ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব বা www-এর আবিষ্কার

৩০ এপ্রিল ইন্টারনেটের জন্মদিন। কথাটা একটু ভুল বলা হল। ৩০ এপ্রিল জন্ম হয়েছিল ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব-এর। যাকে আমরা জানি www নামে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব— বিশ্বজোড়া জাল। আমরা সাধারণভাবে যাকে ইন্টারনেট বলি, সেটা আসলে এই www-র থেকে একটু আলাদা। ইন্টারনেটকে বলা যেতে পারে কাঠামো, যার ওপর ভিত্তি করে www গড়ে উঠেছে। খুলে বলি।

 

ইন্টারনেট-এর কাজ শুরু হয়েছিল গত শতকের ছয়ের দশকের মাঝামাঝি। রাশিয়া যখন ১৯৫৮ সালে স্পুটনিক ওয়ান-কে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ হিসাবে মহাকাশে পাঠাল, তখন বিশ্বের আরেক মহাশক্তিধর দেশ আমেরিকা নড়েচড়ে বসল। তারা ভয় পেতে শুরু করল। রাশিয়া যদি মহাকাশে একটা উপগ্রহ পাঠাতে পারে, তাহলে আমেরিকাকে তাক করে একটা মিসাইল ছুঁড়তে কতক্ষণ! আর যদি সেই মিসাইলের লক্ষ্য হয় আমেরিকার কোনও গবেষণাগার? সেই সংস্থার যা-যা তথ্য-তত্ত্ব মুজুত করা ছিল, সব ধ্বংস হয়ে যাবে। অতএব দরকার এমন ব্যবস্থা, যাতে গবেষণাগার বা সামরিক সংস্থার নানা তথ্য মজুত করে রাখা কম্পিউটারগুলোকে একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে ফেলা যায়। এতে করে, একটা কম্পিউটার বা একটা জায়গার একাধিক কম্পিউটার কাজ না করলেও কোনও তথ্য হারিয়ে যাবে না। জন্ম নিল Advanced Research Projects Agency Network বা ARPANET, প্রথম নেটওয়ার্ক যা বিস্তীর্ণ একটা জায়গার কম্পিউটারের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তুলল। টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে আগে শুধুমাত্র শব্দের আদানপ্রদান ঘটত। চেষ্টা চালানো হল, যাতে শব্দের বদলে তথ্যের ছোট ছোট অংশ, যাকে তাত্ত্বিক পরিভাষায় প্যাকেট বলা হয়, অর্থাৎ তথ্য বা ডেটার প্যাকেট পাঠানো যায়। আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগে প্রথম স্থাপিত হল এই নেটওয়ার্ক। প্রায় এক দশকের চেষ্টায় ১৯৭৫ সালে সরকারি গবেষণাগার এবং সামরিক সংস্থাগুলোর ব্যবহারের জন্যে খুলে দেওয়া হল ARPANET-কে। পাশাপাশি চলছিল আরও একটা প্রচেষ্টা। কম্পিউটার জুড়ে জুড়ে যেমন নেটওয়ার্ক তৈরি হচ্ছে, তেমন করে যদি অনেকগুলো নেটওয়ার্ক জুড়ে আর একটা বড় নেটওয়ার্ক বানানো যায়। এইভাবে এল ইন্টার-নেটওয়ার্ক বা আন্তঃ নেটওয়ার্কের ধারণা। এই ইন্টারনেটওয়ার্কই চলতি ভাষায় হয়েছে ইন্টারনেট।

এবার আসি www বা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের প্রসঙ্গে। টিম বার্নাস-লি নামে এক তরুণ স্বপ্ন দেখতেন কম্পিউটার শুধুমাত্র প্রোগ্রামিং-এর কাজই করবে না, সে ভাবনাচিন্তাও করবে। তথ্য খুঁজে পেতে মানুষকে সাহায্য করবে। টিমের জন্ম ১৯৫৫ সালে। বাবা-মা দুজনেই গণিতজ্ঞ। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সময় বাজারে আসা মার্ক ওয়ান কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং করতেন। টিম তাই ছোটবেলা থেকেই কম্পিউটারের সাহচর্যে বেড়ে ওঠেন। তিনি চাইতেন কম্পিউটার শুধুমাত্র প্রথামাফিক অঙ্কই কষবে না, বাঁধা ছকের বাইরে গিয়েও সে কাজ করবে। যেমন ধরো, আমার মাথায় একটা শব্দ এল— কুলের আচার। আমি শুধুমাত্র এটাই ভাবব না কুলের আচার কীভাবে তৈরি হয় বা তাতে কী কী উপাদান দেওয়া হয়। আমি ‘কুলের আচার’ শব্দ উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুপুর রোদে ছাদে বসে বয়ামের মধ্যে থেকে আচার চুরি করে খাওয়ার কথাও কল্পনা করব।

টিম বার্নেস লি

কিন্তু তখনও কম্পিউটারকে এইভাবে ব্যবহার করার কথা কেউ ভাবেনি। কম্পিউটারে তথ্য জমা করা হত। কিন্তু সেই তথ্য ব্যবহার করে অন্য কাজে লাগানোর কথা কারও মাথায় আসেনি। টিম ১৯৮০-তে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় শার্ন (CERN) ল্যাবরেটরিতে কাজ শুরু করলেন কনট্রাক্টর হিসাবে। যদিও শার্ন ল্যাব পার্টিকল ফিজিক্সের জন্যে বিখ্যাত। কিন্তু টিমের কাজ সেখানে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারের। তিনি শার্নের বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের বোঝাতে শুরু করলেন, এমন একটা ব্যবস্থা যদি করা যায় যাতে করে একে অপরের পরীক্ষার ফলাফল তাঁরা দেখতে পান, তাহলে সবারই সুবিধা হয়। একটা পরীক্ষার ফলাফল সহজেই অন্য আর একটা পরীক্ষায় ব্যবহার করা যায়। কিন্তু সবাই যে যার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। কেউই তাঁকে সেভাবে পাত্তা দিলেন না।

সেই বছর শার্ন ছেড়ে টিম যোগ দিলেন ইমেজ কম্পিউটার সিস্টেমস্‌ লিমিটেড নামে এক কোম্পানিতে। সেখানে তিনি কাজ করতে লাগলেন কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং নিয়ে। একটা কম্পিউটার কী করে কাজ করতে পারে আরেকটা কম্পিউটারের সঙ্গে এই ছিল টিমের কাজের বিষয়। ফলে ইন্টারনেট সম্পর্কে ধীরে ধীরে সড়গড় হয়ে উঠলেন। তিন বছর সেখানে কাজ করে ১৯৮৪-তে টিম আবার ফিরে এলেন শার্ন ল্যাবে। সেখানে অবস্থা তখন আরও গুরুতর। গবেষণার নানা তথ্য কম্পিউটারে তুলে আনতে প্রোগ্রামাররা গবেষকদের নিত্যনতুন বিধিনিষেধের মুখোমুখি করছেন। এরই মাঝে টিমের নজরে এল হাইপারটেক্সটের ধারণা। যাঁরা লাইব্রেরিতে কাজ করেন, তাঁরা এই হাইপারটেক্সট নিয়ে তখন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। নানা বই আর ডকুমেন্টের মধ্যে একটা যোগসূত্র তৈরি করছেন তাঁরা। আগে বই খুঁজতে বইয়ের নাম, লেখকের নাম এসব তথ্য ব্যবহার করা হত। হাইপারটেক্সটের মাধ্যমে চেষ্টা করা হতে থাকল একটা নির্দিষ্ট বর্ণনা বা একটা বাক্যের অংশ দিয়ে কীভাবে বই খোঁজা যায়। সেই শব্দ বা বাক্যের সঙ্গে যোগ আছে এমন সমস্ত বই, দলিল, দস্তাবেজ খুঁজে ফেলার এই প্রয়াস একেবারেই টিমের ভাবনার সঙ্গে মিলে গেল। ‘কুলের আচার’ দিয়ে সার্চ করলে শুধু তার উপাদান বা তৈরির প্রক্রিয়াই নয়, সেই সম্পর্কে আমাদের স্মৃতি, আমাদের জমে থাকা গল্পও উঠে আসবে।

 

টিম ইন্টারনেট আর হাইপারটেক্সটের ধারণা একসঙ্গে মিলিয়ে দিলেন। ১৯৮৯-এ তিনি তাঁর ওপরওয়ালাকে একটা খসড়া প্রস্তাব দিলেন। আবারও খুব বেশি পাত্তা তিনি পেলেন না। তবে এবার টিম দমে না গিয়ে নিজেই একটা ব্রাউজার উইন্ডো বানিয়ে ফেললেন। তারপর শার্ন ল্যাবেরই একটা কম্পিউটারকে সার্ভার বানিয়ে খাড়া করলেন দুনিয়ার প্রথম ওয়েবসাইট। সেই সাইট এখনও চাইলে দেখতে পাওয়া যায় এই ঠিকানায় – http://info.cern.ch/hypertext/WWW/TheProject.html, তাঁর স্বপ্নের দুনিয়াজোড়া জালের ব্যাখ্যা। কী করে মানুষ ওয়েব ব্রাউজার ব্যবহার করে জুড়ে যেতে পারেন একে অন্যের সঙ্গে। তারিখটা ছিল ১৯৯০-এর ২০ ডিসেম্বর। এবার নড়েচড়ে বসলেন কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন মানুষজন টিমের এই কাজকর্ম দেখে দারুণ উৎসাহ জানালেন। সকলেই www-র সঙ্গে জুড়ে থাকতে চান। খোঁজ পেতে চান অযুত সম্ভাবনার। শার্ন ল্যাব প্রথমদিকে এই আবিষ্কারের পেটেন্ট নিতে চেয়েছিল। কিন্তু টিমের দর্শনের সঙ্গে তা কিছুতেই খাপ খাচ্ছিল না। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব হবে সকলের জন্যে উন্মুক্ত। শেষে তাঁর জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হলেন ল্যাব কর্তৃপক্ষ। ১৯৯৩-এর ৩০ এপ্রিল শার্ন থেকে আপামর জনসাধারণের জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বিনামূল্যে খুলে দেওয়া হল www-র দরজা।

 

২৫ জন বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, লেখক, বিশ্বনেতাদের দলকে বেছে নিতে বলা হয়েছিল মানব-ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ৮০টি ঘটনাকে, যার মাধ্যমে আমাদের এই দুনিয়া বদলে গেছে চিরতরে। এই তালিকায় সবার ওপরে স্থান পেয়েছে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের আবিষ্কার। টিম বার্নেস-লি-র এই www-র জন্যে আমরা আজ এক নিমেষে পৌঁছে যাচ্ছি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ইমেল, চ্যাট, ভিডিও কলের মাধ্যমে সারা পৃথিবী এখন একটা ছোট্ট জনপদে পরিণত হয়েছে। আমরা তাকে আদর করে ডাকি— ভুবনগ্রাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published.