রাজামশাইয়ের চোখে ঘুম আর মোট্টে আসে না। রাতের পঞ্চব্যঞ্জন আহার সেরে রাজপ্রাসাদের ই-য়া-য়া লম্বা দালানময় পায়চারি করতে করতে ক্রোশখানেক হাঁটা হয়ে যায়, তবু রাজার চোখের পাতা ভারী হয় না। ঘণ্টাঘরের সেপাই হাতুড়িতে করে পেতলের কাঁসরে ঢং ঢং করে বারোবার ঠোকা দেয়, তবুও রাজার ঘুম আর আসে না। শয়নকক্ষের জানলার বাইরের অশ্বত্থগাছের বুড়ো প্যাঁচাটা ‘হুট হুট হুটুর হুট’ বলে ডেকে রাজার সঙ্গে ভাব জমাতে আসে, রাজামশাই তাকে খেঁকিয়ে বিদেয় করেন।

চেয়ে দেখেন সোনার পালঙ্কে রানি আরামে নিদ্রা যাচ্ছেন। টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো টিকোলো নাক থেকে ‘ফোঁররর ফোঁৎ ফুররর ফুস্স্‌’ করে সুরেলা শব্দ বেরোচ্ছে। রাজামশাইয়ের রাগে গা জ্বলে যায়। ইচ্ছে করে বিছানা ঝাড়ার ময়ূরপুচ্ছের ঝাড়ুর পালক দিয়ে রানির নাকে একটা রাম সুড়সুড়ি দিতে, কিন্তু সাহস হয় না। রানিকে একটু ভয়ই পান রাজামশাই। এক্ষুনি হয়তো উঠে রাজার অনিদ্রার দাওয়াই ওই তিতকুটে পাঁচনটা গিলিয়ে দেবে আবার। রাজবৈদ্যটাও হয়েছে তেমনই অলম্বুষ। একটা ওষুধে যদি কাজ হয়! গেলাস গেলাস তেঁতো পাঁচন গেলায় শুধু, এদিকে রোগ সারার নামচর্চা নেইকো।

চুপিচুপি ঘরের বিশাল দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসেন রাজামশাই। দরজার দু-পাশে দুজন সেপাই বল্লমে হেলান দিয়েই ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে। উফ! সব শত্রু! কাল সকালেই দরবারে এই দুটোকে ছারপোকাভর্তি বিছানায় ঘুমনোর সাজা দিতে হবে। নিজে ঘুমোতে পারেন না বলে কাউকে ঘুমোতে দেখলেই রাজার গা চিড়বিড়, দাঁত কিড়মিড় করে। মনে হয় কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে তুলে তার সুখনিদ্রায় জল ঢেলে দেন এক কলসি। সেপাই দুটোকে শাপশাপান্ত করতে করতে রাজামশাই পা বাড়ান দরবারের দিকে।

 

লাল কার্পেটে মোড়া, কারুকার্য করা থামে শোভিত দরবারে পোঁছে দেখেন, যে সেপাই ব্যাটা শিঙে ফুঁকে দরবারের রাজার আগমন আর প্রস্থানের খবর হাঁকে, সে রাজার সিংহাসনের গদি মোড়া পাদানিতে গুটিশুটি মেরে শুয়ে, শিঙেটাকে পাশবালিশ বানিয়ে, পরমানন্দে নাক ডাকছে। ব্যাটার নাক ডাকার যা শব্দ! ওই দিয়েই ঘোষণার কাজ হয়ে যাবে, শিঙের আর দরকার কী খামোখা! রাজামশাই হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, “এইয়ো বাঁদর সেপাই! শিগ্গির শিঙে ফোঁক দেখি উঠে। সক্কলকে ডেকে আন, পড়ে পড়ে ঘুমনো হচ্চে। এদিকে রাজা কি দরবারে একা বসে সভা করবে নাকি?”

সেপাই বেচারা আচমকা এরকম হুঙ্কারে বিষম খেয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়। কোনোমতে সামলেসুমলে উঠে ঘুম ঢুলুঢুলু চোখে বলে, “ক্-ক্-কিন্তু রাজামশাই এখন তো সবে মধ্যরাত্রি! দরবার তো শুরু হয় সকালবেলায়!”

রাজামশাই আরও রেগে তেঁড়েফুঁড়ে বলে ওঠেন, “বেশি বকবক করলে ওই শিঙে নিয়ে তোর কানেই এমন পোঁ করে বাজিয়ে দেব, যে কানে সাতদিন তালা পড়ে থাকবে!”

বেচারা সেপাই নিজের কান বাঁচাতে আর কথা না বাড়িয়ে পোঁ করে শিঙে ফুঁকে হাঁকতে শুরু করে, “মহাপ্রতাপশালী, মহাবীর, মহামান্য মহারাজাধিরাজ শ্রী শ্রী…”

 

মধ্যরাতে সভা শুরু হওয়ার ঘোষণায় এক এক করে মন্ত্রী, সেনাপতি, কোটাল, পাত্র, মিত্র, অমাত্য, রাজগুরু, রাজজ্যোতিষী, রাজবৈদ্য সকলে হাই তুলতে তুলতে, চোখ রগড়াতে রগড়াতে, মাথা চুলকোতে চুলকোতে এসে হাজির হলেন দরবারে। রানিমাও ঘুম ভেঙে রাজামশাইকে বিছানায় না দেখে এবং শিঙে ফোঁকার বিকট আওয়াজ পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে রাজদরবারে হাজির। এতটাই ব্যোমকে চমকে গেছেন যে চোখের নিচে লাগানো চন্দনগুঁড়ো আর গোলাপজলের রূপটানটাও মুছতে ভুলে গেছেন। সবার চোখেই একরাশ ঘুমের সাথে একগাদা প্রশ্নও ঝুলে আছে। সেটা লক্ষ করে বেশ মজাই পেলেন রাজামশাই। গোঁফের ফাঁকে মিচকে হেসে, গলা খাঁকারি দিয়ে রাজা বলে উঠলেন, “জেগেই যখন রয়েছি, ভাবলুম রাজকার্য সেরেই রাখি। মিছে সময় নষ্ট করা ভালো কথা নয় মোটেও।”

বেজার মুখে, ঢুলুঢুলু চোখে রাতদুপুরে চলল রাজসভা। রানিমা হাই তুলে ফিরে গেলেন অন্দরমহলে।

 

রোজ রাতে চলল রাজার অনিদ্রা আর সেইসাথে রাজকার্য! মন্ত্রী সেনাপতি থেকে শুরু করে রাজ্যের সাধারণ মানুষ সকলে গেল বেজায় বিরক্ত হয়ে। এমনকী চোর-ডাকাতরাও অসন্তুষ্ট। গেরস্তরা সব রাতে রাজপ্রাসাদের শিঙের আওয়াজে উঠে পড়ে আর তাদের কাজেও বাগড়া পড়ে যায়। দাস-দাসীরা চোখ বুজে বুজে কাজ করতে গিয়ে তরকারি নুনপোড়া বানায়, হাত থেকে পড়ে বাসন ভাঙে। রানিমারও চোখের কোলেও কালি পড়তে শুরু করল, কোনও রূপটানেই সেই কালি আর মোছে না। সবার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। দেশ-বিদেশে লোক পাঠিয়ে ঘুমপাড়ানোর ওষুধের সন্ধান করতে লাগলেন রানিমা আর মন্ত্রীমশাই। নতুন নতুন ওষুধ আসে, বদ্যি আসে, কোনও কাজ হয় না। সবাই ওষুধ খুঁজে খুঁজে আর রাত জেগে জেগে তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েছে, কিন্তু রাজামশাইকে কেউ কিচ্ছুটি বলতে পারছে না।

 

অবশেষে বিশেষ খবর এল, তাও আবার এক-আধটা নয় তিন-তিনটে। পুবের দিকে যেদিকে সূর্য ওঠে সেদিকে তিনদিনের রাস্তা পেরিয়ে গেলে পৌঁছবে বনবনানীর বাগানে। সেখানে রাতের বেলায় ফোটে অদ্ভুত ঝিমঝিমানি ফুল। সে এমন ফুল, যার গন্ধ নাকে গেলে একবার ঘুম না এসে উপায়ই নেই। যত বড়ই জাগুনে লোক হোক, একটা লম্বা ডাল শুদ্ধু ফটফটে সাদা রঙের ঝিমঝিমানি ফুল যদি মাথার কাছে রেখে শুতে যায়, তবে চার পল পেরোতে না পেরোতেই ভোঁস ভোঁস করে নাক ডেকে ঘুমোবে এক্কেবারে।

দ্বিতীয় দাওয়াইয়ের খবর মিলল পশ্চিমের দিকে, যেদিকে সূয্যি ডোবে। তিনদিনের রাস্তা পেরিয়ে গেলে পরে, গিয়ে পড়বে ঘুটঘুটে জঙ্গল। সেই ঘুটঘুটে জঙ্গলে পথ হারিয়ে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছবে বনের মাঝে হাজারপাতা গাছের সামনে। সেই হাজারপাতা গাছে ফোটে একশ ফল। তার মধ্যে বেশ পাকা লাল টুকটুকে একটা ফল পেড়ে এনে, শরবত বানিয়ে রাজামশাইকে ঘুমনোর আগে চোঁ চোঁ করে যদি খাওয়ানো যায়, তাহলে ঘুম আটকায় কার সাধ্যি। কানের কাছে দরবারের ওই শিঙে ফুঁকলেও রাজার ঘুম ভাঙবে না কিছুতেই।

আর শেষ অব্যর্থ ওষুধের সন্ধান পাওয়া গেল উত্তরে। তিনদিন তিনরাতের পথ উজিয়ে গেলে দেখা পাবে উত্তুরে বুড়ির কুঁড়েঘরের। একটা আধটা নয়, পুরো চল্লিশটা ভেড়া নিয়ে বাস করে সে রাগী বুড়ি। কনকনে ঠান্ডা উত্তুরে হাওয়ার কামড় থেকে বাঁচতে বুড়ি বোনে ভেড়ার পশমের কম্বল। সেই কম্বল গায়ে মুড়ি দিয়ে বালিশে মাথা রাখলেই কম্বলের উল চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঘুম নেমে আসবে চোখের পাতায়।

 

*****

 

তবে আর মিছে দেরি কেন? কোটালমশাই সেনাপতিমশাই আর মন্ত্রীমশাই, যথাক্রমে পুবে পশ্চিমে আর উত্তরে ঘোড়া ছুটিয়ে রওয়ানা দিলেন চাট্টি করে সৈন্যসামন্ত নিয়ে। রাজামশাইকে মিছিমিছি জানানো হল ওঁরা গেছেন দক্ষিণের দুষ্টু রাজার সাথে যুদ্ধ করতে।

 

কোটালমশাই পুবে চলেছেন তো চলেছেন। অবশেষে তিনদিন পর যখন রাত ঘনিয়ে এল, গিয়ে থামলেন বনবনানী বাগানের সামনে। সারা বাগান সাদা ফুলে ছেয়ে রয়েছে। সৈন্যদের হুকুম করলেন বেশ সুন্দর দেখে গোটাকয় ফুল তুলে আনতে। ঘোড়া থেকে নেমে সৈন্যরা ঢুকল বাগানে। কিন্তু যেই না ফুলে হাত দেওয়া, ওমনি ‘বোঁওওও বোঁওওও’ করে আওয়াজ তুলে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা বোলতা ভীমরুল সব তাড়া করল সৈন্যদের। সৈন্যরা কামড় খেয়ে ‘আহা উহু’ করে আর কোমরের খাপ থেকে তরোয়াল বার করে সাঁই সাঁই চালায় হাওয়ায়। কিন্তু তাতে কিচ্ছুটি হয় না। অতটুকু পোকামাকড়দের কি তরোয়ালে করে মারা যায়? অবশেষে কোটালমশাই বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু শুকনো ডালপালা জড়ো করে তাইতে আগুন জ্বালিয়ে বেশ খানিকটা ধোঁয়া দিলেন চারদিকে ভুস ভুস করে। ধোঁয়ার ধাক্কায় পোকামাকড়গুলো একটু উড়ে সরে গেল। সেই সুযোগে কোটালমশাই ডালশুদ্ধু সাদা ফুল তুলে ঘোড়ায় চেপে সৈন্য সামন্ত নিয়ে দৌড় দিলেন উলটোদিকে।

 

কোটালমশাই তো সফল হলেন। এদিকে সেনাপতিমশাইয়ের অবস্থা আরও খারাপ। ঘুটঘুটে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে তো পড়লেন, কিন্তু তার পরে কী বিপদ কী বিপদ! সাধে কী আর জঙ্গলের নাম ঘুটঘুটে? এক ফোঁটা আলো ঢোকে না সে জঙ্গলের ভেতর। বিশেষ করে অন্ধকারে একহাত দূরের জিনিস তো দূরের কথা নিজের হাতই ঠিকমতো দেখা যায় না। সেনাপতি আর তাঁর সৈন্যসামন্তর দল এ গাছে ও গাছে দুমদাম করে ধাক্কা খেতে খেতে, কার ঠুকে নাক ভাঙল, কার হাত মচকাল, কার মাথায় আলু গজাল!

কোনোমতে তারা গিয়ে পৌঁছল অদ্ভুত একটা গাছের সামনে। সে গাছে ঝুলে আছে লাল-লাল ফল। অন্ধকারের মধ্যেও ফলগুলোর লাল রঙের আভায় গাছটা দেখা যাচ্ছে। এ কি আর বলে দিতে হয় যে এটাই সেই হাজারপাতা গাছ? কিন্তু সে গাছের গুঁড়ির গা-টা এমনই পিচ্ছিল যে, গাছ বেয়ে উঠতে গেলেই ধপাস ধপ করে সব নিচে পড়তে লাগল সৈন্যরা। অবশেষে মতলব ভাঁজলেন সেনাপতিমশাই। মানুষের মই তৈরি করলেন। সেটা কীরকম?

দশজন সৈন্য পাশাপাশি হামাগুড়ি দিয়ে বসল মাটিতে। তাদের পিঠে একই ভাবে চার হাত পা ভাঁজ করে হামাগুড়ি দিয়ে বসল ন-জন সৈন্য, তার পিঠে আটজন। এমনি করে করে সব্বার ওপরে উঠলেন সেনাপতিমশাই। ততক্ষণে গাছের সবার নিচের ডালটা নাগালে চলে এসেছে। টপাৎ করে একটা ফল ছিঁড়ে নিয়ে ‘ইয়াহু’ বলে চিৎকার করে উঠলেন সেনাপতিমশাই। যেই না চিৎকার করা ওমনি সৈন্যরা চমকে গিয়ে লাফিয়ে উঠল। ব্যস! মানুষের পিরামিড ভেঙে সবাই ‘পপাত চ মমার চ’। ঝোলায় লালফল নিয়ে, যন্ত্রণায় কোঁকাতে কোঁকাতে রওনা দিল সবাই রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে।

 

কোটালমশাই আর সেনাপতিমশাই তো যেনতেন প্রকারেণ কার্য সমাধা করলেন। এদিকে মন্ত্রীমশাইয়ের অবস্থা সবথেকে করুণ! উত্তুরে বুড়ির কুঁড়েঘরে পৌঁছে তো গেলেন, কিন্তু সে বুড়ি বড্ড কঠিন ঠাঁই। কম্বল নিতে এসেছেন শুনেই খ্যাঁকখেঁকিয়ে উঠল, “কেন বাপু? এতগুলো হাট্টাকাট্টা লোক নিজেদের কম্বল নিজেরা বুনে নিতে পারো না?”

মন্ত্রীমশাই সব বেত্তান্ত বুড়িকে বুঝিয়ে বলে, তারপর বললেন, “যত খুশি মোহর নাও তুমি বুড়িমা, শুধু একটা কম্বল দাও। নইলে রাজামশাই আমাদের প্রাণ বার করে দিচ্ছেন যে একেবারে।”

বুড়ি একটু শান্ত হয়ে বলল, “আমি মোহর নিয়ে কী করব শুনি? এই চল্লিশটা ভেড়াকে সামলাতেই আমার পেরাণ বেইরে যাচ্ছে তা কম্বল বুনব কখন? তোমরা যদি আমার ভেড়াগুলোকে সামলাও আমি তবে তোমাদের রাজার জন্য কম্বল বুনতে বসি। কি? রাজি?”

অগত্যা মন্ত্রীমশাই ঘাড় হেলালেন, উপায়ই বা কী এছাড়া!

 

বুড়ি বসল তার উল আর কাঁটা নিয়ে কম্বল বুনতে আর খোদ মন্ত্রীমশাই তাঁর লোকলস্কর নিয়ে চললেন ভেড়া সামলাতে। ভেড়া তো নয়, যেন আলিবাবার গল্পের চল্লিশটা দস্যু। একজন এদিকে পালায় তো অন্যজন ওদিকে ছোটে। ধরতে গেলে কেউ ঢুঁসো মেরে কাদায় ফেলে দেয় তো কেউ দাড়ি ধরে চেবায়। ভেড়াদের পেছনে ছুটে ছুটে, কাদায় মাখামাখি হয়ে, হা-ক্লান্ত মন্ত্রীমশাই আর তাঁর দলবল যখন জিভ বার করে হাঁপাচ্ছেন তখন উত্তুরে বুড়ি একটা মখমলের মতো নরম আর সকালের সূর্যের তাতের মতো গরম কম্বল এনে তাঁর সামনে হাজির করলেন।

“এই নাও বাপু তোমার কম্বল। চারটে ভেড়া সামলাতেই হিমসিম, এরা নাকি রাজ্য চালাবে!”

বুড়ির কথা শুনে চল্লিশটা ভেড়াও ‘ম্যাঁহ্যাঁহ্যাঁহ্যাঁ! ম্যাঁহ্যাঁহ্যাঁহ্যাঁ!’ করে হেসে উঠল।

মন্ত্রীমশাই মনে মনে ভেড়াগুলোকে দাঁত খিঁচিয়ে, কম্বলখানা বুকে জড়িয়ে, সৈন্যদের নিয়ে প্রাণপণে দৌড় লাগালেন।

 

*****

 

অবশেষে কোটালমশাই, সেনাপতিমশাই আর মন্ত্রীমশাইয়ের তিনটে দলই সাদা ফুল, লাল ফল আর পশমের কম্বল নিয়ে ফিরে এলেন রাজপুরীতে। বোলতার কামড়ে লাল লাল ফুলো ফুলো টোপলা টোপলা কোটালমশাই, বাঁকা ফোলা নাকওয়ালা সেনাপতিমশাই, কাদা আর ভেড়ার লোমে মাখামাখি মন্ত্রীমশাইকে দেখে রানিমার বেজায় হাসি পেলেও হাসলেন না। আসলে রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে রানিমার এইসান মাথাব্যথা হয়েছে যে হাসতে গেলেও মাথাটা ঝনঝন করছে! যাই হোক রানিমা চটজলদি তোড়জোড় করতে লাগলেন সব। রাজামশাইয়ের শয়নকক্ষে পালঙ্কের মাথার দিকের শ্বেতপাথরের চৌকির ওপর সোনার ফুলদানিতে রাখা হল সাদা ঘুম-ঘুম গন্ধফুল। রানিমা লাল ফল পিষে রস বার করে তাইতে গোলাপপাপড়ি, বরফকুচি দিয়ে নিজের হাতে উপাদেয় শরবত বানালেন। পালঙ্কের ওপর মখমলের চাদর বিছিয়ে তার ওপর ভাঁজ করে রাখলেন উত্তুরে বুড়ির বোনা কম্বলখানা।

 

ঢং ঢং করে রাত বারোটা বাজতেই রাজামশাই দরবারে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে লাগলেন। ওদিকে সেনাপতিমশাই দরবারের সেপাইটার শিঙেটা লুকিয়ে দিয়েছেন। কোটালমশাই গিয়ে বাকি সকল সভাসদদের দরবারে আসা থেকে আটকেছেন। মন্ত্রীমশাই এসে রাজামশাইকে বললেন, “রাজামশাই আজকের দিনটায় আপনার স্বর্গত ঊর্ধ্বতন সপ্তম পুরুষের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে দরবারে ছুটি ঘোষণা করেছিলেন মাসখানেক আগে, ভুলে গেছেন বুঝি?”

রাজামশাইকে অনিদ্রা রোগে ধরার পরে টুকটাক ভুলে যান বটে জিনিসপত্র। মাথা চুলকে বললেন, “বলেছিলুম বুঝি? ওইজন্যই শিঙেও বাজেনি আজ। তাহলে আর আজ দরবারে গিয়ে কাজ নেই। এখন তবে আমি কী করি?”

রানিমা তড়িঘড়ি বলে উঠলেন, “রাজামশাই অনেকদিন তো রাতে ঘুমনোর চেষ্টা করেননি। আমি খুব সুন্দর একটা শরবত বানিয়েছি। একটু চেখে তারপর একটু চোখটা বোজার চেষ্টা করেই দেখুন না!”

রাজামশাই ভাবলেন কিছুই যখন করার নেই একটু ঘুমোনোর চেষ্টাই করা যাক। চোঁ চোঁ করে সেই লাল ফলের শরবতটা খেয়ে রাজামশাই পালঙ্কে শুলেন। গায়ে দিলেন নতুন কম্বল। মাথার কাছে সাদা ফুলে ভরা ফুলদানি। রানিমা মনে মনে ঠাকুরকে ডাকলেন। ঘুম দেওয়ার জন্য বিশেষ কোনও ঠাকুর নেই, তাই তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকেই একবার স্মরণ করে নিলেন।

 

সবে চোখটা লেগেছিল রানিমার, এমন সময় রাজামশাইয়ের বাজখাঁই হুঙ্কারে ঘুমটা চটকে গেল। মন্ত্রী সেনাপতি কোটাল সবাই দৌড়ে এলেন। রাজামশাই চিৎকার করছেন, “সব চক্রান্ত! সঅঅঅব চক্রান্ত! কী শরবত খেলুম রে বাবা, পেট ভুটভাট করে মরে গেলুম। আর কম্বল! এটা কম্বল? এত গরম যেন কেউ আগ্নেয়গিরির ভেতর ফেলে দিয়েছে, তার ওপর গা কুটকুটিয়ে মরলুম। আর… আর… এগুলো কেমনধারা জংলি ফুল অ্যাঁ? কীরকম বিচ্ছিরি গন্ধ! সব্বাইকে আমি কারাগারে বন্দি করব! সেপাই অ্যাই সেপাই!”

 

কোটাল সেনাপতি মন্ত্রীমশাই সকলে তো বেজায় ভড়কে গেলেন! যে ফুলের গন্ধে হাতি-ঘোড়া মুচ্ছো যায়, যে ফলের রস খেলে তিমিমাছ অব্দি জলের তলায় নাক ডেকে ঘুমোয় সেই ফুল আর ফলে রাজামশাইয়ের কিচ্ছুটি হল নাকো। উলটে বলেন পেট ভুটভাট করছে, পচা গন্ধ! উত্তুরে বুড়ির বোনা কম্বলের নাম শুনেই দুষ্টু ছেলেমেয়েরাও ঘুমিয়ে পড়ে আর রাজামশাইয়ের কি না তা-ই গায়ে দিয়ে গা কুটকুট করছে! নাহ! এত কষ্ট বৃথা গেল! শেষ চেষ্টাটুকুতেও কাজ হল না।

রানিমা বললেন, “রাজামশাই আপনি শান্ত হোন! আজ বরং রাতটা কাটুক! সেপাইরা সবাই তো আজ ছুটিতে বাড়ি গিয়ে নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে… ইয়ে মানে ঘুমোয়নি… জেগেই আছে নিশ্চয়ই! কাল বরং ওরা এলে তখন না হয় বন্দি-টন্দি করা যাবে’খন!”

রাজামশাইয়ের ঘুম না পেলেও উঠে আবার দরবারে গিয়ে বিচারটিচার করতে, বন্দি করতে আলিস্যি লাগছিল। তাই তখনকার মতো ক্ষান্ত দিলেন।

 

সকালের আলো ফুটতেই রাজামশাই গেলেন দরবারে, শিঙা বাজল, সভাসদরা এল, রাজা বসলেন বিচারে। এমন সময় বে-টাইমে ফের শিঙা বেজে উঠল। সবাই চমকে তাকাল, কে এল?

শুভ্র শ্বেত বসনে রাজমাতা এসে ঢুকলেন দরবারে। পেছন পেছন রানিমা এলেন। রানিমা ফিসফিসিয়ে রাজমাতাকে বললেন, “রাজমাতা! না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রাজামশাইয়ের মাথাটা একেবারেই গেছে! আপনিই কিছু করুন এবার। বাধ্য হয়েই আপনাকে তড়িঘড়ি আশ্রম থেকে ডেকে আনলাম। আমরা সবাই তো হাল ছেড়ে দিয়েছি। চেষ্টা করতে গিয়ে শেষটা কারাগারেই বন্দি হতে হবে সকলকে, রাজমাতা!”

রাজমাতার বয়স হয়েছে, তিনি বনের ধারে আশ্রমে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু এমন বিপদের দিনে রানিমা বাধ্য হয়ে সেই রাতদুপুরেই খবর পাঠিয়েছিলেন।

 

*****

 

রাজমাতাকে দেখে রাজামশাই তো চমকে উঠলেন। রাজমাতা দরবারে এসে রাজামশাইকে বললেন, “রাজামশাই, চলো দেখি উদ্যানে।”

রাজামশাই খুব অবাক হলেন। কিন্তু বকুনির ভয়ে বিনা তর্কে মাকে অনুসরণ করলেন। বাগানে বটগাছের তলায় শ্বেতপাথরে বাঁধানো বেদীতে বসে রাজমাতা ব্যাগ থেকে বার করলেন পুঁথিপত্র। এক এক করে বই-খাতা-খাগের কলম সব ধরালেন রাজামশাইকে। সেই ছোটবেলার মতো গণিত, শাস্ত্র, ইতিহাস সব পড়া দিয়ে রাজামশাইকে বসালেন রাজমাতা। রাজামশাই অবাক হয়ে বললেন, “রাজমাতা, এসব কেন? এ তো অনেক ছোটোবেলাতেই করেছি আমি।”

রাজমাতা বললেন, “একবার দেখি তাও তোমার সব মনে আছে নাকি। আগে এক থেকে কুড়ির ঘরের নামতা লেখো, তারপর পাঁচপাতা হাতের লেখা করো দেখি।”

গণনার কাজ তো সব কোষাধ্যক্ষমশাই, খাজাঞ্চীমশাই এঁরাই করেন, রাজামশাইকে ওসব দেখতে হয় না। রাজামশাই বহু কষ্টে মাথা চুলকেটুলকে একশা করে অবশেষে নামতা লেখা শেষ করলেন। এদিকে অনেকদিন লেখালেখির অভ্যেসও নেই রাজামশাইয়ের, রাজনির্দেশগুলিতে শুধু সিলমোহর ছেপে দিলেই হয়ে যায়। হাতের লেখা তাই কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং হয়ে গেছে একেবারে। রাজমাতা পাঁচপাতার জায়গায় দশপাতা হাতের লেখা করালেন রাজামশাইকে।

“আচ্ছা রাজামশাই, তোমার ঘুম হয় না কেন? ছোটোবেলায় তো তুমি পড়তে বসলেই ঘুমে ঢুলতে। খেলাধুলো করে এলে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়তে, এখন কেন ঘুম পায় না তোমার?”

মায়ের প্রশ্নে রাজামশাই দুঃখ করে বললেন, “আসলে এখন রাত্রে শুতে গেলেই যত রাজ্যের চিন্তা মাথায় ভিড় করে। এই বুঝি দক্ষিণের রাজা আক্রমণ করল। বৃষ্টি হলে ভাবি বন্যা হয়ে ফসল নষ্ট হলে প্রজারা কী খাবে। রোদ্দুর হলে ভাবি খরা হয়ে নদী শুকিয়ে গেলে খাবার জল কোথায় মিলবে। তন্দ্রা এলে চমকে উঠে ভাবি কালকের কত কাজ বাকি। এই করতে করতেই ঘুম চলে যায় রাজমাতা, ভোর হয়ে যায়।”

রাজমাতা বললেন, “হুম! বুঝেছি! তোমার খেলাধুলো করতে গান শুনতে বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে না?”

“ওসব জিনিস যে কেমন হয় তাই তো ভুলে গেছি রাজমাতা!”

 

এমন সময় রাজমাতা দেখলেন, রাজামশাইকে মাথা গুঁজে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে দেখে বাগানের মালীর ছেলে আর মেয়ে দুটি উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখছে। রাজমাতা ওদের কাছে ডাকলেন।

“ভয় পেও না! আমার কাছে এসো তোমরা। লুকোচুরি খেলবে? রাজামশাই চোর হবেন, তোমরা লুকোও, উনি তোমাদের খুঁজবেন। তোমাদের নাম কী?”

বাচ্চা দুটো তো ভারী অবাক হয়ে এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। মৃদুস্বরে বলল, “আমরা রুনু আর ঝুনু!”

রাজামশাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলেন, “রাজমাতা এ আপনি কী বলছেন! তার চেয়ে আমি বরং আরও দশপাতা হাতের লেখা করি! আমার কি আর বাচ্চাদের সাথে খেলার বয়স আছে? লোকে হাসবে যে!”

রাজমাতা হেসে বললেন, “মনের আবার বয়স বাড়ে নাকি? এসো আমরা চারজন মিলেই লুকোচুরি খেলি! আমি আর রুনু ঝুনু লুকোব, তুমি আমাদের খুঁজবে। কেমন?”

রাজামশাই রাজমাতার আদেশ অমান্য করতে পারেন না। লুকোচুরি শুরু হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই খেলা জমে ওঠে। সারা বাগান খিলখিল হাসিতে ভরে ওঠে।

 

বেশ অনেকক্ষণ খেলার পর চারজনই হাঁপিয়ে গিয়ে বেদীতে এসে  বসে পড়েন। রুনু-ঝুনুর ভয় এক্কেবারে কেটে গেছে তখন। ওরা বায়না ধরে, “ও রাজমাতাদিদা একটা গপ্পো শোনাও! একটা গান শোনাও! ও রাজামশাই তুমিও বলো দিদাকে!”

রাজামশাইও হেসে উঠে শিশুদের মতোই বায়না ধরেন মায়ের কাছে। রাজমাতা তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গুনগুনিয়ে ঘুমপাড়ানি গান ধরেন। দিনের বেলায় ঝলমলে সূর্যের আলোয়, গাছের শীতল ছায়াতে শুয়ে, পাখির কলকাকলির শব্দের মধ্যে রাজামশাইয়ের দু-চোখের পাতা ভার হয়ে আসি। দিনের পর দিন ধরে অনিদ্রায় ভোগা রাজামশাই মায়ের কোলে ছোট্ট শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়েন। রুনু ওর মাথায় বাঁধা হলুদ উড়ুনি কাপড়টা খুলে রাজামশাইয়ের গায়ে চাপা দিয়ে দেয়। ঝুনু ইয়াব্বড় একটা কলাপাতা এনে ঘুমন্ত রাজামশাইয়ের মাথার ওপর মেলে ধরে, যাতে মুখে রোদ্দুর লেগে ওঁর ঘুম না ভাঙে।

 

আড়াল থেকে রানিমা, মন্ত্রীমশাই, সেনাপতি, কোটাল আর বাকি সমস্ত সভাসদরা সেপাই-সান্ত্রীরা অবাক চোখে দেখতে থাকেন।

 

রাজার ঘুম সুস্মিতা কুণ্ডু

 

ছবি – সুমিত রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published.