল সরিয়ে কপাল দেখায়। সেখানে লম্বা একটা কাটা দাগ।

রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তা সোনার ডাকপাখি- সোনার কচ্ছপ- পেলি কিছু?”

“না হুজুর।” ছেলেটা নির্বিকার মুখে বলে, “এখনও পাই নাই। ভগবান ব্যস্ত মানুষ। হয়তো এইবার দ্যাখেন নাই। পরেরবার দ্যাখবেন।”

রবীন্দ্রনাথ হাসেন, “ভগবান তোকে সোনার কচ্ছপ দিলে তুই সেটা নিয়ে কী করবি কিছু ভেবেছিস?”

“বেনের কাছে বিক্রি কইর‍্যা দিমু হুজুর। সংসারে আর অভাব হইব না।” ছেলেটা চটজলদি জবাব দিল।

রবীন্দ্রনাথ ছেলেটাকে নিয়ে চর বরাবর হাঁটতে শুরু করলেন। বললেন, “সোনার কচ্ছপ বেনের কাছে বেচে দিবি?”

“হ্যাঁ হুজুর।”

“তারপর বেনে যখন সেই সোনার কচ্ছপকে মেরে ফেলবে তখন?”

“মাইর‍্যা ফ্যালাবে? ক্যান?”

“না মারলে কচ্ছপের সোনা নেবে কী করে?”

ছেলেটা একটু থমকে গেল। সোনার কচ্ছপদের এমন পরিণতির কথা সে হয়তো কল্পনা করেনি কখনও। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তাইলে সোনার কচ্ছপ আমি বেনেরে দিমু না।”

“তাহলে কী করবি?”

“তারেও পদ্মায় ছাইড়া দিমু।”

“সে কী? ছেড়ে দিবি? সোনার কচ্ছপ পেয়েও ছেড়ে দিবি?” রবীন্দ্রনাথ মজা করে বললেন, “ভেবে দ্যাখ, কয়েকটা সোনার কচ্ছপ পেলে তুই জমিদার হয়ে যাবি।”

“জমিদার? আপনার মতো?”

রবীন্দ্রনাথ ভোরের আকাশের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “আমি আর জমিদার হতে পারলাম কই? আমি তো আসমানদার হয়েই থেকে গেলাম।”

ছেলেটা এই কথা শুনতে পেল না। সে চিন্তিত গলায় বলল, “আর ছাইড়্যা দিলে গরীবই রইয়্যা যামু।”

রবীন্দ্রনাথ হা-হা করে হেসে ওঠেন, “দূর বোকা। যে সোনার কচ্ছপ হাতে পেয়েও ছেড়ে দিতে পারে সে কি আর গরিব থাকে? সে আরও বড়লোক হয়ে যায়। জমিদারের জমিদার।”

“জমিদারের জমিদার?”

“হ্যাঁ। জমিদারের জমিদার।”

“হেইডা কী হুজুর?”

“সেটা তোকে এখন কী করে বোঝাই!” রবীন্দ্রনাথ বিব্রত হয়ে হাসলেন, “জমিদারের জমিদার হলে মানুষ অমর হয়ে যায়।”

“অমর কী হুজুর?”

“অমর… যে কখনও মরে না। একই রকম থেকে যায় চিরকাল। এই যেমন তুই এখন আছিস এমনই তুই বিশ-ত্রিশ বছর পরেও থাকবি। একশ বছর পরেও থাকবি।”

ছেলেটা বিড়বিড় করে, “জমিদারের জমিদার… অমর…” তারপর চিন্তিত গলায় বলে, “হুজুর একবার ভাইব্যা দ্যাহেন, নদীর জলে সোনার কচ্ছপরে দ্যাখলে মাঝি-মাল্লারা ওরে ধরার জইন্য নৌকা ফেইল্যা কেমন হাঁকুপাঁকু সান্তার দিতি শুরু করবে। ওরা যদি ওরে ধইর‍্যা ফ্যালায়?”

রবীন্দ্রনাথ হাঁটতে-হাঁটতেই বললেন, “নাহ, ধরতে পারবে না। কেউ দেখতেও পাবে না। সোনার কচ্ছপ কেবল মাত্র জমিদারের জমিদারই দেখতে পাবে, আর কেউ পাবে না।”

আচমকা ছেলেটার চোখ গেল পিছন দিকে। মেছের সর্দার এদিকেই আসছে হনহনিয়ে। সে অমনি চর ছেড়ে ডাঙার দিকে ছুট লাগাল।

রবীন্দ্রনাথ উচ্চকণ্ঠে বললেন, “সোনার কচ্ছপ পেলে কী করবি মনে আছে?”

“ছাইড়্যা দিমু।” ছেলেটা ছুটতে-ছুটতে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “তাইলেই জমিদারের জমিদার… অমর…”

মেছের সর্দার এসে পোঁছবার আগেই ছেলেটা ডাঙায় উঠে গাছের আড়ালে হারিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ হাঁটা থামান না। হাঁটতে হাঁটতেই তাঁর মনে পড়ে ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি।

 

অনেকদিন পর…

রবীন্দ্রনাথ বোটের জানলা দিয়ে নাগর নদীর দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মনে মনে বললেন, নে, এই শেষ দেখা। আর আমি আসব না। আর তোতে আমাতে কথা হবে না।

বনমালী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ ধরে। রবীন্দ্রনাথকে মগ্ন দেখে ইতস্তত করছিল, এবার ডেকেই ফেলল, “হুজুর, কাছারি বাড়ি যাবার পালকি তৈরি।”

রবীন্দ্রনাথ জানলা থেকে চোখ না ফিরিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, “তৈরি? তাহলে তো এবার যেতে হয়।”

 

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়-হয়। পতিসরের কাছারিতে আজ অনেক লোক। কালিগ্রাম পরগনার প্রজারা ছাড়াও এলাকার অনেক গণ্যমান্য লোক এসেছেন। এসেছেন রাজশাহীর জেলাশাসক অন্নদাশঙ্কর রায়। এই কাছারিতে এটাই রবীন্দ্রনাথের শেষ দিন। নাগর নদীর তীরে আজই শেষবারের মতো ভিড়েছে তাঁর বোট। শুধু এই কাছারিতে কেন, জমিদার হিসেবেই রবীন্দ্রনাথের আজ শেষদিন। সেই বারো বছর আগে ছেড়েছেন শিলাইদহ। আর আজ পতিসর। ব্যস! আজ থেকে তিনি শুধুই আসমানদার।

 

কবিকে কবিতার ভাষাতেই শ্রদ্ধাঞ্জলি দিল এলাকার লোকজন,

প্রভু রূপে হেথা আসো নাই তুমি/ দেবরূপে এসে দিলে দেখা/

দেবতার দান অক্ষয় হউক/ হৃদি পটে থাক্‌ স্মৃতি রেখা।

 

এবার রবীন্দ্রনাথের বলার পালা। রবীন্দ্রনাথের গলা ধরে এল, “সংসার থেকে বিদায় নেবার সময় তোমাদের সঙ্গে দেখা হল এটাই আমার সান্ত্বনা। তোমাদের কাছে অনেক পেয়েছি। কিন্তু কিছু দিতে পেরেছি বলে মনে হয় না…”

কিছুটা বলে একটু থামলেন তিনি। তারপর আবার যোগ করলেন, “তোমাদের সঙ্গে তোমাদের মতো করে সহজভাবে জীবনটা কাটাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা আর পারলাম কই! তবুও এই যাবার বেলায় এটুকুই চাই যে তোমরা আমাকে তোমাদেরই একজন বলে মনে রেখো। জমিদার হিসেবে নয়।”

অনেকেরই চোখ আর্দ্র হয়ে এল। নীরবতা ভেঙে কেউ একজন ভাঙা গলায় বলল, “আপনি শুধু জমিদার নন হুজুর। আপনি জমিদারের জমিদার।”

জমিদারের জমিদার! রবীন্দ্রনাথ অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন আবার। এই কথাটা কেউ যেন বলেছিল তাঁকে। নাকি তিনি কাউকে বলেছিলেন।

 

দু-ধারে প্রজাদের সারি। পতিসরের ঘাট থেকে বোট ছাড়ল। পালে মন্দ-মধুর হাওয়া লেগেছে। দু-পাশে একে-একে ফেলে যাচ্ছেন তাঁর পরিচিত জনপদ। কবির সাদা চুল-দাড়ি হাওয়ায় উড়ছে। উড়ছে বাদামী জোব্বা। গ্রামের শেষ, শ্মশান দেখা দিল। তা-ও পেরোলো একসময়।

রবীন্দ্রনাথ বোটের ঘরে ঢুকতে যাবেন, এমন সময় তাঁর চোখ পড়ল পাড়ের দিকে। পাড় থেকে কী যেন ঝিলিক দিচ্ছে। তিনি দেখলেন একটা উসকোখুসকো চুলের ছেলে পারে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে তাঁর দিকে চেয়ে আছে। বড় চেনা সে হাসি। কোথায় দেখেছেন ছেলেটাকে? তন্ময় হয়ে যাওয়ার আগেই বিকেলের রোদে ছেলেটার হাতে ধরা সেই স্বর্ণাভ বস্তুটি আবার ঝিলিক দিল। ছেলেটা আলতো হাতে মাটিতে নামিয়ে দিতেই সেটা গুটি গুটি পায়ে নদীর দিকে এগোতে থাকল।

সোনার কচ্ছপ!

ছেলেটা এখনও হাসিমুখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তার বয়স একটুও বাড়েনি।

কচ্ছপটা ধীরে ধীরে হেঁটে নদীর জলে নেমে পড়ল। তারপর বোটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাঁতার কেটে সেদিকেই এগোতে থাকল যেখানে শেষবেলার সূর্যটা একটু পরেই ঝাঁপ দেবে আতরাইয়ের বুকে।

 

অলংকরণ – সুমিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published.