দুষ্টু ঈশানী রায়চৌধুরী

এ অঞ্চলের নাম মোহনপুর। মফস্‌সলের ছোটখাটো টাউন যেমনটা হয় আর কী! মানে বিজলিবাতি আছে, কিন্তু টিভির ছবি মাঝেমাঝেই ঝামেলা করে। একবার ঝড়জল হলে সেই যে বাতি চলে যায়, আসতে আসতে কয়েক ঘণ্টা কাবার। বাসস্ট্যান্ডের দিকে গেলে বেশ কয়েকটা বড়সড় দোকান। কলকাতা থেকে নিয়মিত চকচকে ঝকঝকে হালফ্যাশনের শাড়ি জামা শার্ট প্যান্ট আসে, একটা ফ্রিজ-টিভির দোকানও আছে, তবে খুব দামি ব্র্যান্ডের মালপত্র রাখে না ওরা, কারণ এ সব জায়গায় খুব বেশি টাকার বিক্রিবাটা কমই হয়। একটা মাঝারি, আর একটা বিশাল মাপের মুদিখানা। বড়টার মালিক হরেন সরকার। তিনি এখন মাতব্বর হয়েছেন খুব। ঝাঁ চকচকে সাজানো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দোকানটিকে বলেন মাল্টিপারপাস স্টোর। আবার ইংরিজি নামও দিয়েছেন ‘হোয়াট নট শপিং সেন্টার’। তবে নিন্দেমন্দ যাই করি না কেন, মালপত্র রাখেন এক নম্বর কোয়ালিটির। কী বললেন, আপনার ট্যাঁকের জোর কম? তাহলে পাশের দোকানে যান। ওই যে ‘কমলা ভাণ্ডার’। কমলা ভাণ্ডারের মালিক নিত্যগোপাল জানা। তিনিও পয়সাওয়ালা লোক। এ দোকানটা ছোট বটে, কিন্তু জানামশাইয়ের একান্নবর্তী সংসারে চার ভাইয়ে মিলমিশ খুব। এই দোকান ছাড়াও আটা কল আর মাছের ব্যাবসা দিব্যি রমরম করে চলে। সন্ধের পর পাড়ার ছেলেছোকরারা খুব ভিড় জমায়। এছাড়া আর যা সব থাকে আর কী! দুটো সিনেমা হল, কিছু খুচরো মালের দোকান, বড় একটা মাছ তরকারির বাজার, ছোটখাটো হাসপাতাল আর ওষুধের দোকান— এই সব। বলতে নেই, এখানে লোকজনের মোটের ওপর শরীর স্বাস্থ্য সরেস। রোগবালাই তেমন নেই। খুব বাড়াবাড়ি হলে কলকাতা শহর তো আছেই। লোকাল ট্রেনে মাত্র এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট। বাসে অবশ্য আরও খানিকটা সময় বেশি লাগে আর সেও ওই ঝাঁকাভর্তি মালের মতো দমচাপা হয়ে যাওয়া।

 

এ জায়গাটার সবচেয়ে বড় গুণ হল বাসিন্দাদের নিজেদের মধ্যে ভারী ভাব। পাশাপাশি বাড়িতে মাছ-তরকারির বাটি চালাচালি হয়, পাড়ার গিন্নিরা দুপুরে কর্তারা বাড়িতে না থাকলে এ-ওর বাড়িতে গল্পের আসর জমান, সমবয়সি ছেলেপুলেরা একসঙ্গে ইস্কুল যায়, বিকেলে ক্লাবের মাঠে খেলা করে, উস্তমকুস্তম ঝগড়া মারামারিও বাদ যায় না। এক বাড়ির আপদে-বিপদে অন্য সব বাড়ির লোকজন দৌড়ে আসে। মোটমাট শহরে যা যা হয় না, তার অনেক কিছুই এখানে হয়।

 

হরেন সরকার আর নিত্যগোপাল জানার পৈতৃক ভদ্রাসন একেবারে পাশাপাশি লাগোয়া জমিতে। দু-পক্ষই গত তিন পুরুষের পুরনো বাসিন্দা। ফলে ভাব-ভালোবাসাও ওই বংশ-পরম্পরায় চলে আসছে। দু-বাড়ির কর্তাতে যেমন গলাগলি ভাব, গিন্নিরাও তেমনি সই পাতিয়েছেন। হরেন সরকারের সবেধন নীলমণি একটিই ছেলে। জ্যোতির্ময়। ডাকনাম সোনাই। বারো বছর বয়স, হাড় বিচ্ছু। সারা অঞ্চলের বাসিন্দারা তটস্থ থাকে। তার একটি চালু নামও আছে। সে নামটা ভারী অদ্ভুত। নাকে-বোতাম সরকার। এ নামের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় যে বছর চারেক বয়সে একদিন কী একটা জিনিস চেয়ে বায়না করছিল সোনাই। কেউ তার কথায় কান দিচ্ছিল না বলে সে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য মায়ের সেলাইয়ের বাক্স থেকে একটা ছোট ঝিনুকের বোতাম তার ডান নাকের ফুটোয় চালান করে দেয়। তারপর ডাক্তার-বদ্যি-হাসপাতাল। সেরে উঠেই সে নিজেকে ‘নাকে-বোতাম সরকার’ হিসেবে ঘোষণা করে।

এইসব ছেলেপুলের ছোট থেকেই নেতা বা মুরুব্বি হয়ে ওঠার এলেম থাকে। পাড়ার কচিকাঁচারা তাকে গুরু মেনেছিল বটে, কিন্তু তার সবচেয়ে বাধ্য শিষ্যা হল জানাবাবুর মেয়ে চম্পাকলি। ডাকনাম ঝুমঝুমি। বয়স দশ। সোনাইয়ের প্রতি তার অচলা ভক্তি।

জ্ঞান হয়ে ইস্তক মাত্র দু-বার এই অচল ভক্তিতে টান পড়েছিল। প্রথমবার সেই তখন, যখন ঝুমঝুমির বয়স বছর ছয়েক। সে তার সোনাইদাদাকে মনের দুঃখে বলতে গিয়েছিল যে তাদের রাঙি গরুটা সুযোগ পেলেই তাকে মাথা নিচু করে ঢুঁসিয়ে দিতে আসে। সোনাই খুব গম্ভীর হয়ে জানতে চেয়েছিল, “হঠাৎ তোরই বা ওর কাছে যাওয়ার কী দরকার?”

– আহা, কী সুন্টুমুনু একটা বাছুর হয়েছে দেখেছ? ওর নাম ভানুমতী রেখেছি আমি। ওর সঙ্গে যে বড্ড খেলতে ইচ্ছে করে!

– বাছুরের সঙ্গে?

– কেন? বাছুর বলে কি মানুষ নয়?

– বটেই তো!

পুরো একটা দিন অনেক ভাবনা চিন্তা করে রাঙিকে বশে আনার উপায় বাতলে দিয়েছিল সোনাই।

– শোন ঝুমঝুমি, তুই একটু সন্ধে লাগলে গোয়ালঘরে যাবি।

– এহ, তখন সাঁঝাল দেয় মংলু। খুব ধোঁয়া। চোখ জ্বালা করে।

– বুদ্ধু কোথাকার! আলো থাকতে থাকতে গেলে তো রাঙি তোকে মানুষ বলে চিনেই ফেলবে! আর শোন, যাবি যখন তার ঠিক আগে আগে হাতে পায়ে একটু গোবর লেপে নিবি।

– ওয়াক থু।

খুব রেগে গেল সোনাই।

– এই না হলে মেয়েদের বুদ্ধি! ওরে, গোবরের সেন্ট, তার সঙ্গে অন্ধকার… রাঙি তোকে আর মানুষ ভাবার মতো ভুল করবে না।

মুখ গোঁজ করে ঝুমঝুমি বলল, “গোবরে বেজায় গন্ধ!”

ভেংচি কেটে সোনাই বলল, “ইহ গন্ধ! গোবরের গন্ধ তো গোবরের মতোই হবে। তুই কি ভেবেছিলি গোলাপফুলের গন্ধ ছাড়বে? যা যা, মেলা ঝামেলা করিসনি। ও কী, চললি কোথায়? আরে শুনে যা। গোবর একটু মোটা করে গায়ে লাগিয়ে ক-টা জোনাকি বসিয়ে নিবি। টুনিবাতির মতো জ্বলবে। তোর টর্চের কাজও হল, আবার রাঙিও পুরোপুরি বোকা বনে গেল… কী রে হাঁদা খুকি, বুঝলি?”

 

দু-দিন পরে সন্ধেবেলা জানাবাবুর বাড়ি থেকে চড় থাপ্পড়ের সঙ্গে সঙ্গে সরু গলার চিৎকার শোনা গেল।

– উরি মা গো, আমার সব ছাল উঠে গেল হাত-পায়ের। আমি বুঝি ইচ্ছে করে গোবর মেখেছি? ওই সোনাইদাদা বলেছিল…

সোনাই এ সব শুনে উদাস চোখে বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করেছিল, “নালিশকুটি কোথাকার! এইজন্য কারও উপকার করতে নেই! এটা একবারও মনে হল না, রাঙি কিন্তু তোকে বাছুর ভেবেই আর গুঁতোতে আসেনি। আরে গায়ে একটু গন্ধ হয়েছে, তাতে কী! তোর মেজকার ঘর থেকে সেন্টের বোতলটা গেঁড়িয়ে নিলেই তো… সেও তো আবার এই সোনাইকেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে। যত্তসব!

সেবার ঝুমঝুমি পাক্কা দেড়দিন সোনাইয়ের সঙ্গে বাক্যালাপ করেনি।

 

এর পরের ঘটনা আরও মারাত্মক। বছরখানেক পরে। সোনাইয়ের বৈজ্ঞানিক হবার খুব শখ। দারুণ কিছু একটা আবিষ্কার করতে পারলে লোকজন খুব খাতির করবে। বিস্ময়-বালক শ্রী নাকে-বোতাম সরকার। কিন্তু কী বানানো যায়? মানে পয়সাকড়ি নেই। চেয়েচিন্তে কিছু মাল জোগাড় করে তা থেকে আবিষ্কার করতে হবে। কিন্তু কাঁচামাল যোগাবে কে? বাড়িতে তো এমন অবস্থা, একটু ঘুরঘুর করতে দেখলেই পেছনে ফেউ লেগে যায়! সকলের ধারণা, সোনাই আবার কোনো কেলেঙ্কারি করবে। তার মানে এমন কিছু করে দেখাতে হবে, যাতে বেশি ঝুটঝামেলার মধ্যে যেতে হবে না, অথচ লোকের তাক লেগে যাবে।

 

– দি আইডিয়া, বুঝলি ঝুমঝুমি।

– কী আবিষ্কার করবে গো সোনাইদাদা?

– আরে টেলিভিশন বানাব।

– টিভি? ও মা, বানাব কেন? আমাদের দু-জনের বাড়িতেই আছে তো!

খটাং করে ঝুমঝুমির মাথায় একটা গাঁট্টা কষিয়ে দিল সোনাই।

– বোকা কোথাকার! একটা থাকলে আর একটা বানাতে নেই? এই টেলিভিশনটা একেবারে শুধু আমার আর তোর হবে। আমরা আমাদের বাড়ির ওই পেছনের ঘরটায় এটাকে রাখব। শুধু কার্টুন দেখব। বাড়িতে তো যত রাজ্যের খবর আর সিরিয়াল চলে!

ঝুমঝুমির মুখ উজ্জ্বল।

– কবে বানাব সোনাইদাদা?

– এই তো, তুই তোর মেজকার ঘর থেকে ট্রানজিস্টরটা নিয়ে এলেই। তোর ওই একটাই কাজ। বাকিটা আমি সামলে নেব।

ঝুমঝুমির মুখটা তোম্বা হয়ে গেল।

– মেজকার ট্রানজিস্টর। মেজকা কান টেনে দেয় যখন তখন।

– ভালো কাজের জন্য একটু আধটু মার খেতেই হয়। সেদিন পনেরোই অগাস্টের ফ্ল্যাগ তুলতে গিয়ে শুনলি না, হেড স্যার বলছেন, “ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান…”

– আমি পারব না সোনাইদাদা।

– তাহলে দূর হ হতচ্ছাড়ি!

 

পরের দিন দুপুরে ছুটতে ছুটতে এল ঝুমঝুমি।

– এই নাও সোনাইদাদা তোমার রেডিও। মেজকা ঘরে ছিল না। কাকিমা বোনকে নিয়ে বোনের মামারবাড়ি গেছে।

– মেজকা কোথায়?

– আজ যে শনিবার গো। মেজকা গেছে নাটকের রিহার্সাল দিতে। ক্লাবঘরে। দশ দিন পরেই তো ফাংশন।

– তুই তো আবার চিরকেলে হাঁদা মেয়ে একটা! এই যে নিয়ে এলি, কেউ দেখতে পায়নি তো?

– না গো না। মা তো ফুরফুর করে নাক ডাকছে পাশের ঘরে। আর বাকি মানুষজন সব দোতলায়।

– তাড়াতাড়ি আয় তাহলে।

 

আরিব্বাস! কী বুদ্ধি সোনাইদাদার। ফটাস করে রেডিওটার সামনেটা কেমন চাড় দিয়ে খুলে ফেলল!

– এ তো ভেঙে গেল গো সোনাইদাদা।

– আঃ, গোল করিসনি। টিভি আসলে কী? যে রেডিওতে ছবি দেখা যায়। সামনে কাচ লাগাতে হবে তো!

– কাচ কোথায় পাবে?

– এই দ্যাখ।

– ও মা, এ তো জ্যাঠাইমার বড় দেরাজের গায়ে লাগানো ছিল। আয়না তো। সেদিন খুলে রেখেছে বিশুদাদা। বলল নাকি কী সব মেরামত হবে, পালিশ হবে।

– ছাড় তো! সে যদির কথা নদীতে। ওটা থেকে এক বাড়ি মেরে এই টুকরোটা ভেঙে নিয়ে এলাম। এই দেখ, ময়দার লেইও আছে। তুই রেডিওটা না আনলে আজ দাদুর ঘরের রেডিওটা ভাঙব বলে ঠিক করেছিলাম। তবে সেটা তো পুরনো, ঘ্যাসরঘ্যাসর আওয়াজ হয়। বাজে টিভি হত। এটা ঢের ভালো হবে। নে নে, লেই দিয়ে ভালো করে এই ফাঁকটায় আয়নাটা বসা।

– ও সোনাইদাদা, পুরোটা বসছে না তো! কেমন চারদিকে ফাঁকফোকর রয়ে গেল।

– সেটা ভালোই হয়েছে। ভেতরে হাওয়া খেললে তো ভালোই। মেশিন গরম হয়ে যাওয়া খুব খারাপ।

– কিন্তু ছবি কই? কার্টুন দেখব কী করে? এ তো আমার মুখ গো! এই তো আমি।

– তোর মুখ দেখা যাচ্ছে, ভালোই হল! তুই কথা বলবি, টিভির ছবিতে ঠোঁট নড়বে। পুরো সিনেমা।

– আহা, অমনি অমনি টিভি হয় না কি? ছাদে অ্যান্টেনা লাগাতে হয়, আমি জানি।

দাঁত খিঁচিয়ে সোনাই বলল, “উফ, বলছি তো সব ব্যবস্থা আছে। ছাদে চল।”

– এ কী! এ তো একটা ফাটা বাঁশ!

– ওই ফাটা জায়গা দিয়ে সিগন্যাল ঢুকবে। তুই ছোট, বোঝার মতো বুদ্ধি কই তোর? নে, তারটা জড়া বাঁশের গায়ে, এবার অন্য দিকটা ওই রেডিওর পেছনে গুঁজতে হবে।

– বাঁশটা পুঁততে হবে না?

– কিচ্ছু দরকার নেই। স্রেফ ঠেকনা দিয়ে রাখ। দরকারমতো এদিক ওদিক সরানো যাবে। আরে, তোর মেজকার গলা না?

ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল ঝুমঝুমির।

– হ্যাঁ তো! রেডিও খুঁজছে মনে হয়।

– একটা ভালো কাজ যদি নিশ্চিন্তে করা যায়! যা, দেখ গিয়ে কী হল।

– ও সোনাইদাদা, তুমিও চলো।

সে টানাপোড়েন অবশ্য বেশিক্ষণ চলেনি। কারণ ট্রানজিস্টরের দুর্ভাগ্য অনুমান করে ঝুমঝুমির মেজকা প্রথমে সোনাইদের খেলার ঘরে হানা দিয়ে শখের বস্তুটির হাল দেখে রাগে কাঁপতে কাঁপতে ছাদে উঠে এসেছিলেন। তারপর তো চেনা গল্প। কান টানলেই মাথা আসার।

সোনাই সারা মহল্লাকে তটস্থ করে রাখে। তার বাবা ব্যস্ত মানুষ, মা বেজায় নিরীহ। ফলে ছুটির দিনের দুপুরগুলো কুকর্মের সঙ্গিনীটিকে বগলদাবা করে সোনাই দাপিয়ে বেড়ায়। আর ছেলেটার মধ্যে কী যে আছে! পাড়ার খুদেগুলো সোনাইয়ের কথায় ওঠে বসে। কখনও চাঁদিফাটা রোদ্দুরে খোলা মাঠে চড়ুইভাতি, কখনও দল পাকিয়ে এর-ওর বাগানের ডাঁসা পেয়ারা লুট, আবার কখনও হুজুগ তুলে ক্লাবের মাঠে স্পোর্টস। স্পোর্টস নিয়ে অবশ্য লোকজনের তেমন আপত্তি নেই। একটা শীতের সকাল-দুপুর ভালোই কাটে। স্পোর্টসের পরে আবার সিঙাড়া রসগোল্লা চায়ের বন্দোবস্তও থাকে। ছোটোখাটো প্রাইজও দেওয়া হয়। এই যেমন ছবি আঁকার রংতুলি, গল্পের বই। তবে এ বছরের প্রাইজগুলো বেজায় ভালো। ক্লাবের দশ বছর পূর্তি হল তো! এবারের স্পোর্টসে তাই স্পেশাল আয়োজন। ফোল্ডিং ছাতা, থার্মোফ্লাস্ক, কাটগ্লাসের ফুলদানি, ক্রিকেট ব্যাট, বার্বি ডল। যদিও আসলে প্রাইজটা গৌণ, হইচইটাই মুখ্য।

 

এ বছরেও স্পোর্টস হচ্ছে। এ বছরেও গতবারের মতো সোনাই গুনে গুনে তিনটে ইভেন্টে নাম দিয়েছে। ১০০ মিটার আর ২০০ মিটার ফ্ল্যাট রেস আর চামচে গুলি রেখে সাবধানে হেঁটে যাওয়া। আজ চার বছর ধরে স্পোর্টস হচ্ছে। গত বছর এই তিনটে ইভেন্টেই সোনাই ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিল। এ বছরেও তাই সে-ই ফেভারিট। সে যেমন হরিণের মতো দৌড়োয়, তেমনই নিঃশব্দ মনঃসংযোগে গুলি চামচ নিয়ে হেঁটে যাওয়ার হিম্মত রাখে ও প্রান্তের ফিতের দিকে।

এবার একটা বিশেষ আকর্ষণও আছে। ঘোষণা করা হয়েছে, ছেলেদের বিভাগে ১০০ মিটার, ২০০ মিটার আর চামচ-গুলির রেস— তিনটের যে কোনও দুটোয় যদি একজন কেউ ফার্স্ট হতে পারে, তাকে ক্লাবের তরফ থেকে একটা সাইকেল দেওয়া হবে। খাস কলকাতা থেকে ট্রেনে করে সাইকেল এসেও গেছে। দারুণ সুন্দর, কুচকুচে কালো শরীরে রোদ্দুর পড়ে চিকচিক করছে। লাল সিল্কের ফিতে বাঁধা আছে হ্যান্ডেলে। ডানপিটে ছেলেরা ফাঁকতালে ক্রিং ক্রিং করে বেলও বাজিয়ে গেছে। যেদিন থেকে সাইকেলের কথা কানে এসেছে, রাতের ঘুম ছুটে গেছে সোনাইয়ের। ওই সাইকেল তার চাই। জবরদস্ত বায়না করলে বাবা হয়তো কিনে দিত, কিন্তু প্রাইজ হিসেবে পাওয়ার মজাই আলাদা! ঝুমঝুমি ইতিমধ্যেই বলে রেখেছে, তাকেও মাঠে সাইকেল চালানো শিখিয়ে দিতে হবে। ঠিক কোথায় রাখা হবে সাইকেল, সে জায়গাও মনে মনে ঠিক করে রেখেছে সোনাই। আর যেন সবুর সইছে না।

 

মাঠে থৈ থৈ করছে লোকজন। একেবারে কচি বাচ্চাদের ইভেন্টগুলো আগে রাখা হয় প্রতিবার। মানে যাদের বয়স দশ বছরের নিচে। ঠিক অন্যবারের মতো এবারেও গোবরগণেশ ছানু স্যাক রেসে উলটে পড়ে কুমড়ো গড়াগড়ি। সারা মাঠ হাসছে। সোনাইও হাসছিল খুব। হঠাৎ তার চোখ পড়ল পিকলুর দিকে। পিকলুরা একটু দূরে থাকে। দুজন স্কুলে একই ক্লাসে পড়লেও আলাদা সেকশন। তবে খেলার মাঠে দেখা হয়। টিফিনের সময়েও। পিকলুও ভালো দৌড়বাজ, তবে সোনাইয়ের মতো নয়। প্রাইজ পায় বটে, ওই সেকেন্ড বা থার্ড। ওর বাবা কলকাতায় চাকরি করতে যান রোজ। রোগা, ফর্সা ছোটোখাটো চেহারার। সোনাই কয়েকবার দেখেছে সকালে প্রায় ছুটতে ছুটতে যাচ্ছেন স্টেশনের দিকে ট্রেন ধরতে আর ফেরেন যখন… সোনাই সেদিন বাবার দোকানে গিয়েছিল কী একটা জিনিস আনতে… হা-ক্লান্ত চেহারা, কুঁচকানো শার্ট, হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে কয়েকটা জিনিস আর সেই সঙ্গে অফিসের একটা ফোলিও ব্যাগ।

 

সোনাইয়ের মাথার বিদ্যুৎ খেলে গেল চিড়িক করে। চিরকেলে দুষ্টু ছেলে!

১০০ মিটার আর ২০০ মিটার দৌড়ের মাঝখানে থাকে চামচ-গুলির রেস। প্রথম অঘটন ঘটে গেল ১০০ মিটার ফ্ল্যাট রেসে। সারা মাঠ অবাক হয় দেখল, সোনাইকে অন্তত পৌনে তিন মিটার পেছনে ফেলে প্রথম ফিনিশ লাইনে পৌঁছে গেল পিকলু। বাকি প্রতিযোগীরা কেউ এই দুজনের ধারে কাছে ছিল না। দুজনই একেবারে গায়ে গায়ে দৌড়োচ্ছিল। একেবারে শেষে সামান্য হোঁচট খেয়ে পিছিয়ে পড়ল সোনাই। ব্যাড লাক ছেলেটার। শেষটুকু আর মেক-আপ করতে পারল না।

 

পরের ইভেন্ট চামচ-গুলি। এই ইভেন্ট সোনাইকে জিততেই হবে। প্রেস্টিজের ব্যাপার! মনটাকে একমুখী করে সাবধানে দৃঢ় পায়ে এগোতে লাগল সোনাই। চামচের ওপরে তিরতির করে কাঁপছিল সবুজ কাচের গুলিটা।

তুমুল হাততালির মধ্যে সকলের আগে দড়ি ছুঁল সোনাইয়ের শরীর। চামচ আর গুলি মাটিতে ফেলে দিয়ে লাফিয়ে উঠে শূন্যে দু-হাত ছুঁড়ে দিল সে। পিকলু ক্লান্ত মুখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। সে এই রেসে সেকেন্ডও হতে পারেনি। সেকেন্ড হয়েছে দিলু। পিকলু থার্ড।

কিশোরদের ২০০ মিটার ফ্ল্যাট রেস শুরু হবে। স্টার্টিং লাইনে সবাই সার বেঁধে দাঁড়িয়েছে। মাঠে তুমুল উত্তেজনা। দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে ছেলের দল। কেউ সোনাইয়ের দিকে, কেউ বা পিকলুর। দুজনই একটা করে রেস জিতেছে। দাঁড়িপাল্লার মাপ সমান সমান। সাইকেল কে পাবে? পিকলুর চোখমুখ দেখে তার ভেতরের উত্তেজনা টের পাওয়া যাচ্ছে না। সোনাইয়ের হাত দুটো মুঠো করা, ঠোঁট টেপা।

বয়েজ স্কুলের পি টি স্যার অধিরথ মল্লিকের গলা শোনা গেল— “নাউ, বয়েজ, অন ইয়োর মার্ক… গেট সেট অ্যান্ড গো…”

কান ফাটানো এয়ার পিস্তলের ফাঁকা আওয়াজ বুকে নিয়ে আটটা বিদ্যুৎরেখা ছুটে যাচ্ছিল ও প্রান্তে লাগানো মোটা দড়ির দিকে।

কিন্তু  তিরিশ মিটারের পর থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেল, বাকি ছ-জন শেষ ল্যাপে ধারেকাছে থাকবে না। প্রতিযোগিতা হচ্ছে আসলে দুজনের মধ্যে। সোনাই আর পিকলু। দুজনের কেউ কাউকে এক ইঞ্চি এগোতে দিতে রাজি নয়। একেবারে গায়ে গায়ে উড়ে যাচ্ছে তারা। তবে কি ফটো-ফিনিশ একেই বলে?

 

হঠাৎ… শেষ তিন মিটারের মাথায় কী যে মতিভ্রম হল সোনাইয়ের। এক সেকেন্ডের জন্য ঘাড় ঘোরাল পেছনের দিকে। ব্যস! এমন সুযোগের অপেক্ষাতেই তো থাকে প্রতিপক্ষ, অবচেতনে হলেও। পাখির মতো ডানা ভাসিয়ে দড়িটা  যখন ছুঁয়ে ফেলল পিকলু… সোনাই তখনও পাক্কা আধ মিটার পেছনে।

সোনাই তো জানে, ‘স্পোর্টসম্যান স্পিরিট’ বলে একটা কথা আছে। তাই প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনের পরে হাসিমুখে পিকলুর হাত ধরে ঝাঁকিয়ে দিল সে। অনুষ্ঠানের শেষে পিকলু যখন নতুন সাইকেলটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছে, তার পাশে পাশে ধুতি আর ট্যুইলের শার্ট গায়ে তার ছা-পোষা চাকুরে বাবা… সোনাই প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল দূরে অপস্রিয়মাণ শরীর দুটোর দিকে।

 

স্পোর্টসের দিন সকলের মায়েরাও আসেন মাঠে। সোনাইয়ের মা ছেলেকে খুঁজতে এসেছিলেন। বড় দুঃখ হয়েছে তাঁর দামাল দস্যি ছেলেটার কথা ভেবে। সোনাইয়ের পিঠে হাত রাখলেন তিনি। চাপা গলায় বললেন, “বাবু।”

সোনাই মুখ ফেরাল। তার চোখ দুটো চকচক করছে। কী হল ছেলেটার? সোনাইয়ের মা সরমা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “খেলায় তো হারজিত থাকেই বাবু। সামনের বছর তুই নিশ্চয়ই জিতবি।”

– আমি তো এবারেও জিতেছি মা!

– সে তো জানি! চামচ-গুলির রেসে আমি তো দমবন্ধ করে ছিলাম।

– আর বাকি দুটোতে?

– কপাল খারাপ তোর! কেন যে হোঁচট খেলি, কেন যে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু ফিরলি…

– সে তো ইচ্ছে করে!

– ইচ্ছে করে?

– তাই তো! আমি তো আজ সকালেই ঠিক করে ফেলেছিলাম হেরে যাব। পিকলুকে জেতাতেই হবে। জানো মা, ওর বাবা ট্রেনে করে কলকাতা যান তো! ছুটে ছুটে ট্রেন ধরেন, ক্লান্ত হয়ে ফেরেন। আমি দেখেছি! এই সাইকেলটা তো বড়রাও চালাতে পারবেন, তাই না? পিকলুর বাবা তাহলে সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করতে পারবেন বাড়ি থেকে স্টেশনে। কাকাবাবুর আর অত কষ্ট হবে না কাল থেকে, তাই না মা?

 

সোনাইয়ের মা ছেলের মাথায় হাত রাখলেন। তাঁর চোখের মণিদুটি ঝিকিয়ে উঠল আনন্দে। একটু হয়তো অশ্রুর আভাসও ছিল। সে অশ্রু চাপা অহঙ্কারের।

আর যদিও এই প্রথম, কিন্তু নিশ্চিত এই শেষবার নয়… দুষ্টু ছেলে সোনাই সরকার, ওরফে নাকে-বোতাম সরকার নিজের ডাকনামটি ছাপিয়ে তার পোশাকি ‘জ্যোতির্ময়’  নামটিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

 

ছবি – সুমিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published.