ভারত-ভাস্কর্যে সেকালের সন্ধান প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

কোনারকের সূর্যমন্দিরের একটা বিশেষ মূর্তির ছবি ব্যবহার করে প্রায়ই বিজ্ঞাপন দেন ওড়িষা সরকারের পর্যটন বিভাগ। ছবিটিতে দেখা যায় হাতির পিঠে বসে থাকা এক রাজাকে যেন আলখাল্লা পরিহিত কয়েকজন মানুষ একখানা জ্যান্ত জিরাফ নিয়ে এসে উপহার দিচ্ছেন। রাজারাজড়া বা ভি আই পি-দের পশুপাখি উপহার দেওয়ার রেওয়াজ এখনও আছে। আজকাল আবার দেশী বা বিদেশী চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের মধ্যেও প্রাণী বদলাবদলির প্রথা দেখা যায়। বোঝাই যাচ্ছে, আজ থেকে আটশ বছর আগেও এরকম হয়ে থাকত। তাছাড়া এই বিশেষ মূর্তিটি থেকে তখনকার কলিঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক যোগাযোগ থাকার বিষয়টিও খুব ভালো করে আন্দাজ করতে পেরেছেন এখনকার ইতিহাসবিদরা।

এইরকম একটা ছোট্ট ভাস্কর্য থেকে এক ধাক্কায় পুরনো দিনের খবর বা তখনকার সমাজ, মানুষের আচার-ব্যবহার প্রভৃতি কেমন ছিল জানতে পারার সঙ্গে গোয়েন্দাদের রহস্য উন্মোচনের ব্যাপারকে যেন তুলনা করা যায়। বহুকাল আগে বিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক এবং আরও অন্যান্য বিষয়ে সুপণ্ডিত নির্মল কুমার বসু পুরী শহরের এক কোনায় অবস্থিত সিদ্ধ-মহাবীর মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে আটকানো একটি ফলকে দেখেছিলেন মন্দির তৈরি হওয়ার একটি দৃশ্য খোদাই করা থাকতে। ভারা বেঁধে ভারী পাথর ওঠানো, রাজার মন্দির নিরীক্ষণ করা প্রভৃতি মূর্ত হয়েছিল সেই ভাস্কর্যে। অধ্যাপক বসু বুঝতে পেরেছিলেন মূর্তিটি ওই মন্দিরের নয়। অন্য কোনও জায়গা থেকে খুলে নিয়ে এসে লাগানো হয়েছে হনুমানজীর মন্দিরে। পণ্ডিত মানুষটি মূর্তিটির একটি স্কেচ এঁকে রেখেছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য, কারণ এখন সেই স্কেচটিই আছে। আসল মূর্তিটি হারিয়ে গেছে নিতান্ত অবহেলা আর অযত্নের ফলে। বড় মন্দির কীভাবে বানানো হত তার আন্দাজ পাওয়া যায় এই মূর্তিটি থেকে।

মন্দির নির্মাণের জন্যে বা অন্য কারণে পাথর বয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য বিভিন্ন মন্দিরে অনেক দেখা যায়। আর দেখা যায় মালবহনের দৃশ্য। ঘোড়া বা হাতির পিঠে, বাঁকে ঝুলিয়ে, কিংবা মানুষের মাথায় চাপিয়ে। কোনারকের মন্দিরের উঁচু বেদীর একেবারে নীচে এইরকম দৃশ্য অনেক আছে। পাথর বহন করার মূর্তি আছে খাজুরাহোর কয়েকটি মন্দিরে।

হিন্দুদের মন্দির সাজানোর একটি প্রধান বিষয়বস্তু হল নৃত্যরতা অপ্সরা, গন্ধর্ব, কিন্নর প্রভৃতির মূর্তি। কিন্তু গানবাজনা ছাড়া যেহেতু নাচ হয় না, তাই গাইয়ে আর বাজিয়ের মূর্তিও প্রচুর বানাতে হয়েছে সেকালের নির্মাতাদের। আবার অনেক মন্দিরে বিশেষ বিশেষ স্থানে, যেমন কোনারকের চূড়ার সামনের বারান্দায়, বা কর্ণাটকের বেলুর এবং হ্যালেবিডুর মন্দিরে কার্নিশের নীচের ব্র্যাকেটে দেখা যায় বিভিন্ন বাজনা হাতে মেয়েদের মূর্তি। এগুলি মন্দিরকে সাজানোর জন্যে যে স্থাপন করা হয়েছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তখন কেমন বাজনা ব্যবহার করা হত তার একটা আন্দাজ আমরা, এ যুগের মানুষরা, পেয়ে যাই ওই মূর্তিগুলি দেখে। সেকালে আমাদের দেশে নানা ধরনের বাঁশি, ঢাক, ঢোল, ডমরু, খঞ্জনি, করতাল প্রভৃতি বাজানো হত। তাছাড়া নানা ধরনের তারের বাজনা ছিল যেগুলি ছড় টেনে বাজাতে হত। আর ছিল কাষ্ঠতরঙ্গ ধরনের বাজনা। লাঠি দিয়ে আঘাত করে তা থেকে শব্দ সৃষ্টির ব্যবস্থা ছিল।

প্রাচীন মন্দিরগুলিতে বাইরের অলঙ্করণে শুধুই যে দেবতাদের বা স্বর্গীয় চরিত্র, যেমন গন্ধর্ব, কিন্নর, অপ্সরা প্রভৃতির মূর্তি থাকত তা নয়। কখনও এমন কারও চেহারাও সেখানে দেখা গেছে পরবর্তীকালের মানুষ যেগুলিকে কোনও বিখ্যাত রাজা বা রাণীর মূর্তি মনে করেছে। রাজা-রাণীর মূর্তি চেনার উপায় হল এদের সঙ্গে থাকা দেহরক্ষী, ছত্রধর, চামড়ধারী, পরিচারক-পরিচারিকার মূর্তি দেখে। তাছাড়া রাজা-রাণীর নিজস্ব রাজসিক চেহারা, ভাবভঙ্গি, পোশাক, মুকুট ইত্যাদি দেখেও খানিকটা আন্দাজ করা যায়। তাঞ্জোরের বিখ্যাত বৃহদীশ্বর মন্দির বা বিগ টেম্পলে অনেক মূর্তির মধ্যে একটিকে স্থানীয় মানুষরা মনে করেন সম্রাট রাজরাজা চোলের অনুকরণে নির্মিত। রাজরাজা এই মন্দিরের নির্মাতা। তিনি রাজত্ব করেছেন আজ থেকে হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে। তাহলে হঠাৎ এই মূর্তিটিকেই তাঁর মূর্তি ভাবা হল কেন?

মনে হয় মন্দির নির্মিত হওয়ার পর, রাজরাজার সমসাময়িক প্রজারা ওই মূর্তিটির সঙ্গে সম্রাটের চেহারার মিল দেখতে পান। কিংবা হয়তো মন্দির বা রাজার পক্ষ থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওই মূর্তিটি রাজার চেহারার আদলে নির্মিত। সেই থেকে বংশ পরম্পরায় তাঞ্জাভুরের মানুষ রাজরাজা হিসেবে ওই মূর্তিটিকে জেনে আসছেন। বৃহদীশ্বর মন্দিরের ভেতরে সেকালে আঁকা কিছু ছবি গত শতাব্দীতে আবিষ্কৃত হয়েছে। সেখানে দেখা যাওয়া রাজার সঙ্গে এই মূর্তিটির কিছু সাদৃশ্যও দেখা যায়।

কোনারকের মন্দিরে অবশ্য যে সম্ভ্রান্ত চেহারার মধ্যবয়স্ক পুরুষ এবং তাঁর পাশে মাথায় ঘোমটা দিয়ে দাঁড়ানো মহিলাকে রাজা নরসিংহ দেব ও তাঁর রাণী মনে করা হয়, সেই মূর্তির নীচে ছত্রধারী, দেহরক্ষী প্রভৃতি থাকলে তিনিই যে নরসিংহ দেব এবং অন্য কেউ নন, সে কথা খুব জোর গলায় বলা যায় না। তাছাড়া এখনকার আরও কয়েকটি মূর্তিতে জগন্নাথ দেবের বিগ্রহের সামনে সে সুসজ্জিত পুরুষকে দেখা যায় তাঁকেও রাজা নরসিংহ দেব বলা হয়। দুজনের চেহারার খুব একটা সাদৃশ্যও নেই।

সাঁচি এবং ভারহুতের স্তূপের রেলিঙে বা রেলিঙের গেটে কোথাও মাথায় অদ্ভুত শিরস্ত্রাণ পরিহিত একটি পুরুষের মূর্তি দেখা যায়। তাঁর চেহারা রাজসিক। কোথাও তিনি বসে আছেন হাতির পিঠে, কোথাও আবার তাঁকে দেখা যায় রাণীদের সঙ্গে। অনেকে বিশ্বাস করেন এটি হল সম্রাট অশোকের মূর্তি। তাই যদি হয়, তাহলে বলতে হবে বাইশ শ, তেইশ শ বছর আগেকার একজন মানুষ, যাঁর কীর্তির সঙ্গে এখনকার যুগ দারুণ ভাবে পরিচিত, তাঁর চেহারাটির সঙ্গে এ যুগের মানুষের পরিচয় করানোর ব্যবস্থাও প্রাচীনকালের শিল্পী করে রেখে গেছেন।

শুধুমাত্র রাজারাণীরা-ই নন, মন্দিরের ভাস্কর্যে নিতান্ত সাধারণ মানুষদেরও দেখা গেছে। কোনারকের বিভিন্ন প্যানেলে আছে মাটির উনুনে রান্না করায় ব্যস্ত মহিলার মূর্তি, ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে থাকা মা, রাস্তা দিয়ে পালকি নিয়ে চলা বাহক, গরুর গাড়ির গাড়োয়ান, মাথায় মোট বয়ে নিয়ে চলা মালবাহক প্রভৃতির মূর্তি। খাজুরাহোর কয়েকটি মন্দিরের ছোট আকারের প্যানেলে দেখা যায় কুস্তি করতে থাকা পালোয়ান, গান গেয়ে শহরের পথে ঘুরে বেড়ানো কীর্তনিয়াদের দল, গাইয়ে-বাজিয়ে প্রভৃতির মূর্তি।

আজকাল যেমন অনেক সময়ে মাইকে গান-বাজনা শুনে কান ঝালাপালা হবার যোগাড় হয়, তেমন বোধ হয় সেকালেও হত। খাজুরাহোর বিশ্বনাথ মন্দিরে একটি মূর্তিতে দেখা যায় এক বাঁশি-বাজিয়ের পাশে বসা লোকটি দু হাতে নিজের কান চেপে ধরে আছে। অর্থাৎ বাঁশি শুনতে সে নিতান্ত অনিচ্ছুক। কিন্তু বাঁশুরিয়ার তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই।

ভারতবর্ষের বহু মন্দিরে যে দুটি দৃশ্য প্রচুর খোদাই করা হয়েছে, সেগুলি হল শিকারের দৃশ্য এবং যুদ্ধের দৃশ্য। শিকার করা হত পায়ে হেঁটে, হাতির পিঠ থেকে এবং ঘোড়ায় চড়ে। দূর থেকে তির নিক্ষেপ করে হরিণ বা বাঘ মারা, এবং হাতি বা ঘোড়ার পিঠ থেকে লম্বা শূল দিয়ে শিকার, সবরকম দৃশ্যই এখানে দেখা গেছে।

যুদ্ধের মূর্তিগুলির বেশিরভাগ রামায়ণ এবং মহাভারতের যুদ্ধ। রথারূঢ় তিরন্দাজ কিংবা সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ যোদ্ধা, সবরকম যুদ্ধের মূর্তি এখানে দেখা যায়। কর্ণাটকের হাসান শহরের অদূরে দ্বাদশ শতকে হয়সল রাজাদের নির্মাণ করা হয়সলেশ্বর মন্দির আছে হ্যালেবিডু নামক ছোট্ট জনপদটিতে। আগে এই জায়গার নাম ছিল দ্বারসমুদ্র। সেই মন্দিরের বাইরে যেমন অলঙ্করণ আর ভাস্কর্য, ভেতরেও তেমন। বাইরে দু থাকে সাজানো জমকালো দেবদেবী আর পৌরাণিক চরিত্রদের মূর্তির মাঝখানে মন্দিরকে যেন বেল্টের মতো পাক দিয়ে রেখেছে কয়েকটি প্যানেল আর সেগুলির মধ্যে রয়েছে আশ্চর্য সব মূর্তি। সেগুলি এতই ছোট যে, ভালো করে না দেখলে চোখ এড়িয়ে যেতে পারে।

এমন প্যানেলের মূর্তিতে যুদ্ধের দৃশ্যে কয়েকটি রথ দেখা যায়, সেগুলি যেন তির দিয়ে বোঝাই করা। মনে হবে যেন মিশাইল লঞ্চার। ঠিক যেমন আধুনিক যুগের যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। দেখলে অবাক হতে হয়। ভাবতে বাধ্য হতে হয়, সেকালে সেই প্রাচীন যুগেও ভারতীয়রা এখনকার মতো মারণাস্ত্র তৈরি করতে পারত। কিন্তু অবাক হবার পালা এখানেই শেষ নয়। ওইরকম একটি রথের পেছনে একটি লোকের মূর্তি আছে, সে তার হাতে ধরা একটি চোঙা মতো বস্তু উঠিয়ে চোখ লাগিয়ে কী যেন দেখছে। মনে হয় দূরবিনের মতো জিনিসটি। বাইনোকুলার নয়। ছোট টেলিস্কোপ। আমরা আধুনিক যুগের মানুষরা জানি দূরবীক্ষণ যন্ত্র প্রথম নির্মাণ করেছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি কিংবা হল্যান্ডের কেউ, খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকের গোড়ায়। তার শ পাঁচেক বছর আগে হ্যালেবিডুর মূর্তিটি বানানো হয়েছিল।

 

হ্যালেবিডুর মন্দিরে টেলিস্কোপ হাতে মূর্তি

 

তাহলে কি আমরা বিশ্বাস করতে পারি না, ভারতবর্ষে বহুকাল আগে থাকতে দূরবিন তো বটেই, অন্য আরও জিনিসই ব্যবহার করা হত, যেগুলি পশ্চিম ভূখণ্ড জেনেছে অনেক পরে। সেকালের মানুষরা তাঁদের যেসব কীর্তি রেখে গেছেন, তাতে মনে হয় বিশ্বাস করতে অসুবিধে নেই। তোমরা কী বলো?

 

চিত্রসূত্র – হ্যালেবিডুর মন্দিরে টেলিস্কোপ হাতে মূর্তি। ছবিটি উইকিমিডিয়া থেকে ডাউনলোড করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.