আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, তখন কত না হাবিজাবি পাঠ্যসূচির বই পড়তে হত। ফেলুদা, শঙ্কু, টেনিদার বইগুলো পড়ার বইয়ের আড়ালে রেখে গোগ্রাসে গিলতাম। কত না-জানা জগত চোখের সামনে উঠত ফুটে। গরমকালে কতবার ভেবেছি, আহা! যদি সত্যিই থাকত এয়ারকন্ডিশনিং পিল, এমন ঘামজবজবে পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতাম।
আর এখন তো তোমাদের পোয়াবারো। সিলেবাসে ঢুকে গেছে টেনিদা। ক্লাস নাইনে শঙ্কুর বই। একটা আলাদা সংকলন করে দিয়েছেন মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। কী মজা, তাই না! তোমাদের লুকিয়ে চুরিয়ে পড়তে হয় না আর। বুক চিতিয়ে পড়ো প্রোফেসর শঙ্কুর কাণ্ডকারখানা। ঢুকে পড়ো কল্পবিজ্ঞানের আশ্চর্য জগতে।
বড় হলে দেখবে শঙ্কুর গল্প নিয়ে পণ্ডিতরা কত তর্ক-বিতর্ক করেছেন। কেউ বলেছেন এটা কল্পবিজ্ঞান নয়। অপবিজ্ঞানের ছড়াছড়ি। কেউ বলছেন, অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি। আমি তোমাদের হয়ে বলে দিই একটা কথা, শঙ্কুর কাহিনি মানুষকে ভালোবাসার গল্প। মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর গল্প। লোভকে জয় করার কাহিনি। বিপন্ন যে, অসহায় যে, তাকে সাহায্য করার গল্প।
সত্যজিৎ রায় একজন বিরাট মাপের মানুষ। ছিলেন বিশ্ববরেণ্য চিত্রপরিচালক। আর যখন লেখা শুরু করলেন, তাঁর কলমের জাদু দেখাল আট থেকে আশি, সবার মন কত সহজে জয় করা যায়। পারিবারিক স্মৃতিবিজড়িত ‘সন্দেশ’ পত্রিকা নতুন করে প্রকাশ করার জন্য ধরলেন কলম। লিখলেন প্রোফেসর শঙ্কুর কাহিনি — ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’। হ্যাঁ, বাবা সুকুমারের হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের মতো এ কাহিনিও রোজনামচা আকারে লিখিত।
প্রথমেই মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুরটা বেঁধে দিয়েছেন মাণিকবাবু। তারক চাটুজ্যেকে মনে আছে? সুন্দরবনের মাথারিয়া অঞ্চলে প্রোফেসরের ডায়রি তিনিই খুঁজে পান। তাঁর হতশ্রী অবস্থা দেখে কুড়ি টাকা দিয়েও ছিলেন কথক।
এই যে বিপদে মানুষকে সাহায্য করার শিক্ষা, বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো শঙ্কুকাহিনির ছত্রে ছত্রে নানানভাবে লুকিয়ে আছে। চলো, সেসব খুঁজে বার করি।
প্রোফেসর শঙ্কুর শেষ পূর্ণাঙ্গ কাহিনি ‘স্বর্ণপর্ণী’। প্রথম অভিযান সেটাই। সেখানেই দেখবে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ডক্টর ত্রিপুরেশ্বর শঙ্কু মানে আমাদের প্রোফেসর শঙ্কুর বাবা নিজের একমাত্র সন্তানকে শিক্ষা দিচ্ছেন,” স্বচ্ছল জীবনযাপনের জন্য অর্থের প্রয়োজন ঠিকই, আর তাতে মানসিক শান্তির পথ সহজ হয়ে যায়; কিন্তু যাদের সে সংস্থান নেই, সুখে থাকা কাকে বলে যারা জানে না, সারা জীবন যারা দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, বা যারা দৈবদুর্বিপাকে উপার্জনে অক্ষম — তাদের দুঃখ যদি কিছুটা লাঘব করতে পারিস, তার চেয়ে বড় সার্থকতা, তার চেয়ে বড় আনন্দ, আর কিছুতে নেই।”
শঙ্কু বিদ্বান মানুষ। জীবনে কোনওদিন সেকেন্ড হননি। বারো বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ষোলোতে ফিজিক্স কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে বি এস সি। বাবার কথামতো চার বছর শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শনসহ নানাবিধ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে কুড়ি বছর বয়সে স্কটিশচার্চ কলেজে প্রোফেসর হয়ে যান। তার পরের কথা তো তোমাদের অনেকেরই জানা। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, প্রাণীতত্ত্ব, উদ্ভিদবিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, মহাকাশ গবেষণা, ভূ-তত্ত্ব — এমন কোনও শাখা নেই, যেখানে শঙ্কুর আবিষ্কার বিজ্ঞানীমহলে সাড়া ফেলে দেয়নি।
এহেন শঙ্কুও সারাজীবন বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। যেখানে মানবতা বিপন্ন হয়েছে, বয়সের তোয়াক্কা না করে ছুটে গেছেন। লোভের বিরুদ্ধে, হিংসার বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই মানবসমাজের স্বার্থে। দেশপ্রেম তাঁর মজ্জায়। বিশ্বনাগরিক হয়েও তিনি আপাদমস্তক ভারতীয়।
নস্যাস্ত্র, যা নাক তাক করে মারলে তেত্রিশ ঘণ্টা হাঁচতে হয়, দুঃস্বপ্নের হোমিওপ্যাথিক বড়ি, যার চারভাগের একভাগ খেয়ে স্বপ্ন দেখে ভয়ের চোটে স্বয়ং শঙ্কুর দাড়ির বাঁ দিকটা পেকে গিয়েছিল — এইসব মজাদার আবিষ্কার বাদ দিলে প্রথম গল্পেই আমরা সস্তার মহাকাশযানের কথা পাই। পাই বিধুশেখর নামক রোবটের কথা, যে মানবিক গুণ পেয়ে মনিবকে বাঁচাতে মঙ্গলবাসীর আক্রমণের যোগ্য জবাব দিতে ছোটে। এখানে আছে ফিস পিলের কথা, যা প্রোফেসরের পোষ্য নিউটনের খাদ্য হবে মঙ্গলযাত্রায়। রয়েছে বটিকা ইন্ডিকা নামক ছোট্ট বড়ির কথা, যা খেলে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য খিদে তেষ্টা মিটে যায়। বাস্তবে এ বড়ি আবিষ্কার হলে খাদ্য সমস্যা কত দ্রুত মিটে যাবে, ভাবো তো!
প্রতিহিংসা যে সর্বনাশ ডেকে আনে তা টের পাবে ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও হাড়’ গল্পে। ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ম্যাকাও’ গল্পে তিলুবাবু আবিষ্কার করেছেন অদৃশ্য হওয়ার ওষুধ। বন্ধুতা যে পাখির মধ্যেও মানবিক গুণ এনে দিতে পারে, এ কাহিনিতে তারই হদিশ পাবে।
শঙ্কুর প্রথম আবিষ্কার সর্বরোগহর মিরাকিউরল, যা সোনেপাত্তি গাছের পাতা থেকে তৈরি, তার প্রথম উল্লেখ পাই ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ঈজিপ্সিয় আতঙ্ক’ গল্পে। মিরাকল কিওর ফর অল কমপ্লেন্টস। কল্পবিজ্ঞান বলতে যেমন বোঝায়, এ গপ্পো তেমন নয়। কিন্তু এখানেও রয়েছে ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী জেমস সামারটনের সঙ্গে প্রোফেসর শঙ্কুর হৃদ্যতার কথা। বেড়াল নিউটন প্রভুর জীবন বাঁচিয়েছে এই কাহিনিতেই। আর হ্যাঁ, ছত্রিশ রকম ফুলের নির্যাস মেশানো একটা সুগন্ধী প্রোফেসর যে আবিষ্কার করেছিলেন, তার উল্লেখ আছে এখানে।
অদ্ভুত হবি নরওয়ের বিজ্ঞানী গ্রেগর লিণ্ডকুইস্টের। বেশ নতুন। কেউ ডাকটিকিট জমায়, কেউ দেশলাই বাক্স। কেউ পুরোন টাকা জমায়, কেউ অটোগ্রাফ। উনি বাছাই করে দেশ বিদেশের বিখ্যাত মানুষদের ধরে এনে তাঁদের জ্যান্ত পুতুল করে জমান। হ্যাঁ। ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল’ গল্পে ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে পড়েছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানী শঙ্কু। এখানেও প্রগাঢ় বন্ধুত্ব তাঁকে উদ্ধার করে। লিণ্ডকুইস্টের পাগলামির শিকার হওয়া ইংল্যান্ডের প্রাণীবিজ্ঞানী আর্চিবল্ড অ্যাকরয়েড উদ্ধার করেন বন্ধু শঙ্কুকে। এখানে রয়েছে শঙ্কু আবিষ্কৃত কার্বোথিনের কথা। এই বস্তু নির্মিত জামা বিদ্যুতের শক নিরোধক। এর কল্যাণেই শঙ্কু ও অ্যাকরয়েড বেঁচে গেলেন। লোভের ভয়ানক শাস্তি পেতে হয়েছিল লিণ্ডকুইস্টকে।
আম এবং কমলার মিশ্রণে আমলা নামক একটি নতুন ফল আবিষ্কার করেছিলেন শঙ্কু। সম্ভবত এই আবিষ্কারের জন্যই সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স তাঁকে ডক্টরেট উপাধি দিয়েছে। এই কাহিনিতে রয়েছে তার উল্লেখ।
শঙ্কুর একটি দারুণ আবিষ্কার মাইক্রোসোনোগ্রাফ। প্রকৃতির সব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শব্দ, যা মানুষের কানে আজ অবধি শোনা যায়নি, এমনকী এমন অনেক শব্দের অস্তিত্বই জানে না মানব — সেই সব শব্দ এই যন্ত্রের সাহায্যে শোনা যাবে। ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও গোলক রহস্য’তে রয়েছে এই যন্ত্র আবিষ্কারের কথা। রয়েছে মাথাব্যথাসহ দুশ সাতাত্তর রকম রোগের অব্যর্থ দাওয়াই অ্যানাইহিলিন ট্যাবলেটের কথা। অবশ্য এই নামে শঙ্কুর এক বিখ্যাত মারণাস্ত্রও রয়েছে। রক্তপাত সহ্য করতে পারেন না বলে সে পিস্তলের আবিষ্কার করেন তিনি। পিস্তলটির ঘোড়া টিপলেই লক্ষ্যবস্তু পুরোপুরিভাবে উবে যায়।
প্রোফেসরের সেরা কাহিনিগুলির একটি হল গোলক রহস্য। গিরিডিতে শঙ্কুর প্রতিবেশী অবিনাশবাবু (যিনি যে কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকেই পাত্তা দেন না) একটি বল কুড়িয়ে পেলেন উশ্রী নদীর ধারে। মাইক্রোসোনোগ্রাফের সাহায্যে শঙ্কু শুনতে পান বলের ভিতরে যে প্রাণ, তাদের কথা। বুঝতে পারেন ওটা বল নয়, কক্ষচ্যুত গ্রহ। নাম টেরাটম। তার অধিবাসীরা ভয়ানক ভাইরাস। তিনদিনে খতম করে দিতে পারে মানবসভ্যতা।
মানবতার বন্ধু শঙ্কুকে আরও একবার দেখতে পাব এখানে। টেরাটম গ্রহের প্রাণীদের বাঁচাতে গিয়ে পৃথিবীকে বিপন্ন করেননি তিনি।
‘প্রোফেসর শঙ্কু ও চী-চিং’ আদ্যোপান্ত একটি মনোরঞ্জক কাহিনি। এখানে আছে এয়ারকন্ডিশনিং পিল আবিষ্কারের কথা। রয়েছে ৪০০ ভোল্ট বৈদ্যুতিক শক ছুঁড়তে পারা ইলেক্ট্রিক পিস্তলের উল্লেখ।
এরকমই আরও একটি রোমাঞ্চকর কাহিনি ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও খোকা’। এখানে আমরা পাব শঙ্কু আবিষ্কৃত সম্নোলিন নামক অব্যর্থ ঘুমের ওষুধের কথা। রয়েছে তাঁর আবিষ্কার পোলার রিপেলিয়ন থিয়োরির উল্লেখ। তোমরা, যারা এ কাহিনি পড়োনি, এই বেলা পড়ে ফেলো, খুব ভালো লাগবে।
ভূত দেখার যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন শঙ্কু। নাম নিও- স্পেকট্রোস্কোপ। ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত’ গল্পে আমরা জানতে পারি তাঁর উচ্চতা ৫ ফুট ২ ইঞ্চি। আর তাঁর অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহের নাম বটুকেশ্বর শঙ্কু।
রোবটও আবিষ্কার করেছেন শঙ্কু। না, ব্যোমযাত্রীর ডায়রির বিধুশেখর নয়, এর নাম রোবু। তিনশ তেত্রিশ টাকা সাড়ে সাত আনা খরচে তৈরি রোবু যে কোনও কঠিন অঙ্ক দশ মিনিটে কষে দিতে পারে। দেশপ্রেমিক শঙ্কুর পরিচয় আমরা পাই ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু’ গল্পে। তিনি লিখেছেন, “বাংলাদেশের সামান্য রসদে বাঙালি বৈজ্ঞানিক কী করতে পারে, সেটা কি বাইরের জগতের জানা উচিৎ নয়? এতে নিজের প্রচারের চেয়ে দেশের প্রচার বেশি।” শঙ্কুর লোভহীনতা ফুটে উঠেছে এই কাহিনিতে। জার্মান বিজ্ঞানী(!)র দেওয়া সোনার লোভে পড়েননি তিনি। তিনি তো রোবুকে বেচে আরেকটা বানিয়ে নিলেই পারতেন। কিন্তু তিনি যে শঙ্কু।
‘প্রোফেসর শঙ্কু ও কোচাবাম্বার গুহা’ গল্পে শঙ্কু পাড়ি জমিয়েছেন দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়া। এই কাহিনিতে আছে তাঁর আবিষ্কৃত অ্যানাস্থিয়াম পিস্তলের কথা। সেটা থেকে তরল গ্যাস বেরিয়ে শত্রুকে কয়েক ঘণ্টার জন্য অজ্ঞান করে দিতে পারে। এই গল্পেই জানতে পারি রঙিন ছবি তোলার জন্য ক্যামেরাপিড নামের একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন শঙ্কু। তা দিয়ে তোলা ছবি পনেরো সেকেন্ডের মধ্য প্রিন্ট হয়ে বেরিয়ে আসে। হরপ্পা আর মহেঞ্জোদাড়োর লিপির পাঠোদ্ধার যে তিনিই করেন, এ কাহিনিতে তার উল্লেখও আছে।
‘প্রোফেসর শঙ্কু ও রক্তমৎস রহস্য’তে আছে লিঙ্গুয়াগ্রাফ আবিষ্কারের কথা। এ যন্ত্রে কোনও ভাষার কথা রেকর্ড হয়ে গিয়ে তিন মিনিটের মধ্যে তার বাংলা ছাপা হয়ে বেরিয়ে আসে। রয়েছে সুপার টর্চ লাগানো বাইনোকুলারের উল্লেখ, যা আমাদের বিজ্ঞানী শঙ্কুরই আবিষ্কার। স্নায়ুকে সতেজ রাখার একটা ওষুধের উল্লেখ পাচ্ছি, যার নাম নার্ভাইটা। কাহিনিতে রয়েছে ভিনগ্রহী লাল মাছেদের কথা। সমুদ্রের তলদেশের আশ্চর্য করা বর্ণনা। ও হ্যাঁ, অবিনাশবাবু, মানে শঙ্কুর সেই প্রতিবেশী, এই অভিযানে শঙ্কুর সঙ্গী হয়েছিলেন।
ভাবো একবার, আজকের যুগের বিজ্ঞানীরা যদি সত্যি লিঙ্গুয়াগ্রাফ আবিষ্কার করে ফেলতেন, ভাষায় ভাষায় বিরোধ থাকার কারণে যে যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব, দূর হয়ে যেত একনিমেষে।
শঙ্কুর মন যে কতটা কোমল, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও গোরিলা’ গল্পটি। স্বয়ং শঙ্কু বলেছেন, “বৈজ্ঞানিকরা গিনিপিগ জাতীয় প্রাণী নিয়ে যেসব নৃশংস পরীক্ষা করে, সেগুলো আমি মোটেই সমর্থন করি না। আমি নিজে বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে কখনও প্রাণী হত্যা করিনি।” এখানে দেখা যাবে বন্ধু প্রাণীতত্ত্ববিদ মাসিংহামকে বাঁচাতে নিজের জীবন বিপন্ন করে সুদূর কঙ্গো ছুটে যাচ্ছেন শঙ্কু।
এই গল্পেই সর্বপ্রথম উল্লিখিত হয়েছে শঙ্কুর ব্রহ্মাস্ত্র অ্যানাইহিলিন পিস্তলের কথা। রয়েছে শকুন নিয়ে গবেষণা করে আবিষ্কৃত এমন এক ইঞ্জেকশেনের কথা, যা মানুষের ঘ্রাণশক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আছে তোমাদের পক্ষে দারুণ উপকারী হতে পারত এমন এক আবিষ্কার পেনলাইটের প্রসঙ্গ। এখানেই আছে অদম্য সাহসী শঙ্কুর পরিচয়। লোভের চক্করে পড়লে পরিণাম যে কী ভয়ানক হয়, এই কাহিনির অন্যতম প্রধান চরিত্র ম্যাসিংহাম তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।
অমনিস্কোপের উল্লেখ পেলাম ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও বাগদাদের বাক্স’ গল্পে। যন্ত্রটা হল এমন একটা চশমা, যা দিয়ে টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ ও এক্স রে-র কাজ চলবে একসাথে। অতিরিক্ত লোভের পরিণাম যে মহাসর্বনাশ, এই গল্পে তার বার্তা রয়েছে আবারও।
‘আশ্চর্য প্রাণী’ গল্পে সুইজারল্যান্ডের সেন্ট গ্যালেন শহরে প্রোফেসর হ্যামবোল্টের গবেষণাগার। সেখানে শঙ্কু ও হ্যামবোল্টের মিলিত গবেষণায় ফ্লাস্কের মধ্যেই পৃথিবীর প্রাণীর ক্রমবিবর্তনের একটা মিনিয়েচার সংস্করণ ঘটে চলল। গল্পে মাইক্রোম্যাগনাস্কোপের উল্লেখ আছে। লোভের পরিণাম যে ভয়াবহ, এই কাহিনিতেও ধরা পড়েছে সেই বার্তা। সার্থক কল্পবিজ্ঞান গল্পে মানুষ পরবর্তী ধাপকে কল্পনা করেছেন সত্যজিৎ। দেখতে আলাদা হলেও তার মধ্যেও থাকবে মানবিক গুণাবলী। অর্থাৎ দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন।
গল্পের নাম ‘স্বপ্নদ্বীপ’। শ্যাঙ্কোভাইট নামের এমন একটি ধাতু আবিষ্কারের কথা আছে এখানে, যা পরাস্ত করতে পারে মাধ্যাকর্ষণকে। এই ধাতুর ব্যবহারে শ্যাঙ্কোপ্লেন বানিয়েছেন শঙ্কু, যা কখনও ক্র্যাশ করবে না। সেই প্লেনের সওয়ার হয়ে অবিনাশবাবুকে সঙ্গী করে প্রোফেসর পাড়ি জমিয়েছেন স্বপ্নে দেখা দ্বীপের উদ্দেশ্যে। টি পিলস, কফি পিলস, তৃষ্ণাশক বড়ি — এই আবিষ্কারগুলির উল্লেখ আছে এখানে।
‘মরুরহস্য’ শঙ্কুর অন্যতম সেরা অভিযান। ক্রিট দ্বীপের বাসিন্দা জীবতত্ত্ববিদ প্রোফেসর হেক্টর ডিমেট্রিয়াস শঙ্কুর পত্রবন্ধু। যাঁর সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় নেই, তাঁর নিখোঁজ হওয়ার সংবাদেও চিন্তিত শঙ্কু। খুঁজতে বেরিয়েছেন বন্ধু সামারভিলকে সঙ্গে নিয়ে। এই কাহিনিতে লুমিনিম্যাক্স নামের এমন একটি জিনিসের কথা, যা শঙ্কুর আবিস্কার। ন্যাপথালিনের বলের মতো দেখতে এই জিনিসে দেশলাই সংযোগ করলেই প্রায় দুশ ওয়াটের আলো বার হয়। একটা বলে সারারাতের কাজ চলে।
আরও একটি উল্লেখযোগ্য গল্প ‘কর্ভাস’। এখানে নিজের আবিষ্কৃত অরনিথন যন্ত্রের সাহায্যে একটি পোষা কাককে শিক্ষা দিয়েছেন শঙ্কু। কাকের নাম কর্ভাস। তাকে সঙ্গে নিয়ে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোর পক্ষীবিজ্ঞানী সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছেন ত্রিলোকেশ্বরবাবু। সেই চিলিতেই জাদুকর আর্গাস শিক্ষিত কর্ভাসকে কেনার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। বিনিময়ে দেবেন দশ হাজার এসকুডো অর্থাৎ প্রায় পনেরো হাজার টাকা। কর্ভাস যে শুধু শঙ্কুর ছাত্রই নয়, সে তাঁর সন্তানের মতো, তাঁর বন্ধু — এ কথা জানিয়ে শঙ্কু বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি নির্লোভ। অর্থের মোহে পোষ্যকে ছাড়বেন না তিনি। আর পোষ্যও তেমনি। মানুষের বুদ্ধি পেয়ে কাক যে মানবিক গুণাবলীতে মানুষকেই হারিয়ে দিতে পারে, এ গল্পের মোচড় তো সেখানেই।
মানুষ যা মনে রাখে, ভুলে যায় তার চেয়ে ঢের বেশি। একজন লোকের মগজে এক কোটি কোটি অর্থাৎ একের পিঠে চোদ্দোটা শূন্য বসালে যত হয়, তত স্মৃতি পোরা থাকে। ‘ডক্টর শেরিং-এর স্মরণশক্তি’ গল্পে রিমেমব্রেন আবিষ্কার করেছেন শঙ্কু। তাঁর সেরা আবিষ্কারগুলির একটি। হারানো স্মৃতি ফিরে আসে এই যন্ত্রের ব্যবহারে। উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে নিজের সাতাশ বছরের স্মৃতি মনে করতে চাইছিলেন এক মার্কিন কোটিপতি, রাজি হননি শঙ্কু। বরং নিজের খরচে উড়ে গেছেন সুইজারল্যান্ড, বিজ্ঞানী ডক্টর শেরিং-এর লুপ্ত স্মৃতি ফিরিয়ে দিতে। শঙ্কু যে মানবতার বন্ধু এ গল্পে তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বিএক্স৩৭৭ নামক মারণাস্ত্রের ফর্মুলা জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানীর হাতে এসে পড়লেও, তিনি তা বেচে কোটিপতি হতে চাননি। এমনকী নিজের দেশের রাষ্ট্রনায়কদের হাতেও তুলে দেননি, সযত্নে মুছে দিয়েছেন।
মহাসংকটে শঙ্কুকে পড়তে দেখা গেছে ‘শঙ্কুর শনির দশা’ গল্পে। আকারে এটি বড় গল্প। তেত্রিশ বছরের পুরনো বন্ধু সামারভিলের সাহায্যে এই সংকট থেকে মুক্তির পথ খোঁজেন তিনি। শঙ্কুর বিপদকে নিজের ঘাড়ে নিতে দ্বিধাবোধ করেননি সামারভিল। বন্ধুত্ব তো এরকমই হয়।
শঙ্কুর আরও দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেলম ক্রোল ও ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেরেমি সন্ডার্স। ‘শঙ্কুর সুবর্ণ সুযোগ’ গল্পে এই দুজন তাঁর সহযোগী। তিনবন্ধু রওনা দিয়েছেন স্পেন। অভিপ্রায়, কৃত্রিম উপায়ে সোনা তৈরি। কিন্তু সোনা তৈরি হলেই বা আমাদের বিজ্ঞানীদের কী! “সোনা তৈরি নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ নেই, বা তৈরি হলেও সে সোনায় আমার কোনো লোভ নেই” — বলেই দিয়েছেন শঙ্কু। কাহিনির নীতিকথা : লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।
এই একই নীতিকথা ফুটে উঠতে দেখবে ‘হিপনোজেন’ গল্পে। একজন দাগী চোরও যে মানবতার রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারে, তারই নজির এ গল্পে রেখেছেন শঙ্কুর স্রষ্টা সত্যাজিৎ রায়।
এবার ধরো, এমন এক ফলের সন্ধান পেলে যা খেলে সমস্ত ধরনের রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কেমন হবে তাহলে? ভালো? আচ্ছা, দাঁড়াও, সাইড এফেক্টের কথাটা বলে নিই। রোগ সারবে ঠিকই, সঙ্গে খিদেও পাবে প্রচণ্ড। সেই খিদে বড় ভয়ানক। ফলমূল, সবজি কিছুই রুচবে না আর। শুধুই ইচ্ছে হবে মাংস খাই। এমনকী তা কাঁচা হলেও। ‘মানরো দ্বীপের রহস্য’ যারা পড়োনি, এইবেলা পড়ে ফেলো। এখানে এক জাপানি বৈজ্ঞানিকের পরিচয় আছে। হিদেচি সুমা। তাঁর তৈরি সুমাক্রাফট আর সুমাগানের গুণপনা আমাদের শঙ্কুকেও মুগ্ধ করেছে।
‘কম্পু’ গল্পেরও নাম, আর জাপান-আবিষ্কৃত কম্পিউটারেরও নাম। কম্পু মানুষের প্রশ্নের উত্তর দেয়, কথা বলে। কল্পবিজ্ঞানের একটি অসাধারণ গল্প। যন্ত্রের ওপর দায়িত্ব বেশি দিলে যন্ত্রই মানুষের প্রভুত্ব করবে, এ কাহিনিতে তারই ঈঙ্গিত। যন্ত্রের মধ্যে মানবিক গুণ চলে আসে। বাড়ে জানার ইচ্ছা। এভাবেই কম্পু জেনে ফেলে মৃত্যুর পরের অবস্থা।
‘একশৃঙ্গ অভিযান’ সম্ভবত সবচেয়ে বড় শঙ্কু কাহিনি। বহুদিন শঙ্কুর নতুন কোনও আবিষ্কারের কথা নেই। তোমাদের মনে হতেই পারে অলৌকিক সব অভিযান আর গোয়েন্দাগিরির নেশায় ভারতের গর্ব বিজ্ঞানী মহাশয় কি তাঁর আসল পরিচয় ভুলে গেলেন?
না, এই কাহিনিতে শঙ্কু আবিষ্কৃত এমন ওষুধের কথা আমরা পাচ্ছি, যা পর্বতারোহণের গ্লানি কমিয়ে দেয়। আছে শ্যাঙ্কলন নামে হালকা প্লাস্টিকের কথা, যা দিয়ে শীতপোশাক তৈরি হয়। অক্সিজেনের অভাব মেটাতে অক্সিমোর পাউডার বানিয়ে ফেলেছেন শঙ্কু। এমনকী কথা দিয়েছেন, অবিনাশবাবুর পাশবালিশের চাহিদা মেটাতে বানিয়ে দেবেন ফুঁ দেওয়া বালিশ। সব মিলিয়ে একশৃঙ্গ অভিযান যতটা কল্পবিজ্ঞান, তার চেয়ে ঢের বেশি রূপকথা। লোভের শাস্তি যে মৃত্যু, সেকথা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন সত্যজিৎ।
‘মহাকাশের দূত’ গল্পে নার্ভিগার নামে শঙ্কু আবিষ্কৃত এক ওষুধের নাম পাওয়া যাচ্ছে। এর এক ফোঁটা জলে মিশিয়ে খেলে দূর হয় নার্ভাসনেস। এই গল্পে পাওয়া যায়, এপসাইলন ইন্ডি নামক একটি গ্রহ থেকে প্রতি পাঁচ হাজার বছর পর পর ভিনগ্রহীরা পৃথিবীতে আসে। মানুষকে প্রযুক্তিতে বেশ কিছুটা এগিয়ে দিয়ে যায়। হ্যাঁ, এসেছিল মহাকাশের দূত। ইচ্ছেমতো আবহাওয়া বদলানো, দূষিত বায়ুকে শুদ্ধ করার উপায়, সূর্যরশ্মিকে মানুষের ব্যাপক কাজে লাগানো ও সমুদ্রের নিচে বসবাস এবং খাদ্যোৎপাদনের উপায় তারা জানিয়ে যায়। সঙ্গে পৃথিবীর অগ্রগতির পঁয়ষট্টি বছরের ইতিহাস। লিখিতভাবে। অর্ধেক মটরদানার মতো আকারের একটা উজ্জ্বল নীলাভ পাথরের টুকরো। তাতেই আছে এত কিছু! প্রোফেসর শঙ্কুকেই বিজ্ঞানীরা এর রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব দিলেন।
আসি অন্য কাহিনিতে। কঙ্গোর ভয়াবহ জঙ্গলে বিজ্ঞানীদের তিনটি দল নিখোঁজ। দু’বছরের মধ্যে। বন্ধু ম্যাকফারসনেরও হদিশ নেই। আমাদের বিজ্ঞানী ঘরে বসে থাকেন কী করে? বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গী ক্রোল, সন্ডার্স এবং যুবক ডেভিড মানরো ও তাঁর কুকুর রকেট। “কঙ্গোর এই অভিযান আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কোঠায় পড়ে, তাতে সন্দেহ নেই।” বলছেন শঙ্কু। নিঃসন্দেহে তাই। টিরানোসোরাস রেক্সের মতো ভয়ানক প্রাগৈতিহাসিক জীব থেকে হাইমেনডর্ফের মতো ক্রূর প্রাক্তন নাৎসি — এদের সামনে পড়তে হয়েছিল যে! সুপ্ত আগ্নেয়গিরির জেগে ওঠার সাক্ষী ছিলেন শঙ্কু ও তাঁর সহযাত্রীরা। যথারীতি মানবতার শত্রুদের পরাস্ত করে ফিরে এসেছেন শঙ্কু। উদ্ধারকারী বন্ধু ম্যাকফারসনের হাতে তুলে দিয়েছেন তাঁরই খোয়া যাওয়া অমূল্য সম্পদ। কবিগুরুর স্বাক্ষর সমেত প্রথম সংস্করণের ইংরেজি গীতাঞ্জলি।
পরের কাহিনির নায়ক শঙ্কু নন, নকুড়বাবু। এক অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ। সে কারণেই কাহিনির নাম ‘নকুড়বাবু ও এলডোরাডো’। পঁচাত্তর হাজার, পরে দু লক্ষ, এমনকী বিশ লক্ষ ডলারের বিনিময়ে আমাদের অহংকার শঙ্কু, নির্লোভ সাধক নিজের আবিষ্কৃত অ্যানাইহিলিন পিস্তল, মিরাকিউরল বড়ি ও অমনিস্কোপের স্বত্ব বিক্রি করতে রাজি হননি। শঙ্কুর চরিত্র এক অনন্য মাত্রা পেয়েছে এই গল্পে। আর, হোক না অলৌকিক ক্ষমতা, লোভী ব্লুমগার্টেনের যে উল্কা সমাধি হল, তার জন্য আমাদের তরফ থেকে একটা ধন্যবাদ অবশ্যই মিস্টার এন সি বিশ্বাসের প্রাপ্য। একজন হেরে যাওয়া, দু-দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করা ব্যক্তির প্রতি অনুকম্পার বশে ভিনগ্রহের অধিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাটাই ছেড়ে দিলেন শঙ্কু। তাঁর মানবিকতার আরেকটা দিক ফুটে উঠেছে এখানে।
গল্পের নাম ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ইউ এফ ও’। আশ্চর্য সব ক্ষমতা নিয়ে এ গল্পেও হাজির নকুড়চন্দ্র। এই কাহিনিতে শঙ্কু আবিষ্কৃত সেরিব্রিলান্ট নামক ওষুধের কথা রয়েছে। কাজ মাথা পরিষ্কার ও অনুভূতিগুলি সজাগ রাখা। নিজের প্রতিশোধস্পৃহাকে চরিতার্থ করতে এক পাগল বৈজ্ঞানিক ভিনগ্রহীদের যান দখল করে আঘাত হানছে এ দুনিয়ার একের পর এক গর্বে। পার্থেনন, আঙ্কোরভাট, সেন্ট পিটার্স গির্জা ধ্বংস করে তার অভিযান তাজমহলের উদ্দেশ্যে। পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রনায়কদের হাত-পা বাঁধা। কারণ সেই মহাকাশযানেই যে বন্দী শঙ্কুসহ বিশ্বখ্যাত তিন বিজ্ঞানী। মানবতার শত্রুদের বিনাশ শঙ্কু কাহিনির প্রধান উদ্দেশ্য। এখানেও তার অন্যথা হয়নি।
এক আশ্চর্যজন্তু পেয়েছেন শঙ্কু। নাম রেখেছেন ‘ইয়ে’। ঘটনাপ্রবাহ আর লোভ তাঁর প্রিয় ইয়েকে পালাতে বাধ্য করল। ‘আশ্চর্জন্তু’ কাহিনির শেষে শঙ্কুর যে মন্তব্য আছে তা তাঁর প্রায় প্রতিটি অভিযানের মূল সূত্র হতে পারে — “…মানুষের সব কিছু জেনে ফেলার লোভের একটা সীমা থাকা উচিত। এমন কিছু থাকুক যা মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করতে পারে, বিস্ময় জাগিয়ে তুলতে পারে।”
‘শঙ্কু ও আদিম মানুষ’ গল্পে ভারতের গৌরব ত্রিলোকেশ্বরবাবুর তৈরি এমন একটা ওষুধের কথা পাচ্ছি, যার প্রয়োগ মানুষের ক্রমবিবর্তনের ধারাকে কয়েক লক্ষগুণ বাড়িয়ে দেয়। নাম এভলিউটিন। মানুষের লোভের শেষ নেই। কত রকমের লোভ যে থাকে! কারও টাকাপয়সার লোভ তো কারও ক্ষমতার। কেউ বা নামের লোভে নিজের প্রতিভাকে অসৎ পথে চালিত করে। হাইনরিখ ক্লাইন শেষোক্ত ধরনের। অবশ্য লোভের পরিণাম অন্যান্য শঙ্কু কাহিনিতে যা দেখেছ,এখানেও তার অন্যথা হবে না। শাস্তি পাবেই লোভী।
‘শঙ্কুর পরলোকচর্চা’ গল্পে রয়েছে কম্পিউডিয়াম নামের একটি আশ্চর্য যন্ত্র আবিষ্কারের কথা। আবিষ্কর্তা প্রোফেসর শঙ্কু, তাঁর বন্ধু উইলহেলম ক্রোল এবং এক তরুণ বিজ্ঞানী রুডলফ হাইনে। এই যন্ত্রের মাধ্যমে আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। হাইনের প্রতিভাবলে স্বচক্ষে আত্মা দেখানোও সম্ভব হল। পদার্থবিজ্ঞান সংস্থার ডিরেক্টর হুবারম্যানকে খুন করে তাঁর পদ দখল করে ছিলেন ইয়োহান শুলৎস। প্রমাণের অভাবে তিনি ছাড়া পান। কম্পিউডিয়ামের সৌজন্যে উপযুক্ত শাস্তি পেলেন তিনি। একেবারে মৃত্যুদণ্ড।
টাইম মেশিন তৈরির দৌড়ে প্রোফেসর রণ্ডির কাছে হেরে গেলেন আমাদের শঙ্কু। সেই রণ্ডিও অবাক হয়ে গেলেন, যখন দেখলেন তাঁর টাইম ট্রাভেল ইনকর্পোরেটেড-এর অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব নির্দ্বিধায় ফিরিয়ে দিলেন ভারতের বিজ্ঞানী। অথচ সেই টাইম মেশিনের গলদ সারিয়ে দিলেন নিজ প্রতিভার জোরে। টাইম মেশিন ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্যের লোভে জার্মান বিজ্ঞানী ক্লাইবারকে পূর্বেই খুন করেছিলেন রণ্ডি। শঙ্কুকেও করতে বসেছিলেন। শেষে টাইম মেশিনের সাহায্যেই নিজেকে বাঁচান তিনি। শুধু তাই নয়, খুনের অকাট্য প্রমাণ জোগাড় করে ব্যবস্থা করেন নির্দয় রণ্ডির হাজতবাসের।
জাদুকর নেফ্রুদেৎ কৃত্রিম উপায়ে হিরে তৈরির উপায় লিখে গিয়েছিলেন। ‘নেফ্রুদেৎ-এর সমাধি’ গল্পে সেই পদ্ধতি খুঁজে পেয়েছেন শঙ্কু। হিরে তৈরি করে প্রত্নতাত্ত্বিক ব্যানিস্টারকে চুরির অপবাদ থেকে মুক্ত করেছেন। তারপর সেই ফর্মুলা টুকরোটুকরো করে ফেলে দিয়েছেন নীলনদের জলে। শঙ্কু যে নির্লোভ তা আমরা জানি। কিন্তু তাঁর বন্ধু উইলহেলম ক্রোল বা মিশরীয় প্রত্নতাত্ত্বিক ডক্টর আব্দুল সিদ্দিকি? দেখলাম তাঁরাও বিশ্বাস করেন দুষ্প্রাপ্যতাই হিরের কদরের কারণ। সহজলভ্য হয়ে গেলে প্রকৃতির এত সুন্দর রহস্য ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাবে।
জার্মানিকে আরও একবার ইহুদি হত্যার পাপে পড়তে দিলেন না শঙ্কু। ‘শঙ্কু ও ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ গল্পে হিটলারপন্থী রেডেলকে তিনি শায়েস্তা করেছেন শুধুমাত্র বুদ্ধির জোরে।
মানুষের লোভ আর তাকে জয় করার কাহিনি হল ‘ডন ক্রিস্টোবাল্ডির ভবিষ্যদ্বাণী’। নস্ট্রাডামুসের জন্মেরও আগে ক্রিস্টোবাল্ডি বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, যেগুলি হুবহু মিলে গেছে। তার মধ্যে একটি হল প্রশান্ত মহাসাগরের এক নাম-না-জানা দ্বীপে মানুষের থেকেও উন্নত প্রাণীর আবির্ভাবের কথা। বিপদে তাকে রক্ষা করবে মানুষই। লোভকে জয় করা শঙ্কুই সেই আশ্চর্য মানুষ, যাঁর কারণে রক্ষা পেল অজানা জীব অটোপ্লাজম।
তাহলে? দেখলে তো প্রোফেসর শঙ্কু কেমন মানুষ! সামান্য মালমশলা নিয়ে প্রত্যন্ত গিরিডিতে বসে তিনি যা করেছেন, সারা পৃথিবীতে ধন্য ধন্য পড়ে গেছে। অগাধ উপার্জন তিনি করতেই পারতেন। কিন্তু তিনি তো ঋষি। লোভকে করেছেন জয়। আর একের পর এক নিজের অভিযানের মাধ্যমে আমাদেরও সেই শিক্ষাই দিয়েছেন। বলতে চেয়েছেন, সবার উপরে মানুষ সত্য। শুধু কি মানুষ! এই বিশাল সৃষ্টির প্রতিটি প্রাণের প্রতিই তাঁর টান। সে কারনে কল্পবিজ্ঞান হয়েও শঙ্কু কাহিনির প্রথম ও প্রধান ধর্ম — তা মানবিক। বিশ্বখ্যাত শঙ্কু এই সভ্যতার বন্ধু। যে শুভবোধের পথে সারাজীবন চলেছেন তিনি, আশা করি বড় হয়ে তোমরাও চলবে সেই পথে। মানবতার মিত্র হয়ে পথ হাঁটবে লোভকে জয় করে।
প্রোফেসর শঙ্কুর আবিষ্কার
আবিষ্কার | প্রথম উল্লেখ | কার্যকারিতা |
---|---|---|
নস্যাস্ত্র | ব্যোমযাত্রীর ডায়রি | নাক তাক করে মারলে তেত্রিশ ঘণ্টা হাঁচতে হয়। |
দুঃস্বপ্ন বড়ি | ব্যোমযাত্রীর ডায়রি | চারভাগের একভাগ খেয়ে স্বপ্ন দেখে ভয়ের চোটে স্বয়ং স্রষ্টা শঙ্কুর দাড়ির বাঁ দিকটা পেকে গিয়েছিল। |
মহাকাশযান | ব্যোমযাত্রীর ডায়রি | অত্যন্ত সস্তায় তৈরি মহাকাশযান। |
বিধুশেখর | ব্যোমযাত্রীর ডায়রি | নিউটন নামক পোষা বেড়ালটির খাদ্য। |
ফিসপিল | ব্যোমযাত্রীর ডায়রি | রোবট, মানবিকগুণ সম্পন্ন। |
বটিকা ইন্ডিকা | ব্যোমযাত্রীর ডায়রি | একটি খেলে পুরো চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে মানুষের খিদে তেষ্টা মিটে যায়। |
অদৃশ্য হওয়ার ওষুধ | প্রোফেসর শঙ্কু ও ম্যাকাও | খেলে মানুষ, পাখি অদৃশ্য হয়ে যায়। |
মিরাকিউরাল | প্রোফেসর শঙ্কু ও ইজিপ্সিয় আতঙ্ক | মিরকল কিওর ফর অল কমপ্লেন্টস। সর্বোরোগনাশক বড়ি। পরে মলম হিসেবেও কাজ করে। |
সুগন্ধী | প্রোফেসর শঙ্কু ও ইজিপ্সিয় আতঙ্ক | ছত্রিশ রকম ফুলের নির্যাস মিশিয়ে সেন্ট। |
কার্বোথিন | প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল | বিদ্যুতের শকরোধক জামা। |
মাইক্রোসোলেগ্রাফ | প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল | মানুষের অশ্রুত শব্দ সব শোনা যায়। যেমন পিঁপড়ের চলাচলের শব্দ। |
অ্যানাইহিলিন ট্যাবলেট | প্রোফেসর শঙ্কু ও গোলক রহস্য | মাথাব্যথা সহ দু’শ সাতাত্তর রকম রোগ সারানোর দাওয়াই। |
এয়ার কন্ডিশানিং পিল | প্রোফেসর শঙ্কু ও চী- চিং | পিলটি পকেটে রাখলেই হবে। ঘরে-বাইরে যাই আবহাওয়া থাক, এসি-র প্রয়োজন মেটাবে। |
ইলেকট্রিক পিস্তল | প্রোফেসর শঙ্কু ও চী- চিং | ৪০০ ভোল্ট বিদ্যুতের শক ছুঁড়তে পারে। |
সম্লোলিন | প্রোফেসর শঙ্কু ও খোকা | অব্যর্থ ঘুমের ওষুধ। |
পোলার রিপেলিয়ন থিওরি | প্রোফেসর শঙ্কু ও খোকা | উল্লেখ নেই |
নিও-স্পেকট্রোস্কোপ | প্রোফেসর শঙ্কু ও ভূত | ভূত দেখার যন্ত্র |
রোবু | প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু | শঙ্কুর তৈরি রোবট |
অ্যানিস্থিয়াম পিস্তল | প্রোফেসর শঙ্কু ও কোচাকম্বার গুহা | তরল গ্যাস কয়েক ঘণ্টার জন্য শত্রুকে অজ্ঞান করে দিতে পারে। |
ক্যামেরাপিড | প্রোফেসর শঙ্কু ও কোচাকম্বার গুহা | রঙিন ছবি তোলা যায়। পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে প্রিন্ট হয়ে বেরিয়ে আসে। |
লিঙ্গুয়াগ্রাফ | প্রোফেসর শঙ্কু ও রক্তমৎস্য রহস্য | যে কোনও ভাষার কথা রেকর্ড হয়ে তিন মিনিটের মধ্যে তার বাংলা ছাপা হয়ে বেরিয়ে আসে। |
সুপার টর্চ লাগানো বাইনোকুলার | প্রোফেসর শঙ্কু ও রক্তমৎস্য রহস্য | অন্ধকারেও বহুদূরের জিনিস দেখা যায়। |
নার্ভাইটা | প্রোফেসর শঙ্কু ও রক্তমৎস্য রহস্য | স্নায়ু সতেজ রাখার ওষুধ। |
অ্যানাইহিলিন পিস্তল | প্রোফেসর শঙ্কু ও গোরিলা | রক্তপাত পছন্দ করেন না বলে এই ব্রহ্মাস্ত্র আবিষ্কার করেন শঙ্কু। লক্ষ্যবস্তু একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। |
ঘ্রাণশক্তি বাড়ানোর ইঞ্জেকশান | প্রোফেসর শঙ্কু ও গোরিলা | শকুন নিয়ে গবেষণা করে আবিষ্কৃত ওষুধ। মানুষের ঘ্রাণশক্তি অনেক বাড়িয়ে দেয়। |
পেনলাইট | প্রোফেসর শঙ্কু ও গোরিলা | কলম এবং তার মধ্যেই আলো। অন্ধকারে সহজেই লেখা যায়। |
অমনিস্কোপ | অমনিস্কোপ | এমন চশমা, যা দিয়ে টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ ও এক্স রে তিনটি যন্ত্রেরই কাজ হয়। |
মাইক্রো ম্যাগনা স্কোপ | আশ্চর্য প্রাণী | মাইক্রোস্কোপের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। |
শ্যাঙ্কোডাইট | স্বপ্নদ্বীপ | শঙ্কু আবিষ্কৃত ধাতু, যা মাধ্যকর্ষণকে হার মানায়। |
শ্যাঙ্কোপ্লেন | স্বপ্নদ্বীপ | শ্যাঙ্কোডাইট দিয়ে বানানো প্লেন, যা ক্র্যাশ করবে না। |
তৃষ্ণাশক বড়ি | স্বপ্নদ্বীপ | তেষ্টা মেটায়। |
টি পিল্স | স্বপ্নদ্বীপ | চায়ের বিকল্প |
কফি পিল্স | স্বপ্নদ্বীপ | কফির বিকল্প |
লুমিনিম্যাক্স | মরু রহস্য | ন্যাপথালিনের বলের মতো দেখতে এই জিনিস সারারাত দারুণ আলো দেয়। |
অরনিথন | কর্ভাস | পাখি পড়ানোর যন্ত্র। |
রিমেমব্রেন | ডঃ শেরিং-এর স্মরণশক্তি | পুরনো স্মৃতি ফেরানোর যন্ত্র। |
গ্লানিহারক ওষুধ | এক শৃঙ্গ অভিযান | পর্বতারোহণের গ্লানি কমায়। |
শ্যাঙ্কলন | এক শৃঙ্গ অভিযান | হালকা অথচ শক্ত প্লাস্টিক |
অক্সিমোর পাউডার | এক শৃঙ্গ অভিযান | অক্সিজেনের অভাব দূর করে। |
নার্ভিগার | মহাকাশের দূত | নার্ভাসনেস দূর করার ওষুধ। |
সেরিব্রিলান্ট | প্রোফেসর শঙ্কু ও ইউ এফ এ | মাথা পরিষ্কার ও অনুভূতি সজাগ রাখার ওষুধ |
এভলিউটিন | শঙ্কু ও আদিম মানুষ | এমন ওষুধ যা মানুষের ক্রমবিবর্তনের ধারাকে কয়েক লক্ষ গুণ দ্রুত করে। |
নামহীন ওষুধ | ডাঃ দানিয়েলের আবিষ্কার | এমন ওষুধ যা খেলে মানুষের হিংস্র সত্তা বেরিয়ে আসে। নিউটন ছাড়া আর কারও ওপর এই ওষুধ প্রয়োগ করেননি শঙ্কু। |
ইনটেলেকট্রন | ইনটেলেকট্রন (অসমাপ্ত শঙ্কু) | বুদ্ধি মাপার যন্ত্র |
চিত্রসূত্র — সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রোফেসর শঙ্কুর কাণ্ডকারখানা’ বইয়ের প্রচ্ছদ
Leave a Reply