ফাদার ব্রাউন ও অভিশপ্ত বই কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রফেসর ওপেনশ সারাজীবন ভূতপ্রেত আত্মা নিয়ে গবেষণা করেছেন, কিন্তু তিনি নিজে ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করেন কি না সেটা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারত না। তাঁকে কেউ ‘বিশ্বাসী’ বলে দাগাতে চাইলে তিনি রেগে আগুন হতেন। শয়ে শয়ে উদাহরণের ঝুলি খুলে দেখাতেন কীভাবে তিনি প্রেতচর্চা নিয়ে একের পর এক ভাঁওতাবাজি ধরে দিয়েছেন। আবার তাঁর সামনে যারা ‘ভূত-টুত কিছু নেই, যত বাজে কল্পনা’ বলে উড়িয়ে দিত সেইসব বস্তুবাদীদেরও তিনি ছেড়ে কথা বলতেন না। নিজের আজীবনের গবেষণা আর সংগৃহীত প্রমাণের ঝুলি থেকে এমন সব অলৌকিক ঘটনা হাজির করতেন, অতি বড় যুক্তিবাদীও সে সবের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ঘেমে কূল পেত না।
মোদ্দা কথা, বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী কোনও দলকেই প্রফেসর ওপেনশ পছন্দ করতেন না এবং সুযোগ পেলে দু-দলের সঙ্গেই তর্কযুদ্ধে নামতেন।

এ রকমই একদিন এক তর্কসভা সেরে একদিন দুপুরবেলা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন প্রফেসর। কিছুক্ষণ আগের বাকবিতণ্ডার জেরে তাঁর মাথা তখনও গরম হয়ে ছিল। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল নেড়ে, লোকের গণ্ডমূর্খতায় নতুন করে চমৎকৃত হতে হতে গজগজ করে হাঁটছিলেন তিনি। এমন সময় ক্ষণিকের জন্য মাথা তুলেই তিনি দেখলেন রাস্তার উলটোদিক থেকে একজন ছোটখাটো, ভারী নিরীহ চেহারার, কালো পোশাক পরা পাদরি হেঁটে হেঁটে আসছেন।

পাদরিকে দেখামাত্র প্রফেসরের রাগ ঝপ করে খানিকটা পড়ে গেল। দু-হাত সামনে বাড়িয়ে তিনি হুংকার ছাড়লেন, “আরে, ফাদার ব্রাউন যে! কোথায় চললেন এদিকে?”

ফাদারের তেমন কোনও জরুরি কাজ নেই শুনে তাঁকে পাকড়াও করে প্রফেসর নিয়ে চললেন নিজের গন্তব্যের দিকে। হাত-পা নেড়ে, উচ্চকণ্ঠে তাঁর সাম্প্রতিকতম তর্কে অবিসংবাদিত জয়ের বর্ণনা দিতে দিতে চললেন প্রফেসর, আর তাঁর পাশে পাশে, ‘বাহ’, ‘চমৎকার’, ‘যা বলেছেন’ ইত্যাদি লাগসই ফোড়ন দিতে দিতে চললেন গোলমুখো ফাদার ব্রাউন।
প্রফেসর বললেন, “উজবুকগুলো খালি জিজ্ঞাসা করে আমার প্রতিপাদ্যটা কী? মানুষের বাইরে কিছু আছে না নেই? অপোগণ্ডগুলো কিছুতেই বুঝবে না যে আমি বিজ্ঞানী। আর বিজ্ঞানীর কাজ কিছু প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা নয়। বিজ্ঞানীর কাজ সত্যিটাকে খোঁজা।”
“ঠিক ঠিক।” বললেন ফাদার ব্রাউন।
পকেট থেকে পাইপ বের করে ধরিয়ে বড় করে ধোঁয়া ছেড়ে ভুরু কুঁচকে প্রফেসর অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। খানিকক্ষণ পর বললেন, “বুঝলেন ফাদার, আমি এখনও স্পষ্টাস্পষ্টি কিছু বলার জায়গায় আসিনি, তবে একটা বিষয়ে ক্রমশ নিজের মনে নিশ্চিত হচ্ছি।”
ফাদার ব্রাউন কৌতূহলী ভুরু তুললেন।
“আমি ক্রমে নিশ্চিত হচ্ছি যে যদি কিছুর খোঁজ পাওয়ার থাকে তাহলে সেটা এই প্ল্যানচেট, মিডিয়াম, হানাবাড়ি, ভূতবাংলো— এসব জিনিসে খুঁজলে পাওয়া যাবে না। এসবের মধ্যে সত্য যতখানি, মানুষের মেলোড্রামার প্রতি লোভ তার থেকে বেশি।”

ফাদার ব্রাউন মিহিগলায় বললেন, “আমার সবসময়েই মনে হয়েছে এই যেখানে সেখানে মানুষের অবয়ব ধারণ করে অতিপ্রাকৃতের আবির্ভূত হওয়ার ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ সন্দেহজনক। অতিপ্রাকৃত বলে যদি কেউ বা কিছু থেকেই থাকে, তারা আমাদের সঙ্গে দেখা করার বা আমাদেরকে দেখা দেওয়ার জন্য উদগ্রীব, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। আমাদের সঙ্গর যদি তাঁদের এতই দরকার হয়, তাহলে মাঝেসাঝে পৃথিবীতে ঢুঁ মেরে দু-একজনকে তুলে নিজেদের জগত নিয়ে যাওয়াটা প্ল্যান হিসেবে বেটার। কাজেই অতিপ্রাকৃতের প্রমাণ পেতে গেলে ভূতের আবির্ভাবের থেকে মানুষের উবে যাওয়া বা অন্তর্ধানের দিকটা তলিয়ে দেখলে কিছু পাওয়া গেলেও যেতে পারে।”

“বাই জোভ!” চেঁচিয়ে উঠে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লেন প্রফেসর ওপেনশ। “আমিও তো ঠিক এইটাই ভাবছিলাম! এই যে নিশিডাক, সমুদ্রে জলপরি বা মৎস্যকন্যার পিছু পিছু সমুদ্রে নেমে যাওয়ার গল্প চলে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, এ সব কি শুধুমাত্র গ্রাম্য কুসংস্কার আর রূপকথা? আর এসব প্রাচীন মিথের কথা যদি ছেড়েই দিই, এই যে রোজ খবরের কাগজে কোটি কোটি নিরুদ্দেশসংক্রান্ত ঘোষণা ছাপা হচ্ছে, এত সব লোক হারিয়ে যাচ্ছে কোথায়? এদের মধ্যে কতজন ফিরছে? যারা ফিরছে না কেন ফিরছে না? সে কি শুধু শখ করে, নাকি অন্য কোনও ধাঁধা আছে?”

মোড়ের মাথার চার্চের ঘড়িতে ঢং ঢং ঘণ্টা বাজল। পকেট থেকে ঘড়ি বার করে চোখ কপালে তুললেন প্রফেসর।
“এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে পরে কোনও একদিন বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছে রইল ফাদার। এই অন্তর্ধানসংক্রান্ত একটা মারাত্মক ইন্টারেস্টিং চিঠি পেয়েছি, রেভারেন্ড লুক প্রিঙ্গলস বলে একজন লিখেছেন। চেনেন নাকি? অবশ্য উনি গত বেশ ক-বছর ধরে মিশনারি হিসেবে আফ্রিকায় আছেন। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ওঁকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া আছে, মনে হচ্ছে একটা সূত্র পাওয়া গেলেও যেতে পারে…” বলতে বলতে, হাত নাড়তে নাড়তে মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন প্রফেসর ওপেনশ।

 

*****

 

ঘটনাস্থলের অল্প দূরেই রাস্তার পাশের একটি বাড়ির দোতলায় প্রফেসরের দেড় কামরার ছোট অফিস। ওই অফিস থেকে প্রফেসর ‘আধিভৌতিক সংবাদ’ নামের একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করতেন। সে পত্রিকায় লঘু ভূতের গল্পের কোনও জায়গা ছিল না, ছাপা হত খালি গম্ভীর, তথ্যসমৃদ্ধ, গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ। অন্যান্য পত্রপত্রিকার জন্যও প্রফেসর নিয়মিত লেখালিখি করতেন। তাছাড়া এদিক-ওদিক তাঁর সভা-সেমিনার লেগেই থাকত, সেসবের কাজকর্মও এই অফিসে বসেই হত। এসব কাজে তাঁকে সাহায্য করার জন্য একটি কর্মচারী ছিল। প্রফেসর যখন অফিসে ঢুকলেন, সে বাইরের ঘরে বসে একমনে খটাখট টাইপ করছিল।
প্রফেসর নিজের ঘরের দিকে এগোতে এগোতে জিজ্ঞাসা করলেন, “রেভারেন্ড প্রিঙ্গলস এসেছেন?”
টাইপরাইটারের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে কর্মচারী উত্তর দিল, “না।”
“উনি এলে সোজা আমার ঘরে পাঠিয়ে দেবে। আর ওই আর্টিকলটার প্রুফ আজকের মধ্যেই দেখে আমার টেবিলে রেখে যাবে।“

নিজের ঘরে ঢুকে কোট হ্যাঙ্গারে টাঙিয়ে চেয়ারে এসে বসলেন প্রফেসর ওপেনশ। তাঁর অফিসের তিনদিকের দেওয়ালজোড়া বুকশেলফে বোঝাই কাগজপত্র, ঘরের মাঝখানে চওড়া সেক্রেটারিয়েট টেবিল, টেবিলের ওপাশে ভিজিটরদের জন্য দুটো হাতলওয়ালা সোজাপিঠের চেয়ার, আর এদিকে তাঁর চামড়াবাঁধানো প্রিয় কেদারা। কেদারার বাঁয়ে জানালার ওপাশে রেলিং দেওয়া সরু বারান্দা। রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে নিচের শহরের রাস্তা, গাড়িঘোড়া দেখা যায়। বসে বসে দেখতে বেশ লাগে।

যদিও সেসব দেখার সময় প্রফেসরের কোনোদিনই হয় না, আজও হল না। কেদারায় বসে টেবিল থেকে মুখ ছেঁড়া বাদামি খামটা তুলে নিলেন তিনি। ভেতরের চিঠিটা আগে বারতিনেক পড়েছেন, আবার পড়লেন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়ে লেখা সংক্ষিপ্ত চিঠি। এ ধরনের চিঠি প্রফেসর অহরহ পান। কত রকম লোকে যে চিঠি লেখে। পেতে পেতে প্রফেসরের এমন অভ্যেস হয়েছে যে চিঠির প্রথম দেড় লাইন পরে তিনি বলে দিতে পারেন লেখক পাগল, ছাগল না বদমাশ। কিন্তু এই চিঠির প্রেরককে সেসবের কোনও দলেই ফেলতে পারলেন না তিনি। সংক্ষিপ্ত এবং সুচারু দু-ছত্রে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাওয়া হয়েছে, আর মিনিটখানেকের মধ্যেই…

গলাখাঁকারির শব্দে চমকে উঠলেন প্রফেসর। তাঁর অফিসের মাঝখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছেন।
“ইয়ে, আপনার কর্মচারী সোজা ঢুকে আসতে বলল তাই…”
অপ্রস্তুত হেসে বললেন রেভারেন্ড লুক প্রিঙ্গলস।
উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করে সামনের চেয়ার দেখিয়ে দিলেন প্রফেসর। তাঁর বন্ধু ফাদার ব্রাউনকে দেখলেই যেমন পাদরি বলে চেনা যায়, রেভারেন্ড প্রিঙ্গলসকে দেখলে ঠিক তেমন যায় না, বরং লালচে বাদামি দাড়িগোঁফে ঢাকা মুখ, গলাবন্ধ কোট পরা লোকটার চেহারার সঙ্গে পাগলাটে বিজ্ঞানীর সঙ্গে মিল আছে বেশি। প্রফেসর ওপেনশ নিজেকে মনে করালেন, চিঠি অনুযায়ী লুক প্রিঙ্গলস গত বেশ কিছু বছর ধরে পশ্চিম আফ্রিকার জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে মিশনারির কাজ করছেন। তাঁর চেনা শহুরে মিশনারিদের সঙ্গে লুক প্রিঙ্গলসের চেহারার মিল না থাকাই স্বাভাবিক।

গোঁফদাড়ির আড়ালের রেভারেন্ডের বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি, বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি প্রফেসরের মন টানল। ঝুঁকে পড়ে টেবিলে কনুই রেখে বললেন প্রফেসর, “আমি আপনার চিঠি পেয়ে থেকে উদগ্রীব হয়ে আছি। একেবারে গোড়া থেকে বলুন দেখি কী কী হয়েছে?”
রেভারেন্ড লুক প্রিঙ্গলস তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন।

“আমি জানি, প্রফেসর, আপনার কাছে নিশ্চয় এরকম চিঠি অনেক আসে, আপনি হয়তো আমাকে আরেকজন ভাঁওতাবাজ বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে ধরে নিচ্ছেন…” মাথা নেড়ে প্রতিবাদ জানালেন প্রফেসর… “কিন্তু আমি খবরের কাগজে, পত্রপত্রিকায় আধিভৌতিক বিষয়ে আপনার গবেষণার নিয়মিত খবর রাখি। তাই ঘটনাটা যখন ঘটল, আপনার নামটাই আমার প্রথম মনে এল। কারণ ঘটনাটা অদ্ভুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ দুঃখজনকও বটে। কোনোরকম হালকা চালে এটা নিয়ে আলোচনা হোক সেটা আমার ইচ্ছে ছিল না, আর এ ব্যাপারকে যথার্থ গুরুত্বসহকারে বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করার জন্য আপনার থেকে যোগ্য লোক এ শহরে…”
রেভারেন্ড প্রিঙ্গলসকে মুহূর্তে মুহূর্তে আরও বেশি ভালো লাগতে শুরু করেছে প্রফেসর ওপেনশ-র।

“পশ্চিম আফ্রিকার নিয়ানিয়া প্রদেশে আমি কিছুদিন মিশনের কাজে নিযুক্ত ছিলাম। জঙ্গলে আমি ছাড়া অন্য শ্বেতাঙ্গ বলতে ছিলেন ক্যাপ্টেন ওয়েলস। ক্যাপ্টেন ওয়েলস মিশনারিদের পছন্দ করতেন না, আমিও তাঁর সঙ্গে এখানে থাকলে বন্ধুত্ব পাতাতাম না হয়তো, কিন্তু সঙ্গের অভাবেই আমাদের মধ্যে সখ্য গড়ে উঠেছিল।
“একদিন তাঁর তাঁবুতে বসে একটা অদ্ভুত গল্প শোনালেন ক্যাপ্টেন। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে ছিল তাঁর সবসময়ের সঙ্গী একটা ছোট ছোরা, তাঁর রিভলভার, আর ছেঁড়াফাটা চামড়াবাঁধাই একটা ছোট বই। ক্যাপ্টেন বললেন, কিছুক্ষণ আগেই তিনি নৌকো করে নদী দিয়ে আসছিলেন, নৌকোতে তাঁর সঙ্গে আরেকটা লোকও ছিল, বইটা নাকি তারই। লোকটা কেবলই বলে চলছিল, বইটা নাকি অভিশপ্ত। যে-ই এই বইয়ের পাতা খুলে ভেতরে দেখবে, তার ভয়ানক বিপদ ঘটবে। স্বয়ং শয়তান এসে তাকে তুলে নিয়ে যাবে। ওয়েলস স্বভাবতই বিশ্বাস করেননি। তিনি লোকটাকে ভীতু, কাপুরুষ, অপদার্থ ইত্যাদি বলে গালি দিচ্ছিলেন, তাতেই বোধ হয় লোকটা শেষটা না থাকতে পেরে তাঁর সামনেই বইটা খুলে ভেতরটা দেখে।”

রেভারেন্ড থামলেন। জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, “বইটার দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে বইটা ফেলে দিয়ে লোকটা উঠে দাঁড়াল, তারপর হেঁটে হেঁটে নৌকার কিনারায় গিয়ে… জাস্ট অদৃশ্য হয়ে গেল।”
প্রফেসর জিজ্ঞাসা করলেন, “লোকটা বইটা কোথা থেকে পেয়েছিল?”
“ক্যাপ্টেন ওয়েলস আমাকে যা বলেছিলেন, বইটা ডক্টর হ্যানকি বলে একজন প্রাচ্যদেশীয় লোকের। ভদ্রলোকটি নানা দেশ ঘুরে আপাতত নাকি ইংল্যান্ডেই এসে আস্তানা গেড়েছেন। ক্যাপ্টেন ওয়েলসের নৌকোর সঙ্গীকে ডক্টর হ্যানকি বইটা দিয়েছিলেন এবং দেওয়ার আগে পইপই করে সাবধানও করে দিয়েছিলেন যে বই খুললে বিপদ হতে পারে।”

প্রফেশর ওয়েলস তাঁর যত্ন করে ছাঁটা দাড়িতে হাত বুলোতে লাগলেন।
“আপনি ক্যাপ্টেন ওয়েলসের কথা বিশ্বাস করেছিলেন?”
“করেছিলাম।”
“কেন?”
“ক্যাপ্টেন ওয়েলসকে চিনলে আপনিও বিশ্বাস করতেন, প্রফেসর। এইরকম একটা অদ্ভুত ঘটনা বানিয়ে বলার কল্পনাশক্তি ক্যাপ্টেনের ছিল না। লোকটার উধাও হয়ে যাওয়ার নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন ওয়েলস। এমনকী এটাও বলেছিলেন যে লোকটা অদৃশ্য হওয়ার সময় তিনি ভেবেছিলেন হয়তো লোকটা জলে পড়ে গেছে, কিন্তু কোনও ছলাৎ শব্দ না শুনতে পেয়ে তিনি নিশ্চিত হন সে রকম কিছু হয়নি। নিজে চোখে না দেখলে ক্যাপ্টেনের পক্ষে এত ডিটেলে কোনও ঘটনার বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব।”
প্রফেসর ওপেনশ মাথা নাড়লেন।
“আর দুই,” লুক প্রিঙ্গলসের মুখে ছায়া ঘনিয়ে এল, “আমি ক্যাপ্টেন ওয়েলসের কথা বিশ্বাস করেছি, কারণ ক্যাপ্টেনের গল্পটা শোনার কয়েক মুহূর্ত পরে আমি ঘটনাটা নিজে চোখে ঘটতে দেখেছি।”
ঘর নিস্তব্ধ হয়ে রইল। প্রফেসর লুক প্রিঙ্গলসের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

“ক্যাপ্টেন ওয়েলস তাঁর হাতের ছোরা আর বইটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখেছিলেন। তাঁবুতে ঢোকার একটাই দরজা ছিল, আমি সেই দরজায় দাঁড়িয়ে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ক্যাপ্টেন ওয়েলস গজগজ করছিলেন। বলছিলেন, ‘এই বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করা পাগলামো আর মূর্খামি ছাড়া কিছু নয়।’ আমি বুঝতে পারছিলাম, নিজের চোখে দেখা সত্ত্বেও ঘটনাটা মন থেকে মেনে নিতে ক্যাপ্টেন ওয়েলসের কষ্ট হচ্ছে। আমি নিজেও যে সেই মুহূর্তে খুব কনভিন্সড ছিলাম তেমন নয়, কিন্তু আমি সর্বদাই সাবধানতার পক্ষে। ক্যাপ্টেন ওয়েলস ক্রমাগত বলে চলেছিলেন, ‘একটা বই খুলে দেখলে কী ক্ষতি হবে? কী ক্ষতি হওয়া সম্ভব?’ এখন ভেবে আমার খারাপ লাগছে, কিন্তু আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম। আমি বলেছিলাম, ‘কী ক্ষতি হতে পারে তো দেখলেন আপনি চোখের সামনে। নৌকোর ঘটনাটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?’
“ক্যাপ্টেন ওয়েলস উত্তর দিলেন না। তাঁর মুখোমুখি হওয়ার জন্য আমি পেছন ফিরলাম এবং আবিষ্কার করলাম আমার তাঁবু ফাঁকা। ক্যাপ্টেন ওয়েলস কোথাও নেই।
“টেবিলের ওপর বইটা খোলা পড়ে ছিল। আর উলটোদিকের তাঁবুর কাপড়ে একটা লম্বা আঁচড়ের মতো ফালি, ফালির নিচে মেঝেতে ক্যাপ্টেনের ছোরা পড়ে ছিল। আমি সেই ফাটল দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে গেলাম, কয়েকটা ছোট গুল্ম থেঁতলে গিয়েছিল। আমি বুঝতে পারলাম না সেগুলো তখনই নষ্ট হয়েছে, না আগের রাতে কোনও বড় প্রাণীর পায়ের চাপের পরিণতি। শুধু একটা ব্যাপার নিশ্চিত, ওই মুহূর্তের পর থেকে ক্যাপ্টেন ওয়েলসকে আর দেখা যায়নি। তিনি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন।”

“আমি বইটা সাবধানে কাগজে মুড়ে নিলাম,” রেভারেন্ড প্রিঙ্গলসের মুখে হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল, “বলা বাহুল্য, বইটার দিকে না তাকিয়ে। তারপর ওটা নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে এলাম। সোজা ডক্টর হ্যানকির কাছেই যাওয়ার প্ল্যান ছিল, কিন্তু আসার পথে ট্রেনে কাগজে আপনার সাম্প্রতিক আলোচনা পড়ার সুযোগ হল যেখানে আপনি বলেছেন আধিভৌতিকের চাবিকাঠি থাকলেও থাকতে পারে মানুষের অন্তর্ধানের আড়ালে। মনে হল আপনাকে বিষয়টা জানানো দরকার। তখনই আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাই।”

চেয়ারে হেলান দিয়ে দু-হাত পেটের কাছে জড়ো করে খানিকক্ষণ বসে রইলেন প্রফেসর ওয়েলস। অন্য সময়ে এরকম গল্প শুনলে তিনি ধরেই নিতেন এটা আদ্যন্ত গুল। কিন্তু লুক প্রিঙ্গলসের অকপট চোখের দিকে তাকিয়ে প্রফেসর সে রকম করতে পারলেন না। এর আগে যতজন প্রফেসর ওয়েলসকে আধিভৌতিক কোনও ঘটনা শোনাতে বসেছেন, সবারই একটা না একটা এজেন্ডা ছিল। প্রফেসর তাঁদের গল্প বিশ্বাস করা বা না করার সঙ্গে তাঁদের স্বার্থ ছিল। যে কোনও একটা মতকে সত্যি এবং অন্য সব মতকে ভাঁওতা প্রমাণ করার উদ্দেশ্য ছিল। সেসবের কিছুই লুক প্রিঙ্গলসের মুখে খুঁজে পেলেন না প্রফেসর।

“বইটা এখন কোথায় রেভারেন্ড?”
“বাইরের ঘরে রেখে এসেছি। আমার ভয় ছিল এ ঘরে নিয়ে এলে আপনি আমার পুরো কথা শোনার আগেই বইটা খুলে দেখতে চাইবেন। আমি সে ঝুঁকি নিতে চাইনি। অবশ্য বাইরে রেখে আসাটাও… মানে আপনার কর্মচারী যদি বইটা খোলে…”
হাত নেড়ে লুক প্রিঙ্গলসের দুশ্চিন্তা উড়িয়ে দিলেন প্রফেসর।
“বেরিজ নিজের কাজ ছেড়ে অন্যের বই খুলে দেখতে যাবে না। অত কম কৌতূহলের লোক আমি আর দেখিনি।”
চেয়ার ঠেলে উঠে পড়লেন প্রফেসর।
“চলুন, বইটা দেখা যাক। এখন যেটা ভাবার, বইটা নিয়ে কী করা উচিত। হ্যানকিকে পাঠিয়ে দেওয়া নাকি নিজেদের কাছে রেখে গবেষণা চালানো।”

অফিসের দরজা খুলে বাইরের ঘরে বেরিয়ে এলেন প্রফেসর ওপেনশ আর রেভারেন্ড প্রিঙ্গলস। টেবিলের ওপর টাইপরাইটারের পাশে একটা বাদামি কাগজের মোড়ক, মোড়কের পাশে একটা বই। বইটা খোলা। টেবিলের পেছনের জানালার কাচের ঠিক মাঝখানে একটা বিরাট গর্ত দিয়ে বাইরের বারান্দা দেখা যাচ্ছে, যেন কারও ভয়ংকর তাড়া ছিল, দরজা খোলার সময় হয়নি, দৌড়ে গিয়ে জানালার কাচ ফুঁড়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

 

*****

 

প্রফেসর ওপেনশই প্রথম কথা বলার শক্তি সংগ্রহ করতে পারলেন। রেভারেন্ডের বিস্ফারিত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, রেভারেন্ড। আমার স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আপনাকে আমি এতক্ষণ সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, কিন্তু এরপর আর কোনও কথা চলে না। কিন্তু এত বড় প্রমাণের মুখে অবিশ্বাসী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতো সাহসী কিংবা মূর্খ কোনোটাই আমি নই।”
রেভারেন্ড ধাতস্থ হয়ে বললেন, “আমাদের মনে হয় একটু খোঁজাখুঁজি করা দরকার। আফটার অল, এটা তো আফ্রিকার জঙ্গল নয়। আপনি আপনার কর্মচারীর বাড়ির ঠিকানা বা ফোন নম্বর কিছু জানেন?”
“ওই নর্থের দিকে কোথায় একটা থাকে বলেছিল, এক্স্যাক্ট ঠিকানাটা তো… ওর ফোন নম্বর আমি জানি না। জানার দরকার হয়নি কখনও।”
রেভারেন্ড বললেন, “পুলিশকেও মনে হয় একটা খবর দেওয়া দরকার।”
“পুলিশ?” মানুষ আর ভূতের বাইরে এই তিন নম্বর প্রাণীটির কথাটা যেন এতদিন তলিয়ে ভাবেননি প্রফেসর।
“ওরা একটা চেহারার বর্ণনা চাইবে।” এই সব জাগতিক ব্যাপারে দেখা গেল রেভারেন্ড প্রফেসরের থেকে বেশি পটু। “আপনি একটা চলনসই বর্ণনা দিতে পারবেন তো?”
প্রফেসর ঠোঁট চাটলেন। “বর্ণনা… মানে বেরিজের তো বৈশিষ্ট্য কিছু ছিল না, বাকি সবার মতোই, দাড়িগোঁফ কামানো, মাঝারি হাইট, মাঝারি চেহারা… কিন্তু রেভারেন্ড, ওসব পরে হবে,” নিজেকে ঘোরের মধ্যে থেকে টেনে বার করে আনলেন প্রফেসর, “বইটাকে নিয়ে আমাদের পরবর্তী করণীয় কাজ কী?”
“আপনি চিন্তা করবেন না, প্রফেসর। আপনি এদিকটা সামলান। আমি বইটা নিয়ে ডক্টর হ্যানকির কাছে যাই, আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া আছে। বাড়িটা কাছেই, আমার গিয়ে আসতে বেশি সময় লাগবে না। আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলি। জিজ্ঞাসা করি ব্যাপারটা কী। এইরকম একটা গোলমেলে জিনিস উনি পেলেন কোথায় আর পেলেনই যদি এটাকে খোলা বাজারে এভাবে ছেড়েই বা রেখেছেন কেন। যা কথা হবে, আমি আপনাকে এসে সব জানাব।”

ঘণ্টাখানেক পর রেভারেন্ড লুক প্রিঙ্গলস যখন ফিরে এলেন তখনও অবশ্য প্রফেসর ওয়েলস নিজের ঘরে জানালার পাশেই বসে আছেন। চোখমুখের বিভ্রান্ত ভাবটা একটু কমলেও সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়নি। উলটোদিকের চেয়ারে ধপ করে বসলেন প্রিঙ্গলস।
প্রফেসর টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। “দেখা হল? কী বললেন ডক্টর হ্যানকি?”
“ডক্টর হ্যানকি বইটা ঘণ্টাখানেকের জন্য নিজের কাছে রেখে দিলেন। কয়েক ঘণ্টা পর আমাকে আপনাকে দুজনকেই দেখা করতে বলেছেন। তখন তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত জানাবেন যে বইটা নিয়ে কী করা হবে। উনি আপনার কাজের সঙ্গে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরিচিত প্রফেসর। আমাকে বিশেষ করে বলে দিয়েছেন, যাতে পরের বার সঙ্গে করে আপনাকেও নিয়ে যাই।”
প্রফেসর পাইপ ধরালেন। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন, “লোকটাকে কেমন দেখলেন?”
“ডক্টর হ্যানকি? ভালোই। আধিভৌতিক বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা আছে। ঘুরেছেনও প্রচুর। ভারতবর্ষের কোনায় কোনায় ঘুরে প্রচুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। আমার কথা বলে খুব একটা খারাপ লাগেনি, তবে আপনি দেখা হলে আরও বেটার বলতে পারবেন নিশ্চিত।”
প্রফেসর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি ডক্টর হ্যানকির সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। ঘণ্টাখানেক পর কোট পরতে গিয়ে একটা কথা তাঁর মাথায় এল। টেবিলের কাছে ফিরে গিয়ে ফোনটা তুলে নিয়ে ডায়াল করলেন। একজন বিশেষ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। দ্রুত উদ্দিষ্ট ব্যক্তি ফোনে এলেন। প্রফেসর তাঁর গমগমে গলায় বলে উঠলেন, “ফাদার? আমি প্রফেসর ওপেনশ বলছি। আজ সন্ধেবেলা আমার সঙ্গে ডিনারে একবার দেখা করতে পারবেন? সকালে যে বিষয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল সে বিষয়ে অলরেডি কিছু তথ্য হাতে এসেছে, এবং শিগগিরই আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য হাতে আসতে চলেছে। আপনার সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। …পারবেন? ভেরি গুড। দেখা হচ্ছে তাহলে।”

 

*****

 

ফাদার ব্রাউন সঠিক সময়েই নির্দিষ্ট রেস্তোরাঁয় পৌঁছেছিলেন, কিন্তু প্রফেসর ওয়েলসের দেখা মিলল না। তাতে ফাদারের বিশেষ অসুবিধে হল না। একা সময় কাটাতে তাঁর কোনও অসুবিধে হত না, তাছাড়া শহরের ব্যস্ত রেস্তোরাঁয় সন্ধেবেলায় বসে থাকলে অনেক রকম লোক দেখা যায়। অনেকে ফাদারকে চিনতেও পারল, এসে আলাপ করে গেল।

বেশ কিছুক্ষণ পর রেস্তোরাঁর দরজা ঠেলে ঢুকলেন প্রফেসর আর প্রফেসরের সঙ্গে আরেকজন। প্রফেসরের চুল উসকো-খুসকো, চোখমুখ উদ্ভ্রান্ত। ডক্টর হ্যানকির সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়েছে। শহরের উত্তরে একটি শান্ত পাড়ায় ডক্টর হ্যানকির বাড়ি, দরজায় পেতলের প্লেটে ডক্টর হ্যানকি, এম ডি, এম আর সি এস লেখা। বেল বাজানোর দরকার হয়নি, দরজা অর্ধেক খোলাই ছিল। ভেতরে বসার ঘরের টেবিলে খোলা পড়ে ছিল ফুটিফাটা মলাটের বইখানা আর উলটোদিকের দেওয়ালে আরেকটা দরজা খোলা গিয়ে পড়েছিল বাগানে। নরম মাটিতে বুট পরা দুটো পায়ের ছাপ চিহ্ন বাগানের মাঝখান পর্যন্ত গিয়ে মিলিয়ে গেছে।

বইটা রেস্তোরাঁর টেবিলে সাবধানে নামিয়ে রাখলেন রেভারেন্ড। ফাদার ব্রাউন উঁকি মেরে দেখলেন। চামড়ার বাঁধাই ফেটে গেছে, ভেতর থেকে টকটকে লাল কালিতে ‘ভিশপ্ত’ অক্ষরগুলো চোখে পড়ল ফাদারের।
হাত নেড়ে পরিবেশককে ডাকলেন ফাদার। তাঁর তেষ্টা পেয়েছে। রেভারেন্ড আর প্রফেসরের ওসব দিকে লক্ষই নেই। উত্তেজিত গলায় দুজনে পরবর্তী কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন।

রেভারেন্ড লুক প্রিঙ্গলস জানালেন তিনি বইটা নিয়ে আরও কিছুক্ষণ সময় কাটাতে চান। প্রফেসর যদি অনুমতি দেন, তাহলে তিনি প্রফেসরের অফিসটা ব্যবহার করতে পারেন। প্রফেসর এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। পকেট হাতড়ে রেভারেন্ডকে অফিসের চাবি দিতে যাবেন, রেভারেন্ড বিষণ্ণ হেসে বললেন, “আপনি ভুলে যাচ্ছেন প্রফেসর। আপনার অফিসের জানালায় এখন একটা মানুষপ্রমাণ গর্ত আছে।”
বই বগলদাবা করে বেরিয়ে গেলেন প্রিঙ্গলস। প্রফেসর ওপেনশ তাঁকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।

টেবিলে ফিরে প্রফেসর ওপেনশ দেখলেন ফাদার ব্রাউন পরিবেশকের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছেন। তার বাড়ির লোকের খবরাখবর নিচ্ছেন। ফাদারের পরিচিতির ব্যাপ্তি সম্পর্কে প্রফেসর বিস্ময় প্রকাশ করাতে ফাদার হাসলেন। এই দোকানে তিনি ন-মাসে ছ-মাসে এক-আধবার আসেন, তখনই এদের কর্মচারীদের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছে। প্রফেসর ওপেনশও আসেন এই দোকানেই খেতে। ন-মাসে ছ-মাসে নয়, সপ্তাহে বারতিনেক। কিন্তু যতক্ষণ থাকেন, মানুষের সঙ্গ যথাসম্ভব পরিহার করে চলার চেষ্টা করেন। সঙ্গে করে পড়ার বা লেখার কোনও কাজ আনেন, তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েই সময়টা কেটে যায়। কাজও হয়, লোকের সঙ্গে অবান্তর কথাও বলতে হয় না।

সকাল থেকে যা যা ঘটেছে, সব ফাদারকে বিস্তারে খুলে বললেন প্রফেসর। আফ্রিকার জঙ্গলের নৌকো থেকে উধাও হয়ে যাওয়া, ক্যাপ্টেন ওয়েলসের তাঁবু থেকে রহস্যজনক অন্তর্ধান, বন্ধ ঘরের দেওয়াল ফুঁড়ে তাঁর কর্মচারী বেরিজের উধাও হয়ে যাওয়া, হ্যানকির বাগানের মাঝ পর্যন্ত পায়ের ছাপ। ফাদার শান্ত মুখে পুরোটা শুনলেন। প্রফেসরের বর্ণনা সবে শেষ হয়েছে, এমন সময় একজন এসে জানাল প্রফেসরের জন্য টেলিফোন আছে।

ওদিক থেকে লুক প্রিঙ্গলসের গলা শোনা গেল। জোরে জোরে শ্বাস শোনা যাচ্ছে।
“প্রফেসর?”
“হ্যাঁ। কী হয়েছে রেভারেন্ড? সব ঠিক আছে তো?”
“আমি আর পারছি না, প্রফেসর। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমি বইটা খুলব। এর পর কী হবে আমি জানি না। হয়তো আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না, আপনি চিন্তা করবেন না, কিন্তু বইয়ের ভেতর কী আছে না জেনে আমার শান্তি নেই। গুডবাই…”
“না, রেভারেন্ড, না, না! বই খুলবেন না! রেভারেন্ড? রেভারেন্ড প্রিঙ্গলস? হ্যালো, হ্যালো…” ফোনে চিৎকার করতে থাকলেন প্রফেসর। ওপার থেকে কোনও উত্তর এল না।

ফোন রেখে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন প্রফেসর ওপেনশ। তারপর ধীরে ধীরে টেবিলে ফিরে এলেন। ফাদার ব্রাউনকে জানালেন এইমাত্র কী ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে।
“এই নিয়ে পাঁচ হল। জঙ্গলে নৌকো থেকে, তাঁবু থেকে, আমার অফিস থেকে, হ্যানকির বাড়ি থেকে এবং আবারও আমার অফিস থেকে। এর আগে আরও কত লোক অদৃশ্য হয়েছে কে জানে।”
খেদে মাথা নাড়লেন প্রফেসর। তাঁর মুখচোখ আতংকে সাদা হয়ে গেছে। ফাদার তাঁর দিকে জলের গ্লাস এগিয়ে দিলেন। এক চুমুকে সেটা খালি করে খানিকটা ধাতস্থ হলেন প্রফেসর।
“তবে ফাদার, এতজনের মধ্যে আমি সবথেকে আশ্চর্য হয়েছি বেরিজের অদৃশ্য হওয়ায়। হয়তো ওকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম বলেই। বইটার মধ্যে নিশ্চয় কোনও আকর্ষণী শক্তি আছে। না হলে বেরিজের মতো একটা আপাদমস্তক কল্পনাশক্তিহীন, বোরিং লোক যে হঠাৎ অন্য লোকের জিনিস খুলে দেখতে যাবে, সেটা আমি কল্পনা পর্যন্ত করতে পারি না।”
ফাদার মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, বেরিজের পক্ষে অন্য লোকের জিনিস খুলে দেখাটা অদ্ভুত বটে, কিন্তু সেটা সহবতের কারণে। আপনি যে যে কারণগুলো বললেন সে জন্য নয়। বেরিজ কল্পনাশক্তিহীন বা বোরিং কোনোটাই ছিল না। ইন ফ্যাক্ট, বেরিজ অসম্ভব রসিক এবং বুদ্ধিমান ছিল। বেড়াতে ভালোবাসত, বই পড়তে ভালোবাসত। লোকাল ক্লাবে, শহরের অ্যামেচার ক্লাবেগুলোতে ও রীতিমতো নামকরা, নিয়মিত অভিনয় করেছে। আমাকে শেক্সপিয়ারের দু-কলি অভিনয় করে দেখিয়েওছিল। দারুণ।”
“আপনাকে?” প্রফেসর ওপেনশ-র মুখ হাঁ হয়ে গেল। “আপনার সঙ্গে আলাপ ছিল নাকি বেরিজের?”
“আলাপ কিছু না, ওই মাঝেসাঝে আপনার অফিসে যখন গেছি, আপনার জন্য অপেক্ষা করার সময় কথাবার্তা হয়েছে আর কী।”
প্রফেসর সামলে নিয়ে বললেন, “কিন্তু বেরিজের অভিনয়ক্ষমতা আমাদের আজকের ক্রাইসিসের পক্ষে অবান্তর। তার সঙ্গে ওর রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। বা বাকিদের উধাও হওয়ার সঙ্গেও।”

পরিবেশক খাবার নিয়ে এল। ফাদার ব্রাউনের ভয়ানক ক্ষিদে পেয়েছিল, তিনি খাবারের দিকে মনোযোগ দিয়ে বললেন, “বাকিদের বলতে?”
প্রফেসর ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকলেন ফাদার ব্রাউনের দিকে। ফাদারকে তিনি অনেকদিন ধরে চেনেন। এমন কিছু বয়সও হয়নি তাঁর ভীমরতি হওয়ার মতো। কিন্তু হয়েছে যে দেখাই যাচ্ছে। কাঁটাচামচ নামিয়ে রেখে ফাদারের দিকে ঝুঁকে পড়ে প্রফেসর কেটে কেটে, স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, “বাকিদের বলতে আরও যে চারজনের কথা আমি আপনাকে বললাম। যারা ব্যাখ্যার অতীত উপায়ে অদৃশ্য হয়েছে, তারা।”
ধীরেসুস্থে মুখের গ্রাস শেষ করে কাঁটা নামিয়ে, রুমাল দিয়ে মুখ মুছে প্রফেসরের রাগত চোখে নিজের শান্ত চোখ রেখে ফাদার ব্রাউন বললেন, “মাই ডিয়ার প্রফেসর, একজন লোকও অদৃশ্য হয়নি।”

ফাদারের উন্মাদ হয়ে যাওয়া নিয়ে যেটুকু সন্দেহ প্রফেসরের ছিল, আর রইল না। ফাদার ব্রাউন বলে চললেন, “গোটা ব্যাপারটায় সবথেকে কেরামতির জায়গাটা হচ্ছে ঘটনাটাকে একটা সিরিজে পরিণত করা। একটা অবিশ্বাস্য ঘটনাকে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন নয়, কিন্তু পাঁচটা অবিশ্বাস্য ঘটনা যখন পরপর ঘটে, তখন তারা একইরকম অবিশ্বাস্য হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিশ্বাস করে নিতে কোনও কষ্টই হয় না।”
“আপনিও ভেবে দেখুন প্রফেসর, ওই নৌকোর লোকটা অদৃশ্য হওয়ার ঘটনাটা আলাদাভাবে শুনলে আপনি বিশ্বাস করতেন? করতেন না। এমনকী তাঁবু থেকে ক্যাপ্টেন ওয়েলসের উধাও হওয়ার ঘটনাটাকে উড়িয়ে দিতেও আপনার কোনও অসুবিধে হত না। অভিশপ্ত বইতে আপনার বিশ্বাস জন্মাল যখন সিরিজের তিন নম্বর ঘটনাটা ঘটল, আপনার কর্মচারী বেরিজ অদৃশ্য হল এবং…”
“এবং আমি নিজের চোখে সেই ঘটনাটা দেখলাম।” টেবিল চাপড়ে হুংকার দিয়ে উঠলেন প্রফেসর। আশেপাশের টেবিলের লোক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল তাঁকে।
ফাদারের মুখে একই সঙ্গে করুণ এবং কৌতুকপূর্ণ হাসি ফুটল।
“আপনি বেরিজকে অদৃশ্য হতে দেখেননি প্রফেসর, বরং উলটোটাই দেখেছেন। আপনি বেরিজকে আপনার অফিসঘরের মাঝখানে আবির্ভূত হতে দেখেছেন। মুখভরা লালচে দাড়িগোঁফ, গলাবন্ধ মোটা কোট…”
“রেভারেন্ড লুক প্রিঙ্গলস?” প্রফেসরের গলা দিয়ে কোনোমতে তিনটে শব্দ বেরোল।
“এক্স্যাক্টলি। রেভারেন্ড লুক প্রিঙ্গলস।”
“কিন্তু আ-আমি, আমি ওকে চিনতে পারব না? গত দেড় বছর ধরে ও আমার জন্য কাজ করছে?”
“পারবেন? আচ্ছা বলুন দেখি বেরিজকে কেমন দেখতে? পুলিশকে আপনি বেরিজের বর্ণনা দিতে পারতেন? দাড়িগোঁফ নেই আর চশমা আছে, এই দুটো তথ্য ছাড়া আর কিছুই বেরিজের সম্পর্কে আপনার জানা ছিল না। আপনারই অফিসের টাইপরাইটারে রেভারেন্ড লুক প্রিঙ্গলসের নামে একটা চিঠি টাইপ করে আপনাকে পাঠিয়ে, একটা বইকে মোটামুটি ফুটিফাটা চেহারা দিয়ে, চশমা খুলে, দাড়ি লাগিয়ে আপনার ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালে আপনি যে ওকে চিনতে পারবেন না সেটা বেরিজ জানত, এবং সে সেটাই করেছিল।”

বিহ্বলতা কেটে গিয়ে প্রফেসরের মুখে একটা বিষাদ ঘনাল।
“কিন্তু ও আমার সঙ্গে এরকম একটা নিষ্ঠুর ঠাট্টা করল কেন?”
“করল, কারণ আপনি ওর দিকে বিন্দুমাত্র মনোযোগ দিতেন না। ওকে কল্পনাশক্তিহীন, নির্বোধ কেরানি ভাবতেন। আবার এই আপনারই মানুষকে তার সমস্ত ভড়ং, মুখোশ পেরিয়ে ‘চিনে’ ফেলার ক্ষমতার খ্যাতি ছিল। আমার ধারণা আপনি নিজেও নিজের এই ক্ষমতাতে বিশ্বাস করতেন। বেরিজের বুদ্ধি ছিল, কৌতুকবোধ ছিল, ও আপনার এই খ্যাতিটাকেই একটু চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছিল আর কী। সে জন্য এত হাঙ্গামা পোয়াতে ও পিছপা হয়নি। গল্প তো ফেঁদেছেই, আগে থেকে কাচটা কেটে রেখে, কাপড় জড়ানো হাতুড়ি দিয়ে আলতো টোকা মেরে সেটা ভেঙেছে। তারপর ডক্টর হ্যানকি বলে একজন কাল্পনিক ডাক্তারের নামে নেমপ্লেট ছাপিয়ে নিজের বাড়ির দেওয়ালে সেঁটে, বাড়ির বাগানে জুতোর ছাপ বানিয়ে আপনাকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছে।”
“ওটা বেরিজের বাড়ি!”
“আর কার? আপনি তো বেরিজের ঠিকানাটাও ঠিক করে জানতেন না। শহরের উত্তরে থাকে কোথাও শুধু সেটুকুই জানতেন। হ্যাঁ, শুধু…” ‘আপনাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য’ বলতে গিয়েও সামলে নিলেন ফাদার ব্রাউন, “আপনার সঙ্গে রসিকতা করার জন্য এত ঝামেলা সবাই করত না, কিন্তু বেরিজ সাধারণ নয়, এটা আপনি এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন আশা করি।”

মুখ নিচু করে গ্লাসের কিনারায় আঙুল বোলাতে লাগলেন প্রফেসর।
ফাদার ব্রাউন বললেন, “বেরিজের ওপর রাগ করবেন না, প্রফেসর। ভূতপ্রেতদের প্রতি আপনি যত মনোযোগ, সময়, সাধনা দিয়েছেন, তার তিলমাত্রও খরচ করেননি আপনার আশেপাশে হেঁটেচলে বেড়ানো রক্তমাংসের মানুষের প্রতি। সেটারই প্রায়শ্চিত্ত বলে এই ঘটনাটাকে ধরে নিন।”

প্রফেসর চুপ করে রইলেন। তাঁর মুখ গম্ভীর। তাঁদের টেবিলের চারপাশে রেস্তোরাঁর টুংটাং, হাসিকথা ভেসে বেড়াতে লাগল।
“এখন বেরিজ কোথায়?”
“আমি নব্বই শতাংশ নিশ্চিত, আপনার অফিসে। মুখ গুঁজে কাজ করছে। যে মুহূর্তে লুক প্রিঙ্গলস আপনাকে ফোন করে জানালেন যে তিনি বইটা খুলতে চলেছেন এবং তারপরের নীরবতায় আপনি নিশ্চিত হলেন যে রেভারেন্ড প্রিঙ্গলস অদৃশ্য হয়েছেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই বেরিজ, নিজের সিটে, নিজের টাইপরাইটার এবং খাতাপত্রের সামনে ফিরে এসেছে।”
একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে বসলেন প্রফেসর ওপেনশ। মেঘ কেটে তাঁর মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। টেবিলে চাপড় মেরে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন।
“ব্রাভো বেরিজ। ঠিকই করেছে ও যা করেছে। আমার এটা প্রাপ্য ছিল। আমি আজই ওর মাইনে বাড়াব।”
পরক্ষণেই তাঁর মুখের ভাব বদলে গেল। ফাদার ব্রাউনের দিকে ঝুঁকে পড়ে তিনি জানতে চাইলেন, “কিন্তু ফাদার, আপনাকে স্বীকার করতে হবে, গল্পটা কিন্তু ও সত্যি সাংঘাতিক ফেঁদেছিল। আপনি বলুন, একমুহূর্তের জন্য হলেও কি আপনার ওই বদখত বইটার দিকে তাকিয়ে গা ছমছম করেনি?”
ফাদার ব্রাউন বললেন, “ওহ, ওই বইটা? আপনি যখন লুক প্রিঙ্গলস, ইয়ে, বেরিজের সঙ্গে কথা বলছিলেন আমি পাতা উলটে ওর ভেতরটা দেখলাম তো। ভেতরে সাদা পাতা ছাড়া কিচ্ছু ছিল না।”

 

ছবি – আশিস ভট্টাচার্য

G K Chesterton (১৮৭৪ – ১৯৩৬) একজন ইংরেজ লেখক, দার্শনিক এবং সমালোচক। তাঁকে ‘হেঁয়ালির রাজপুত্র’ বলা হয়। ফাদার ব্রাউন তাঁর সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় চরিত্র। ‘ফাদার ব্রাউন ও অভিশপ্ত বই’ তাঁর লেখা ‘The Blast of the Book’ গল্পটির অনুবাদ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published.