যত হাসি তত কান্না… কে বলে গেছে সেটা নিয়ে ভাবার সময় এখন হালুমমামার হাতে নেই। হালুমমামা কে? এই প্রশ্নটা তোমরা করতেই পারো। উনি হলেন বি-রা-ট বড় একজন শিকারি। হ্যাঁ, বিরাট বড়। তবে বর্ষার দিনে কয়েকটা মশা ছাড়া উনি আজ পর্যন্ত কিছুই মেরে উঠতে পারেননি। একবার অবিশ্যি মাংসের ঝোলে একটা মাছি পড়েছিল। সেটাকে মেরেছিলেন। ব্যস! তবে হালুমমামা বলেন, একজন প্রকৃত শিকারি হল সে, যে কিনা মারব-মারব করে, কিন্তু মারে না। নইলে দুম করে বন্দুক টিপে গোটা বিশেক হাতি আর বাঘ মারা কোনও ব্যাপারই নয়। এইসব কথা শুনে অনেকেই আড়ালে মুখ টিপে হাসে। কেউ বলে, “হালুমের খালি বড় বড় কথা। এই বয়সে এসেও এখনও সাঁঝের বেলা একা-একা বাথরুমে যেতে ভয় পায়। সে নাকি আবার বড় শিকারি!” আবার কেউ বলে “খালি নাম কেনার বাহানা। হ্যান করেছি ত্যান করেছি বলে খানিক গাঁজাখুরি গপ্পো ফেঁদে লোকের সময় নষ্ট করা।” এইসব হালুমমামার গা সওয়া হয়ে গেছে। মহাপুরুষদের এত বাজে কথায় কান দিলে চলে না, এতে তাঁদের মনঃসংযোগ নষ্ট হয়। তবে গেলবারের বোশেখ মাসে হালুমমামা শান্তিপুর গেছিলেন আম খেতে। সেখানে তাঁর ঢ্যাঙামাসির বাড়ি। তা রসে টইটম্বুর ফজলি আমে সবে একখানা কামড় দিতে যাচ্ছিলেন, বাড়ি ভর্তি লোক গিজগিজ করছে। বলা নেই কওয়া নেই মাসি বলে উঠলেন, “হালুম আমার লোক খারাপ নয়কো মোটে। তবে কিনা…” তবে কিনা কী? এইটা জানার জন্য সক্কলে আড়ি পাতল। হালুমমামাও আম খাওয়া থামিয়ে মাসির দিকে তাকালেন। মুখের উপর চ্যাটাং-চ্যাটাং কথা বলায় ঢ্যাঙামাসির জুড়ি নেই। অনেকে বলেন, পষ্ট কথা বলার কোনও প্রতিযোগিতা হলে ঢ্যাঙামাসি বলে বলে গোল্ড মেডেল আনতেন। তো সে যাই হোক। ভারী ভালোমানুষের মতো মুখ করে ঢ্যাঙামাসি বললেন, “হালুম আমার লোক খারাপ নয়কো মোটে। তবে কিনা ওর মাথায় একটু ব্যামো আছে! খালি বলে বাঘ মারব, হাতি মারব! অথচ এই সেইদিন পর্যন্ত নুটু বহুরূপী বাঘ সেজে এলে দাঁতে দাঁত লেগে যেত ওর। সব আমার কপাল! একখানা মাত্তর বোনপো, তারও কিনা মাথার ব্যারাম!” এই কথা শোনার পর আর আম খাওয়া যায় না। আধ খাওয়া আম ফেলে হালুমমামা ভীষ্মপ্রতিজ্ঞা করলেন যে এই প্রাণ থাকতে আর মাসির বাড়ি যাবেন না। তবে এমন পেতিজ্ঞে তিনি প্রতি বছর করেন। তারপর মাসির কান্না-কান্না চিঠি পেয়ে আবার শান্তিপুর যান। আর গিয়ে মাসখানেক থেকেও আসেন। কিন্তু মাথার ব্যামো আছে বলাটা একটা জঘন্য অপমান। এই অপমান নিয়ে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না। তখন নয় মরে যেতে হয় নইলে কিছু একটা জবরদস্ত করে দেখাতে হয়।
মরে যাওয়া নিয়ে মাসখানেক চর্চা করলেন হালুমমামা। তারপর থৈ খুঁজে না পেয়ে গেলেন তাঁর মেজকাকার কাছে। গোয়ালপাড়ার ভুসো মল্লিককে সবাই এক ডাকে চেনে। কয়লার ব্যাবসা করেন বলে সবাই তাকে ভুসোবাবু বলে ডাকে। তিনি ব্রহ্মজ্ঞান আয়ত্ত করেছেন। ভুসো মল্লিককে যারা ল্যাংট পরা বয়স থেকে দেখছেন, তাঁরা জম্ম ইস্তক তাঁকে ইস্কুল বা কলেজে যেতে দেখেননি। তাই এই ব্রহ্মজ্ঞান তিনি কীভাবে পেলেন সেটা কেউ জানে না। তবে পেয়েছেন যে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। হালুমমামা জানেন এসব হল ট্যালেন্টের ব্যাপার। ট্যালেন্ট থাকলে কী না হয়। এই যে তিনি ছোটবেলায় ননীবালা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মতো নিরীহ একটা ইস্কুল থেকে লেখাপড়া করেছেন। তাঁর সঙ্গে যারা বেঞ্চে বসে লেখাপড়া করত, তাঁরা আজ কেউ ইস্কুল মাস্টার বা কেউ ব্যবসায়ী হয়েছেন। সব নিরীহ পেশা! তিনি যে ওইরকম নিরীহ একটা ইস্কুলে পড়েও এত ভয়ঙ্কর একজন শিকারি হতে পেরেছেন সেটা কীসের জন্য? ট্যালেন্ট। তাই মেজকাকার ট্যালেন্ট নিয়ে তাঁর মনে কোনও সন্দেহ নেই। এক রবিবার সকালে তিনি কাকার পায়ের উপর দড়াম করে উপুড় হয়ে পড়লেন। ভুসোবাবু সকাল থেকে উনত্রিশটা খবরের কাগজ পড়েন। প্রথম পাতা থেকে একদম শেষ পাতার শেষ বিজ্ঞাপনটা পর্যন্ত। এই সময়টা তাঁকে কেউ বিরক্ত করে না। আজ সবে চব্বিশ নম্বর খবরের কাগজের সাত নম্বর পাতায় চোখ রেখেছেন, হালুমমামা তাঁর পায়ের কাছে “কাকা গো!” বলে বিকট চেঁচিয়ে গড়াগড়ি খেতে থাকলেন। অন্য কেউ হলে ভুসোবাবু তাঁকে বাইরের বৈঠকখানায় অপেক্ষা করতে বলতেন। তবে হালুম হচ্ছে গিয়ে তাঁর আপন ভাইপো। সাত নম্বর পাতায় খুব জরুরি একটা খবর ছিল। সেটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন কিনা তাই “আহা করিস কী? করিস কী?” বলে আঁতকে উঠলেন তিনি। হালুমমামা আবেগের চোটে প্রথমে কিছুই বলতে পারলেন না। হাপুস নয়নে সাড়ে তিন মিনিট কাঁদলেন। কান্না শুনে মেজকাকি এক থালা লুচি, তরকারি আর মিষ্টি নিয়ে এলেন। হালুমমামা ফোঁপাতে ফোঁপাতে লুচি খাচ্ছেন এই সুযোগে ভুসোবাবু সাত নম্বর পাতাটা পড়ে ফেললেন। খেয়েদেয়ে মস্ত একটা ঢেকুর তুলে চোখ মুছে হালুমমামা বললেন, “আমি আর বাঁচতে চাই না কাকা!” ভুসোবাবু বললেন, “সে তো ভালো কথা। অল্প বয়সে মরলে সোজা শ্রীবিষ্ণুর চরণে ঠাই হয়। অমুক পুরাণে লেখা আছে।” হালুমমামা বললেন, “আরে, আমি এখন কেন মরব সে কথা জানতে চাইলে না যে বড়!” ভুসোবাবু জানেন শিকার করা নিয়ে লোকজন প্রায়শই হালুমকে নিমঠোনা মারে। টিপ্পনী কাটে। তিনি খুব বুদ্ধি করে বললেন, “অপমান, ঘোর অপমান। এর পর বেঁচে থাকা যায় না রে!” হালুমমামা বিস্মিত হয়ে গেলেন। এই জন্য, ঠিক এইজন্যই তিনি মেজকাকাককে এত শ্রদ্ধা করেন। ব্রহ্মজ্ঞান না থাকলে কি কেউ এই কথা এত সহজে বলে দিতে পারত? হ্যাঁ, অপমান, তাও কিনা মাথার গোলমাল আছে বলা। মানে আড়ে আড়ে বলা যে হালুমমামা পাগল। হালুমমামা গুছিয়ে সব বললেন কাকাকে। কোনও কিছু বাদ রাখলেন না। সেই যে আমখানা তিনি না খেয়ে চলে এসেছিলেন, আর পিছন থেকে ঢ্যাঙামাসি, “ও হালুম, আমটা এঁটো করলি কেন? আমি এখন এঁটো আম নিয়ে কী করব?” এইসব বলে খুব চেঁচামিচি করছিলেন সেটাও বললেন। ভুসোবাবু সব কিছু মন দিয়ে শুনলেন। তারপর বললেন, “সোমবার আয়। ওদিন পুন্নিমে। ঢ্যাঙাকে তো কিছুদিন আগেও পুতুল নিয়ে খেলতে দেখেছি। সে কিনা ভুসো মল্লিকের ভাইপোকে অপমান করে? হালুম এটা তোর অপমান নয়, এটা আমাদের বংশের অপমান। সোমবার পুন্নিমেতে নিদান দেব। এসপার নয় ওসপার!”
পুন্নিমে এসে গেল। এমনিতে এইসব বিশেষ দিনগুলোতে গাঁয়ের লোকেরা ভুসোবাবুর কাছে নিদান চাইতে আসে। কিন্তু আজ বৈঠকখানা বেমালুম খালি। দুরুদুরু বুকে হালুমমামা সেখানে গিয়ে দেখলেন কাকা চোখ বন্ধ করে পদ্মাসনে বসে একটা কাঠের টেবিলে টুকটুক করে তাল তুলে তবলা বাজাচ্ছেন। হালুমমামার পায়ের শব্দ পেয়েই তাঁর তবলা গেল থেমে। তিনি ধীরে ধীরে চোখ খুলে সোজা নিজের তর্জনী হালুমের দিকে তুলে বললেন, “হালুম মল্লিক, তুমি প্রস্তুত তো?” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হালুমমামা স্যালুট করার ভঙ্গীতে বললেন “ইয়েস স্যার!” ভুসোবাবু উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হালুমমামার সামনে খুব দ্রুত পায়চারি করতে করতে বললেন, “এ অপমান তোর নয়। এ অপমান আমার। না অপমান আমারও নয়। কার? এই অপমান কার?” হালুমমামা ভয়ে ভয়ে বললেন, “কার?” স্টিম ইঞ্জিনের মতো নিশ্বাস ফেলে ভুসোবাবু বললেন, “এ অপমান সমগ্র জাতির। ঢ্যাঙাকে আমি কাঠগড়ায় তুলব। আমি ওর এই মন্তব্য নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখব, প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করব, পার্লামেন্টে যাব, আমি রাষ্ট্রপুঞ্জে…” হালুমমামা ঢোঁক গিলে বললেন, “ইয়ে মানে এতটাও দরকার নেই কাকা। সম্পক্কে মাসি হন!” এটা শুনে ভুসোবাবু একটু থামলেন। তারপর বললেন, “জানি, সেইজন্য এত কিছু করছি না। কিন্তু তোকে এমন কিছু করতে হয় যাতে ঢ্যাঙাকে যোগ্য জবাব দেওয়া যায়। মাসির মুখের হাসি কেড়ে নিতে হবে! তাকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিতে হবে, বুঝলি?” হালুমমামা একদিকে ঘাড় কাত করে সায় দিয়ে মনে মনে ভাবলেন, কাকা তখন থেকে উসটুম-ধুসটুম বকে যাচ্ছে কিন্তু নিদানটা দিচ্ছে না। তাই এবার প্রশ্নটা করতেই হল। “কী এমন করা যায় কাকা? যাতে মাসির মুখের হাসি মিলিয়ে যাবে?” একবার হালুমমামা ইস্কুলের ক্লাসে ওঠার পরীক্ষায় সব বিষয়ে সাত পেয়েছিলেন। বাংলায় সাত, অঙ্কে সাত, ইংরিজিতে সাত, সবেতেই সাত। এই রেজাল্ট দেখার পর হেডস্যার তাঁর দিকে সাত মিনিট রক্ত জল করা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। আজ অ্যাদ্দিন পর ভুসোবাবু সেভাবেই তাকালেন হালুমমামার দিকে। পেট গুড়গুড় করে উঠল মামার। খুব সুর টেনে টেনে ভুসোবাবু বললেন, “যত হাসি তত কান্না এটা কে বলেছেন?” পড়াশোনা সংক্রান্ত কোনও প্রশ্ন করলে হালুমমামা খুব ঘাবড়ে যান। মনের মধ্যে অনেক মনীষীর নাম আসছে। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, জগদীশ বোস! এঁদের মধ্যে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই এটা বলে থাকবেন। কিন্তু জবাবটা ভুসোবাবু নিজেই দিলেন। “কে বলেছে সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু আসল ব্যাপার হচ্ছে এই বাণীর অর্থ কী?” মেলা জ্বালা হল দেখছি, ভাবলেন হালুমমামা। এ তো রীতিমতো বাংলার ক্লাস হয়ে যাচ্ছে। এবার ভুসোবাবু নিজেই উত্তর দিলেন। “এর অর্থ খুব গভীর। মানে হল, যে হাসে তার কান্নাও পায়।” ক্লাসটা বাংলা থেকে দর্শন হয়ে যাচ্ছে। কারও কান্না বা হাসি পাওয়ার সঙ্গে তার কিছু একটা করে দেখানোর কী সম্পর্ক সেটা কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না। “শোন হালুম,” ভুসোবাবু বললেন। “হাতি কিন্তু কাঁদে। আমি জানি কাঁদে। ব্যথা পেলে কাঁদে, দুঃখ হলে কাঁদে।” হালুমমামা বেড়ালপানা মুখ করে বললেন, “তাই বুঝি?”
“কী তাই বুঝি? তুই না মস্ত শিকারি? দেখিসনি কোনোদিন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই কাঁদে, দেখেছি বোধ হয়।”
“ব্যস! এইবার শুধু হাতির হাসিখানা তোকে রেকর্ড করতে হবে!” এটা শোনার পর হালুমমামা নিজে কাঁদবেন না হাসবেন সেটা বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে কাকার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভুসোবাবু ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে আছেন এই দুর্দান্ত নিদান দেওয়ার পর। তিনি খেয়ালই করলেন না যে হালুমমামার কেমন অবস্থা। “দ্যাখ, আগেই বলেছি যে কাঁদে সে হাসেও। হায়নার হাসি শুনেছিস, তার মানে সে কাঁদেও নিশ্চয়ই। আর সেই জন্যই এই প্রবাদ। কিন্তু হায়না অতি তুচ্ছ প্রাণী। তাই হায়নার কান্না আমরা চায়না গিয়ে দেখব। কিন্তু মাসির হাসি কাড়তে হলে তোকে হাতির হাসি শুনতে হবে। দ্যাখ, এই বিশ্বে আজ পর্যন্ত কেউ কোনোদিন হাতির হাসি শোনেনি বা দেখেনি। সাহেবরাও নয়। তুই যদি এই কাজটা করতে পারিস, বিশ্বের ইতিহাসে তোর নাম সোনার অক্ষরে জ্বলজ্বল করবে। আমার তো মনে হয় রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়ে যেতে পারিস তুই, বা ধর এক-আধটা নোবেল, অস্কার পাওয়াও অসাধ্য নয়!” হালুমমামা স্থাণুবৎ বসে আছেন। পাথরের মতো স্থির। যে বিশালাকার হাতি দূর থেকে দেখলেই তাঁর পেট গুড়গুড় করে আর ভীষণ মায়ের কথা মনে পড়ে যায়, সেই হাতি যে কিনা দাঁতাল হয়, পাগল হয় আর না জানি কী কী হয়, সে হাসল, কাঁদল না ঢেকুর তুলল, ওরে বাবা রে!
হালুমামা নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আমতা-আমতা করে বললেন, “হ্যাঁ, খুব ইয়ে একটা ব্যাপার বটে, কিন্তু…” ভুসোবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, “এর মধ্যে আবার কিন্তু কীসের হালুম? ভুসো মল্লিকের নিদানের পর তো কেউ কিন্তু বলে না! তোর কি আমার উপর ভরসা নেই?” এ মা! ছি ছি, কানে হাত দিয়ে জিভ কাটলেন হালুমমামা। “কিন্তু হাতি কীভাবে হাসবে কাকা?” ভুসোবাবু সুড়ুত করে চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “সে আমি কী জানি বাপু! মজার কথা শুনলে হাসতে পারে, মজার কাণ্ড দেখলে হাসতে পারে, আবার নাও হাসতে পারে। যদি তোর বাবার মতো গোমড়ামুখো হয়, তাহলে কোনও কিছুতেই হাসবে না।” “অ্যাঁ? তাহলে?” ভুসোবাবুর দাদা অর্থাৎ হালুমমামার বাবা গুঁপোবাবু ছিলেন মহা রাশভারী মানুষ। গেরামভারী চেহারা আর মস্ত এক জোড়া গোঁফ ছিল তাঁর। কোনও কোনও লোকের ভয়ে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়। গুঁপোবাবুর ভয়ে বাড়িতে মশা আর মাছিরাও নাকি ঢুকত না। মাছ ধরতে যেতেন ছিপ ছাড়া। জলের দিকে ঝুঁকে মাছের উদ্দেশ্যে রক্তচক্ষু করে বলতেন, “এই ইধার আও!” ব্যস, মাছেরা নিজে নিজেই সুড়ুত করে ঝুড়িতে উঠে পড়ত! তাঁকে কেউ কোনোদিন হাসতে দেখিনি। হালুমমামার ঠাকুমা পর্যন্ত বলতেন, “জম্ম ইস্তক গুঁপোর দাঁত দেখলুম না।” গুঁপোবাবু বছর দুই হল গত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর কথা শুনলেই এখনও হালুমমামার পেটে প্রজাপতিরা ম্যারাথন করে। দেওয়ালে টাঙানো গুঁপোবাবুর গোল্লা গোল্লা চোখওয়ালা ছবির দিকে তাকালে ‘মাগো’ বলে ওঠেন অনেকেই। বাবার প্রসঙ্গ উঠতে আরও দমে গেলেন হালুমমামা। কিন্তু সেটা কাকার সামনে প্রকাশ করলেন না। ভুসোবাবু এতক্ষণ একটা খড়কে কাঠি দিয়ে কান চুলকোচ্ছিলেন। হালুমমামাকে ভোম্বল হয়ে বসে থাকতে দেখে বললেন, “কাল খবরের কাগজে দেখলুম, রূপপুরের কাছে বারো মাইলের জঙ্গলে একদল হাতি এসেছে। ব্যস, এর চেয়ে বেশি কিছু বলব না। যা ভাগ পালা এখন!”
কীরকম মুশকিলে যে হালুমমামা পড়েছেন সেটা বলে বোঝানো যাবে না। হাতির হাসি না শুনলে কাকা মুখ দেখবেন না, মাসি পাগল বলবেন! আর পাড়াপড়শি যে নিমঠোনা মারবে সেটা তো উপরি পাওনা। উফ! মনে হচ্ছে সেইদিন চুপচাপ আমটা খেয়ে নিলেই হত। এখন সেই আধখাওয়া আম গলায় ঢেঁকির মতো চেপে বসে আছে। না গিলতে পারছেন, না উগরোতে পারছেন। লোকজনও হয়েছে ভারী বদমায়েশ। সবাই আঙুল দেখিয়ে ‘ও রূপপুরের জঙ্গল ওই হোতা’ বলে মুখ ঘুরিয়ে ডাঁট দেখিয়ে চলে গেল। প্রথমে অবিশ্যি গ্রামে খুব হইচই পড়ে গেছিল এই বলে যে একজন মস্ত বড় শিকারি এসেছেন। তারপর হালুমমামার চেহারা ছবি দেখে লোকে বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি। তাই মামাকে একাই রূপপুরের এই জঙ্গলে আসতে হল। শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে জঙ্গলখানা খুব একটা ছোটও নয়। বেশ একটা গা ছমছমে ব্যাপার আছে। হালুমমামা প্রথমে একটা ঝাঁকড়া গাছের নিচে বসে হাপুস নয়নে গলা ছেড়ে কাঁদলেন। আশেপাশে কেউ ছিল না বলে “ও মেজপিসি, ও রানুদিদি, ও বড় জেঠু” বলে বিকট চিৎকার করেই কাঁদলেন। তখন কে জানি খুব কচি গলায় বলে উঠল, “তুমি কে গা? অমন মড়াকান্না কাঁদছ কেন?” এমনিতেই আধমরা হয়েছিলেন, তার মধ্যে আচমকা মানুষের গলার স্বর শুনে প্রায় ভিরমি খাওয়ার যোগাড় হল হালুমমামার। “তুমি কে? ভ-ভ-ভুত?” এবার কণ্ঠস্বর সামনে এল, বা বলা চলে নিচে এল। সে এতক্ষণ গাছের ডালে ঝুলছিল। একটা বছর সাতেকের ছেলে। নিচে নেমেই সে হালুমমামার দিকে প্রায় তেড়ে এসে বলল, “ভূত কেন হব গা? কটকটে রোদে ভূত আসে? ভূত কি এত বাচ্চা হয়? ভূত কি এত কথা বলে? ভূত কি…” উফ বাপরে বাপ! প্রশ্নের পর প্রশ্ন। হালুমমামা হাতজোড় করে বললেন, “বাছা আমার ঘাট হয়েছে, তুমি যে ভূত নয় সেইটা আমি বুঝেছি। এবার লক্ষ্মী ছেলের মতো বলো দেখি, হাতির পাল ঠিক কোনদিকে আছে?” ছেলেটা ভুরু কুঁচকে মামার বন্দুকের দিকে তাকিয়ে বলল, “গুলি মারবে? তাহলে বলব না!” হালুমমামা জিভ কেটে বললেন, “এ মা! না না, মারব কেন?”
“তাইলে বন্দুক নেছ কেন?”
“সে তো ওই আত্মরক্ষা… যাকগে, বল না বাবা কোনদিকে আছে?”
“বইল্লাম তো, কীসের জন্য দরকার না বললে বইলব না!”
মহা জেদি ছেলে তো। আমতা আমতা করে হালুমমামা পুরো ব্যাপারটা বলেই ফেললেন। আর সেই শুনে ছেলের কী হাসি! হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে তার বেদম অবস্থা। এমনিতেই হালুমমামা হাঁড়িপানা মুখ করেছিলেন এখন সেই হাঁড়ির উপর এক পোঁচ কালি লাগল। হাতির বদলে এই ছেলের অমন দাঁত ছরকুটি হাসি দেখে তাঁর কী হবে শুনি? ছেলেটা একটু ধাতস্থ হয়েছে। তাও ফিকফিক করে হেসে বলল, “হাতিরে তোমরা হাসতে দেখবে কেমন করে? সে ব্যবস্থা করেছ? জঙ্গল কাটি দেছ, রেললাইন পেতেছ, বিজলির তার বসাইছ।” হালুমমামা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এই শোনো, পাকা-পাকা কথা বলবে না একদম। একদম পাকা-পাকা কথা বলবে না। হাতির পাল কোথায় আছে জানো তো বলো, নইলে ভাগো ইঁহাসে।” ছেলেটা আবার হাসল ফিকফিক করে। “ঠিক আইছে। আমি ভাগছি। তোমায় বাঘে খেলে আমার কী!” যে প্রবল বিক্রমে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন মামা, ততটাই ভয় খেয়ে ধপাস করে বসে পড়লেন মাটিতে। ছেলেটা মহা বিচ্ছু। সেও ঠিক মামার সামনে এসে বসল আর কোঁচড় থেকে একটা ডাঁসা পেয়ারা বের করে কচরমচর করে চিবুতে থাকল। “নাম কী?”
“কারে জিগাও গো শিকারি?”
হালুমমামা আলগা স্মার্টনেস দেখালেন। “নিশ্চয়ই ওই গাছ বা ঝোপটাকে জিগ্যেস করছি না। তোকেই করছি।”
“তোমার নাম কী বটে?”
মেলা জ্বালা হল দেখছি। নাম কী, তার উত্তরেও আরও একটা প্রশ্ন। হালুমমামা দূরে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “আমার নাম হালুম মল্লিক, খুশি?” হালুমমামা ভেবেছিলেন এটা শুনেও ছেলেটা খুব হাসবে। কিন্তু ছেলেটা বলল, “দুই বচ্ছর আগে পাতাবনে তুমিই এয়েচিলে না বাঘ ধরতে?” হালুমমামার মুখ চুন হয়ে গেল। তিনি বিলক্ষণ এসেছিলেন পাতাবনে। তবে বাঘ-টাঘ ধরার আগেই শুধু বাঘের হালুম ডাক শুনেই তাঁর ভয়ানক পেট ব্যথা শুরু হয়ে যায়। তারপর তো আর লজ্জা ছি-ছি-র শেষ ছিল না। একটা স্থানীয় সংবাদপত্র তো রসিয়ে রসিয়ে খবরও করেছিল— “হালুম শুনে অজ্ঞান হলেন হালুম শিকারি!” হালুমমামা তাঁদের দপ্তরে গিয়ে খুব বিনীতভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে উনি মোটেই অজ্ঞান হননি। ওঁর শুধু একটু পেট ব্যথা করছিল। কে শোনে কার কথা। সম্পাদক নাকি এসব শুনে জলহস্তীর মতো হাঁ করে হেসেছিলেন আর পরের দিন খবর করেছিলেন এটা নিয়ে। উফ! অপমান আর অপমান! মাঝে মাঝে মনে হয় বাঘের পেটে চলে গেলেই ভালো হত। ছেলেটা আবার ফিকফিক করে হেসে বলল, “অমন উচ্ছেপানা মুখ করে কী ভাবছ গো? তুমি লোক খারাপ নয় বুইঝতে পেরেছি। খামোখা কেন বনের প্রাণীদের মারতে চাও? ওদের ছেড়ে দাও না নিজের মতো। তোমায় যদি তোমার বাপ-মা-র কাছ থেকে কেউ কেড়ে নেয় কেমন লাগবে?” অন্য সময় হলে হালুমামামার মনে হত পাকা কথা বলছে বা জ্ঞান দিচ্ছে। কিন্তু কেন জানি না এখন হালুমমামার মনে হল ছেলেটা ভুল বলছে না। ছেলেটার বলার মধ্যে কী জানি একটা ব্যাপার ছিল, মনকে নাড়া দিয়ে গেল। তবুও তিনি আমতা আমতা করে বললেন, “ঠিকই। তবে ওই যে হাসি… হাসি না শুনলে মাসি যে…” ছেলেটা দুষ্টুমি ভরা চোখে তাকিয়ে বলল, “হাসি শুনবে বটে? তাইলে এসো আমার সঙ্গে!”
বুধন মানে ওই ছেলেটা হালুমমামাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল আর তিনি সেখানে গিয়ে আদৌ কোনও হাতিকে হাসতে দেখেছিলেন কিনা সেটা কেউ জানে না। বুধন নাকি মামাকে মাথার দিব্যি দিয়েছিল যে ফিরে গিয়ে কাউকে কিচ্ছুটি বলা যাবে না। তবে ফিরে আসার পর হালুমমামা নাকি শিকার করা এক্কেবারে ছেড়ে দিয়েছিলেন আর কেউ কোনও কিছু জিগ্যেস করলেই তিনি উত্তর দিতেন, “টপ সিক্রেট!” এই যেমন শান্তিপুরের ঢ্যাঙা মাসি জানতে চাইলেন, “ওরে হালুম অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলি?”
“বলা যাবে না মাসি, টপ সিক্রেট।”
“হ্যাঁ রে, তুই নাকি তোর ওই উনুনমুখো ভুস কাকার কথা শুনে জঙ্গলে হাতির হাসি শুনতে গিয়েছিলি?
“সরি মাসি, টপ সিক্রেট!”
ভুসোবাবুও নানাভাবে হালুমমামার কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে মিশন সাকসেসফুল কি না। কিন্ত ওই একই উত্তর, “বলা যাবে না কাকা, টপ সিক্রেট!”
তোমাদের মতো আমারও দারুণ কৌতূহল হচ্ছিল এই বিষয়ে। হালুমমামাকে প্রশ্ন করলাম, “বলো না গো, সত্যি কি শুনলে হাতির হাসি?” একগাল কান এঁটো করা হাসি হেসে মামা বললেন, “বলা যাবে না রে, টপ সিক্রেট!”
অলংকরণ — আশিস ভট্টাচার্য
Leave a Reply