মোহর রহস্য রুমেলা দাশ

পিসিমার কথা

 

“না না, এটাকে তোরা গল্প বলিস না। এসব কোনও মিথ্যে নয়; বুজরুকিও নয়। একেবারে সত্যি; স্বয়ং মন্দিরের প্রধান পুরোহিত শ্রী গোবিন্দ পূজারীর মুখ থেকে শুনেছিলাম। শুনতে শুনতে গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেছিল আমার। তখন বয়স কত হবে? বেশ মনে আছে বাবা-মায়ের হাত ধরে সে বছর প্রথম গেছিলাম পুরীর সমুদ্রে। আমাকে নিয়ে মানত ছিল যে; ওই তোদেরই মতন বয়স! মাথা নেড়া করে পুজোটুজো দেওয়ার পর পরেরদিন সমুদ্রের জলে সে যে কী দাপাদাপি করেছিলাম।”

“তখনকার কথা তোমার এখনও মনে আছে পিসিমা?” পচা একটা ফিচেল হাসি দেয়।

“ঠিক বলেছিস। আমার তো কালকের কথাই আজ মনে থাকে না। আর ভাব পিসিমার তখন যদি ১১-১২ বছর বয়স হয়! পিসিমার স্মৃতিশক্তি কী ভালো! আজ থেকে… আজ থেকে…” অগ্নি হাতের আঙুলের কর গুণতে থাকে।

“ও পিসিমা তোমার এখন বয়স কত?” অগ্নিকে মাঝপথে থামিয়ে দিব্য সটান প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।

ধপধপে সাদা চুলের মানুষটা হাসে। মাথা দোলায়; কোঁকড়া চামড়ায় হাতজোড় করে দু-হাত উঁচু করে কপালে ঠেকিয়ে আবার নামিয়ে নরম করে বলে, “কর গুণে কি আর সবকিছুর হিসেব হয় রে? ধরে নে নয়-নয় করে তা প্রায় ষাট-সত্তর বছর কী তারও আগের কথা। শুধু সে হিসেবেও চলবে কেন? তারও কত আগে যে প্রভু এই ধরাধামে এসেছিলেন!” গলাটা আবেগে ভিজে আসছিল পিসিমার।

পচা, অগ্নি আর দিব্য তিনজনে গাঁ ঘেঁষাঘেঁষি করে বয়স্ক মানুষটাকে গোল হয়ে ঘিরে বসে। অগ্নি সম্পর্কে তাঁর নিজের রক্তের সম্পর্কের কাছাকাছি হলেও এই ফ্ল্যাটবাড়ির তাঁর নাতির বয়সি আরও দুই-চার ঘরের পুচকে সদস্যও মাঝেমধ্যে উঁকি দেয় শৈলবালার ঘরে। বিশেষ করে যখন পড়া-পরীক্ষার চাপ একটু হালকা থাকে।

শৈলবালা মণ্ডল; দেবদ্বিজে ভক্তিসম্পন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান মেনে চলা এক বৃদ্ধা। বয়স আন্দাজ কমবেশি আশির ঘরে পৌঁছে গেছে। স্পষ্ট করে তা বলা মুশকিল। কারণ শৈলবালাদেবীর শারীরিক সক্ষমতা এই বয়সেও একা হাতে যে কোনও বাচ্চাকে কোলেপিঠে বড় করা থেকে সংসার সামলানোর যাবতীয় দক্ষতায় অল্পবয়সি যে কোনও মহিলাকেই টেক্কা দিয়ে উঠতে পারে। তিনি হলেন সবার পিসিমা।

ব্যাপারটা এইরকম। শৈলবালাদেবী হলেন অগ্নির ঠাকুরদার লতায় পাতায় সম্পর্কের কোনও এক বোন। বিধবা হন তেরো বছর বয়সে। কপাল মন্দ। স্বামী মারা যাওয়ার কিছুদিন পর থেকেই শ্বশুর ঘর, বাপের ঘর কোথাও থাকার জায়গা হয়নি। সেই সময়েই আশ্রয় দেন অগ্নির দাদু শ্রী অনিল রায়। দাদার সংসারের আশ্রয়ে শক্ত ভিত হয়ে একে একে আঁকড়ে ধরেন গোটা পরিবারকে। অগ্নির বাবারা ছিলেন দুই ভাই তিন বোন; তাঁরা তখন সদ্য মা-হারা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো দিশেহারা হয়ে তাদের থেকে কিছুটা বড়, অভিজ্ঞতায় ভরপুর শৈলবালাকে মায়ের মতো করে দেখতে শুরু করে। শৈলবালা হয়ে ওঠেন তাদের আদরের ‘পিসিমা’। সেই সূত্রেই পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়পরিজন যে-ই রায়বাড়ির চৌকাঠে পা রেখেছে, এই ভদ্রমহিলাকে জেনেছে পিসিমা বলেই। এমনকী অগ্নির প্রজন্মের ভাই-বোনেরাও সেই পিসিমা ডাক চালু রেখেছে। বাল্যবিধবা হলেও বছরের পর বছর ধরে শৈলবালা নিজের শারীরিক মানসিক জোর এতটুকু কম হতে দেননি, বরং দ্বিগুণ উৎসাহ উদ্দীপনায় আজও বয়ে চলেছেন সাংসারিক যাবতীয় দায়ভার। পছন্দ করেন নিজের হাতে রেঁধেবেড়ে ঠিকঠাক খ্যান-উপাখ্যান মেনে খাওয়াদাওয়া পুজোআচ্চা করা। চেহারাতেও যেন অনেকটা সেই ধ্যানী-যোগিনীর প্রতিফলন। শান্ত, স্নিগ্ধ, নির্মল। মনে হয় হঠাৎ করে কোনও প্রাচীন যুগের তপস্বী আধুনিক কায়দা প্রত্যক্ষ করতে চলে এসেছেন এই তল্লাটে। এই বয়সেও যেমন তাঁর টানটান শিরদাঁড়া, তেমন দৃপ্ত আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর। আর ঠিক এই অযাচিত আকর্ষণের কারণেই খুদেরা অনেকটা সেই পুরভরা সন্দেশের মধ্যের তুলতুলে স্বাদ নেওয়ার জন্যই কার্টুন, ভিডিও গেম বাদ দিয়ে পিসিমার কাছে এসে আজও হরেক বিচিত্র গল্প শুনে যায় দেদার উৎসাহে। পরীক্ষা পড়াশুনার ফাঁক ফোকরে ঠিক সুযোগ বুঝেই ধাঁ করে চলে আসে শৈলবালার কোলের কাছটাতে।

“ও পিসিমা কী হল? চুপ করে আছ কেন? বলো, বলো!”

“দাঁড়া পিসিমাকে একটু ভাবতে দে! অগ্নি তুই না? আমরা রচনা লেখার সময় ভাবি না? আমাদের বানিয়ে বানিয়ে লিখতে তো সময় লাগে নাকি?” অগ্নির হাঁটুতে ঠেলা দিয়ে পচা বলে।

পচার কথা শুনে পিসিমার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে।

জানলার বাইরে মেঘ চিরে বেরিয়ে আসে ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া! দুপুরের খর তাপ একটু কমেছে। বৃষ্টি আসবে কি? জ্যৈষ্ঠের শেষ! হলেও অসম্ভব কিছু নয়।

মিইয়ে যাওয়া রোদে পিসিমার মুখময় ছড়িয়ে পড়েছে এক অদ্ভুত দীপ্তি। রুপালি আভার স্বল্প চুলের হাত-খোঁপায় একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করেন শৈলবালাদেবী।

“এমনি এমনি আমার মা বাবা কিন্তু পুরীতে আমার মাথা মুণ্ডনের মানত করেননি। ডাক্তার-বদ্যি এখানকার মতো তো তখন ছিল না। খুব ভুগতাম জ্বরে। লেগেই থাকত সর্দি-কাশি। ঝাড়ফুঁকেও সারছিল না। মা কেঁদে কেঁদে সারা। শেষমেশ মানত। ওই যে বললাম মন্দিরের প্রধান পুরোহিত গোবিন্দ জেঠু। উনি তো বাবার সঙ্গে একই পাঠশালায় পড়তেন। তিনিই আমার মা-বাবাকে একটা উপায় বাতলে দিয়েছিলেন। একমাত্র মাথা ন্যাড়া করে পুজো দিলে ঠাকুরের দয়া হবে। আর তারপরেই…”

“তারপরেই কী, পিসিমা?” উত্তেজনায় এগিয়ে আসে দিব্য।

বাইরের সোঁদা সোঁদা গন্ধ ততক্ষণে ঘরময় ঘুরতে শুরু করেছে। এলোমেলো দুলছে আমগাছের ডালগুলো। মনে হচ্ছে চারপাশের পরিবেশটাও হঠাৎ করে বদলে গিয়ে ওদের কিছু বলতে চায়! টপাটপ করে দু-একটা গাছপাকা আমও হাওয়ার বেগ সামলাতে না পেরে চাপা শব্দ করে মাটিতে পড়ছে। বাতাস গজরাতে গজরাতে এগিয়ে আসছে! মনে হচ্ছে প্রচণ্ড বাতাসকে কেউ ঢাকনাবন্দি করেছে বুঝি।

তিনটে কচি মুখ ঠায় তাকিয়ে বৃদ্ধার দিকে!

গলা ঝেড়ে শুরু করেন তিনি।

“পুরীতে জগন্নাথের মন্দিরে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি ছ-বার ভোগ নিবেদন হয় আর প্রতিবারে পাঁচ-ছ-রকমের ব্যঞ্জন হয়। কেবলমাত্র কার্তিক মাসে সাতবার ভোগ দেওয়া হয়।

“কার্তিক মাসে সাতবার ভোগ নিবেদন হওয়ার কারণ, প্রতিদিন সকালে দেবতার ভোগ চিরাচরিত প্রথায় রাজার বাড়ি যায়। রাজা একদিন দেখেন যে বাল্যভোগে চুল পড়ে আছে! রাজার মনে সন্দেহ হয় ঠিক তোদেরই মতো! রাজা রেগেমেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যান। পান্ডাকে বলেন, ‘তোমরা অপবিত্রভাবে অযত্নে প্রভুকে ভোগ নিবেদন করছ, তা না হলে ভোগে চুল এল কি করে?’ পান্ডা ভয়ে বলে ওঠে, ‘এ তো জগন্নাথদেবের চুল!’ এই মিথ্যা না বলে তো কোনও উপায় ছিল না। রাজা যদি গর্দান নেন! পান্ডা ভয়ে ভয়ে জগন্নাথদেবকে স্মরণ করে রাজাকে নিয়ে চললেন মন্দিরে। রাজা তো গিয়ে থ। দেখেন সত্যিই জগন্নাথদেবের মাথায় চুল আছে। রাজা বললেন, ‘মিথ্যা বলছ তুমি! চুল তো তুমি আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছ।’ পান্ডা উত্তর খুঁজে না পেয়ে বলেন, ‘আপনি চুল ধরে টানুন, দেখুন সত্যি কি না।’ রাজা বলেছিলেন, ‘যদি সত্যি প্রমাণ না হয়, তবে তোমাদের আজই শূলে চড়াব।’ এই বলে রাজা ভগবানের চুল ধরে যেই টানলেন অমনি দরদর করে রক্ত পড়তে লাগল। রাজা অনুশোচনায় দগ্ধ হলেন এবং সেই পান্ডাকে পুরস্কৃত করলেন এবং ঠিক করলেন যে বছরে প্রতি কার্তিক মাসে সাতবার ভোগ নিবেদন হবে। এটাই এখনও নিয়ম চলে আসছে। ভগবান এইভাবে তাঁর ভক্তদের বাঁচিয়ে দিলেন। এটাই হল ঈশ্বরের লীলা!”

“সত্যি সত্যি ভগবান আছে? ও পিসিমা বলো না, তোমার জ্বরও কি সেরে গেছিল তারপর?” দিব্য চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞেস করে।

“তার মানে আমাদের যা কিছু ভালো সব ভগবানই করে? আমি পড়া না পারলে সরস্বতী ঠাকুরকে ডাকলেও আসে না কেন? যখন খুব খেলতে ইচ্ছে করে তখন শরীর খারাপ হয় কেন? ধুস, ঠাকুর বলে কিচ্ছু নেই।” পচা দুদিকে মাথা নাড়ে আর বলে।

“না দাদুভাই। আমি কিন্তু একবারও তোদের কথা অস্বীকার করছি না। আর এটাও বলছি না যে বিজ্ঞানকে, আধুনিক প্রযুক্তিকে অস্বীকার কর। আমি শুধু এই কথাই বলছি আমাদের সমস্ত পৃথিবীতে একটা অদেখা শক্তি আছে। যাঁকে আমরা চোখে দেখতে পাই না। ছুঁতেও পারি না। এমনকী কোনও গবেষণাগারের মাইক্রোস্কোপেও তা ধরাও পড়ে না। সেটা শুধু অনুভব করতে হয়। তোরা নিশ্চয়ই বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারবি। আমার এটুকুই বলার, মনে অশ্রদ্ধা না এনে বরং তাঁর নিরন্তর খোঁজ চালিয়ে যা।”

“আর তোমার জ্বর পিসিমা?” দিব্য কৌতূহল চেপে রাখতে পারে না।

“আমি একটু একটু করে ভালো হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু মনের মধ্যে খুঁত ছিল। কিছুতেই বিশ্বাস হত না… ভাবতাম এসব সম্ভব হল কী করে? দেখতে ইচ্ছে করত তাঁকে! একদিন…”

“পিসিমা আসব? খুব জোরে ঝড় উঠেছে যে! পচার মা ডাকতে এসেছে। ওরা বরং ঘরে যাক!” অগ্নির মায়ের কথায় চমকে দরজার দিকে তাকায় খুদে তিন।

সত্যিই তো! এতক্ষণ কেউ খেয়ালই করেনি। সাঁই সাঁই করে মাটি থেকে ধুলো উঠে ছেয়ে ফেলছে ওদের ফ্ল্যাটের চারপাশ। কান খাড়া করলে কটাকট করে শিল পড়ার শব্দও পাওয়া যাচ্ছে।

পচা একলাফে সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে। সঙ্গে দিব্য। অগ্নিও।

“আমার আঁকার স্যার আসবে!” দৌড় লাগায় পচা।

“পিসিমা কাল কিন্তু গল্পটা শেষ করবে…” বলে দিব্যও বাড়ি যায়।

বন্ধুরা চলে যেতে অগ্নি আবারও বলে, “পিসিমা তুমি তো কত কিছু জানো? এই গল্পটা আমি আগেও অনেকবার শুনেছি। কিন্তু একটা কথা তোমাকে বারবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, তুমি ঠাকুর কোনোদিন দেখেছ? কোনোদিন তাঁর সঙ্গে কথা বলেছ?”

শৈলবালাদেবী অগ্নির মাথার চুলে বিলি কেটে বলেন, “বাকিটা কাল বলব! তুমি বরং পড়তে বসো। তোমার মা দাঁড়িয়ে আছে যে!”

অগ্নি দেখে ওর মা তখনও দাঁড়িয়ে। এবার ওকে পড়তে বসতেই হবে। গরমের ছুটি শেষ হয়ে এল। আবার শুরু পড়া। পিসিমার গল্পে অনেক অলৌকিক অজানা থাকলেও কেমন একটা আরাম বোধ হয়। ঠিক যেমন এখন আকাশটা ভিজিয়ে দিচ্ছে ভাপ ওঠা পিচ-গলা রাস্তাঘাট গোটা শহরটাকে, তেমনই।

 

 

অশনিসংকেত

“অ্যাই, তোর নাম পচা কে দিল রে?” ছাদে উঠে গল্পগুজব করতে করতে হে-হে করে হেসে দিব্য অগ্নির গায়ে ঢলে পড়ে।

“পিসিমা বলছিল ওর গায়ে নাকি ছোটবেলায় খুব ফোঁড়া হত। একটা সারত, আরেকটা হত। সবাই বলত ওর গা পচে গেছে। ওর দিদিমাই তাই ওর নাম পচা রেখেছিল। ওর আসল নাম যে পল্লব, পচা নয়, সেকথা সব্বাই ভুলে গেছে!” অগ্নি হাসছিল আর বলছিল।

“হ্যাঁ হ্যাঁ, তোর পিসিমাই একেবারে পণ্ডিত না? সব জানে! বেশি বেশি! যতসব কিম্ভূত কিমাকার গল্প শোনায়। ভগবানের মাথায় চুল, গোপাল নাকি রাতভর তবলা বাজায়, লক্ষ্মীর সিংহাসনের সামনে সাদা পায়ের ছাপ! যত্তসব! আচ্ছা বল তো, তোর পিসিমা বলতে পারবে ভিটামিন বি-টু-এর উৎস? মানুষের জীবন সংগ্রামের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার কোনটি? সুষম খাদ্যতালিকায় কোনটির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি? কী রে চুপ কেন সব, পারবে বলতে? পারবে?” পচা ওদের পাঁচতলা ফ্ল্যাটের জলের ট্যাঙ্কের কাছে দাঁড়িয়ে দাপটের সঙ্গে কথাগুলো বলছিল।

সূর্য ডুবতে ডুবতে পাতলা কমলা আলোর চাদর ছড়িয়ে দিচ্ছিল। মাথা উঁচু-নিচু আকাশচুম্বী পাঁচতলা-দশতলা বাড়িগুলো নিশ্চুপে অপেক্ষায় ছিল একটা দিন শেষ হওয়ার। কার্নিশে বসে থাকা পায়রা দুটো ঘাড় কাত করে ওদের দেখে ঝটপটিয়ে উড়ে গেল দূরে ঘন হয়ে আসা মেঘেদের দলে।

আর ঠিক তখনই শোনা যায় একটা ধীর সংযমী গলার আওয়াজ, “গাছের কচি ডাঁটা, লাঠি আর তোমার সবচেয়ে শেষ প্রশ্নের উত্তর কার্বোহাইড্রেট! কি, তাই তো? পচাবাবু?”

পচা, দিব্য, অগ্নি নিজেদের কথাবার্তা থামিয়ে অবাক হয়ে তাকায়; এ তো পিসিমা!

উনি এলেন কখন? কখন যে উনি ওদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন কেউ বুঝতেই পারেনি। আর উত্তরটাও যে উনিই দিয়েছেন তা তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু কী করে?

ওরা কিছু বলার আগেই, বোঝার আগেই পিসিমা ছাদের কোণে রাখা টবের তুলসী গাছ থেকে দুটো পাতা তুলে নিয়ে চলে যান।

“অগ্নি তুই তো কোনোদিন বলিসনি পিসিমা…” থতমত খেয়ে দিব্য কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল; তার আগেই অগ্নি বলে ওঠে, “উনি আমার বাবা আর বাকি যারা যারা স্কুলে যেত; তাদের বইখাতা দেখতেন। আমাদের বাড়ির বাংলা খবরের কাগজ তো আগে পিসিমার ঘরে যায়! আমাকে ছোটবেলায় কতবার পড়া দেখিয়ে দিয়েছেন জানিস?”

“উহ! একেবারে অলরাউন্ডার রে! সব জানে!” পচা মুখ বেঁকায়।

“সব জানে কি জানে না সেটা তো দেখতেই পেলি।” অগ্নি মাদুর থেকে উঠে পড়ে বলতে শুরু করে, “জানিস সবাই বলে পিসিমা আমাদের ঘরের লক্ষ্মী। আর তাই তো মোহরভর্তি ঘড়া পেয়েছে!”

“মো-ও-ও-হ-ও-ও-র? সে কী!” পচা আর দিব্য সমস্বরে বলে ওঠে।

“অগ্নি তোদের ঘরে মোহর আছে আমাদের কোনোদিন বলিসনি তো? কী রে? ওগুলো কি তোদের ঘরেই আছে? কোথায় রেখেছিস? কোথা থেকে পেয়েছে পিসিমা? আমাদের দেখাতে পারবি?” একটার পর একটা প্রশ্ন করে যায় দিব্য।

“উফ! বলছি বাবা বলছি! তার আগে তোরা প্রমিস কর এই কথা কাউকে বলবি না। বাবা-মা আমাকে কাউকে বলতে বারণ করে রেখেছে।” অগ্নি চার-পাঁচ পা এগিয়ে গিয়ে ছাদের যেদিক থেকে পিসিমা এসেছিল, সেদিকে পায়ে পায়ে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে আবার ফিরে আসে।

“আমি সব বলব। আগে তোরা প্রমিস করবি তারপর।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ! সব বুঝেছি। কী এমন ব্যাপার; জানিস আমার অন্নপ্রাশনে এক আরবফেরত কাকু আমাকে গিনির তৈরি কোমরের ঘুনসি করে দিয়েছিল। ওরকম বড় গিনি নাকি আজকাল চোখে পড়ে না।” পচা বলে।

“তাহলে তোরা প্রমিস করবি না? আমিও আর বলছি না।” পচার কথায় রেগে যায় অগ্নি।

“তুই থামবি পচা। আমরা কেউ কিচ্ছু বলব না। তুই তাড়াতাড়ি বল। সন্ধে হয়ে যাচ্ছে, মা এক্ষুণি আমাকে ডাকতে না ছাদে উঠে আসে।”

দিব্যর কথায় ভরসা পেয়ে বলতে শুরু করে অগ্নি, “ওই মোহরগুলো পিসিমা পেয়েছিল পুরীর সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে। তোরা তো শুনেছিস ছোটবেলা থেকেই পিসিমার কেমন ঠাকুরে ভক্তি। তারপর পুরীতে জগন্নাথদেবের পুজো দেওয়ার পর যখন জ্বর একটু একটু করে সেরে যায়, ঠাকুরের ওপর পিসিমার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়। তখন সবে সবে ওনার স্বামী মারা গেছেন! একদিন স্বপ্ন দেখেন উঠানে মাটির তৈরি উনানের নিচে নাকি ঘড়াভর্তি সম্পত্তি আছে! কে যেন স্বপ্নে পিসিমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ঘড়া তুলে আনতে। পিসিমাও ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে উঠানে মাটির উনানের কাছে গিয়ে শাবল দিয়ে খুঁড়তে থাকেন। ব্যস! একটু খুঁড়তেই চোখ একেবারে ছানাবড়া। দুটো কালকেউটে বেড় দিয়ে রয়েছে দু-দুটো মোহর ভর্তি ঘড়া! সকালের সূর্যের আলো পড়ে ঘড়া দুটোর মোহর চকচক চকচক করছিল। পিসিমা আর যায় কোথায়? অমন বিষধর সাপ দেখে লোকজন ডেকে ভয়ে দৌড়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে যায়। আশ্চর্যের ব্যাপার যখন বাড়ির লোকজন সবাই পিসিমার কথায় উঠানে আসে, দেখে কোত্থাও কিচ্ছু নেই। সাপদুটোও নেই। নেই মোহরে ঠাসা ঘড়াও!”

“তাহলে? তুই যে বললি তোদের বাড়ি ঘড়া আছে।”

“হ্যাঁ পচা, আছে। পিসিমা ঘড়া সত্যিই পেয়েছিলেন। কিন্তু বাড়ি থেকে নয়, পুরীর সমুদ্র থেকে। বড় বয়সে। পিসিমা যখন ঠাকুরের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তখন তো ভীষণ ছোট ছিলেন। স্বপ্নের ভগবান বলেইছিলেন এই স্বপ্নের কথা কাউকে জানানো যাবে না। পিসিমা যেহেতু ভয় পেয়ে চিৎকার করেছিলেন তাই আর মোহর পাননি।”

“অগ্নি, এ তো পুরো সিনেমার মতো। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”

“ঠিক বলেছিস দিব্য। গল্পের গরু একেবারে তড়বড়িয়ে গাছে উঠে গেছে। গাছ থেকে নামবার নামই করছে না!”

“শোন পচা। তোরা জানতে চাইলি তাই বলছিলাম। বিশ্বাস না হলে শুনিস না। আমি প্রমাণও দিতে পারি। কিন্তু খবরদার এরকম করে কথা বলবি না।”

অগ্নি রেগেমেগে হনহনিয়ে ছাদের দরজার দিকে এগোতে যাবে কী ক্যা-ক্যা করে সাংঘাতিক জোরে ডাকতে ডাকতে একটা কাক আচমকা অগ্নির মাথায় এক ঠোক্কর দিয়ে পগার পার।

“বাবা গো!” বলে মাথায় হাত দিয়ে ততক্ষণে ছাদের মেঝেতে বসে পড়েছে অগ্নি।

কাকটা অগ্নির মাথার তালুতে শুধু ঠোক্করই দেয়নি। নখ দিয়ে অগ্নির মাথার একগোছা চুলও নাকি চড়চড় করে ছিঁড়ে নিয়েছে।

পচা, দিব্যর হই হল্লা আর অগ্নির কান্না শুনে ফ্ল্যাটের অনেকেই ছাদে উঠে আসায় ওরা গল্প থামিয়ে যে যার মতো ঘরে ফিরে গেছিল।

গল্পটাও আধখানা হয়ে থমকে গেছিল ঠিক ওখানেই।

 

 

মোহর ভ্যানিশ

“আগেকার দিনের মানুষ তো অনেক কিছুই জানেন! সবটা কিন্তু ফেলনা নয়।”

“হ্যাঁ মৌসুমী, আমি ছোটবেলায় একবার মায়ের মুখে শুনেছিলাম কাক মাথার ওপর উড়ে যাওয়ার সময় চুল ছিঁড়লে, ঠোক্কর দিলে অশুভ! কিন্তু পিসিমা এভাবে… যদিও ওনার বয়সটাও একটা বড় ফ্যাক্টর! এত বড় ধাক্কা উনি সামলে উঠতে পারবেন?”

“সেটা জানি। আসলে গোটা ফ্ল্যাটে, পাড়ায় যেভাবে টহল দিয়ে বেড়াত মানুষটা। শুধু তাই বলব কেন? বিকেলে পাড়ায় বেরিয়ে ঠিক একবার পার্কে চক্কর দিয়ে আসবেন। কেউ বিপদে-আপদে পড়লে খোঁজ খবর নেবেন; এটাই বা কম কী বলো? এই তো দিন দশ-পনেরো আগের কথা; লক্ষ্মীর বরের পায়ে কী একটা সমস্যা হচ্ছিল। উনি ঘরোয়া এমন একটা টোটকা বলেন, লক্ষ্মীর বর এখন টইটই করে কাজে দৌড়চ্ছে। বড় ভালো মানুষটা, অথচ দেখো কোনোদিন নিজেরই সংসার হল না। এত ঝড়ঝাপটা জীবনের ওপর দিয়ে। কিন্তু একবারও ওনাকে দেখে মনে হয় না বয়স আশি ছুঁয়েছে।”

দিব্য খাবার টেবিলে বসে ওর বাবা-মায়ের কথাগুলো শুনছিল। মনটা ওরও কেমন কেমন করছে। পিসিমা অসুস্থ। তিনদিন হল তিনি নার্সিংহোমের আইসিইউতে। ওই যে যেদিন অগ্নির মাথায় কাকে ঠোক্কর দিল, সেদিন রাতেই খুব শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় পিসিমাকে ওখানে ভর্তি করা হয়। পিসিমা নাকি যাওয়ার আগে বারবার বলছিলেন, “কাকটা অশুভ বার্তা দিতেই নাকি অগ্নির মাথার চুল ছিঁড়েছিল!”

এখন আবার কে? বেল বাজছে!

“অ্যাই দিব্য দেখ তো কে আবার ডাকছে। বেল বাজাচ্ছে এখন। পিসিমার কোনও খবর এল কি না!”

মায়ের কথায় দিব্য দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে, পচা।

“কী রে তুই?”

পচা ঠোঁটে আঙুল দেখিয়ে চারপাশটা দেখে নিয়ে টুক করে দিব্যদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে।

“উফ! আস্তে কথা বল। ওদিকে জানিস কী কাণ্ড হয়েছে?”

“কী?” পচার কথায় দিব্যও গলা চেপে জিজ্ঞাসা করে।

“আরে এদিকে পিসিমাও হাসপাতালে। আর অগ্নিদের মোহরও ভ্যানিশ!”

“মানে বলিস কী? তুই ঠিক জানিস? কে বলল তোকে? কখন?” আঁতকে ওঠে দিব্য!

“দাঁড়া দাঁড়া, আমাকে একটু শ্বাস নিতে দে! একেবারে পাক্কা খবর। আমার তো মনে হচ্ছে পিসিমাই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে জানিস, যাতে বাড়ির লোক মোহর নিতে না পারে। একবার অগ্নি বলেছিল না, পিসিমা ওই মোহর কাউকে দিতে চায় না। আর সবাই ভাবছে চুরি গেছে। অশুভ ইঙ্গিত। চোরের কাজ। ছাতার মাথা। যত্তসব। প্রথম থেকেই আমার পিসিমাকে সন্দেহ হয়। নাহলে তুই বল এই পাড়ায় কোনোদিন চোর ঢুকেছে?”

“পচা তুই এত রাত্তিরে? চুরি? কোথায়? কী বলছিস?” দিব্যর মা এগিয়ে আসে।

“না কাকিমা, আমি ঠিক…”

“কী হয়েছে গো? হঠাৎ কী হল?” দিব্যর বাবাও খাবারের টেবিল থেকে উঠে ড্রয়িংরুমে চলে আসে।

মৌসুমী বলে, “দেখো না ছেলেটা কীসব বলছে চুরির কথা!”

“কী রে পচা, কী বলতে এসেছিস? কী হয়েছে?”

দিব্যর বাবার কথায় থতমত খেয়ে উত্তর দেয় পচা, “অগ্নিদের মোহর চুরি হয়ে গেছে!”

“হোয়াট? মোহর! চুরি?” একসঙ্গে আঁতকে ওঠে দিব্যর মা-বাবা!

“কী সব বলছিস তোরা? মোহর? চুরি?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার কথায় বিশ্বাস যদি না হয়, তাহলে যাও না ওদের ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো না। ওদের ঘর থেকেই তো সবটা শুনে দিব্যকে জানাতে এলাম।” দিব্যর বাবা রমেনবাবুর প্রশ্নে উত্তর দেয় পচা।

“আজ প্রায় কুড়ি বছর এই ফ্ল্যাটে আছি। কই আমরা তো কোনোদিন শুনিনি পিসিমাদের ঘরে মোহর আছে? তোরা কোনোদিন দেখেছিস? তোরা তো খেলতে যাস ওখানে?” মৌসুমী একনাগাড়ে বলে যায়।

“আমরাও কি জানতাম কাকিমা! ওদের বাড়ির সকলের এই কথা বলা বারণ ছিল। এই তো সেদিন অগ্নি বলল, তাই জানতে পারলাম!”

“যতদূর জানি ওরা তো তেমন একটা উচ্চবিত্ত… আমাদের মতোই তো, মধ্যবিত্ত! মোহর পাবে কোথায়? তোরা কী যে সব বলিস!”

রমেনবাবুর কথায় পচা উৎসাহের সঙ্গে বলতে শুরু করে, “সত্যি সত্যি সত্যি— এই গড প্রমিস বলছি! জানো কাকু! অগ্নির পিসিমা পুরীর সমুদ্র থেকে ওই মোহরের ঘড়া পেয়েছে।”

মৌসুমী আর রমেন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।

পচা বলে যাচ্ছিল, “জানো কাকু, পিসিমা নাকি প্রথমে স্বপ্নে দেখেছিল ওই ঘড়া। ঘড়া আটকে ছিল দুখানা কালকেউটে। পিসিমা সাপ দেখে ভয় পেয়ে ঘরে পালিয়ে আসে। পুরীর সমুদ্রে গিয়ে আবার পায় ওই মোহর। ওদের বাড়ির সবাই তো পিসিমাকে লক্ষ্মী বলে।”

“এ তো পুরো ড্রামা! দাঁড়া ক-টা বাজে বল তো? ও মা! এগারোটা বাজতে যায়। কাল সকালে দেখি একবার যাব অগ্নিদের বাড়ি। অনেক রাত হল, শুতে যা। তোর বাবা-মা চিন্তা করবে। কী জানি বাবা, কার মনে কী যে থাকে! মানুষকে বাইরে থেকে দেখে কি চেনা যায়?”

দিব্যর মা গজগজ করতে করতে ঘরের ভেতরে চলে যায়। বাবাও। ওরা চলে যাওয়ার পর দিব্য পচাকে জিজ্ঞেস করে, “তুই দেখেছিস মোহরগুলো? সবগুলোই চোরে নিয়ে গেছে?”

“না আমি দেখব কী করে? অগ্নিদের বাড়িতে ওর জেঠু-কাকারা এসেছে! সবাই মিলে বলাবলি করছিল। আমাকে দেখেই চুপ করে যায়। ওরা তো বাইরের কাউকে জানাতে চায় না। আমি তো জেনেছি অগ্নির কাছ থেকে!”

“অগ্নির কাছে মোহরের কোনও ফটো আছে? তোকে দেখিয়েছে?”

“ধুর! ওসব ছবি-টবি নয়। শোন না আসল কথাটা। মোট চারটে মোহর!”

“চারটে মাত্র? অগ্নি যে বলেছিল ঘড়াভর্তি?” মাথা চুলকায় দিব্য।

“আরে না না। ঘড়ায় আরও কী কী সব আছে। কড়ি, ব্যবহার করা পিতলের মাথার চিরুনি। তার মধ্যে চারটে মোহর। মোহরগুলো আলাদা বাক্সে রাখা থাকত। ওদের ঠাকুরঘরে লক্ষ্মীর সিংহাসনের সামনেই। আমার তো খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। কী ব্যাড লাক বল! আমরা দেখবার আগেই চোরে নিয়ে পালিয়েছে।”

“সবকটাই?” জিজ্ঞেস করে দিব্য!

“ওদের কথা শুনে সেরকমই তো মনে হল। তবে আরও কয়েকটা ব্যাপার জানলাম জানিস! মোহরগুলোর পিঠে নাকি আরবি হরফে কিছু খোদাই করা রয়েছে। অগ্নি বলছিল, আরবি ভাষা দেখে ওর এক কাকু বলেছে মোহরগুলো এক হাজার থেকে বারোশ বছরের পুরোনো হতে পারে। তবে লেখাগুলো ঠিক কী, তা তেমন বুঝতে পারেনি কেউই। পিতলের যে ঘড়াটায় এগুলো পিসি পেয়েছিল, সেটাও নাকি খুব দামি!”

“হঠাৎ করে জলে ভেসে এল ঘড়া?” দিব্যর মাথায় যেন কিছুতেই ব্যাপারটা ঢুকছিল না।

“আরে ইতিহাসের বইতে পড়িসনি! আগেকার দিনে রাজাদের কাছে অনেক ধনরত্ন থাকত। আত্মরক্ষার জন্য শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করতে তা মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা হত। এইগুলোও তেমনই গচ্ছিত রত্ন হয়তো! জলে ভেসে এসেছে হয়তো। ওসব স্বপ্ন, ঠাকুরের নির্দেশ বাজে কথা। ইশ! একটা কেউ যদি থাকত, যে ঘড়াটা দেখে চিনতে পারত। আসল না নকল। তাহলে পিসিমা…”

“এই পচা আসতে বল, শুনতে পাবে বাবা-মা। তুই এখন ঘরে যা। কাকু-কাকিমা এক্ষুণি উপর থেকে নেমে আসবেন। উলটে আমিই বকা খাব। কাল স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে চলে আসিস, কথা বলব। কী যে হচ্ছে না, আমার তো ভয়ে হাত-পা গুটিয়ে আসছে। একে সেদিন কাকটা অগ্নির মাথায়… আজ আবার বলছিস কোন ডাকাত ফ্ল্যাটে ঢুকেছে!”

পচা চলে যাওয়ার পর দরজাটা ভেজাতে ভেজাতে দিব্যর হাত-পায়ের তলা ঘেমে উঠছিল। না জানি কীসব হচ্ছে! পিসিমার কথাই যদি সত্যি হয়; তবে…

দেওয়ালের অন্ধকার কোনও ঘুপচি কোণ থেকে টিকটিকিটা ডেকে উঠেছিল— টিক! টিক! টিক!

ঠিক তিনবার!

 

 

ঠিক সত্যির মতো

লোকটাকে পরিষ্কার দেখা না গেলেও একটা আন্দাজ করা যাচ্ছিল। ডিগডিগে সরু পা ফেলে চুপিসাড়ে এগিয়ে যাচ্ছিল জলার দিকে। গায়ে হয়তো জামা নেই। উদোম শরীরটা আন্দাজ করতে পারছিল কিছুটা। খালি একটা বোঁটকা গন্ধ আসছিল বাতাসের উলটোদিকে থাকার কারণে। একটা ছোট্ট কমলা আগুনের ফুলকি। মাঝে মাঝে বড় হচ্ছিল, আবার কমে আসছিল। ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব! লোকটার মুখের কাছে আটকে আছে। লোকটা বিড়ি খাচ্ছে, গন্ধটা ওই পাতা পোড়ারই। মনে হচ্ছে লোকটা পা টিপে টিপে সন্তর্পণে হাঁটতে চাইছে। যাতে ওর পায়ের কোনও শব্দ না হয়। ও কি কিছু লুকাতে চাইছে? কেন?

বেশ কিছুক্ষণ ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে একটা গাছের কাছে এসে লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ে। মুখ থেকে কমলা জ্বলন্ত আগুনটা আঙুলে ধরে ছুঁড়ে আগাছার মধ্যে ফেলে দেয়। লোকটার মাথার ওপরে গোল হয়ে আরও উপরে উঠে যায় ধোঁয়াটা।

জলা! হ্যাঁ ঠিকই!

এটা তো জলাই। এই আধবোজা পুকুরটায় শ্যাওলা ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। একটা দুটো চারাপনা মাছও নেই মনে হয়। মাছ ধরতেও দেখা যায় না কাউকে। খুব প্রয়োজনে না পড়লে এখানে বাসন ধুতেও কেউ আসে না। ময়লা, নোংরা আবর্জনায় ভর্তি; মানুষ চলাচল না থাকায় এদিকটায় রাস্তার আলোও তেমন একটা নেই। উলটোদিকে শুধু কয়েকটা টিন টালির চালের ঘর আছে। বাচ্চারা খেলাধূলা করে; ওদের বাবা-মায়েরা কাজকম্মো করতে বেরোয়। আর একটা-দুটো ল্যাম্পপোস্ট। ওগুলো না জ্বললে দুহাত দূরের কিছু ঠাহর করাই মুশকিল। সন্ধে নামলে ক্রমাগত ঝিঁঝির ডাক আর মশার উৎপাত। লোকজন এই গলিতে খুব একটা হাঁটাচলা করে না। মাঝেমধ্যে একটা-দুটো সাইকেল। জলার পাড় ঘেঁষে কোমর ঝুঁকে পড়া গাছগুলোর একটার কাছেই লোকটা দাঁড়িয়েছে। ওই তো মাথা এপাশ ওপাশ করে আরও একবার দেখল কেউ আছে কি না।

লোকটা ওকে দেখতে পায়নি তো?

ও মা! লোকটা যেখানে দাঁড়িয়েছে, ওই গাছের গোড়ার কাছেই বসে পড়েছে তো!

কিছু খুঁজছে? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এই ঘুরঘুট্টি চাপ চাপ কালোর মধ্যে আন্দাজ করা বেশ মুশকিল। হামাগুড়ি অবস্থায় হাত দিয়ে গাছের পেছন ঝোপঝাড়ের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুঁজেই চলেছে। উসখুস করছে, অস্থির হচ্ছে, লোকটার অস্থিরতায় গাছের ডালে বসা কী একটা নিশাচর  ডানা ঝটপটিয়ে আকাশের কালোর মধ্যে মিশে গেল।

বাদুড় না পেঁচা?

গা শিরশির করছে, গুমোট ভ্যাপসা গন্ধ মিশে আছে বাতাসে। অনেকক্ষণ গাছের একটা পাতাও নড়েনি।

নিশাচরটাকে খেয়াল করতে গিয়ে মনে হল খুব কাছ থেকে একটা ভোঁতা শব্দ হচ্ছে। খুব কাছাকাছি; লোকটা মুখ দিয়ে সামান্য শব্দও করছে। ঠিক গায়ের জোর ফলালে যেমন হয়, হাতটাও কয়েকবার ওপর দিকে উঠে সজোরে নিচে নামল। তাহলে কি লোকটা কিছু করছে? মাটি খুঁড়ছে?

আরেকটু এগিয়ে গেলে হত না?

চোখটা সয়ে যেতে বুঝতে পারে; জলার উলটোদিকে কিছুটা দূরে একটা ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে। ওটারই ক্ষীণ আলো আসছে।

লোকটা উবু হয়ে বসে মাটি খুঁড়ছে। খুঁড়েই যাচ্ছে।

লোকটার মুখটা একবার যদি দেখা যেত। নাহ, আর অপেক্ষা করা কোনোভাবেই ঠিক হবে না।

পা-টা জোরে চালাতে গিয়েই সাংঘাতিক হোঁচট। ডানপায়ের বুড়ো আঙুল মুচড়ে হুমড়ি খেয়ে এক্কেবারে সটান সামনে।

না চাইতেও গলা দিয়ে আপসে একটা যন্ত্রণার আওয়াজ বেরিয়ে এল।

“আহ!”

মাথাটা বনবন করে ঘুরছিল। চোখ খুলতেই পচা দেখে কোথায় জলার ধার! কোথায় গুমো গন্ধ! কোথায় লোক! কোথায় ঘুরঘুট্টি অন্ধকার!

এ যে আলোয় ভেসে যাওয়া ওর বিছানা!

তাহলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল? এরকম কখনও হয়? স্বপ্ন যেন সত্যির মতো। পচা যেন হঠাৎ করেই একটা বাস্তব থেকে আরেকটা বাস্তবে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। যেন পৃথিবীর আকর্ষণের জোর ধাক্কায় ওর সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। কল্পবিজ্ঞানের টাইম মেশিনের মতো!

পা মুড়ে বসে আছে বিছানা টপকে মেঝের ওপর। ব্যথায় কনকন করছে আঙুলগুলো।

কী উৎপাত!

এরকম ঝকঝকে স্ক্রিনের স্বপ্ন আগে কেউ কোনোদিন দেখেছে?

দেখেনি। নির্ঘাত দেখেনি। পচা নিজেই এই বারো বছরে দেখেনি। চিরটাকাল ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই স্বপ্ন ভেঙেচুরে ছাইয়ের মতো মিলিয়ে যায়। একটা-আধখানা টুকটাক যাও মনে থাকে; সেগুলোও এমনই তালগোল পাকানো যে কাউকে বলা কওয়ার মতো নয়!

কিন্তু ওই লোকটা? ওই জলার ধার! ছবিগুলো যেন অ্যালবামের পাতার মতো মাথায় গেঁথে গেছে।

পচা আঙুলগুলো টানটান করে বিছানা ধরে উঠে দাঁড়ায়!

“হ্যাঁ রে হল তোর? আর দশ মিনিটের মধ্যেই তো বাস চলে আসবে! আর কত ঘুমাবি?”

সর্বনাশ! পচার মা ডাকছে। ন-টা বেজে গেছে। এতক্ষণ ঘুমাল কী করে? বাথরুমে ঢুকেই কল চালিয়ে দিল পচা। কোনোরকমে ব্রাশ, শাওয়ার করেই স্কুলের ব্যাগ গোছাতে, খেতে আরও মিনিটদশেক।

বাসে উঠে থেকে মুখ গোঁজ করে থাকল পচা। যে সারাদিন এত কথা বলে, তার যেন কোনও কথাই বলতে ইচ্ছে করছে না আজ। দিব্য মাঝে একবার নিজের সিট থেকে উঠে কথা বলতে এসেছিল। কিন্তু পচার আজকে কোনোদিকেই মন নেই। ব্যাপারটা এমন কিছুই নয়, তবুও যেন কেমন কেমন।

ওই জলা, ওই জলার পাশে ঘাড় হেঁট করা গাছ সবই তো ওর চেনা। বন্ধুরা না গেলেও ও কতদিন সাইকেল নিয়ে বেড়িয়েছে ওখানে। ওদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে কয়েক মিনিট হাঁটলেই জায়গাটা চোখে পড়বে। আর ওই লোকটা? বড্ড চেনা চেনা লাগছে! কোথায় যেন দেখেছে… কোথায় যেন দেখেছে… পেটে আসছে, কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না।

এইরকম অস্থিরতা কোনোদিন হয়নি। কঠিন প্রশ্নপত্র পেলেও নয়।

কী করবে? দিব্যকে একবার বলবে স্বপ্নটার কথা?

নাহ থাক! খুব বোকা-বোকা হবে। বাসভর্তি ক্লাসের ছেলেমেয়ে আছে, সবাই মজা করবে। তার চেয়ে একবার স্কুল থেকে ফেরার পথে জলার দিকটা একচক্কর দিয়ে আসবে?

লোকটাকে কি আগে পচা কখনও দেখেছে? কোথায়?

ওইরকম সরু সরু পা, সামনের দিকে একটু ঝুঁকে হাঁটাটা যেন অনেক আগে দেখা, চেনা।

ধুস! পচাও না। পিসিমার গল্প শুনতে শুনতে নিজেও কীসব আজগুবি ভাবনা ভাবতে শুরু করেছে। কোথায় ফ্রেশ মুডে স্কুলে গিয়ে অগ্নিদের ব্যাপারটা নিয়ে একটা জোরদার আলোচনা চালাবে, তা নয় কীসব ভেবে চলেছে! স্বপ্ন আসার আর সময় পেল না।

দিব্যটা মনে হয় কথা না বলাতে খেপে গেল। পচা পিছনে ব্যাগটা রেখে দিব্যর দিকে এগোচ্ছিল। আচমকা ট্রাফিক সিগনালে হ্যাঁচকা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ে বাসটা। আর ঠিক তখনই পচার চোখ পড়ে বাইরে ফুটপাথের দিকে।

হাত-পা জমে বরফ হয়ে যায় ওর! কিছুতেই এগোতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল ওর পা যেন বাসের মেঝের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ পাতালে ঢুকে যাচ্ছে।

ঢুকেই যাচ্ছে।

 

 

দুর্ঘটনার কবলে

“স্যার আজকে আসবেন বলেছিলেন, পরশু তো আমার আঁকার পরীক্ষা। কিন্তু এখনও এলেন না। মা আমি একবার এগিয়ে গিয়ে দেখব? ও মা!”

“যাবি যখন যা। তবে সাবধানে। সাড়ে ন-টা বাজে। এত রাতে…”

“হ্যান্ডমেড পেপারে ওয়াটার কালার শেখানোর কথা ছিল। ওটা তো জানিই না আমি। স্যার একটু দেখিয়ে দিলে খুব ভালো হত।”

“ঠিক আছে, যা যা। একা যেতে পারবি তো? নাকি বাবা যাবে তোর সঙ্গে?”

“না মা, অসুবিধা হবে না। এই তো সামনেই… একাই পারব। এই তো এখান থেকে এইটুকু।”

পচা কোনোমতে মাকে উত্তর দিয়েই দৌড় লাগায়। সুযোগটা যে এইভাবে পেয়ে যাবে বুঝতে পারেনি। স্যার আজ এলেও কোনও একটা ছুতোয় আঁকা হয়ে গেলে স্যারের সঙ্গে ঠিক বেরোত পচা। বেরোতে ওকে হতই। সারাদিন ভীষণ অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে কেটেছে। ক্লাসে মন বসাতে পারেনি। টিফিন আওয়ারে গল্পও করতে পারেনি দিব্যর সঙ্গে। কথাটা বলব-বলব করেও গলায় এসে আটকে গেছে, কিছুতেই বলে উঠতে পারেনি। খালি চোখের সামনে ভেসেছে সেই ছবিটা। গতরাতের অদ্ভুত স্বপ্নটা।

ওটা কি সত্যিই স্বপ্ন?

সত্যি সত্যি হ্যান্ডমেড পেপারে ওয়াটার কালার শেখার দরকার ছিল। কিন্তু তার জন্যে রাতে না বেরোলেও চলত। ইউটিউব খুললেই ব্যাপারটা মোটামুটি আন্দাজ করে নিতে পারত। কিন্তু পচার মাথায় ঘুরছে অন্যকিছু।

যে করে হোক এক চক্কর ঘুরে আসতেই হবে জলার ধার। আর তার জন্য এই সময়টাই উপযুক্ত। স্কুল থেকে ফেরার পথে বন্ধুরা সঙ্গে ছিল। চট করে বাড়ির পথ না ধরে জলার দিকে গেলে আর কেউ জিজ্ঞেস না করুক, দিব্য তো করতই। তাই যায়নি। এখনই একমাত্র সুযোগ। আর বাস থেকে দেখার পর থেকে আরোই যেন…

স্যারের বাড়ির গলি জলা ছাড়িয়ে আরও দুটো মোড় পরে। ওদিকটায় না গিয়ে পচা শর্টকাটে সোজা জলার পথ ধরল। চোখ সইয়ে নিয়ে অন্ধকারে পথ চলতে লাগল। অন্ধকার, গুমোট পরিবেশ, নিঝুম ভাঙা ভাঙা রাস্তার সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঝিঁঝির ডাক প্রতি মুহূর্তে ফিরিয়ে আনছিল কাল রাতে দেখা সবকিছু।

পোঁ-পোঁ করে একটা মশা সেই থেকে কানের ধারেকাছে উড়ছে।

আহ! উফ! দু-চারবার থাপ্পড়ও খেল নিজের গালে। পায়েও মনে হয় কিছু মশা কামড়াচ্ছে। এত চুলকাচ্ছিল যে দাঁড়িয়েই পড়তে হল মাঝরাস্তায়। আর তারপরেই কেমন একটা সন্দেহ হল।

কেউ কি সঙ্গে সঙ্গে আসছে?

কে? কে আসবে?

একটা খসখস শব্দ হচ্ছে। পায়ে রাস্তায় ঘষা লাগার মতো শব্দটা… হাওয়াই চটি পরলে অনেকটা এমন ঘষটানোর আওয়াজ হয়। প্রথমে মনে হচ্ছিল শুকনো পাতা, পড়ে থাকা প্লাস্টিকের ওপর নিজেরই পায়ের পাতার আওয়াজ, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে…

পচা দাঁড়াতেই শব্দটা থেমে গেল কি?

নাহ! একটা কাজ খুব বোকার মতো করে ফেলেছে ও। যদি টর্চ বা একটা লাঠি সঙ্গে করে নিয়ে আসত। তাহলে অন্তত বুকে আলাদা বল হত। একে তো ব্যাপারটা কাউকেই জানাতে পারেনি। এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কাউকেই চোখে পড়ছে না। চরম উত্তেজনায় মনের ভুলও তো হতে পারে।

কোথায় একটা হিন্দি সিনেমার গান চলছে। জলার ওপারের টালির চালের ঘরগুলো থেকে। আচ্ছা! ওই তো… ওই তো… ছায়া ছায়া কোমরবেঁকা গাছগুলো জলা ছুঁয়ে নুয়ে আছে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে না থেকে হেঁটে এগিয়ে যাওয়াই ভালো। আউচ! মশাটা আবার কামড়াল। কী সাংঘাতিক হুল রে বাবা! এবার একদম মোক্ষম। চোখের কোলে। পৃথিবীর সব মশা কি আজ ওকে কামড়াবে বলেই ঠিক করেছে? কী বিরক্তি!

নাহ! ভালো মানুষের মতো পায়ে পায়ে হাঁটলে হবে না। দৌড়তে হবে। মশার উৎপাত থেকেও বাঁচা যাবে, আবার জলার কাছটায় তাড়াতাড়ি পৌঁছনোও যাবে।

চার-পাঁচটা লম্বা পায়ের স্টেপ। দৌড়তেও হল না। এসে গেছে।

এই তো মনে হচ্ছে এখানেই… এই গাছটাই কি?

কী অসম্ভব ঝোপঝাড়ে ভর্তি চারপাশটা!

সাপখোপ থাকে যদি?

কী করে দেখবে? লোকটা এখানে কিছু রেখেছে কি না কী করে ঠাহর করবে? বিশ্রী সেই পাতা পাতা পোড়া-পোড়া গন্ধটা লেগে দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাহলে কি…

বুকের ভেতরটা ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে। দু-পা পিছোতেই সারা শরীরটা আচমকাই ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। পড়ে যায় পচা। মনে হচ্ছে হাজার ফুট নিচে তলিয়ে যাচ্ছে!

শেষবারের মতো শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে চিৎকার করে উঠল ও— “মা-আ-আ-আ-আ-আ-আ!”

 

*****

 

“আপনি হঠাৎ ওখানে কী করছিলেন? অত রাতে? ওখান দিয়ে সচরাচর তো কেউ যাতায়াত করে না!” গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন অফিসার।

“আমি আসলে পল্লবের বাড়িই যাচ্ছিলাম।”

“আপনি ওইরকম সময়েই যান? রাত করে? আমার ডাউট হচ্ছে গোটা ব্যাপারটা এই বাচ্চা ছেলেটা… ঘোরের মধ্যে যে কথাগুলো ও বলছিল! কেউ কি জোর করে ওকে টেনে নিয়ে গেছিল? নাকি কোনও কারণে নিজে… পুরোপুরি জ্ঞান না ফিরলে বুঝতে পারছি না।”

“কাল হয়তো ভগবানই আমাকে পাঠিয়েছিলেন। আমার বাড়িতে এক আত্মীয় এসে পড়ায় দেরি হয়ে গেছিল। এদিকে পল্লবের সামনে পরীক্ষা। শর্টকার্ট ধরেছিলাম। আমাকে ওর বাড়ি যেতেই হত। আর আমি না গেলে যে কী বিপদই না হত। মানুষকে বাইরে থেকে দেখে চেনবার উপায়ই নেই। পাড়ার লোক হয়ে এমন? কতটা পাপ তার মনের মধ্যে! নাহলে একটা বাচ্চা ছেলেকে এভাবে? নিজের ঘরেও তো সন্তান আছে! ছি ছি! সত্যি অফিসার আমি তো ভাবতেই পারছি না। যত ভাবছি গা শিউরে উঠছে আমার।”

“স্যার প্লিজ! আপনারা এখানে কথাবার্তা বলবেন না। পেশেন্টের মনের ওপর চাপ পড়বে। আপনারা বরং বাইরে গিয়ে কথাবার্তা বলুন। এখানে আর ভিড় বাড়াবেন না প্লিজ।”

অনেকগুলো মানুষের টুকরো টুকরো কথা কানে আসছিল। আর ঝাঁঝালো ওষুধের গন্ধ! ভারী চোখের পাতা একটু-একটু করে খুলেছিল পচা।

ও কোথায়?

“বাড়ির লোক কেউ আছেন? পেশেন্টের জ্ঞান ফিরে এসেছে!” নার্স ঘরের পর্দা সরিয়ে বাইরে ডাকছিল।

হাত-পাগুলো শক্ত হয়ে আটকে আছে বিছানার সঙ্গে। ডানহাতের সঙ্গে সাদা একটা লম্বা নলের মত লাগানো।

মুখের কাছে ঝুঁকে এসে দাঁড়ায় মা, বাবা, স্যার, সাদা জামা পরা ডাক্তার আর ওগুলো কে? পুলিশ?

পচা তো কোনও অন্যায় করেনি। তাহলে পুলিশ কেন? উঠে বসতে পারছে না কেন ও?

“না না, তোমাকে মাথা তুলতে হবে না! কিচ্ছু হয়নি তোমার। শান্ত হও।” ডাক্তার জেঠু মাথায় হাত বোলাচ্ছিল।

“কেন গেলি বল তো বাবা? কী দরকার ছিল? আমার মনটা এত কু গাইছিল তুই চলে যাওয়ার পর। থাকতে না পেরে তোর বাবাকে পাঠিয়েছিলাম। আর…” মায়ের চোখ ভিজে এল।

“আহ! থামো না। আবার ওসব কথা কেন? তোমার কিচ্ছু হয়নি পল্লব। সব ভালো হয়ে যাবে দেখো!”

“আপনারা প্লিজ এখন বাইরে যান। পরে ভিজিটিং আওয়ার্স হলে আসবেন।”

পচা কোনও কথা বলা বা বোঝার আগেই ওর মা-বাবা ঘরটার বাইরে বেরিয়ে যায়। পুলিশ আর ওর স্যারও। থেকে যায় শুধু ডাক্তার। আর নার্স দিদিটা।

কী হয়েছে ওর? ও তো ভালোই ছিল? হাসপাতাল কেন? মাথার পেছনটা ভার-ভার লাগছে কেন?

“তুমি নিজেও জানো না তুমি নিজে কত বড় কাজ করেছ! আমি বুঝতে পারছি, তুমি অনেক কিছু ভাবছ। তোমার মনে অনেক প্রশ্ন। কিন্তু সব ভুলে এখন তোমাকে ঘুমাতে হবে। কেমন? ব্রেভ বয়!”

মাথাতেই ঢুকছিল না। কী বলছে সবাই?

ও-ই বা এভাবে শুয়ে আছে কেন? চাইলেও উঠতে পারছে না কেন? মনে হচ্ছে আগের সব শক্তি হারিয়ে ওর শরীরটা যেন দলা পাকিয়ে গেছে।

ডাক্তার জেঠু নার্সকে কী সব বলে একটা সিরিঞ্জ ভরে নিল। অনেকটা ওষুধ। ডানহাতের তেলোর উলটোপিঠে লাগানো নলের মুখে ওষুধটা ফুটিয়ে দিতেই মাথাটা কেমন ঝিম ধরে আসে…

আহ! চোখ চেয়ে থাকতে পারছে না আর। সবকিছু আবার তালগোল পাকিয়ে ম্যাজিকের মতো উবে যাচ্ছে। জলার দিকে যেতে গিয়ে ঠিক কী হয়েছিল ওর? ঠিক গাছটার কাছে যেতেই…

হালকা হয়ে যাচ্ছে শরীরটা। একটু একটু করে… ক্রমশ…

হাত-পাগুলো অবশ হয়ে এল…

 

 

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর

“দুঃখ করিস না, আমরা তো আছি!” অগ্নির কাঁধে হাত দিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল পচা, দিব্যর মা-বাবা আরও অনেকে।

“হ্যাঁ, আমরা সবাই আছি। আর মানুষ তো সারাজীবন থাকে না।” ফ্ল্যাটেরই কোনও কাকিমা বলছিল।

পিসিমা চলে গেছেন কয়েকদিন হয়ে গেছে। এখন বিকেল সন্ধের দিকে পাড়া-প্রতিবেশী মাঝে মাঝেই অগ্নিদের ফ্ল্যাটে চলে আসেন। সুখ-দুঃখের ভাগীদার হতে। কিন্তু অগ্নিদের বাড়ির প্রত্যেকেই জানে এটা পিসিমার মৃত্যুতে সান্ত্বনা দেবার তুলনায় মোহর সংক্রান্ত কৌতূহলেরই আধিক্য। তার বেশি আর কিছুই নয়। মুখে আর পাঁচটা মানুষ যাই বলুক না কেন, পিসিমা চলে যাওয়ার পর ছোটদের আড্ডাতেও ভাটা পড়েছে। আর তার চেয়েও বড় কথা, অদ্ভুতরকম পরিবর্তন ঘটেছে পচা মানে পল্লবের চরিত্রে। সেইরকম কথায় কথায় তর্ক তো করেই না, উলটে চুপচাপ হয়ে গেছে। সারাক্ষণ কী যেন ভেবেই চলেছে। যা ওর চরিত্রের একেবারে বিপরীত।

“আচ্ছা পচা এবার তো অন্তত আমাদের বল, সেদিন তুই স্বপ্নে কী এমন দেখেছিলিস, যার জন্যে কাউকে কিচ্ছু না বলে অন্ধকারে জলার দিকে ছুটতে হল?” ঠাকুমার ফাঁকা বিছানায় তিনবন্ধু ঠিক আগের মতোই বসে কথা বলছিল।

“দ্যাখ, তুই আর কাউকে না বলিস আমাদের তো বলতে পারিস। আর গোটা ব্যাপারটা যখন আর আমাদের তিনজনের মধ্যেই আটকে নেই। পুলিশকাকুরাও জেনে গেছে!”

“এই পচা বল, অগ্নি আমি কী জিজ্ঞেস করছি? তুই কী ভাবছিস? উত্তর দে!”

দিব্যর ঠেলা খেয়ে হুঁশ ফেরে পচার। মনের মধ্যে জমা থাকা কথাগুলো আরও একবার বন্ধুদের সামনে উগরে দেয়, “জানিস, ছোটবেলায় এক দিদির মুখে শুনেছিলাম আমরা সারাদিন চেতনে-অবচেতনে যা কিছু ভাবি, সেগুলো আমাদের মস্তিষ্ক জুড়ে থেকে যায়। সেসবই স্বপ্ন হয়ে ভেসে ওঠে। সারাদিন যদি আমরা পরীক্ষা পড়াশুনা নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকি তাহলে কোথাও না কোথাও গিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্থ কোষগুলো উদ্দীপিত হয়ে মস্তিষ্কের হরমোন ক্ষরণ ঘটাবে। আর সেগুলোই ভয় হয়ে কখনও আনন্দ হয়ে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করবে।”

“উফ! পচা আসল কথায় আয়। তুই আবার কবে থেকে এত জ্ঞান দিতে শুরু করলি? তোর তো কোনও কিছুতেই বিশ্বাস নেই!”

“হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস অগ্নি। বিশ্বাস ছিল না, হয়েছে।”

“মানে তুই বলতে চাইছিস ওই স্বপ্ন দেখেই তোর সবকিছুর ধারণা একেবারে নিমেষে পালটে গেল? আর পিসিমা বললেই তোর বিশ্বাস হত না? নিজের বেলায় আঁটিসাঁটি, তাই না?”

“আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে, বল দেখি তুই কী বলতে চাস? শুনি তোর সেই স্বপ্ন!” অগ্নিকে থামিয়ে দিয়ে দিব্য প্রশ্ন করে পচার দিকে তাকায়।

“আমিও প্রথম প্রথম তোদের মতোই ভেবেছিলাম জানিস। ভেবেছিলাম সারাদিন অগ্নিদের বাড়ির মোহরের ব্যাপারটা নিয়ে হইচই হচ্ছে। সেই কারণেই আমার মাথাতেই ওইসব চিন্তা। সেই থেকেই স্বপ্ন… সবকিছু ওলটপালট এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বাস থেকে যখন…”

“বাস থেকে কী রে পচা? কোন বাস?” দিব্য কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে।

“জানি ওটা স্বপ্ন, তাও কেন জানি না ঘুম ভাঙার পর বারবার মনে হচ্ছিল ওটা স্বপ্ন হতেই পারে না। ওটা সত্যি! সত্যিই… এত স্পষ্ট এত জোরালো স্বপ্ন এর আগে আমি কখনও দেখিনি। কখনোই নয়। ছবির মতো ভেসে উঠছিল জলার ধার… অন্ধকারের মধ্যে একটা লোক ঝুঁকে ঝুঁকে এগিয়ে যাচ্ছে… কিছু একটা লুকাচ্ছে যেন… আর তারপর ঠিক ওই ঝাঁকড়া নুয়ে পড়া গাছের গোড়াতেই কিছু একটা লুকিয়ে রাখছে। কিন্তু ঘুমটা তারপরেই যে ভেঙে গেল। অনেক চেষ্টা করেছি। ভেতর ভেতর খুব কষ্ট হয়েছে। মনে হয়েছে স্বপ্নটা যদি আরেকবার দেখা যায়! অনেক চেষ্টা করেও ওই স্বপ্ন আর দেখতে পাইনি। কিন্তু ওই লোকটার চেহারা বিশেষ করে সরু সরু পা, সামনে অল্প ঝুঁকে হাঁটা। নামটা পেটে আসলেও কিছুতেই মাথায় আসছিল না।”

“সত্যি পচা, গোপালকাকু যে এইভাবে আমাদের ভালোমানুষির সুযোগ নেবে, আমরা কি থোড়ি জানতাম? কী করে জানল মোহরের ব্যাপারটা, সেটাই তো একটা রহস্য। আর পিসিমা ওদের কত উপকারই না করেছে। কিছুদিন আগেই লক্ষ্মী কাকিমা কাজে এসে বলেছিল গোপালকাকুর পায়ে মোচড় লেগেছে। যেখানে গাড়ি চালাতে যায়, যেতে পারছে না। পিসিমাই তো দিয়ে এল ঘরোয়া টোটকা। গোপালকাকু দাঁড়াতে পারল। আর সে কিনা…” অগ্নি মাথা নিচু করে বলে যাচ্ছিল।

“আচ্ছা, এও তো হতে পারে লক্ষ্মী কাকিমা তোদের ঘরের কোনও কথা কখনও শুনে জানিয়েছে। সেও হয়তো…”

“না দিব্য, লক্ষ্মী কাকিমাকে আমি ছোট থেকে এ বাড়িতে কাজ করতে দেখেছি। আসলে আমার মনে হয় পিসিমার গুরুদেবের জন্মদিন উপলক্ষ্যে ঠাকুরঘর রঙ করতে এসেছিল গোপালকাকুর এক বন্ধু আর কাকু নিজেও। তখন কি…”

“কিন্তু আমি একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না অগ্নি। একমাত্র পচাই বা কেন এমন স্বপ্ন দেখল?”

“আমি যে তোদের কথায় সবথেকে বেশি অবিশ্বাস করতাম দিব্য! বিশেষ করে পিসিমার…”

“তার মানে? তার মানে তুই বলতে চাইছিস…” অগ্নি চেঁচিয়ে ওঠে।

“আমি কিছুই বলতে চাইছি না রে। স্কুলবাস থেকে যখন গোপালকাকুকে রামরতন জুয়েলার্সে ঢুকতে দেখলাম। কেমন একটা সন্দেহ হল। দিব্যকে জিজ্ঞেস কর সেদিন সারাদিন আমি কী ভীষণ অন্যমনস্ক ছিলাম। পড়াতে মন দিতে পারিনি। তুই সেদিন স্কুলে যাসনি। কিন্তু অগ্নির সঙ্গে টিফিন পিরিয়ডেও কথা বলতে পারিনি ওই অস্থিরতায়। আর তারপর সন্ধেরাত হতেই ছুট লাগিয়েছিলাম জলার ধারে। যে আমি সব বিষয়েই কারণ খুঁজে দেখি। সেই আমি কিছু না ভেবেই শুধু একটা স্বপ্নকে ভর করে। তাহলে কি পিসিমার কথাগুলোই সত্যিই! কেউ একজন আছেন?”

“লোকটা তোর মাথায় মারল তুই কিছু বুঝতে পারিসনি?”

“কিছুই বুঝতে পারিনি অগ্নি। টেনশন হচ্ছিল। তাছাড়া জলার দিকে যত এগোচ্ছিলাম মশার কামড় বাড়ছিল তত। আর তারপরেই…”

“ভাগ্যিস তোর আঁকার স্যার ওদিক দিয়ে তোদের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। নাহলে যে কী হত। লোকটা পচার মাথায় লাঠি দিয়ে মারল? চিৎকার করতেই জলার ওপার থেকে বস্তির লোক ছুটে আসে। সেদিন শনিবার ছিল। শীতলাপুজো হচ্ছিল তো ওখানে। একজন পালিয়েছিল। তিনজন ধরা পড়েছিল। পরে সেই পালিয়ে যাওয়া লোকটা। পুলিশের মারের চোটে সব গড়গড় করে বলে দিয়েছে। আমরা পিসিমাকে হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তখনই দুদিন এসেছিল একটা লোক। বাবার কাছে বাকি টাকাটা নিতে তখনই কোনোভাবে… ভাব, চারটে মোহর কীভাবে গাছের গোড়ায় পুঁতে রেখেছিল। আমার তো ভাবতেই গা শিউরে উঠছে! সুযোগ বুঝে বিক্রি করে দিত। তাই হয়তো সোনার দোকানে কথা বলতে গেছিল। পুলিশ তো ওই দোকানের কাকুটাকেও অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করছে শুনেছি।”

“সত্যি পচা, তোকে মেনি মেনি থ্যাঙ্কস। তুই না থাকলে কিছুতেই আমরা মোহরগুলো খুঁজে পেতাম না রে। কেউ জানতেই পারতাম না।”

“আমাকে ধন্যবাদ না দিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দে!”

পচা এই কথা বলছে! অগ্নি আর দিব্য মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। এ যে অবাক কাণ্ড! সূর্য কি পশ্চিমদিকে উঠেছে?

“অগ্নি একটা রিকোয়েস্ট ছিল। প্লিজ প্লিজ প্লিজ, না করিস না ভাই। মোহরগুলো এবার অন্তত আমাদের একবার দেখা? আর কত লুকিয়ে রাখবি?”

“দিব্য তুই বলবার আগেই আমি বাবাকে বলেছিলাম। তোদের দেখাতে চেয়েছিলাম। বাবা রিস্ক নিতেই চাইল না। বলল আর কোনোভাবেই বাড়িতে রাখবে না ওসব। থানা থেকে নিয়ে এসেই ব্যাঙ্কের লকারে রেখে এসেছে। তাতেই দেখ সবাই এসে এসে একবার করে ঘুরে যাচ্ছে মোহর দেখার জন্যে। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেছে। তবে পুজোর সময় অষ্টমীর দিন একবার ঠিক বাড়িতে আনবে। তখন আমি তোদের দেখাব।”

“ওকে ডান। চল বাড়ি যাই! কী রে পচা, উঠবি তো নাকি?”

“আসলে তিনটে সেলাই পড়েছে তো। তাই আমাদের পচাবাবু ভেবলে গেছেন।” পচার পিঠে একটা জোর চাপড় দেয় দিব্য।

সেদিনের মতো গল্পগাছা শেষ করে ঘরে ফিরে আসে দিব্য, পচা।

 

“ওষুধটা খেয়ে নে বাবা। এখন আর বেশি দেরি করিস না।” পচা ঘরে ঢুকতেই একটা রঙিন ট্যাবলেট নিয়ে ওর মা সামনে এসে দাঁড়ায়। বিশ্রী মুখ করে পচা ওষুধটা খেয়ে নেয়।

এই একমাস যে কী যাচ্ছে ওর ওপর দিয়ে। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। বিশেষ করে পিসিমার কথা মনে পড়লেই বুকের মধ্যে কষ্টটা ডুকরে উঠছে। অজান্তেই কত হাসি মশকরা করেছে পিসিমার সঙ্গে। আজ যদি উনি থাকতেন…

কিচ্ছু ভালো লাগছে না। পড়তে বসতে, আঁকতে, গান শুনতে কোনও কিছুতেই মন বসছে না। কারুর সঙ্গে কথা বলতেও না।

তাড়াতাড়ি ঘরে চলে আসে পচা। মা বাবার কাছে বেশিক্ষণ দাঁড়ালেই হাজার কথা। হাজার প্রশ্ন।

অন্ধকার নিস্তব্ধ ঘরে লাইটের সুইচের টক করে শব্দটা বড্ড জোরে শোনায়। খালি বিছানাটা ওর জন্যে অপেক্ষা করছে। বিছানার ওঠবার জন্য পা বাড়াতেই বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে।

এটা কী? কোত্থেকে এল? পড়ার টেবিলের ওপর!

পচার পা দুটো কাঁপতে শুরু করে। বুকের শব্দটা বাইরে বেরিয়ে যেন কানের কাছে বাজছে। হৃদপিণ্ডটা বাইরে বেরিয়ে এল কী?

একটু একটু করে পচা এগিয়ে যায় ওর পড়ার টেবিলের কাছে। পিঠ বেয়ে ওঠানামা করে ভয়। গলায় কী যেন দলা পাকিয়ে আসে। কথা ফোটে না মুখে।

ডান হাত পড়ার টেবিলে ছুঁইয়ে হাতে করে তুলে নেয় সোনালি ধাতব চেহারার একটা মুদ্রা। মুদ্রার দু-পিঠে অজানা ভাষায় লেখা কিছু অক্ষর!

আতঙ্কে, উত্তেজনায়, শিহরণে পচার চোখ বুজে আসে। একটা সিরসিরে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে। বৃষ্টি নেমেছে কি?

মুহূর্তের জন্যে হলেও বোজা চোখে ভেসে ওঠে একটা চির পরিচিত মুখ। পিসিমা…

তাঁর ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি লেগে।

 

ছবি – সুমিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published.