মুখ লুকোল মাকড়সা অন্বেষা সেনগুপ্ত

এক যে ছিল মাকড়সা, সে ছিল বড়ই অলস। রোজ বেলা বারোটায় ঘুম থেকে উঠত, একপেট খাবার গিলে হেঁকে বউকে বলত, “ওগো শুনছওওওও, আমি ক্ষেতে চললাম, দোরটা দিয়ে দাও।”

 

আসলে কিন্তু সে ক্ষেতে যেত না। ক্ষেতই নেই, যাবে কোথায়? বনের মধ্যে গিয়ে একটা বড় দেখে গাছের ছায়ায় শুয়ে বসে সারাদিন কাটিয়ে দিত।

 

বউ বেচারি এসব কিছুই জানে না। সে মাঝে মাঝেই বলত, “হ্যাঁ গা, সারাদিন এত খাটাখাটনি করো, ক্ষেতের কাজে হাত লাগাতে হলে বোলো কিন্তু।” এর বেশি কিছু সে বলত না, কী জানি মানুষটা ক্ষেপে যায় যদি! মাকড়সা বসে ঠ্যাং ছড়িয়ে হাওয়া খেত আর বলত, “ভেব না গিন্নি, সময় হলেই বলব। এখনও ঢের দেরি আছে।”

 

পাড়াপ্রতিবেশী শুধোত, “বলি ক্ষেতের কাজ শুরু করবে কবে? এর পরে দেরি হয়ে যাবে যে!”  মাকড়সার সেই এক জবাব, “ও অনেক সময় আছে। হবে, হবে।”

 

একদিন মাকড়সা তার বউকে ডেকে বলল, “কাল বাদাম বুনব মাঠে। যাও তো গিন্নি, বাজার থেকে বাদাম নিয়ে এসো। কাল না বুনলেই নয়।”

বউ তো ছুটেমুটে বাজারে চলল। আহা, এতদিনে সুমতি হয়েছে মানুষটার, মুখ ফুটে একটা কাজের কথা বলেছে! বাজার থেকে থলে ভরে সে নিয়ে এল বাদাম।

 

থলে কাঁধে ফেলে পরদিন মাকড়সা বেরোল ক্ষেতে। বনে ঢুকে গাছের তলায় বসে টপাটপ বাদাম খেল যতটা পেটে ধরে, তারপর গাছের ছায়ায় ঘুম লাগাল তোফা। সন্ধেয় বাড়ি ফিরেই হাঁকডাক লাগাল— “উরি বাবারি, কী খিদে পেয়েছে! সারা শরীর ঝিমঝিম কচ্ছে, সারা দিন কী ভূতের খাটুনি, বাপ! আর দাঁড়িয়ে থাকতে পাচ্ছিনি। দাও দাও, কী খাবারদাবার আছে শিগগিরি দাও। সারাদিন ঘরে বসে ভাত রাঁধো আর তরকারি কোটো, তোমরা কী বুঝবে পুরুষমানুষের কী খাটুনি যায়!”

বউ বেচারি ভালোমানুষ, মুখে মুখে তক্কো করতে পারে না, তাই বেড়ে দিল যৎসামান্য যা রান্না করেছিল। বেচারার শরীরটা ক-দিন ভালো যাচ্ছিল না।

মাকড়সা এসব জানে না। সে সকাল হলেই খাবারদাবার বেঁধে নিয়ে ক্ষেতে যাবার নাম করে বেরিয়ে পড়ে। গাছের ছায়ায় সারাদিন ঝিমোয় আর মনের আনন্দে বাদাম খায়।

 

দিন যায়। সকলের ক্ষেতেই বাদাম ফলেছে, সবাই বস্তা ভরে ঘরে আনছে বাদাম। কিন্তু মাকড়সা যায় আর আসে, আনে না কিছুই। একদিন থাকতে না পেরে বউ শুধাল, “বাদাম তুলবে না? ঘরে আনবে কবে? আমি একটু হাতে হাতে কাজ করে দেব?”

মাকড়সা আবার মাথা নেড়ে বলল, “না না, তোমায় যেতে-টেতে হবে না। আমিই ক-দিন পরে সব তুলেটুলে নিয়ে আসব-খন।”

 

বলে তো দিল, কিন্তু আনবে কী? কোত্থেকেই বা আনবে? ক্ষেতই নেই তার, বাদাম তো দূর অস্ত! সেদিন গাছের তলায় শুয়ে অনেক ভাবল সে। বাদাম কোথায় পাবে? নতুন কেনবার পয়সা নেই, আর কিনতে গেলেই তো সবাই জেনে যাবে যে সে মিথ্যে বলছিল এতদিন। তবে উপায়?

 

– চুরি করব তবে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। মাঝরাতে পাড়া নিশুত হলে সে বেরোল পা টিপে টিপে। গ্রামের একধারে মোড়লের বাড়ি, বিরাট বাগান বাদাম গাছে ভর্তি। গাছে থোলো থোলো বাদাম ফলে আছে। পাঁচিল টপকে মাকড়সা ঢুকে পড়ল বাগানে, বাদাম পেড়ে বস্তা ভরাল। কী ভাগ্যিস মোড়লের বাড়ি কুকুর ছিল না, নইলে সেই রাতেই তার দফা গয়া হয়ে যেত। বস্তাটাকে বনের ভেতর সেই বড় গাছের কোটরে লুকিয়ে রেখে বাড়ি ফিরে গেল সে, পরদিন হাঁকডাক করে বউয়ের ঘুম ভাঙাল।

– শিগগির শিগগির খাবার দাও, আজ বাদাম আনতে যাব যে। খুব খাটনি আছে আজ। বেশ জমিয়ে রান্নাবান্না কোরো তো আজ, এসে যেন দাঁড়াতে না হয়।

বউ শান্ত মানুষ, ঘাড় নেড়ে দিল।

 

মাকড়সা বনে গিয়ে বস্তা থেকে বের করে চাট্টি বাদাম খেল, তারপর খানিক ঘুমিয়ে, খানিক হাওয়া খেয়ে সন্ধের মুখে বাড়ির দিকে হাঁটা মারল বস্তা কাঁধে।

বাদাম পেয়ে বউ মহাখুশি, এমন বড় বড় পুরুষ্টু বাদাম বলে কথা! সে বস্তা থেকে তুলে একটা খেল, দুটো খেল, একমুঠো খেল। কী ভালো খেতে!

 

সেদিন থেকে রাত হলেই মাকড়সা বস্তা কাঁধে বেরোয়, মোড়লের বাগান থেকে এক বস্তা করে বাদাম চুরি করে বনে লুকিয়ে রেখে আসে। পরদিন সন্ধেয় বাদাম দেখিয়ে বউয়ের কাছে বাহাদুরি নেয়।

 

সব ঠিকই ছিল, কিন্তু একদিন মোড়লের এক চাকর দূর থেকে দেখে ফেলল। রোজ গাছে বাদাম কমে যাচ্ছে, তক্কে তক্কে সে ছিলই, এবার দেখতে পেল কে একটা ভূতের মতো এসে বস্তা বেঁধে বাদাম নিয়ে যাচ্ছে।

চাকরটা তখুনি কিছু করল না বটে, কিন্তু মতলব ভাঁজতে লাগল চোর ধরার৷ চোর তাকে দেখতে পায়নি। আবার সে আসবেই রাতের বেলা। আর এলেই তাকে ধরতে হবে খপ করে৷ ভেবেচিন্তে সে একখান মতলব ঠাওরাল৷

 

গোটাদুয়েক বালতি হাতে সে গেল বনের দিকে, খুঁজে বের করল রবার গাছ৷ গাছের রস বালতি ভরে নিয়ে এসে তা দিয়ে তৈরি করল খয়েরি রবার, আর সেই রবার দিয়ে একটা মানুষ বানিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল বাদামগাছগুলোর ঠিক পাশে৷

 

মাকড়সা এতশত জানে না, সে গভীর রাতে বস্তা কাঁধে ঢুকল বাগানে৷ বাদামগাছগুলোর কাছে গিয়ে দ্যাখে, কে যেন একটা দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্ধকারে৷ ভারী রাগ হয়ে গেল তার৷ এ ব্যাটা নির্ঘাত বাদামে ভাগ বসাতে এসেছে৷

 

“এই, তুই কে রে?” জিগাল সে। লোকটা উত্তর দিল না। মাকড়সা আরও ক্ষেপে গেল। লাটসায়েব ঠ্যাঙা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখো! কথা বলতে কী হয়?

“কে তুই? রাতদুপুরে কী করতে এসেছিস?” ফের চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল সে। লোকটা চুপ করে ঠায় দাঁড়িয়ে।

এবার আর মাকড়সা রাগ চাপতে পারল না, ধাঁই করে এক ঘুঁষি বসিয়ে দিল লোকটার মাথায়। “তবে রে হতভাগা, আমার সঙ্গে ইয়ার্কি!”

 

আর যেই না হাত মাথায় ঠেকা, অমনি চটচটে রবারে হাতটা আটকে গেল তার। সে আর কিছুতেই ছাড়ানো যায় না। এঁকেবেঁকে কত কসরত করল মাকড়সা, কিন্তু হাত যেখানকার সেখানেই রইল। রেগেমেগে যেই আরেকটা হাত দিয়ে ঘুঁষি চালিয়েছে, অন্য হাতটাও গেল আটকে।

এবার মাকড়সার মাথায় ঢুকল যে মানুষটা জ্যান্ত নয়, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। পা চালিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল সে, পা-ও আটকে গেল রবারমানুষের গায়ে। এক্কেবারে বন্দি হয়ে পড়ল সে।

 

বন্দি মাকড়সা মনে মনে কপাল চাপড়ায়, ইস, কী বোকা আমি! নিজের বুদ্ধির ভুলে ফাঁদে পড়লাম, এবার সকাল হলেই তো লোকে দেখতে পাবে আর ছি ছি করবে। এহেহেহে…

আর এহেহেহে! পরদিন সকালে মোড়লের চাকর এসে, তাকে রবারমানুষের গা থেকে খুলে, বেঁধেছেঁদে হাজির করল মোড়লের কাছে। তারপর দে মার দে মার…

 

এরপর মাকড়সা সেই যে লজ্জায় ঘরের অন্ধকার কোণে মুখ লুকোল, আর সেখান থেকে সে বেরোয়নি, কারও সঙ্গে কথাও কয়নি। আজও তার ছেলেমেয়েরা, ছেলেমেয়েদের ছেলেমেয়েরা, আর ছেলেমেয়েদের ছেলেমেয়েদের ছেলেমেয়েরা, অন্ধকার কোণেই লুকিয়ে থাকে, কারও সামনে বেরোয় না।

 

(আফ্রিকান উপকথা ‘Anansi and the Rubber Man’ অবলম্বনে)

অলংকরণ – সুমিত রায় 

Leave a Reply

Your email address will not be published.