একটা বিরাট বাড়ি। তার একটা ঘর। সেখানে একটা ছেলে। একা। কাছাকাছি বয়সের যে দুজন আছে বাড়িতে তারাও তাকে একেবারেই পাত্তা-টাত্তা দেয় না। উলটে সুযোগ পেলেই ভয় দেখায়।  তার বাবা খুব ব্যস্ত মানুষ। কত জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়ান। বাড়ির অন্য গুরুজনরা সকলেই গুরুগম্ভীর। সকলেই পণ্ডিত, কর্মবীর। পারিবারিক পেশা, সমাজসেবা, দেশ-উদ্ধার এমন কত না কাজ তাঁদের।

শুধু, ছেলেটা ভারী একা। তাকে গান থেকে কুস্তি সবরকম বিদ্যে শেখাবার বন্দোবস্ত করেছে তার বাড়ি। সার সার মাস্টার, ঝড়ে জলে কোনোকিছুতেই গলির মুখে তাঁদের ছাতা বাধা মানে না। তাকে নিয়ম করে খেতে হয়। নিয়ম করে শুতে হয়। সারেগামা, কুস্তি, বিলিতি বিদ্যে সবকিছুর পাঠ নিয়ে চলতে হয়ে নিজের পরিবারের উপযুক্ত হয়ে ওঠবার জন্যে। তার সেসব ভালো লাগে না। সে ইশকুলে যেতে ভালোবাসে না।

এ গল্পটা কি তোমার?

তাই মনে হচ্ছে না?

তাই যদি হয়, তাহলে তুমি কী করো? মন খারাপ করো? ইচ্ছে করে হোমটাস্ক না করে মাকে পেরেন্ট টিচার মিটিঙ-এ বকা খাওয়াও? অথবা, খুব কি রাগ করো তুমি বাবার ওপর? রাগ করে সেই খেলাটা খেলো একলা বসে? সেই যে, মোবাইলে সেই গেমটা, যেখানে কেউ ডেকে বলে, নিজের হাতটায় ব্লেডের আঁচড় দিয়ে বন্ধুদের দেখা দেখি তুই কেমন বীর?

উঁহু থাক। জিজ্ঞেস করব না। তাছাড়া এ গল্পটাও অন্য একটা লোকের ছেলেবেলার জীবনী থেকে নেয়া। বইটার নাম জীবনস্মৃতি। তার লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

 

যখন সে খুব ছোট, তার চারপাশে শুধু অন্যদের সাফল্যের স্রোত ছিল। তার চারপাশে টাকাপয়সা, সম্মান, উঁচু সমাজের বড় বড় কাজকর্মের উজ্জ্বল ঢেউ ছিল।

কিন্তু, সেই সবকিছুর মধ্যে সে একেবারে একলা ছিল। তার দুঃখের কথা কেউ শুনতে চাইত না। শুনলেও বুঝতে পারত না। কারণ, যারা তার গুরুজন ছিল, তারা যে একেবারে অন্যজগতের বাসিন্দা! সেখানে বড় না হলে ঢোকা যায় না। আবার বড়রাও তাদের সোনায় তৈরি জেলখানা থেকে মুখ বাড়িয়ে ছোটদের বিবর্ণ দুনিয়াটাকে দেখবার শক্তি ধরত না। ছেলেটা তাই তার সব দুঃখকে নিজের বুকেই ধরে রাখত।

যে শহরটায় সে থাকত, সেই শহরটা তখন একটা ভীষণ অন্ধকারে রাজত্ব ছিল। সেখানে যেমন গরিব লোকের বাস তেমনই তাদের মতো সুখী, বড়লোক মানুষজনের ঘরবাড়ি। তার অধিকাংশ বাড়ির ছেলেরা খুব কম বয়েসে নেশা করতে শিখত। যে কাজগুলোকে আমরা বেজায় খারাপ কাজ বলে ভাবি, সেইসব কাজ তারা খুব গর্বের সঙ্গে করতে শুরু করত খুব কম বয়েসে।

তখন সে দেশের প্রায় সবটাই গ্রাম ছিল। সেইসব গ্রামের জমিদাররা অনেকেই সেই শহরটায় থাকত। গরিব মানুষদের যেটুকু যা রোজগার, তার অনেকটাই কেড়ে আনত শহরের বাসিন্দা সেই জমিদাররা। আর তাদের বাড়িগুলোতে তার মতো যে ছেলেরা জন্মাত, তাদের অনেকেই একটু বড় হয়েই সেই টাকা দু-হাতে উড়িয়ে দিয়ে বিচ্ছিরি সব আনন্দফূর্তি করত। তারপর তাদের অনেকেই কম বয়েসে মরেও যেত।

আবার ওরই মধ্যে কিছু ব্যতিক্রমও ছিল বইকি। যেমন আমাদের গল্পের এই ছেলেটা। সে কিন্তু হার মানেনি। বড়দের উদাসীনতা, সমাজের অন্ধকার— এই সবকিছুর হাত থেকে বাঁচবার জন্য রাস্তা খুঁজেছিল তার মন।

কীভাবে?

সেই গল্পই বলতে বসেছি আজ।

 

এই কাজটা করতে গিয়ে প্রথমে কয়েকজন বন্ধুকে খুঁজে নিতে চাইল সে। কিন্তু মানুষ-বন্ধু জোটাবার তো কোনও সুযোগ নেই সেই উদাসী, সচ্ছল পণ্ডিত মানুষদের বাড়িতে। তাই প্রথমেই, জানালা দিয়ে বাইরের দুনিয়ায় যাদের চোখে পড়ে, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাল সে। তারা ছিল একটা পুকুর আর একটা বটগাছ।

কিন্তু পুকুর কেমন করে বন্ধু হবে? সে কি গল্প বলতে পারে?

পারে বইকি। যদি তুমি তার গল্প শোনবার শক্তি তৈরি করতে পারো নিজের মধ্যে, তবেই সে গল্প তুমি শুনতে পাবে। ছেলেটাও সে শক্তিকে গড়ে তুলল নিজের মধ্যে। একটু একটু করে। না, তার জন্য তাকে কোনও মনস্তত্ত্ববিদের কাছে নিয়ে যেতে হয়নি তার বাবাকে। আস্তে আস্তে সে পুকুরের গল্প বলার সন্ধান নিজেই বের করে নিয়েছিল। দেখতে পেয়েছিল সেখানে ফুটে ওঠা নানান ছবির মিছিলকে। তবে, ছেলেটা তো আর কার্টুন চ্যানেল দেখেনি, সিনেমাও দেখেনি। দেখবার মধ্যে দেখেছে কেবল কিছু বই। সেইসব মজাদার ছবিদের তাই তার কাছে একটা বিরাট বড় ছবির বই বলে মনে হত।

কেমন ছবি?

তার লেখার থেকেই দেখা যাক এসো। পুকুরে আসা মানুষজনের স্নান করবার ছবি এগুলো। কেউ বা প্রাণপণে নাকটা টিপে ধরে ঝুপঝাপ ডুবকি লাগাচ্ছে। আবার কেউ বা এইসান ভিতু যে জলে নেমে ডুব দেবার বদলে গামছায় করে জল তুলে মাথায় ঢালবার চেষ্টা করছে। দৃশ্যটা ভাবো একবার! গামছা দিয়ে রামভিতু জল তুলে মাথায় দেবার জন্য লড়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কোমরজলে দাঁড়িয়ে দু-হাতে জল নাড়াবার ভান করতে করতে হঠাৎ একখানা ডুব দিয়ে ফেলল। যেন তাহলে শীতটা তাকে ডুব দিতে দেখতে পাবে না। আবার কেউ তো যাকে বলে মহাবীর। সিঁড়ির দু-ধাপ ওপর থেকে ধুমুস করে ঝাঁপ মারল জলে।

চোখকান তৈরি করে নিতে এইবার এমন হাজারো সব ছবি এইবার তার চোখে গল্প হয়ে ফুটে উঠতে শুরু করল।

কিন্তু বেলা বাড়লে পুকুর তো নিস্তব্ধ হয়ে যায়। তার গল্প যায় থেমে। তখন? তখন সে নতুন গল্পের খোঁজে চোখ মেলত তার আরেক প্রাচীন বন্ধুর দিকে। সে একটা ঝুপসি বটগাছ। তার গাঢ় ছায়ায় ঢাকা ঝুরির রাজপ্রাসাদের ভেতর কত না রহস্যের আনাগোণা। নির্জন দুপুরে সেই বটগাছ তার কল্পনাকে থ্রিলার পড়বার আমেজ দিত। তার মনে হত, চেনা পৃথিবীর সব নিয়ম যেন ওর অন্ধকারে অচল। শহরের বাস্তবের বুকে সে যেন এক অসম্ভবের রাজত্ব।

 

যে ছেলেটা দুঃখকে জয় করেছিল দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

 

আর, এই করতে করতেই আরও একটু বড় হয়ে গেল সে। ক্রমাগত অভ্যাসে তার দেখবার চোখ, শোনবার কান, তীক্ষ্ণ অনুভূতি আরো ধারালো হয়ে উঠতে থাকল। আর তারই সঙ্গে সঙ্গে, যে শহরটাকে আগে প্রাণহীন বলে ঠেকত, যে বাড়িটা ছিল শুধুই একাকিত্ব আর উদাসীন মানুষদের বাসা, সেই শহর , সেই বাড়িও তাকে গল্প শোনাতে শুরু করল। নতুন নতুন গল্প।

শহরের পথ দিয়ে হেঁকে যাওয়া ফিরিওয়ালার ‘চুড়ি চাই খেলোনা চাই’-এর সুর, আকাশে ভাসমান চিলের উদাস ডাক, তার বাড়ির ঢেঁকিশালে মেয়েদের কাজকর্ম, এই সমস্ত ছবিকেই নিপুণভাবে খুঁজে নিতে শিখে গেল তার ইন্দ্রিয়রা। সে টের পেল, তার শহর, তার বাড়ি— এদেরও প্রাণ আছে। এদেরও অনেক রঙিন গল্প আছে বলবার।

ওদিকে তার জীবনটা তখন আরও দুঃসহ হয়ে উঠেছে সেই সময়। সে কষ্ট তোমার পাওনি কখনও। যে চাকরদের ওপর তার ভার দেয়া আছে, তারা তাকে ভয় দেখিয়ে খড়ির গণ্ডি এঁকে তার ভেতর আটকে রাখবার চেষ্টা করে। তাকে মারে, তাকে দুটোর বেশি তিনটে লুচি দিতে চায় না খেতে বসিয়ে। আর সেটুকুও দেয় মহা অবজ্ঞায়, ছুঁড়ে ছুঁড়ে। আধপেটা খাইয়ে রেখে দেয় ছোট্টো ছেলেটাকে, নিজে বেশি করে খাবে বলে। ছোট ছেলে দুধ খেতে না চাইলে তাকে খাওয়াবার চেষ্টা না করে নিজের খাবার জন্য সরিয়ে নিয়ে যায় দুধটুকুকে।

কার কাছে নালিশ করবে সে? কীভাবে এর প্রতিকার করবে? এমন একটা অসহায় অবস্থা যখন হল তার, ঠিক তখনই তার সেই তীক্ষ্ণ চোখ কান, অনুভূতি তার কাজে এল। বাড়ির ভেতরের খুদে বাগানটায় গিয়ে সে দেখতে পেল, গাছেরাও কষ্টে আছে সেখানে। কিন্তু কষ্টে থাকলেও তারা লড়াই করছে। মালিদের অবহেলা সয়ে, পাথুরে চাতালের বাঁধনকে ভেঙে অদম্য শক্তিতে বেঁচে রয়েছে তারা। হতাশ হয়ে দুঃখে শুকিয়ে যায়নি। সূর্যের দিকে পাতা ছড়িয়ে চলেছে। ফুল ফুটিয়ে চলেছে।

সব অবহেলা সয়ে, সব যন্ত্রণাকে অতিক্রম করে ফুল ফোটাবার শিক্ষা হয়তো সেই গাছেরাই দিয়েছিল তাকে। তাই, অনেক বড় হয়ে তার সেই জীবনস্মৃতি বইতে সে লিখল, এই বাগান তার কাছে স্বর্গের বাগান ছিল। ঘুম ভাঙতে না ভাঙতে সে চলে আসত তার কাছে, তার শিশিরভেজা মাটির গন্ধের আদরটুকুকে মেখে নিতে।

গাছ, মাটি, আকাশ, চিল, পুকুর, ফিরিওয়ালার হাঁক— এইসব বাস্তব উপাদানের পাশাপাশি কল্পনার সৃষ্টিরাও আস্তে আস্তে জায়গা খুঁজে নিচ্ছিল তার নিজস্ব এই আনন্দের দুনিয়ায়। নিজের বাড়ির ভেতরে সে কল্পনায় গড়ে নিয়েছিল একটা না-দেখা, রহস্যময় ‘রাজার বাড়ি’। গড়ে নিয়েছিল তার একটা ছোট্ট মেয়ের জবানিতে। সে মেয়ের কোনও পরিচয় সে লিখে যায়নি। হয়তো সে মেয়েটাও তার কল্পনাতেই গড়া ছিল! কে জানে। সেই অদেখা রাজবাড়িকে সে খুঁজে চলত অনবরত। আর চোখের সামনেই লুকিয়ে আছে অথচ খুঁজলে মেলে না এই যে রোমাঞ্চটা, এইটেকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত সে একলা একলা।

এইভাবেই তার বড় হয়ে ওঠা। উদাসী গুরুজনদের সান্নিধ্যে, নিরুত্তাপ এক শহরের বুকে, নিষ্ঠুর, অনুভূতিহীন কর্মচারীদের শাসনে— এর বিরুদ্ধে হার না-মানা লড়াই করতে করতেই তার মধ্যে জন্মেছে দুই সুপার পাওয়ার— অসামান্য গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর অসীম শক্তিধর কল্পনা।

আর তারপর, যৌবনে পা দিয়ে একদিন সেই সুপার পাওয়ারের দুই ডানায় ভর দিয়েই সে বাংলার সাহিত্যের আকাশে হাজির হল এক অসীম শক্তিধর লিখিয়ে হিসেবে।

 

তার পর থেকে যে উদ্দাম প্রতিভার বিস্ফোরণে পৃথিবীকে মোহিত করে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, উৎসে হয়তো ছিল ছেলেবেলার সেই অন্ধকার দিনগুলোকে কাটাবার জন্য তাঁর লড়াই। যে লড়াই দিয়েই তিনি গড়েছিলেন তাঁর দুই প্রধান শক্তিকে।

এই যে হাজারো দুঃখের মধ্যেও আনন্দকে খুঁজে নেবার শক্তি, ছোটবেলায় এর নিবিড় চর্চা বড়বেলাতেও কাজে এসেছে তাঁর। তোমার জানো কি না জানি না, কিন্তু ব্যক্তিজীবনে তাঁর মতো দুঃখী মানুষ খুব কম ছিল। কারণ, কৈশোর থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত চোখের সামনে একের পর পরমাত্মীয়ের মৃত্যু। প্রিয় বউঠাকরুণ থেকে প্রিয় সন্তান, সবার মৃত্যু দেখতে হয়েছে তাঁকে। সব হারাবার যন্ত্রণা সইতে হয়েছে বারংবার। আর সেই সইবার সময় ফের একবার তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে ছোটবেলায় গড়ে তোলা সেই নিবিড় পর্যবেক্ষণ আর অনুভূতিশীলতার অভ্যাস।

প্রিয়তম সন্তানের মৃত্যুর পর তাঁকে চিতায় তুলে দিয়ে ট্রেনে ফিরতে ফিরতে তাই হঠাৎ বাইরে চাঁদের আলোয় ছাওয়া শান্ত পৃথিবীর ছবি তাঁকে সান্ত্বনা দিতে পেরেছিল তাই। কারণ তিনি শুনতে পেয়েছিলেন সে তাঁকে বলছে, তুচ্ছ একটা প্রাণ যাওয়াতে জগতের কোনও ক্ষতি তো হয়নি। তাহলে তুমি কেন দুঃখে ডুবে থাকবে।

সেই আঘাতের পরেও তাই ফের কবি হাতে তুলে নিতে পেরেছিলেন কলম। লিখতে পেরেছিলেন আরও অনেক অমর গান— যে গানরা আজও সুখেদুঃখে আমাদের চিরসঙ্গী হয়ে থাকে। আমাদের অন্ধকার দিনে আলো দেয়, আমাদের আলোর দিনকে উজ্জ্বলতর করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.