একশ বছর, না না একশ বছরেরও আগের কথা। ১৯০৭ সাল। বাংলার এক অখ্যাত লেখক তাঁর প্রথম বইটি রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন কিছু মতামত পাওয়ার আশায়। দুঃসাহসিক কাজ হয়তো নয়, তাঁর মতন আরো অনেক লেখকই রবীন্দ্রনাথকে নিজেদের বই পাঠাতেন দু-চারটে ভালো কথা শোনার জন্য। এবং দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতেন বাংলার সাহিত্যকূলরত্নটি কী মতামত দেবেন বা আদৌ কোনও মতামত দেবেন কিনা সে কথা ভাবতে ভাবতে। এইবার কিন্তু বুক দুরুদুরু শুধু সাহিত্যিকেরই করল না, করল স্বয়ং রবি ঠাকুরেরও। বইয়ের নাম দেখেই উত্তেজনা বেড়ে গেছিল, কিন্তু একই সঙ্গে জেঁকে বসেছিল একটা চাপা আশঙ্কা। বিষয়বস্তুটি যে কবির বড়ই প্রিয়, হৃদয়ের কাছাকাছি রয়ে গেছিল সারা জীবন। বাংলার রূপকথা। সেই অনামী লেখক রবীন্দ্রনাথকে হতাশ করেননি। দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ পড়ে রবীন্দ্রনাথ শুধু ভালো কথাই বলেননি, লিখে দিয়েছিলেন বইয়ের ভূমিকাও। সেই ভূমিকাতেই জানিয়েছিলেন “দক্ষিণারঞ্জনবাবুর ঠাকুরমার ঝুলি বইখানা পাইয়া, তাহা খুলিতে ভয় হইতেছিল। আমার সন্দেহ ছিল, আধুনিক বাংলার কড়া ইস্পাতের মুখে এ সুরটা পাছে বাদ পড়ে। এখনকার কেতাবী ভাষায় এ সুরটি বজায় রাখা বড় শক্ত। আমি হইলে তো এ কাজ সাহসই করিতাম না। ইতঃপূর্বে কোন কোন গল্পকুশলা অথচ শিক্ষিতা মেয়েকে দিয়া আমি রূপকথা লিখাইয়া লইবার চেষ্টা করিয়াছি– কিন্তু হউক মেয়েলি হাত, তবুও বিলাতী কলমের যাদুতে রূপকথার কথাটুকু থাকিলেও সেই রূপটি ঠিক থাকে না; সেই চিরকালের সামগ্রী এখনকার কালের হইয়া উঠে।”
রবীন্দ্রনাথের দরাজ প্রশংসা বইটির খ্যাতিবৃদ্ধিতে অনেকটাই সাহায্য করেছিল কিন্তু কালে কালে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ বাংলার শিশুসাহিত্যে অমূল্য রতন হয়ে উঠেছিল নিজগুণেই। রূপকথার ‘রূপ’টির সার্থক সাধনা করেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ বইটিতে।
এই রূপের সাধনা কিন্তু কথার কথা নয়। রূপকথা রবীন্দ্রনাথের কাছে শুধু ছেলেভুলোনো গল্প নয়, ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানোর গল্প নয়। রূপকথা ‘বিশ্বজগৎ এর নিত্য উৎসব’কে রূপেরসে ভরে শৈশবটিকে অতুলনীয় করে তোলার এক বিশেষ প্রয়াস। সেই কারণেই বাংলার রূপকথা শোনানোর ভার রবীন্দ্রনাথ তুলে দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় ভাইপো অবনীন্দ্রনাথের হাতে। রবিকাকা জানতেন ছবি লেখেন অবন ঠাকুর। রবিকাকার উৎসাহেই তাঁর লেখালেখিতে হাতেখড়ি। সে লেখালেখিতে প্রাণ এসেছিল অবনীন্দ্রনাথ নিজে বিশ্বজগৎ এর সেই নিত্য উৎসব-এ অংশ নিয়েছিলেন বলেই। লীলা মজুমদার তাঁর ‘অবনীন্দ্রনাথ’ বইতে তাই লিখেছিলেন, “অবনীন্দ্রনাথ নিজের ছোটোবেলাটি নিরেট সোনার মতন গালিয়ে ফেলে তাই দিয়ে গল্প তৈরি করেছেন, তাই পড়লে মন করে উড়ু উড়ু।” ঠাকুরবাড়ির সার্বিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছাড়া হয়তো এই উৎসবে অংশগ্রহণ করা সহজ হত না। আর এই পরিবেশটি গড়ে তুলতে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তাই অবনীন্দ্রনাথেরও আগে তিনি মৃণালিনী দেবীকে উৎসাহ দিয়েছিলেন বাংলার হরেক রূপকথার সংগ্রহশালা তৈরি করতে। এ সংগ্রহশালা অবশ্য কাঠ, পাথর, কাঁচ দিয়ে তৈরি নয়। তৈরি খাতার পাতা দিয়ে। মৃণালিনীর নিজের খাতায় লেখা থাকত বাংলার লোককথা। এরকমই একটি গল্প ‘ক্ষীরের পুতুল’। যেমনটি সে গল্প শুনিয়েছিলেন মৃণালিনী, তেমনটিই অবনীন্দ্রনাথ শুনিয়ে গেছেন বাংলার ছেলেমেয়েদের। এখনও শোনাচ্ছেন।
কথার থেকে রূপেই বেশি আগ্রহী ছিলেন বলেই কিনা কে জানে, সময় সময় রবীন্দ্রনাথের মনে ঠাঁই পেয়েছে শুধুই রূপকথার প্রেক্ষাপট, চরিত্ররা নয়। কার্ত্তিক মাসের এক জ্যোৎস্নারাতে আত্মমগ্ন রবীন্দ্রনাথ রূপসী বিশ্বচরাচরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে করতে ভাবছেন, রাজা রাজকন্যা পাত্র মিত্র কেউ নেই, পড়ে রয়েছে শুধু ‘তেপান্তরের মাঠ’ আর ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী’ (ছিন্নপত্র, ৩রা কার্ত্তিক, ১৮৯১)। বছরখানেক পর আরেক চিঠিতে আক্ষেপ করছেন— ‘গ্রীষ্মশীর্ণ ছোট নদীর শান্তস্রোত, উদাস বাতাসের প্রবাহ, আকাশের অখণ্ড প্রসার’-এর মধ্যে থেকে পড়ার মতন কোনও বই পাচ্ছেন না। জানাচ্ছেন এই পরিবেশে পড়ার একমাত্র উপযুক্ত গল্প হল বাংলার মেয়েলি রূপকথা, যেগুলি লিখতে হবে ‘সরল ছন্দে সুন্দর করে ছোটোবেলার ঘোরো-স্মৃতি দিয়ে সরস করে’ (ছিন্নপত্র, ৮ই এপ্রিল, ১৮৯২)। এই আক্ষেপটুকুই যে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ দূর করেছিল, সে কথা রবীন্দ্রনাথ আমাদের জানাবেন আরও বছর পনেরো পরে। রূপকথার এই চিত্রকল্পটি রবীন্দ্রনাথের ছোটদের জন্য লেখা কবিতাগুলিতেও ধরা পড়েছে। যেমন ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থের ‘খোকা’ কবিতায় দেখি রূপকথার রেশটুকু রাজা-রানির গল্প দিয়ে ধরা পড়েনি, সে রেশ রয়ে গেছে এক স্মৃতিসমাহিত রূপসী গাঁয়ে।
“শুনেছি রূপকথার গাঁয়ে
জোনাকি-জ্বলা বনের ছায়ে
দুলিছে দু’টি পারুল কুঁড়ি,
তাহারি মাঝে বাসা—
সেখান থেকে খোকার চোখে
করে সে যাওয়া-আসা” ইত্যাদি।
‘ঠাকুরমার ঝুলির’ অতি পরিচিত গল্প সাত ভাই চম্পা। সে গল্পে ঈর্ষা আছে, দুঃখ আছে, স্নেহ আছে, আছে প্রতিশোধস্পৃহা। এ গল্প পরিচিত মানবিক অনুভূতিগুলিরই সামাজিক প্রতিফলন মাত্র। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন ‘সাত ভাই চম্পা’ কবিতা লিখছেন (‘ঠাকুরমার ঝুলি’ বেরোনোর বছর চারেক আগে) সেখানে না রইলেন কোনও বড় রানি-ছোট রানি, না রইল কোনও সামাজিক ব্যাখ্যান। রয়ে গেল শুধু গ্রামবাংলার অপার রূপ। যা সার্থক রূপকথার মতনই শাশ্বত ও সুন্দর।
“দেখছে চেয়ে ফুলের বনে
গোলাপ ফোটে-ফোটে,
পাতায় পাতায় রোদ পড়েছে,
চিকচিকিয়ে ওঠে।
দোলা দিয়ে বাতাস পালায়
দুষ্টু ছেলের মতো,
লতায় পাতায় হেলাদোলা
কোলাকুলি কত।
গাছটি কাঁপে নদীর ধারে
ছায়াটি কাঁপে জলে—
ফুলগুলি সব কেঁদে পড়ে
শিউলি গাছের তলে।
ফুলের থেকে মুখ বাড়িয়ে
দেখতেছে ভাই বোন,
দুখিনী এক মায়ের তরে
আকুল হল মন” ইত্যাদি।
সাত ভাই চম্পা আর পারুল বোনকে নিয়ে পরে যখন গান লিখছেন রবীন্দ্রনাথ (‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’) তখনও রূপকথার চরিত্র নয়, উপজীব্য বিষয় হয়ে ওঠে রূপকথার রূপ— “তেপান্তরের পাথার পেরোই রূপ-কথার/ পথ ভুলে যাই দূর পারে সেই চুপ-কথার/ পারুলবনের চম্পারে মোর হয় জানা মনে মনে।।”
কবি বলেই কি রূপের এই সাধনা? গীতিকার বলেই কি চরিত্রের বদলে প্রাণ পেয়েছে চিত্র? হয়তো। একজন কবির চোখ আর একজন গদ্যকারের চোখ তো এক হয় না। তাই রবীন্দ্রনাথের রূপকথাসম ছোট গল্পগুলিতেও কবিতার ছোঁয়া রয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প মূলধারার রূপকথামাফিক চিরাচরিত ‘এক যে ছিল রাজা’-র সরলরৈখিক পথ ধরে এগোয়নি। এবং সেই পথে এগোয়নি বলেই রবীন্দ্রনাথের রূপকথায় বিষাদের পরশ জেগে থাকে, সে গল্প ছেলেভুলোনো আদৌ হয়ে ওঠে না। লিপিকা-র ‘রাজপুত্তুর’ গল্পে রাজপুত্তুর আসলে পাড়াগাঁয়ের গরিব ছেলে। তার রাজকন্যা ভিন জাতের বলে তাকে সহ্য করতে হয় অসহনীয় কষ্ট। দারিদ্র্য, সামাজিক বঞ্চনা নিয়েই এই রাজপুত্রের জীবনযুদ্ধ। তার জন্যও রবীন্দ্রনাথ সোনার কাঠি রেখে দিয়েছেন। কিন্তু সে সোনার কাঠি ছোঁয়ান স্বয়ং যম। এই অন্য রূপকথাতেও কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এসেছেন ‘তেপান্তরের মাঠ’ আর ‘সাত সমুদ্র’কে। তেপান্তরের মাঠ এক দীর্ঘ জীবনসংগ্রামের রূপক হয়ে দেখা দিয়েছে। আর সমুদ্র? সে অনাগত সুখের দিনের হাতছানি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘স্বপ্নের ঢেউ তোলা নীল ঘুমের’ মতন।
রবীন্দ্রনাথের রূপকথা ঈশপের নীতিকথা নয় অথচ মূলধারার রূপকথার অন্তর্নিহিত নৈতিকতাকে রবীন্দ্রনাথের থেকে স্পষ্ট করে কেউ তুলে ধরেননি। এমনকী দক্ষিণারঞ্জন, অবনীন্দ্রনাথরাও নন। দক্ষিণারঞ্জনের গল্পের শেষে দুঃখিনী দুয়োরানীদের দুঃখ ঘোচে, দুষ্টা সুয়োরানীরা কঠিন শাস্তি পান, কিন্তু সে সবই যেন ভাগ্যের খেলা এবং পাপের ফল। অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুতুল’-এও দুষ্টা রানি মারা যান, কিন্তু সে মৃত্যু হিংসায় জ্বলেপুড়ে মৃত্যু। দক্ষিণারঞ্জন বা অবনীন্দ্রনাথদের ভালো চরিত্ররা নিতান্তই ভালো, খারাপরা একপেশে খারাপ। সেখানে রবীন্দ্রনাথের সুয়োরানীর সঙ্গে বাকি সুয়োরানীদের নামটুকু ছাড়া আর বিশেষ মিল নেই। ‘সুয়োরানীর সাধ’ গল্পে শেষ শয্যায় সুয়োরানী তার স্যাঙাৎনিকে বলে “ঐ দুয়োরানীর দুঃখ আমি চাই… ওর ঐ বাঁশের বাঁশিতে সুর বাজল, কিন্তু আমার সোনার বাঁশি কেবল বয়েই বেড়ালেম, আগলে বেড়ালেম, বাজাতে পারলেম না।” সুয়োরানীরাও যে মানুষ, নিছক রাক্ষুসী (আক্ষরিক অর্থেই হোক বা রূপকার্থে) যে নন, সে কথা কিন্তু বাকি রূপকথার গল্পে ধরা পড়ে না।
রূপকথা যে শেষমেশ আমাদের নিজেদেরই গল্প, বড় মানবিক এক আখ্যান, সে কথা রবীন্দ্রনাথের রূপকথারা বারে বারে জানায়। সে গল্পে দৈবিক শাস্তি নেই, অলৌকিক স্বপ্নপুরী নেই, নেই রোমাঞ্চকর আখ্যান। জনপ্রিয় রূপকথার নিরিখে, সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠকের চাহিদার হিসাবে হয়তো এই ‘নেই’কথা নিছক খামতি। কিন্তু ওই যে বলছিলাম, কথা নয় রূপ দিয়েই সেসব খামতি তাঁর নিজের মতন করে ঢেকে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। একটা উদাহরণ দিই? গ্রিম ভাইদের ব্যাঙই হোক বা ‘ঠাকুরমার ঝুলি’-র বানর, গল্পের শেষে তারা সবাই সুপুরুষ রাজপুত্রে বদলে যায়। আর রবীন্দ্রনাথের পরী (‘পরীর পরিচয়’, লিপিকা)? সেই যে কালো পাথরে নিখুঁত করে খোদাই করা একরাশ কালো চুলের প্রতিমা, যাকে দেখে সবাই ছি ছি করে উঠেছিল, সে কি গল্পের শেষে স্নো-হোয়াইট রাজকন্যেটি হয়ে দেখা দেয়? না তো। পরী-বউয়ের সঙ্গে শুভদৃষ্টির মুহূর্তটিতে রাজপুত্র চোখ খুলে দেখে কাজরী নামের পরীটি কোথাও নেই। বদলে বিছানার সাদা চাদরের ওপর জড়ো হয়ে আছে একরাশ কুন্দফুল, তার ওপর এসে পড়ছে জ্যোৎস্নারাতের আলো।
রবীন্দ্রনাথের পরীর ডানা খসে যায় না। চলে গিয়ে সে জানিয়ে যায় আসলেই সে পরী। যে দেখতে জানে সেই শুধু দেখতে পায়। আর যার ভাগ্য অত ভালো নয় তার জন্য রয়ে যায় কিছু কুন্দশুভ্র শুভেচ্ছা।
অলংকরণ – মাজহার নিজারের ছবি অবলম্বনে
Leave a Reply