সানু আর চিনু ওদের নতুন ছাদে বসে গল্প করছিল। একফালি একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। ক’দিন পরেই অমাবস্যা হবে। সানুর ক্লাস ক্লাস টেন, চিনুর ফাইভ। রান্নাঘর থেকে মা হাঁক পাড়তেই চিনু বলল, “দিদিভাই, শিগগির চল। মা রাগ করবে।”
– দাঁড়া না, বাবা-ই তো এখনও এল না। কেবল সন্ধে লেগেছে। চাঁদটা দ্যাখ, কেমন পাতলা নখের মতো।
– না রে, আমি আর থাকব না। বকবে তো আমাকে।
– দাঁড়া দাঁড়া, আমিও যাচ্ছি। একা একা এখানে আমার পোষাবে না। তুই বড্ড ভিতু রে।
চিনু পা বাড়াতেই সানুও উঠে দাঁড়াল।
– এই দিদিভাই, ওগুলো কী রে? কালো-কালো সুপুরির মতো।
– এই ন্যাড়াছাদে তুই সুপুরি কোথায় দেখলি?
– ওই তো সিঁড়িটার কোণে। ওঠার সময় আমার পায়ে লেগেছিল। কেমন যেন নরম-নরম।
– এ মা, ওটা তো ভূতের ইয়ে।
– যাহ, ভয় দেখাবি না কিন্তু।
– যাহ কী রে! মানুষ, গোরু, ঘোড়া, টিকটিকি, আরশোলার হয়, আর ভূতের হবে না। বেঁচে থাকার জন্য ওরাও তো খাওয়াদাওয়া করে। ঘাড় মটকে মানুষের রক্ত খায়। শ্মশান-মশানে ঘুরে ঘুরে মানুষ, গোরু, ছাগলের বাসি মড়া খায়, রান্নাঘর থেকে মাছভাজা চুরি করে খায়। তো, সব কি আর হজম হয়? পটি তো করতেই হয়।
– দিদিভাই, তুই কিন্তু বাজে কথা বলছিস। আমি এত ভূতের গল্প পড়েছি, কেউ এসব কথা লেখেনি।
– তা বলে কি সত্যকে গোপন করা যায়? সেটা আপনিই বর্ণে-গন্ধে ফুটে ওঠে। তুই মাড়িয়ে দিয়েছিস নাকি?
– না তো। মানে, মনে হয় অল্প একটু লেগেছিল। মাড়ালে কী হয় রে দিদিভাই?
– হাড়-ঘুলঘুলি হয়।
– ধ্যাৎ, বেশি সাঁতরাগাছি করিস না। ঠিক করে বল না কী হয়।
– কী মুশকিল, বললাম তো হাড়-ঘুলঘুলি হয়।
– সেটা কি খুব খারাপ অসুখ নাকি রে?
– তা বলতে পারিস। মানে, ব্যাপারটা কী জানিস? হাড়ের ভেতরে সরু সরু অসংখ্য ফুটো হয়ে যায়।
– কী যে বলিস!
– আরে বাবা, মাংসের ভেতরে খুব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম টানেলের মতো তৈরি হয়ে যায়। টানেলগুলো মাংস, হাড় ভেদ করে একবারে ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
– তারপর?
– তারপর বাতাস বইলেই ওই ফুটোগুলোর ভেতর দিয়ে হাওয়া চলাচল করে, আর নানারকম স্কেলে বাঁশির মতো আওয়াজ বেরোতে শুরু করে।
– এই দিদিভাই, আমার পায়ে একবার হাত দিয়ে দেখ না, প্লিজ।
– তোর কোনও ভয় নেই, আমার অ্যান্টিভেনম জানা আছে।
– অ্যান্টিভেনমের চেম্বার কোথায় রে দিদিভাই?
– সে আছে। তারপর শোন না। ওই বাঁশির আওয়াজ পেলেই ভূতগুলো বুঝে ফেলে। সে তখন বাতাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে ওই সূক্ষ্ম টানেলের ভেতর দিয়ে ঘুলঘুলাইয়ার ভেতরে ঢুকে পড়ে। তারপর কী হয় জানিস। যার এ রকম হয়, সে আর জুতো পরতে পারে না। তার মানে, যে পায়ে হাড়-ঘুলঘুলি হয়েছে, সেটা বায়ু চলাচলের জন্য এত হালকা হয়ে যায় যে, জুতো পরলে সে জুতো টেনে তোলারও ক্ষমতা তার পায়ের আর থাকে না।
– এই দিদিভাই, আমার ডান পা-টা একটু দেখ না।
– বলেছি না, আমার ওষুধ জানা আছে। খামোকা ভয় পাচ্ছিস কেন। আমাদের ক্লাসের তনিমার হয়েছিল। সকালে চান-টান করে খেয়েদেয়ে স্কুলে যাবে বলে পথে নেমেছে, অমনি উত্তুরে হাওয়ায় ওর পায়ে বাঁশি বাজতে লেগেছে। কখনও আবার দু-একটা পরিচিত গানের সুরও বাজতে শুরু করেছে। একবার তো ‘ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’-এর মতো কিছুটা বেজেই চেঞ্জ করে ‘একবার বিদায় দে মা’ হয়ে গেল। রাস্তার লোকজন আড়ে আড়ে তনিমাকে দেখছে। তনিমার বাঁ পা-টা কেমন অবশ হয়ে আসছিল। সাতদিন স্কুল কামাই। সব ডাক্তার ফেল। মায় নেপাল কবিরাজ। শেষে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমিই ব্যাপারটা ধরলাম। তারপর ব্যস! এক ডোজেই বাবা ভূতেশ্বর মিশমিশে পালাবার পথ পায় না। তবে একটা লাভ হয়েছিল তনিমার। ‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী’ গানটার অন্তরায় এসে ওর সুর গুলিয়ে যেত। সেটা অ্যাকিউরেট তুলতে পেরেছিল।
– তারপর কী হল রে দিদিভাই?
– শোন, তারপর কী হয়। যে পায়ে হাড়-ঘুলঘুলি হয়, সে পায়ে খুব হালকা চপ্পল পরা যায়, কিন্তু পরা উচিত নয়।
– কেন, কেন উচিত নয়?
– ভূতেরা জুতো পরা একদম পছন্দ করে না। কেন জানিস? ওদের জুতোর ফিতে বাঁধতে খুব অসুবিধে হয়। ওদের পাগুলো গোড়ালির কাছে গিয়ে উলটো তো। আমরা যেমন সামনে ঝুঁকে জুতোর ফিতে বাঁধি, ওরা তো তেমন পারে না। ওদের উলটো দিকে আর্চ করে বাঁধতে হয়। সব ভূতের পক্ষে তো সেটা সম্ভব নয়। হ্যাংলাপ্যাংলা হলে পারতে পারে। কিন্তু যদি নমিতাদির মতো গদাই হয়, তবে সেটা অসম্ভব ব্যাপার। সব ভূতের মেরুদণ্ড তো নমনীয়, মানে মাখনের মতো তেউড়ে যাবে, নবনীয়ও বলতে পারিস, তা হয় না।
– দিদিভাই, চল নিচে যাই। বাবা মনে হয় এসে গেছে।
– দূর দূর, বাবা এলে এতক্ষণে ম্যাও ম্যাও করে তানপুরার আওয়াজ পেতি না। শোন না, ইন্টারেস্টিং জায়গায় এসে গেছি। ভূতেদের মেরুদণ্ডের এই যে খামতি, জুতো পরতে না পারা — জাপানি ভাষায় এর একটা সংক্ষিপ্ত নাম আছে।
– খামোখা জাপানিরা আবার ভূত নিয়ে মাথা ঘামাবে কেন? ওরা তো শুনেছি বিজ্ঞানে অনেক উন্নতি করেছে।
– আরে সেটা করেছে বলেই তো যা কিছু রহস্যময়, সেগুলোর জট খোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হাই-টেকের ব্যাপার তো। একবার যদি কেসটা ধরে ফেলতে পারে, তবে ওদের পায় কে! চুটিয়ে ব্যবসা শুরু করবে। মাইক্রোচিপ জুড়ে জুড়ে এমন এক-একটা ভূত বানাবে, যারা কিমোনো পরে কাবুকি মুখোশ পরে নাচতে নাচতে সমস্ত মেড ইন ইউ এস এ-মার্কা যন্ত্রপাতি বিগড়ে দিয়ে সায়োনারা বলে চলে আসবে।
– আচ্ছা দিদিভাই, ভূতেদের এই অসুখের একটা সংক্ষিপ্ত নাম আছে না?
– হ্যাঁ, নিশিরাতেমিশিকালো। শোন, কেন হঠাৎ জাপানিরা ভূতের ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়ল। ব্যবসা ছাড়াও অন্য কারণ আছে।
– কী আবার অন্য কারণ?
– আরে ওদের রোবট কারখানায় যে রোবটগুলো নষ্ট হচ্ছিল, সেগুলো সব ভূত হয়ে যাচ্ছিল। তারপর বহুত ঝামেলা পাকাচ্ছিল।
– কী বলিস, রোবটের ভূত?
– কেন হবে না বল। ওরা রোবটগুলো অবিকল মানুষের মতো এত নিখুঁত করে বানাচ্ছিল যে, আসল মানুষের সব ইতিহাস, ভূগোল, মায় ওয়ার্ক-এডুকেশন পর্যন্ত ওরা জেনে গিয়েছিল। ওরা জানত মানুষ মরে গেলে ভূত হয়। ওরা চাইত না যে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ওদের জীবনটা বাতিল লোহালক্কড়ের জাঙ্কে শেষ হোক। আসলে ভেতরের একটা তীব্র চাহিদা থেকে ওরাই ওদের ভূত তৈরি করে নিত। রোবট নষ্ট হলে জাপানিরা আর সেগুলো সারানোর চেষ্টা করে না। ওতে নাকি সময় বেশি নষ্ট হয়। সঙ্গে সঙ্গে হুবহু ওই নম্বরের আর একটা রোবট এসে যায়। কিন্তু ওই যে বলে ‘ঢেঁকি সগ্গে গেলেও ধান ভানে’। রোবটের ভূতগুলো রাতারাতি সব কাজ করে রাখত। তাও ধরা পড়ত না। জাপানিরা ভেবেছিল কোনও এক অজ্ঞাত কারণে রোবটদের কর্মক্ষমতা দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
– তা, ধরা পড়ল কী করে?
– সে এক মজার ব্যাপার। সারা পৃথিবীতে যত বাটার দোকান আছে, সব দোকান থেকে এগারো নম্বর জুতো ভ্যানিশ হতে লাগল। কিছুতেই চোর ধরা পড়ে না। ভারতীয়রা বলতে লাগল এর পেছনে পাকিস্তানের হাত আছে। ওরা নাকি এগারো নম্বর জুতোর চামড়া, মেহেন্দি পাতা আর প্যাঁজরসুন দিয়ে পারমাণবিক চুল্লিতে চোলাই করে একটা ভয়ঙ্কর অস্ত্র তৈরি করেছে। নাম দিয়েছে ‘আশমানি-আল-পয়জার’। পাকিস্তানিরা বলল, এর পেছনে ইজরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার হাত আছে। কম্যুনিস্ট দেশগুলো সবাই একসুরে বলল, এর পেছনে সাম্রাজ্যবাদীদের কালো হাত দিনের আলোর মতো পষ্ট।
– তাহলে, আসলে ব্যাপারটা কী হয়েছিল?
– আসলে ব্যাপারটা হয়েছিল, রোবটের ভূতগুলোর পা কিন্তু গোড়ালির কাছে গিয়ে উলটো হল না। সোজাই হল। আর, অমনি ওদের জুতো পরার শখ হল। রোবটের ভূত বলে কথা। ভূতেদের সমাজে ওদের খাতিরই আলাদা। আদ্যিকালের মামদো, পেঁচো, ব্রহ্মদৈত্যি — এরা তো ভূতজগৎ থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে। ওদের সেন্ট্রাল কমিটি ভাবছিল পুরনো আমলের ভূতেদের জন্য একটা অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করবে। জায়গা-জমি দেখাশোনা চলছিল। কলকাতায় ট্রেজারির কাছে একটা জায়গা ওদের পছন্দও হয়েছিল।
– আচ্ছা দিদিভাই, এরা সমস্ত উন্নত দেশ ছেড়ে কলকাতায় ট্রেজারির কাছে এল কেন?
– মানুষজন বলাবলি করে ‘সরকারি পয়সা বারো ভূতে খায়’। কথাটা কেমন করে যেন ওদের কানেও পৌঁছেছিল। ওরা ভাবল খাবার যদি হাতের সামনেই থাকে, তবে আর ফালতু ঘাড় মটকানোর পরিশ্রম করার কী দরকার। বারো গোত্রের ভূতের একটা ফর্দ বানাল ওরা। রেলগোত্র, দড়িগোত্র, কেরোসিন গোত্র, ফলিডল গোত্র, মেট্রোগোত্র, দড়িকলসি গোত্র — এই রকম। পরে একটা উড়ো খবর শুনে ওরা পিছিয়ে যায়।
– নিশ্চয় টাকাপয়সা জোগাড় করতে পারেনি।
– কী যে বলিস। দশজন অনাবাসী ভূত। তাদের মধ্যে দু’জন যক্ষ। টাকা দেবার জন্য ঝুলোঝুলি।
– তবে?
– হঠাৎ ওরা শুনল কী একটা গোলমাল হয়েছে। সব লোকজন ট্রেজারি দেখিয়ে বলছে, এখানে ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ হচ্ছে। ব্যস, ওই শুনেই ওরা ভয় পেয়ে গেল। ক্যানসেল করে দিল পরিকল্পনা।
– দিদিভাই, রোবট ভূতগুলোর শেষ পর্যন্ত কী হল রে?
– শোন, রোবট ভূতগুলোর বাবুগিরির ঠ্যালায় বাটার দোকানের এগারো নম্বর সব জুতো ভ্যানিশ। বাঘা বাঘা গোয়েন্দা ফেল। শেষতক চোর ধরলেন স্কটলেনের ইনেস্পেক্টর বার ম্যান। তুই দেখেছিস তো, আমাদের বাড়িতে এসেছে। সেই যে, অনেকটা বাঁটুল দি গ্রেটের মতো চেহারা।
– ও, তাই বল। বর্মনকাকু। শুধু শুধু বার ম্যান বলছিস কেন?
– আরে বাবা, ওদের নাম ওভাবেই বলতে হয়। ইজ্জত বাড়ে। এই যে বারাসতের মানিক সাহা, মিলিটারিতে গিয়ে জেনারেল মানেক শ হয়ে গেল। ঠাকুরপুকুরের নিখিল সেন বিলেতে গিয়ে হয়ে গেলেন নিকলসন। ভাই জানকী সেনকে নিয়ে রঙের ব্যবসা শুরু করে এখন রমরমা অবস্থা। তারপর ধর তোর গৌহাটির নিলু বড়ুয়া। কতবড় বৈজ্ঞানিক ছিলেন। কিন্তু আমরা তাঁর কদর বুঝলাম না। উনিও মনের দুঃখে ভারত ছেড়ে একেবারে ডেনমার্কে চলে গেলেন। কী সব আবিষ্কার করে একেবারে নোবেল প্রাইজ পেয়ে গেলেন। পরে অবশ্য নামটা পালটে নীলস বোর করে নিয়েছিলেন। আরও আছে। কাঁকিনাড়ার অমূল্য সেন বৃটিশ সরকারের কাছে কত করে অনুরোধ জানিয়েছিল দক্ষিণ মেরু আবিষ্কারে যাওয়ার জন্য। বৃটিশ সরকার কিছুতেই অনুমতি দিল না, পাছে একজন ভারতীয় পৃথিবীবিখ্যাত হয়ে যায়। অমূল্য সেন বাড়ি থেকে পালিয়ে নরওয়েতে গিয়ে ওদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে উনিশশ এগারো সালে দক্ষিণ মেরু জয় করলেন। তখন অবশ্য তাঁর নাম হয়েছে আমুন্ড সেন। বুঝলি তো, নামে অনেক কিছুই আসে যায়। তো সেই বার ম্যান কাকুই শেষ পর্যন্ত রহস্যভেদ করতে পারল।
– কেমন করে ধরল রে?
– ও তুই বুঝবি না। ইদানীং ভূতের উপদ্রব খুব বেড়ে যাওয়ায় লালবাজারে একটা ভূতদমন শাখা খোলা হয়েছিল। নানারকম টোপ দিয়ে খেলিয়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছিল। শুনেছি বার ম্যান কাকু এগারো নম্বর মোকাসিনোর টোপ দিয়েছিল। তারপর একটি ধরা পড়তেই সড়াৎ সড়াৎ করে সবগুলো ধরা পড়তে লাগল।
– আচ্ছা দিদিভাই, একটা সত্যি কথা বল তো…
– তুই কি মনে করিস আমি সব মিথ্যে কথা বললাম। থাক তুই ছাদে একা। আমি চললাম।
– বা রে, আমি কি তাই বলেছি। আমি শুধু জানতে চাইছি ওই যে জাপানি অসুখটা বিদ্ঘুট্টি নাম বললি, ওটা তুই কোথায় শুনেছিস।
– কেন, অন্যের কাছে শুনতে যাব কেন। জানিস না, ভূগোলে আমাদের জাপানের প্রধান প্রধান বন্দরের নাম মুখস্থ করতে হয়। মাধ্যমিকের পড়া তুই কী বুঝবি।
– ও, তোদের ভূগোল বই-এ বুঝি ‘জাপানি ভূতের রোগ ও তাহার চিকিৎসা’ বিষয়ে একটা অধ্যায় আছে?
– দেব কষে এক চাঁটি, চলে যাবি বৈদ্যবাটি।
– ও মা দ্যাখো, দিদিভাই আম…
– চুপ চুপ, বলছি শোন। ও কী রে, ঢেকুর তুলছিস আর মুখটা ওরকম বেঁকেচুরে যাচ্ছে কেন তোর?
– মাকে বলিস না, স্কুলে মাংসের চপ খেয়ে ছিলাম একদিন। তারপর থেকেই এ রকম হচ্ছে। মনে হয় গ্যাস্টিকালচার হয়েছে।
– আচ্ছা, আজকাল টিফিনে এসব খাওয়া হচ্ছে।
– বা রে, শ্যাফালি খাওয়াল যে।
– কী বললি, কে খাওয়াল?
– শ্যা…ইক্, শেফালি। জানিস আমাদের নতুন বাংলা দিদিমনি সব এ-কার ওয়ালা শব্দ গুলো অ্যা-কার দিয়ে বলেন। ভ্যাস্পা, ন্যাপাল, তাহার মাঝে আছে দ্যাশ অ্যাক সকল দ্যাশের স্যারা, ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দ্যাশ স্মৃতি দিয়ে ঘ্যারা। কেউ হাসলে বলেন, ব্যাঞ্চের উপ্রে খাড়াও। ল্যাখাপড়া শিখতাছ, না ঘুরার ডিম। ব্যাত দিয়া সিধা করন লাগে। আবার অ্যা-কারের শব্দগুলো বলেন এ-কার দিয়ে। যেমন ধর, গ্যাসকে বলেন গেস। বেসার্ধ, জামাপেন্ট, পাঁঠাটি বেঁ বেঁ করিয়া ডাকিতেছে। এখন হে হে করে হাসছ, পরে ভে ভে করে কাঁদতে হবে। দিদিভাই রে, আমার ডান পা-টা কেমন অবশ-অবশ লাগছে। তোর সেই অ্যান্টিগোনাস, না কী যেন ওষুধ একটু দিবি?
– দিতে পারি, দাম দিতে পারবি?
– ধুস, সেই ভূতগুলোর কী হল বল না?
– তুই না একদম ধৈর্য রাখতে পারিস না। কোনওদিন তোর উন্নতি হবে না। বাবাকে দেখিস না কতদিন ধরে নিরেগামাপা করে যাচ্ছে। ও পাশের তিলুদের বাড়িতে ছ’মাসের বেশি ভাড়াটে থাকে না, তবু বাবা কোনওদিন ধৈর্য হারিয়েছে?
– ভূ…
– বলছি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কথা বলতে পারব না। কলকাতাতে ধরা পড়েছিল পাঁচশ ছাপান্নটা। সব বার ম্যান কাকুর টোপে। জাপান সরকার কাকুকে ‘মিশিকালো’ পুরস্কার দিয়েছিল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কালাহারু কাকুর হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছিল। সেদিন টোকিওর ফোটোগ্রাফারদের ধর্মঘট ছিল, তাই ছবিটা কাকুর কাছে নেই। ধরা পড়তেই ভূতগুলোর সে কী কান্না। ওরে ওমেগা রে, ও বাইনারিকাকু, ও সিলিকনমামা, হায় হায় আমার আই সি গেল রে। তবে উনিও দারোগা বটে। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে এমন দাবড়ানি দিয়েছেন, ভূতে-ওঝায় এক ঘাটে জল খাওয়ার অবস্থা।
– বার ম্যান কাকুর সাহস আছে তো।
– ট্রেনিং ছিল তো। ভূতেদের তো আর বন্দুক-পিস্তল-জলকামান দেখিয়ে লাভ নেই। কাকু শুধু বলেছেন, চোপ, সবকটাকে একদম মার্বেল করে দেব। ব্যস, ম্যাজিকের মতো কাজ হয়েছে। সবক’টা পিলপিল করে ভ্যানে গিয়ে বসেছে।
– মার্বেল শুনেই ভূতগুলো ভয় পেয়ে গেল?
– তুই জানিস না? ভূত-দমন শাখার থিওরেটিক্যাল ক্লাসে ভূত-বিশেষজ্ঞ লেখকদের বই পড়ানো হয়। সেই বইয়ে আছে — ভূত মরিয়া মার্বেল হয়।
– তারপর?
– তারপর আর বলিস না। সে বড় দুঃখের কথা।
– ও মা, সে কী রে…
– হ্যাঁ রে, এমনি এমনি কি আর কাকু বাবার কাছে এসে বসে রামপ্রসাদী শোনে।
– দুত্তোর, আসল কথাটা বল না।
– আসল কথা শুনবি? গাড়ি এসে যখন থানার সামনে দাঁড়াল, ভেতরে একটিও কয়েদি নেই।
– তারপর?
– বার ম্যান কাকুর তো চাকরি নিয়ে টানাটানি। দেখিস না বাবার কাছে শুকনো মুখে বসে থাকে।
– তো বাবা কী করবে?
– তুই জানিস না, বাবা পুলিশ কমিশনারের শালীকে গান শেখায়।
– কিন্তু ভূতগুলো গেল কোথায়?
– গেল কোথায়, সেটা আমি আন্দাজ করেছি। কিন্তু বলব কাকে। একদিন কাকুকে বলতে গেলাম, ঠিক ওই সময়েই বাবা ‘দোষ কারও নয় গো মা’ শুরু করে দিল। তোর কাছে বলে কোনও লাভ নেই। ভাবছি খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেই চিঠি লিখে সব জানিয়ে দেব। নাগরিক হিসেবে সমাজকে ভূতমুক্ত করার একটা দায়িত্ব তো আমার আছে।
– দিদিভাই, সব ঠাকুরের দিব্যি। প্লিজ, বল না।
– শোন, প্রিজন ভ্যান থেকে পালানো কোনও সমস্যাই নয়। আজকাল যদু-মধু ছিঁচকে চোরও ভ্যান থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। আর এ তো রোবটের ভূত। আসলে ‘মার্বেল’ শোনার পর থেকেই ওরা কেতরে গেছিল। যে করেই হোক পালাতে হবে। দু-একটা সিনিয়ার ভূত কেরামতি দেখিয়ে দিল। ব্যস, টপাটপ বেরোতে লাগল সব। আর বিভিন্ন জায়গায় সেঁধিয়ে যেতে লাগল। কিছু গেল নামকরা সংবাদপত্রের অফিসে। কিছু টিভি, কিছু রেডিও-স্টেশনে। একটা বড় দল একদলা জমাট অন্ধকারের মতো সাঁৎ করে টেলিফোন ভবনে ঢুকে পড়ল। কতগুলো রোগাপটকা ঢুকল হাসপাতালে। সেটা ইলেকশনের বছর ছিল। বেশ কয়েক’শ ঢুকে পড়ল নির্বাচনী কার্যালয়ে। ব্যস, সেই যে ঢুকল, আর বেরোনোর নাম করে না। একেবারে মৌরসীপাট্টা। নড়েও না, চড়েও না। যা খুশি তাই করে যাচ্ছে। কেউ কিছু বুঝতেই পারে না। দিব্যি আছে। যে তারিখে ওরা ভ্যান থেকে পালিয়েছিল, সেই তারিখের রাত্রিবেলা ওরা ‘আন্তর্জাতিক ভূত-নিশীথ’ পালন করে। খুব ধুমধাম হয়। ব্যান্ডেল, সাঁওতালডি, কোলাঘাট, জলঢাকা, ফরাক্কা — সব ক’টি ইউনিট বিকল হয়ে যায়। সমস্ত টেলিফোন স্তব্ধ হয়ে পড়ে। হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার, পেশেন্ট, নার্স, আয়া — সবাই একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে। রাস্তার কুকুর এসে সদ্যোজাত শিশু খেয়ে যায়। বিভিন্ন প্রেসে গিয়ে ওরা ইচ্ছেমতো ম্যাটার সাজায়। বাঙালি ঘোষককে দিয়ে জাপানি উচ্চারণে বাংলা বলায়। নিজেরা ইচ্ছেমতো ভোটার লিস্টে নাম তোলে, নাম কাটে। মানে, যা খুশি তাই করে।
– দিদিভাই, তুই এত জানলি কী করে?
– যে আমাকে অ্যান্টিভেনম দিয়েছে, সে-ই বলেছে।
– এর থেকে মুক্তির কোনও উপায় নেই?
– আছে। সেটাই এবার চিঠি লিখে জানাব।
ছবি – অরিজিৎ ঘোষ
গল্পটি টগবগ উৎসব সংখ্যা ১৪২৪-এ প্রকাশিত
Leave a Reply