বাজবরণ সৈকত মুখোপাধ্যায়

আমার নাম অনীক মিত্র। ‘নিশিডাক’ নামে একটা ত্রৈমাসিক রহস্য রোমাঞ্চ পত্রিকা বার করি। আমি সম্পাদক। তরুণ ব্যানার্জি সহ-সম্পাদক। পত্রিকার অফিস কলকাতায়, বিডন স্ট্রিটে।

নিশিডাকের বয়স এখনও দু বছর পেরোয়নি, কিন্তু এর মধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একেকটা এডিশন তিন-চার হাজার কপি হেসে-খেলে বিক্রি হয়ে যায়। এমনকী পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও পত্রিকা পাঠাতে হয়। গ্রাহক রয়েছেন পাঁচশ-র ওপর।

পত্রিকার এই যে সাফল্য, তার পেছনে রয়েছে আমাদের নতুন নতুন আইডিয়া। যেমন আমাদের একটা বিভাগ রয়েছে যেটার নাম ‘চলে গেছি, তবু আছি’। ওই বিভাগে আমরা ভুতুড়ে-বাড়ি, হানাবাড়ি ইত্যাদি কভার করি। কলকাতার ভুতুড়ে বাড়ির ইতিহাস নিয়ে আগে অনেক লেখালেখি হয়ে গেছে। তাই আমরা প্রথমেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, গার্স্টিন-প্লেসের পুরনো রেডিও-অফিস, ব্যারাকপুরের সাহেব-কুঠি কিংবা রাইটার্স বিল্ডিং-এর ভূতের কথা আর লিখব না। বরং গ্রাম কিংবা মফস্বলের অল্প-জানা সব ভুতুড়ে বাড়িতে আমাদের লেখকেরা এক-একটা রাত কাটিয়ে, তাদের সেই হাতে-গরম অভিজ্ঞতার কথা পত্রিকায় লিখবেন।

এই কাজ করতে গিয়ে গত বছরে পুরুলিয়ার এক হানাবাড়িতে আমাদের এক শুভানুধ্যায়ী মারা গেছেন। তাঁর নাম ছিল শিবেন্দু অধিকারী, আমাদের সবার প্রিয় শিবেনদা। শিবেনদার অদ্ভুত মৃত্যুর গল্পও আমরা লিখেছি।

শিবেনদার মৃত্যুতে ‘চলে গেছি, তবু আছি’ বন্ধ হয়নি। বরং পাঠকদের চাপে ওই বিভাগের পাতার সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে।

প্রথম প্রথম ভুতুড়ে বাড়ির খোঁজে আমাদের এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে হত। এখন কিন্তু নিজে থেকেই আমাদের কাছে ভুতুড়ে বাড়ির খোঁজখবর চলে আসে। ই-মেলে, চিঠিতে কিংবা টেলিফোনে পত্রিকার পাঠকেরাই জানান — ‘স্যার, আমি অমুক জায়গায় থাকি। আমাদের এই শহরে (কিংবা গ্রামে) একটা ভূতের বাড়ি আছে। সেখানে এমন এমন সব কাণ্ড হয় বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না।

আমরা সেই সব খবর ঝাড়াই-বাছাই করে তার মধ্যে যেগুলোকে মনে হয় সম্ভাবনাপূর্ণ, সেগুলোতে রাত কাটিয়ে আসি। সবসময় যে ভূতের দেখা পাই, তা নয়। সত্যি কথা বলতে কী, আমি নিজে কখনও ভূত দেখিনি। তবে এমন অনেক কিছু শুনি কিংবা অনুভব করি যা ঠিক রোজকার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না। সেই সব অভিজ্ঞতাকেই যখন আমাদের লেখকেরা ভাষার যাদু মাখিয়ে নিশিডাকের পাতায় পরিবেশন করেন, তখন পাঠকদের গা ছমছম করে ওঠে।
বলছিলাম না, আমাদের পত্রিকার বিক্রি এখন আর শুধু পশ্চিমবঙ্গে সীমাবদ্ধ নেই? সেই জন্যেই মাঝে মাঝে বিহার, ইউ পি, আসাম কিংবা আন্দামান থেকেও প্রবাসী বাঙালি পাঠকদের চিঠি পাই। বেশিরভাগ চিঠিতেই তাঁরা নিজেদের ভালো লাগার কথা জানান। কী করলে পত্রিকা আরও আকর্ষণীয় হতে পারে সে ব্যপারেও মতামত দেন। আর অল্প কিছু চিঠিতে থাকে ওই যে, একটু আগে যা বলছিলাম — হানাবাড়ির খবর।

কয়েকদিন আগে সেরকমই একটা চিঠি পেয়েছিলাম উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলার এক ছোট শহর ইন্দাসরাই থেকে। প্রেরকের নাম শ্রীমন্মথনাথ সরকার।
চিঠিটা অনেকগুলো কারণেই চোখ টেনেছিল।

প্রথমত, বাংলার বাইরে একজন প্রবাসী বাঙালি নিশিডাক পড়ছেন এটা জানলেই তো মনটা খুশি হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয়ত, হাতের লেখা আর ভাষার বাঁধুনি থেকে মন্মথবাবুকে বেশ শিক্ষিত ভদ্রলোক বলে মনে হয়েছিল।

তৃতীয়ত, এটাই সবচেয়ে বড় কারণ, উনি যে ঘটনার কথা লিখেছিলেন, সেটা কেবল একটা বাড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ভূত কিংবা অপদেবতা যাই হোক, তার ঘোরাফেরা নাকি ইন্দাসরাইয়ের চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা বিঘের পর বিঘে চাষের জমির জুড়ে। একজন বা দুজন নয়, শয়ে শয়ে লোক তাকে চাক্ষুষ করেছে।
মন্মথবাবু চিঠিতে তাকে অপদেবতা বলেই উল্লেখ করেছিলেন। কেমন সেই অপদেবতার কার্যকলাপ? ওনার চিঠি থেকেই কিছুটা অংশ তুলে দিই —

“আপনারা হয়তো জানেন, উত্তরপ্রদেশের এই অঞ্চলটা কৃষিপ্রধান অঞ্চল। বর্ষাকালে ধান বোনার মরশুমে খোলা মাঠে হাজার হাজার লোক কাজ করে। ওইটাই আবার বজ্রপাতেরও ঋতু। তাই বাজ পড়ে প্রতিবছরই এখানে বেশ কিছু লোক মারা যায়। সে বড় মর্মান্তিক ব্যাপার। হয়তো বৃ্ষ্টি এল। মাথা বাঁচানোর জন্যে দশ-বিশ জন লোক কোনও একটা বড় গাছের নীচে আশ্রয় নিল। বাজ পড়ল সেই গাছের মাথাতেই। ব্যস। সবাই একসঙ্গে শেষ।

“অবস্থাটা কিন্তু এই বছর একটু হলেও পালটেছে। তার কারণ, বাজবরণের আবির্ভাব। মাসখানেক হল সে ইন্দাসরাইয়ের কৃষিক্ষেত্রে আবির্ভূত হয়েছে। ভালো কথা। বাজবরণ নামটা কিন্তু আমার দেওয়া নয়। এখানকার সাধারণ মানুষের মাথা থেকেই নামটা বেরিয়েছে।

“তবে আমি তাকে দেখেছি। ঘন মেঘে যখন আকাশ ছেয়ে যায়, তখনই দূর প্রান্তরের কোনও এক জায়গায় আবির্ভাব হয় বাজবরণের। সে মানুষের কাছে আসে না। আমার মতন সকলেই তাকে দূর থেকেই দেখে। সেইজন্যেই তার নাক চোখ কেমন তা বলতে পারব না। তবে বোঝা যায় সে বিশাল লম্বা এবং রোগা। কঙ্কালসার চেহারা। কী পোশাক পরে জানি না। তবে যাই পরুক, সেটা তার গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকে। মাথায় চুল নেই বলে মাথাটাকে কঙ্কালের খুলি বলে মনে হয়। হয়তো কাছে গেলে দেখতে পেতাম চোখ এবং নাকের জায়গায় হাড়ের ফুটো। গায়ের রং, যতদূর মনে হয়, কুচকুচে কালো। হাঁটার ভঙ্গিটা অদ্ভুত। ওপরে তাকায় না, পেছনে নয়, পাশে নয়। মাথা সোজা রেখে হেঁটে যায়। হাঁটার সময় হাতদুটো দোলে না। শরীরের সঙ্গে লেপটে থাকে।

“মানুষ নয়, সব মিলিয়ে তাকে কোনো অপদেবতা বলেই মনে হয়।

“এ তো গেল চেহারার বর্ণনা। যে কাজটা সে করে, সেটা আপনাদের বললে আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। আমি হলেও করতাম না। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করার পর সে মাথার ওপরে লম্বা হাতদুটো তুলে দাঁড়ায়। এক মিনিট, দু মিনিট, বড়জোর পাঁচ মিনিট। হঠাৎ যেন তার মাথার ওপরে মেঘেদের মধ্যে একটা অস্থিরতা দেখা দেয়। মেঘগুলো ঠিক ওই জায়গাটাতেই কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘন হয়ে ওঠে। এক-দুবার গুম গুম করে ডেকে ওঠে। তারপরেই আকাশ থেকে চোখধাঁধানো নীল আগুনের ফলা নেমে আসে বাজবরণের মাথায়।

“কয়েক মুহূর্তের জন্যে বজ্রপাতের কানফাটানো আওয়াজে দর্শকদের চৈতন্য লোপ পায়। চেতনা ফিরে আসার পরে তারা দেখে, বাজবরণ ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে দূর থেকে আরও দূরে।

“আমি গত বর্ষায় অন্তত দশবার বিভিন্ন দিনে, বিভিন্ন সময়ে এই দৃশ্য নিজের চোখে দেখেছি। আরও শয়ে শয়ে কৃষক মাঠে কাজ করতে করতে এই দৃশ্য দেখেছে। বাজবরণ আকাশের বজ্রকে নিজের শরীরে টেনে নিয়ে ইন্দাসরাইয়ের মাঠ-প্রান্তরকে বজ্রপাতের ভয় থেকে মুক্ত করে দিচ্ছে।

“বাজবরণের উৎপত্তি নিয়েও এখানকার লোকের মনে একটা বিশ্বাস রয়েছে। তবে সেটা এখনই বলব না, গাঁজাখুরি গল্পের মতন শোনাবে। তার চেয়ে আপনারা নিজেদের চোখে বাজবরণকে দেখুন। দেখুন তার মাথার ওপর বজ্রপাতের অলৌকিক ঘটনা।

“চলে আসুন ইন্দাসরাই।

“এখন বর্ষাকাল। আমন ধান বোনার মরশুম। বজ্রপাতেরও কমতি নেই। এই হল বাজবরণের আবির্ভাবের প্রিয় সময়। হাওড়া থেকে কোনও একটা রাতের এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে ভোর ভোর পাটনা জংশনে এসে নামুন। সেখান থেকে আবার বক্সার লোকালে উঠুন। পাটনা থেকে ঠিক আড়াই ঘণ্টা সময় লাগবে এখানে পৌঁছতে।

“হোটেলে থাকার কথা ভুলেও ভাববেন না, কারণ ইন্দাসরাইয়ে কোনও হোটেল নেই। এই অধমের বাড়িতেই না হয় দুটো রাতের আতিথ্য গ্রহণ করলেন। এক সময় এডগার অ্যালান পো, এম আর জেমস, ডাবলিউ জেকব, অ্যামব্রোজ বিয়ার্স কিংবা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভৌতিক গল্পের পোকা ছিলাম। নিশিডাক পত্রিকার গল্পগুলো এখনও আমার শিরদাঁড়ায় হিমস্রোত বইয়ে দেয়। সেই পত্রিকার লেখকদের সঙ্গে দুদিন কাটাতে পারলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করব। অতএব অসঙ্কোচে চলে আসুন। ইতি…”

 

 

দুই

 

চলেই গেলাম ইন্দাসরাই।

গেলাম আমি আর তরুণদা, মানে আমাদের সহ-সম্পাদক তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তরুণদা একদিকে যেমন ভালো গল্পকার, অন্যদিকে তেমনই ডাকাবুকো অ্যাডভেঞ্চারার। অনেক ঘাটের জল খেয়েছেন। জুতো সেলাই থেকে রাইফেল-শ্যুটিং সবই পারেন। ওঁকে সঙ্গে না নিয়ে আমি তাই পারতপক্ষে কোনও ভৌতিক অভিযানে বেরোই না।

আমরা দুজনে শনিবার দুরন্ত এক্সপ্রেসে চড়ে পাটনায় পৌঁছলাম। মন্মথবাবুর কথামতন বক্সার লোকালেও কোনও রকমে চাপা গেল। ‘কোনও রকমে’ বলছি এই কারণে যে, সেই লোকাল ট্রেনের চেহারাটা ছিল অবিকল ডেঁয়ো-পিপড়ের খপ্পরে পড়া দানাদারের মতন। শ-দুয়েক মানুষ বাদেও নটা সাইকেল, দুটো রামছাগল, তিন ঝুড়ি মুরগি, গোটা ছয়েক মাছের পোনার হাঁড়ি এবং কুড়িটা নারকোল গাছের চারাকে আমাদের সেই কামরার ভেতরে জায়গা করে দিতে হয়েছিল। ইয়ার্কির ব্যাপার নয়।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে অবশ্য ভিড় অনেক হালকা হয়ে গেল। আমরা দুজনে বসার জায়গাও পেয়ে গেলাম। এই প্রথম জানলা দিয়ে বাইরে চোখ মেলতে পারলাম আর সঙ্গে সঙ্গেই চোখদুটো যেন জুড়িয়ে গেল।

দেখলাম আকাশ জুড়ে বর্ষার কালো মেঘ আর তার নীচে যতদূর চোখ যায়, নানা রকমের সবুজের সমারোহ। কোথাও কচি ধানের হালকা সবুজ, কোথাও অড়হড় খেতের গাঢ় সবুজ, আবার কোথাও আঁখের বনের রুপোলি রং মেশানো সবুজ। মাঝে মধ্যেই নীলগাইয়ের পাল আমাদের ট্রেনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটছিল। এখানে ওখানে গ্রামের কোনও বাড়ির ছাদের ওপর পেখম ঝুলিয়ে বসেছিল ময়ূর। সব দেখেশুনে তরুণদা নিজের মনেই মন্তব্য করলেন, “এখানে তো দেখছি লক্ষ্মীঠাকরুন আর কেষ্টঠাকুর নিজেদের মধ্যে সব জমি ভাগবাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন। এর মধ্যে অপদেবতা বাজবরণের জায়গা কোথায়?”
মন্মথবাবুকে ফোনে আমাদের আসার খবর জানিয়ে রেখেছিলাম। উনি ইন্দাসরাই স্টেশনে গাড়ি নিয়ে হাজির ছিলেন। ভদ্রলোকের যে ছবিটা মনে মনে এঁকে রেখেছিলাম, তার সঙ্গে আসল চেহারাটা হুবহু মিলে গেল। খুব একটা লম্বা নন। শ্যামলা গায়ের রঙ। কাঁচাপাকা চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো। বয়স ষাটের কাছাকাছি হলেও দিব্যি শক্তপোক্ত দোহারা চেহারা। ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, কলেজস্ট্রিটের কাবুলি জুতো আর লেদার-ব্যান্ডের এইচ এম টি ঘড়িতে আপাদমস্তক বাঙালি। শুধু ওনার মুখ দিয়ে ভুরভুর করে যে জর্দার গন্ধটা বেরোচ্ছিল, সেটা বাজি রেখে বলতে পারি, বাংলার জিনিস নয়। আদত বেনারসি জর্দা।

পুরো পরিচয় পাওয়ার পর বুঝতে পারলাম, মন্মথবাবু পয়সাওলা মানুষ। ইন্দাসরাইয়ে ওঁদের তিনপুরুষের কাঠের কারবার। ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে হলেও পড়াশোনা কম করেননি। লখনৌ কলেজ থেকে ইংরিজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বি এ পাশ করেছিলেন। প্রিয় শখ, পয়সা উপার্জন নয়, বই পড়া।
মন্মথবাবু নিজেই ড্রাইভ করছিলেন। স্টেশন থেকে ওনার বাড়ি যাওয়ার রাস্তার দুপাশেই মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু ধানখেত। আমি আর তরুণদা উদগ্রীব হয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম, যেন যে কোনও মুহূর্তেই দেখতে পাব অনেক দূরে সেই লম্বা কালো অপদেবতার মূর্তি।
মন্মথবাবু বোধ হয় ড্রাইভারের সামনের আয়নায় আমাদের মুখ দেখতে পাচ্ছিলেন। রাস্তার দিকে নজর রেখেই বললেন, “ভগবান খুব সমঝদার ব্যক্তি। জানেন, এখন ঝড়বৃষ্টি হলে আপনাদের মনের মতন করে খাওয়াতে পারব না। তাই মেঘের জোগান আজ কিঞ্চিৎ কম রেখেছেন।”
ওঁর বলার ভঙ্গিতে আমরা দুজনেই হেসে ফেললাম। তবে কথাটা সত্যি। আকাশে তখন ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু মেঘের আনাগোনা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বাজ পড়ার সম্ভাবনা ছিল না, তাই বাজবরণের দেখা পাওয়ার আশাও ছিল ক্ষীণ।

‘মনের মতন করে’ খাওয়ানো বলতে মন্মথবাবু কী বুঝিয়েছিলেন সেটা আগে আন্দাজ করতে পারিনি। একদম পাত পেড়ে ভোজ খাওয়ালেন। মাছেরই পদ ছিল অন্তত চার রকমের। অত বড় চিতল মাছের পেটি শেষ কবে খেয়েছি মনে পড়ে না। মন্মথবাবু বললেন, সব মাছই নাকি ঘাঘরা নদী থেকে ধরা। ঘাঘরা নদীটা ইন্দাসরাইয়ের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে। উনি কথা দিলেন, একসময় আমাদের নদীর ধার থেকে ঘুরিয়ে আনবেন।
খেতে খেতেই বাজবরণের গল্প শুরু হয়েছিল। খেয়ে ওঠার পরেও শোবার ঘরে তাকিয়া হেলান দিয়ে সেই গল্পই চলল। কথায় কথায় মন্মথবাবু বললেন, “ইন্দাসরাই নামটার সঙ্গে বজ্রের সংযোগ রয়েছে জানেন তো?”

আমরা দুজনে একসঙ্গেই প্রশ্ন করলাম, “কীরকম?”

উনি বললেন, “ইন্দাসরাই হচ্ছে ইন্দ্রসরোবরের অপভ্রংশ। দধীচিমুনির কথা শুনেছেন নিশ্চয়ই। যিনি বজ্র নির্মাণের জন্যে ইন্দ্রকে নিজের অস্থি দিয়েছিলেন। অস্থি দেওয়ার জন্য ধ্যানে বসে প্রাণত্যাগ করেছিলেন দধীচিমুনি আর তার আগে নিজেকে শুদ্ধ করার জন্য স্নান করেছিলেন ওই ইন্দ্রসরোবরের জলে। লোকে বলে, ওই সরোবরের তীরেই ওনার আশ্রম ছিল।”

তরুণদা জিজ্ঞেস করলেন, “সেই সরোবর আছে এখনও?”

“আছে বই কি। এখন অবশ্য ঠিক সরোবর বলে চেনা যায় না… মজে গেছে। এখান থেকে মাইল তিনেক উত্তরে গেলে দেখতে পাবেন জঙ্গলের মধ্যে বিশাল এক জলাভূমি। ওইটাই পুরাণের ইন্দ্রসরোবর। তবে ওদিকে না যাওয়াই ভালো।”

“কেন? না যাওয়াই ভালো কেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

মন্মথবাবু কিন্তু-কিন্তু করে বললেন, “না, মানে নানারকমের উদ্ভট গল্প শোনা যায় জায়গাটার সম্বন্ধে।”

তরুণদা বললেন, “ভূত?”

মন্মথবাবু বললেন, “মুনির আত্মাকে কি ভূত বলা যায়? কী জানি! তবে দেহত্যাগের একটা যন্ত্রণা তো ওনার ছিল নিশ্চয়ই। আজকালকার দিন হলে ওটাকে তো অপমৃত্যুই বলতাম। সুইসাইড। হয়তো তাই থেকেই…”

বললাম, “আপনি চিঠিতে লিখেছিলেন বাজবরণের উৎপত্তি সম্বন্ধে লোকাল লোকেদের একটা বিশ্বাস রয়েছে। সেই বিশ্বাসের সঙ্গে কি তাহলে দধীচিমুনির সম্পর্ক রয়েছে?”

মন্মথবাবু বললেন, “মোক্ষম ধরেছেন। লোকের ধারণা বাজবরণ আর কেউ নন, স্বয়ং দধীচি। ওনার অস্থি দিয়ে তৈরি বজ্র যে ওনার দেশের লোকেদেরই মাথায় পড়বে এটা বোধ হয় মুনিমশাই সহ্য করতে পারেন না। তাই নিজের মাথাতেই যাবতীয় বজ্রপাত ধারণ করেন। ওনার নিজের হাড় দিয়ে যে জিনিস তৈরি, তা তো আর ওনার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। এই বিশ্বাসটা আরও পাকাপোক্ত হয়েছে কীসে জানেন?”

আমি প্রশ্ন করলাম, “কীসে?”

“বাজবরণের যত ঘোরাফেরা সব ওই ইন্দ্রসরোবরের দিকটা ঘেঁষে। ওই জঙ্গল থেকেই তিনি বেরিয়ে আসেন, আবার ওই জঙ্গলেই মিলিয়ে যান। ওদিকটায় অনেকখানি অঞ্চল জুড়ে কোনও চাষের খেত নেই, লোকালয় তো দূরের কথা। রয়েছে কেবল পোড়ো জমি আর জঙ্গল। শুনেছি, বহুবছর আগে এক সাধুবাবা ওই জঙ্গলের মধ্যে একটা মন্দির বানিয়েছিলেন, দধীচির মন্দির। লোকজনের যাতায়াতও শুরু হয়েছিল সেই মন্দিরে। কিন্তু…”

“কিন্তু কী?”

“একদিন সেই মন্দিরের চুড়োয় বাজ পড়ল। লোকজন ছুটে গিয়ে দেখল, সাধুবাবা একটা পোড়াকাঠের মূর্তির মতন মন্দিরের উঠোনে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। দেহে প্রাণ নেই। ব্যস, রটে গেল দধীচিমুনি চান না ইন্দ্রসরোবরের জঙ্গলে কেউ পা রাখুক। তারপর থেকে এত বছর আর কেউ ওই জঙ্গলের দিকে পা বাড়ায়নি।”

তরুণদা চিন্তিত মুখে বললেন, “কিন্তু মাঝখানে তো কয়েক হাজার বছর কেটে গেছে। হঠাৎ এতদিন বাদে মুনির টনক নড়ল কেন?”

“সেটা নিয়ে আমিও ভেবেছি। উত্তর পাইনি। সেইজন্যেই আমার বিশ্বাস ওটি মুনি নয়, অপদেবতা। আমি আবার ভগবানের থেকে ভূতে একটু বেশি বিশ্বাস রাখি। তবে দেবতা কিংবা অপদেবতা যাই হোক, বজ্রখেকো বাজবরণ যে এ তল্লাটে রয়েছে সেটা ঠিক। কপালে থাকলে আজকেই তাকে দেখতে পাবেন।”

 

 

তিন

 

কথা বলতে বলতে কখন যে চোখদুটো লেগে গিয়েছিল বুঝতেই পারিনি। ঘুম ভাঙল মন্মথবাবুর হাতের ঠেলায়। “অনীকবাবু, অনীকবাবু! উঠুন। তরুণবাবু উঠে পড়ুন। বেরোতে হবে।”

আমি আর তরুণদা দুজনেই ওঁর ডাকাডাকিতে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। চোখ খুলে প্রথমেই মনে হল, রাত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, না। সবে বিকেল চারটে। তাহলে?

সেইসময়েই গুরগুর করে মেঘ ডেকে উঠল। বুঝলাম এই অন্ধকার আসলে বর্ষা দুপুরের অন্ধকার। কাজলের মতন রাশি রাশি কালো মেঘ এসে কখন যেন ইন্দাসরাইয়ের আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। গুমগুম শব্দে ক্রমাগত মেঘ ডাকছে, সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলসানি। মন্মথবাবু বললেন, “গাড়ি বার করে রেখেছি। চোখেমুখে জল দিয়ে চলে আসুন। চা-টা রাস্তায় কোথাও খেয়ে নেব।”

এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব আর কিছু হয় না। আমি আর তরুণদা পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাড়ির পেছনের সিটে উঠে বসলাম। এ যাত্রাতেও ড্রাইভারের সিটে মন্মথবাবু।

আমাদের গাড়ি মিনিট দশেকের মধ্যেই পাকা রাস্তা ছেড়ে একটা সরু মোরামের রাস্তায় ঢুকে পড়ল। কিছুটা যাওয়ার পর রাস্তার ধারে একটা জমি পড়ল, যেটা কচ্ছপের পিঠের মতন উঁচু। দেখলাম, জমির মালিক সেখানে ধান কিংবা আঁখ না বুনে ইউক্যালিপটাসের বাগান করেছেন। সেই বাগানের মধ্যেই একটা পরিষ্কার জায়গায় গাড়িটাকে পার্ক করে মন্মথবাবু নেমে দাঁড়ালেন। পেছন পেছন আমরা।

মন্মথবাবু বললেন, “অনেক ঘোরাঘুরি করে দেখেছি, বাজবরণের দেখা পাওয়ার জন্যে এই জায়গাটাই সবচেয়ে ভালো। প্রথমত, জায়গাটা একটু উঁচু বলে চারিদিকে অনেক দূর অবধি দৃষ্টি যায়। তাছাড়া এই পথেই ইন্দ্রসরোবরের সবচেয়ে কাছে পৌঁছনো যায়। ওই দেখুন, ওই যে বাঁশগাছগুলো দেখছেন, ওর পেছনেই সেই জলা।”

তাকিয়ে দেখলাম, বড়জোর দুশ মিটার দূর থেকেই একটানা এক জঙ্গল শুরু হয়েছে। ভালো করে দেখলে জঙ্গলের আড়ালে জলের চিকমিকানিও চোখে পড়ে।

এতক্ষণ অবধি বেশ গুমোট ছিল। এবার হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। তার সঙ্গে বাদুলে হাওয়ার ছুটোছুটি। ভিজতে ভিজতেই ভাবছিলাম, কলকাতায় ফিরে গিয়ে তরুণদা যখন আমাদের এই অভিজ্ঞতার কথা লিখবেন, তখন সেই লেখাটা নিশ্চয় এখান থেকেই শুরু করবেন, এই ইউক্যালিপটাস বনের বৃষ্টি দিয়ে।
হঠাৎ মন্মথবাবু আমার জামার হাতাটা খামচে ধরে ফিসফিস করে বলে উঠলেন, “ওই দেখুন!”

উনি কোনদিকে আঙুল দেখাচ্ছেন সেটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগল। তারপরেই যা দেখলাম তাতে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। মন্মথবাবু তাঁর চিঠিতে যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, ঠিক সেই স্ক্রিপ্ট মেনেই যেন আমাদের সামনে একটা অভিনয় শুরু হয়েছে। কখন যেন জঙ্গলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে লম্বা, কালো একটা মূর্তি। খোলা মাঠের মাঝখান দিয়ে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে সেই মূর্তি হেঁটে চলেছে। তার গতি আমাদের উলটোদিকে। তার আর আমাদের দাঁড়িয়ে থাকার জায়গাটার মধ্যে দূরত্ব ক্রমশই বাড়ছে, কারণ দীর্ঘকায় ওই মুনি কিংবা অপদেবতা এক এক স্টেপেই অনেকটা পথ পেরিয়ে চলেছে।

তরুণদার দিকে তাকিয়ে দেখি ওনার চোখে কখন যেন উঠে এসেছে বাইনোকুলার। আমি আবার বাজবরণের দিকে নজর ফেরালাম।

এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বাজবরণ তার হাতদুটো আকাশের দিকে তুলে ধরল, ঠিক যেমনটা মন্মথবাবু তাঁর চিঠিতে লিখেছিলেন। মনে হল, তার দশ আঙুলের ডগা থেকে দশটা গাঢ় লাল আলোর রেখা পাক খেতে খেতে আকাশের দিকে উঠেই আবার মিলিয়ে গেল। পরক্ষণেই মেঘেদের মধ্যে দেখা দিল একটা চাঞ্চল্য। যেন কোনও ম্যাজিকে মেঘগুলো জ্যান্ত হয়ে গেছে, তারা আর হাওয়ার সঙ্গে পা মিলিয়ে দৌড়চ্ছে না। বরং চারিদিক থেকে এসে জমা হচ্ছে বাজবরণের ঠিক মাথার ওপরে একটা জায়গায়।

তারপরেই বাজ পড়ল।

পরিষ্কার দেখলাম, তীব্র-নীল আগুনের একটা ফলা আকাশ থেকে নেমে এসে ছুঁয়ে দিল বাজবরণের ব্রহ্মতালু। সেই বজ্রপাতের অভিঘাতে আমরা কেঁপে উঠলাম। আগুনের গরম হলকা আমাদের গা চেটে দিয়ে চলে গেল। কিন্তু আশ্চর্য, বাজবরণ ঠিক সেইভাবেই আকাশের দিকে দু-হাত তুলে দাঁড়িয়ে রইল। একটা হোঁচট অবধি খেল না।

এক মুহূর্ত পরেই বাজ পড়ার সেই চিরাচরিত ‘কড়াক’ শব্দটা পেলাম, যাকে ইংরিজিতে বলে থান্ডার-ক্ল্যাপ।

আমি বাজবরণের দিকে ক্যামেরা তাক করে পরপর চারবার শাটার টিপলাম। একবারও পরিষ্কার ছবি উঠল না। ভিউফাইন্ডারে শুধু একটা ধোঁয়াটে ফিগার দেখা যাচ্ছিল। বড়জোর মিনিট দশেক… প্রান্তরের আর এক কোনায় আবার সেই একই দৃশ্যের অভিনয় শুরু হল। সেই একইভাবে বাজবরণ আকাশের দিকে হাত তুলে ধরে দাঁড়াল। তার আঙুলের ডগা থেকে হিলহিলে সব আলোর সাপ দৌড়ে গেল মেঘের দিকে। শুরু হল মেঘেদের মিউজিকাল চেয়ার। আর তারপরেই পৃথিবী কাঁপিয়ে থান্ডার-ক্ল্যাপ।

বাজবরণ সৈকত মুখোপাধ্যায়

অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল। ধোঁয়ার মতন সাদা বৃষ্টির চাদরে পুরো দুনিয়াটাই ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে দিয়ে কোনও রকমে যা দেখলাম, তাতে মনে হল, বাজবরণ মাঠ ছেড়ে জঙ্গলে ফেরার রাস্তা ধরেছে। এরপর কী হবে? আমরাও কি বাড়ি ফিরে যাব?

বাইনোকুলারটা ব্যাগে ঢুকিয়ে হঠাৎই তরুণদা টিলার ঢাল বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলেন। আমি পেছন থেকে ডাকলাম, “তরুণদা! কোথায় যাচ্ছেন?”

“তুমিও এসো অনীক। বাজবরণ ওই জঙ্গলের দিকে হাঁটা লাগিয়েছে। ও জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ার আগেই ওকে ধরতে হবে।”

এবার চিৎকার করে উঠলেন মন্মথবাবু। বললেন, “বাড়াবাড়ি করবেন না তরুণবাবু। অশরীরীদের সঙ্গে ছেলেখেলা করবেন না।”

তরুণদা ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, “মন্মথবাবু, ও আর যাই হোক, অশরীরী নয়। ওর শরীর রয়েছে। বাইনোকুলারের মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার দেখলাম, ওর পায়ে কাদা লেগে রয়েছে। আমাকে শুধু দেখতে হবে সে কেমন শরীর, যা মাথায় বাজ পড়ার পরেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, হেঁটে চলে যেতে পারে।”

মন্মথবাবু বললেন, “আমি গাড়ি ছেড়ে যেতে পারব না। আপনারা দুজন ঘুরে আসুন। আর শুনুন। বিপদ বুঝলে…”

উনি হাত তুলে মোবাইল ফোনটা দেখালেন।

 

 

চার

 

বাজবরণ যেদিকে গিয়েছিল, আমি আর তরুণদাও সেইদিকে চললাম, মানে ওই জঙ্গলের দিকে। চলাটা সহজ ছিল না। বৃষ্টিতে পায়ের নিচের আলপথ কাচের মতন পেছল হয়ে গিয়েছিল। আমাদের দুজনেরই পায়ে হান্টার-শু ছিল, তবু কতবার যে পিছলে পড়লাম, তার ঠিক নেই। তার ওপরে বৃষ্টির চোটে চোখে ভালো দেখতেই পাচ্ছিলাম না। যাই হোক, প্রায় পনেরো মিনিট প্রাণ হাতে নিয়ে হাঁটবার পরে কোনও রকমে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। ততক্ষণে বাজবরণ কোথায় লুকিয়ে পড়েছে, কে জানে।

এখন আমাদের চারিদিকে বাঁশ, ডুমুর, হিজল, কদম এমন সব জংলা গাছের বন। পুরো বনটাই একটা বিরাট জলাজমিকে ঘিরে গোল হয়ে গজিয়ে উঠেছে। আমি আর তরুণদা চোখ খোলা রেখে জলাজমির সীমানা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম।

একে মেঘে ঢাকা আকাশ, তার ওপরে দ্রুত সন্ধে নেমে আসছে। বৃষ্টিরও কোনও বিরাম নেই। এই পরিবেশে এই জঙ্গলের মধ্যে বাজবরণকে খুঁজে পাওয়ার আশাটাকে ততক্ষণে নিতান্তই দুরাশা বলে মনে হচ্ছিল। এমনকী তরুণদার মতন প্রাণোচ্ছল মানুষের অভিব্যক্তিও বলছিল উনি ফেরার কথা ভাবছেন।
ঠিক তখনই আমরা একটা বড় বটগাছের নীচে ভাঙা ইমারতটাকে দেখতে পেলাম।

বাড়িটার গড়ন দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না, ওটাই সেই দধীচিমুনির পরিত্যক্ত মন্দির। মন্দিরের বারো আনাই ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। যে ঘরটা এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেটা নিশ্চয় এককালে মন্দিরের গর্ভগৃহ ছিল, কারণ সেটার মাথাতেই টোপরের মতন চুড়োর কিছুটা অংশ তখনও কোনও রকমে দাঁড়িয়ে ছিল। তরুণদা ব্যাগ থেকে একটা বড় টর্চ বার করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। তারপর নিজে মাটি থেকে একটা মোটা গাছের ডাল তুলে নিয়ে বললেন, “চলো, দেখে আসা যাক, মন্দিরে দধীচিমুনি ওরফে বাজবরণ ফিরে এসেছেন কিনা।”

কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে আমরা ঘরটার দরজার সামনে পৌঁছে গেলাম। দরজাটা বন্ধ ছিল। অবাক হয়ে দেখলাম, ক্ষয়ে যাওয়া পুরনো ইঁটের দেয়ালের গায়ে বসানো পিভিসি-শিট দিয়ে তৈরি পাল্লাদুটো একেবারেই নতুন। এমনকী অ্যালুমিনিয়ামের ডোর-ল্যাচটাও এখনও ঝকঝক করছে। তরুণদা গাছের ডালটা বাগিয়ে ধরে একটা লাথি মেরে দরজাটা খুলে ফেললেন।

দরজা খুলতেই শেষ বিকেলের নীলচে আলোর একটুখানি চলকে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল আর সেই আলোয় আমি আমার জীবনের বীভৎসতম দৃশ্যটি দেখলাম। দেখলাম, দরজার ঠিক মুখোমুখি দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছেন লম্বা কালো একজন মানুষ। তার চোখ নাক কানের পাতা মাথার চুল কিছুই নেই। মুখের এখানে ওখানে শুধু কয়েকটা অন্ধকার গর্ত। খালি গা। দেখতে পাওয়ার কথা নয়, তবু মাংস চামড়া ভেদ করে তার বুকের খাঁচা দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যেও পাঁজরের সাদা হাড়গুলো জ্বলছিল। দেখলাম বেশ কয়েকটা হাড় মিসিং।

আমার গলা দিয়ে অজান্তেই একটা শব্দ বেরিয়ে এল — দধীচি।

তরুণদা আমার হাত থেকে টর্চলাইটটা কেড়ে নিয়ে সোজা ওই লোকটার গায়ের ওপর আলো ফেললেন। একটা শেয়াল এতক্ষণ লোকটার শরীরের পেছনে গা-ঢাকা দিয়ে বসেছিল। চোখে আলো পড়তেই লাফ মেরে কোনদিকে যেন পালাল। মুখে করে নিয়ে গেল মানুষের পাঁজরের একটা হাড়ের টুকরো।
তরুণদা লোকটার মাথা থেকে পা অবধি মেপে নিয়ে বললেন, “দধীচি নন, অন্য কোনও হতভাগ্য। কয়েকদিন আগেই মরেছেন। এখন শেয়ালের খাদ্য।”
ঘরের মধ্যে ঢুকতেই পচা মাংসের দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল। চারিদিকে টর্চের আলো ফেলে দেখলাম ঘরটার চেহারা একটা অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরির মতন। চারিদিকে থরেথরে ঝকঝকে মেশিনপত্র সাজানো রয়েছে। একটা বড় জেনারেটর, নানান আকারের কয়েল, রেজিস্ট্যান্স, ক্যাপাসিটর, মনিটর। এক কোনায় একজনের শোয়ার মতন একটা বিছানা আর সেই বিছানার ওপরে পড়ে রয়েছে একটা ল্যাপটপ।

তরুণদা ওদিকে হেঁটে গেলেন এবং সেই ল্যাপটপটা হাতে তুলে নিয়ে বললেন, “চলো অনীক। আপাতত এইটা থেকে দেখা যাক, বাজবরণ রহস্যের কোনও সূত্র পাই কিনা। কাল আবার আসা যাবে।”

আমাদের ফিরতে দেখে মন্মথবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। ওঁকে সংক্ষেপে সব কথা জানিয়ে আমরা ওঁর বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।

গাড়িটা যখন মোরাম রাস্তা থেকে বাঁক নিয়ে পিচের রাস্তায় উঠছে, তখনই হঠাৎ তরুণদা উত্তেজিত গলায় বলে উঠলেন, “দ্যাখো অনীক, দ্যাখো।”

মন্মথবাবু ব্রেক কষে গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তরুণদা যেদিকে দেখাচ্ছিলেন, সেদিকে তাকিয়ে আমরা দুজনেই দেখতে পেলাম, অনেক দূরে মাঠের শেষে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাজবরণ। এমনিতে তাকে দেখতে পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু বৃষ্টি ধরে গিয়ে তখন ক্রমাগত বিদ্যুত চমকাচ্ছিল। সেই বিদ্যুতের আলোতেই দেখলাম, লম্বা মানুষটা খুব ধীর পায়ে শরীরটাকে কোনও রকমে টানতে টানতে হেঁটে চলেছে। এমনকী এও মনে হল, সে যেন হাতদুটোকে ওপরে তুলবার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। কিছুটা উঠেই হাতদুটো আবার পড়ে যাচ্ছে।

মন্মথবাবু ধরা গলায় প্রশ্ন করলেন, “আপনারা কি একটু আগে এনাকেই দেখে এলেন?”

তরুণদা বললেন, “সম্ভবত না। একে দেখে ঠিক চলমান মৃতদেহ বলে তো মনে হচ্ছে না।”

“তাহলে যাকে দেখলেন তিনি কে?”

দধীচির মন্দির থেকে তুলে আনা ল্যাপটপটা তরুণদার কোলেই ছিল। উনি গাড়িতে উঠে থেকেই ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। মন্মথবাবুর প্রশ্ন শুনে ল্যাপটপের কোনায় আটকানো একটা ভিজিটিং কার্ডের দিকে মুখটা ঝুঁকিয়ে বললেন, “যার মৃতদেহ দেখে এলাম তিনি ডক্টর রামনাথ দ্বিবেদী। ফালমিনোলজিস্ট।”

“কী লজিস্ট?”

“ফালমিনোলজিস্ট। এফ ইউ এল — ফাল। এম আই এন ও — মিনো। এল ও জি আই এস টি — লজিস্ট। যদ্দূর জানি, ফালমিনোলজি হল বিজ্ঞানের সেই শাখা, যেখানে বজ্রবিদ্যুত নিয়ে গবেষণা করা হয়। উপরন্তু এই ভিজিটিং কার্ড বলছে, ডক্টর রামনাথ দ্বিবেদী ইলিনয় ইউনিভার্সিটির রিসার্চ স্কলার ছিলেন।”

মন্মথবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ইলিনয় থেকে এতদূর ইন্দাসরাইয়ে এসে একজন এইভাবে মারা গেলেন! ভাবা যায়?”

 

 

পাঁচ

 

মন্মথবাবুর বাড়িতে ফেরার পর চান-টান করে, চা খেয়ে ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় গেল। তারপর আমরা তিনজন ল্যাপটপটাকে ঘিরে বসলাম। মেশিনটা খুলতে খুব একটা অসুবিধে হল না। কয়েকটা ফাইল পাসওয়ার্ড দিয়ে প্রোটেক্ট করা ছিল। সেসব ফাইলের নাম দেখেই বুঝতে পারছিলাম খুলতে পারলেও সেগলো আমরা বুঝতে পারতাম না, কারণ নামগুলোর সঙ্গে জটিল সব বৈজ্ঞানিক পরিভাষা জোড়া ছিল। আমরা যা খুঁজছিলাম সেটা ডেস্কটপেই পেয়ে গেলাম। একটা ফোল্ডার যেটার নাম খুব সাদাসিধে — মাই ডায়েরি।

হয়তো মৃত মানুষের ডায়েরি পড়া উচিত নয়, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমাদের হাতে অন্য কোনও বিকল্পও ছিল না।

তরুণদা তাঁর ভরাট গলায় সেই ডায়েরি পড়ে গেলেন। বেশিরভাগটাই বুঝলাম না। তবে যেটুকু বুঝলাম, তাও মাথার চুল খাড়া করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
রামনাথ দ্বিবেদী বজ্রপাতের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এনার্জিকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে বেশ কয়েক বছর ধরে গবেষণা করছিলেন। একটা সময় তাঁর মনে হল তিনি সাফল্যের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছেন। একই সময়ে তাঁর মনে হল, তাঁর কয়েকজন সিনিয়র সহকর্মী তার রিসার্চের কাজ চুরি করবার চেষ্টা করছেন।
এই জায়গায় রামনাথ দ্বিবেদী লিখেছেন, সহকর্মীরা তাঁকে ছোট করার জন্যে তাঁকে পাগল বলে প্রচার শুরু করছে। শুনে কেমন যেন খটকা লাগল। সত্যি করেই পাগল হয়ে যাননি তো রামনাথবাবু?

প্রতিভাবান আর পাগলে তফাৎ কিন্তু খুব সামান্য।

যাই হোক, রামনাথবাবু ইউনিভার্সিটি থেকে তিন মাসের ছুটি নিয়ে ভারতে, আরও সঠিক ভাবে বলতে গেলে ইন্দাসরাইয়ে পালিয়ে এলেন।

এখানে আসার পেছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। প্রথমত রামনাথবাবু এদিককারই লোক। বালিয়া শহরে তাঁর পৈতৃক বাড়ি, যদিও সেই বাড়িতে এখন আর আত্মীয়স্বজন কেউ থাকেন না। দ্বিতীয়ত, ছোটবেলার অনেকগুলো বছর এইদিকে কাটিয়েছিলেন বলে রামনাথবাবুর মনে ছিল জায়গাটা কেমন বজ্রপাতপ্রবণ। তাঁর গবেষণার বাকি কাজটুকুর জন্যে এরকম একটা জায়গার প্রয়োজন ছিল।

তৃতীয় কারণটাই ছিল সবচেয়ে জোরালো। এর থেকে বোঝা যায়, পাগল হলেও রামনাথ দ্বিবেদী কতটা বুদ্ধিমান ছিলেন। ওঁর গবেষণার জন্যে একদিকে যেমন প্রয়োজন ছিল অনেকখানি খোলা মাঠ, আবার তেমনই প্রয়োজন ছিল নির্জনতা। কেউ যেন তাঁর ব্যাপারে নাক না গলায়। কেউ যেন সকালবেলায় খবরের কাগজ পড়ার অজুহাতে তাঁর ঘরে না ঢুকে পড়ে। তিনি ইন্দ্রসরোবরের মন্দিরের কথা জানতেন। জানতেন জায়গাটা অভিশপ্ত বলে পরিচিত। ওখানে পারতপক্ষে কেউ পা দেয় না। তাছাড়া তিনি মনের চোখে দেখে নিয়েছিলেন তাঁর গবেষণার কাজকে স্থানীয় লোকেরা কেমন করে দধীচির লোককথার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারে।

অতএব মন্দিরটাকে একটু সারিয়ে-সুরিয়ে নিয়ে ফালমিনোলজিস্ট রামনাথ দ্বিবেদী আজ থেকে ঠিক দুমাস আগে ওখানে ঢুকে পড়লেন। ঘর সারানোর জন্যে একটাই মিস্তিরিকে নিয়ে এসেছিলেন বালিয়া থেকে। সেই মিস্তিরি কাজ সেরে আবার বালিয়াতেই ফিরে গিয়েছিল। কাজেই ইন্দাসরাইয়ের কেউ জানলই না যে, রামনাথবাবু ওখানে ঢুকলেন।

এবার ওখানে বসেই রামনাথবাবু তাঁর গবেষণা শেষ করলেন।

ভুল বললাম। বলা উচিৎ ‘প্রায়’ শেষ করে ফেললেন। যেটুকু উনি শেষ করতে পারলেন না সেটুকুর জন্যেই ওঁর প্রাণ গেল।

ডায়েরিতে খুব অল্প কয়েকটা কথায় রামনাথবাবু তাঁর সামনের চ্যালেঞ্জ এবং তার সমাধানগুলোর কথা লিখে রেখেছিলেন।

চ্যালেঞ্জ নাম্বার ওয়ান — একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বজ্রপাত ঘটানো। এর জন্যে রামনাথ দ্বিবেদী যে টেকনোলজির প্রয়োগ করেছিলেন তাঁকে বলা যেতে পারে ‘লেজার ইনডিউসড প্লাজমা চ্যানেল’। অ্যাটমোস্ফিয়ারের মধ্যে দিয়ে খুব জোরালো লেজার বিম পাঠালে আয়োনাইজড গ্যাসের একটা স্তম্ভ তৈরি হয়। সেই পথে আকাশের বিদ্যুত মাটিতে নেমে আসে। নেমে আসে একটা নির্দিষ্ট জায়গায়।
বাজবরণের আঙুলের ডগা থেকে আকাশের দিকে তেড়ে যাওয়া আলোর সাপের রহস্য যেন একটুখানি পরিষ্কার হল।

চ্যালেঞ্জ নামবার টু — বিলিয়ন জুলের একটা থান্ডারবোল্টের শক্তিকে ধরার মতন ক্যাপাসিটর এবং ব্যাটারি বানানো। সেটা বানিয়ে ফেলেছিলেন ওই প্রতিভাধর বিজ্ঞানী। তবে বজ্রের শক্তির বেশির ভাগটাকেই উনি নষ্ট করে দিতেন। নাহলে বাজ ধরার মেশিন নষ্ট হয়ে যেত। উনি ভবিষ্যতে এমন ব্যাটারি আর ক্যাপাসিটর বানানোর স্বপ্ন দেখতেন, যাতে পুরো শক্তিটাকেই বন্দী করা যায়।

আরও বেশ কয়েকটা সমস্যা ছিল। সবগুলো ভালো বুঝতে পারিনি। যেমন বজ্রের ভেতরে যে বৈদ্যুতিক শক্তি, তা নাকি কখনও পজিটিভ আবার কখনও নেগেটিভ চার্জ বিশিষ্ট হয়। একই যন্ত্রে দুরকমের শক্তিকে ধরা কঠিন। এরও সমাধান করেছিলেন রামনাথ দ্বিবেদী।
তবে ওঁর কাছে যেটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, সেটার সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক ছিল না। সম্পর্ক ছিল মনস্তত্ত্বের। ওঁর নিজের আশ্চর্য মনস্তত্ত্ব। বজ্রবিদ্যুত নিয়ে গবেষণা ল্যাবরেটরিতে বসে করা যায় না, খোলা আকাশের নীচে বেরোতেই হবে। সেভাবে বাইরে বেরোলে লোকের চোখ এড়ানো যাবে না। কৌতূহলী মানুষের মুখের কথা শুনে টনক নড়বে মিডিয়ার। ইন্দাসরাই থেকে খবর পৌঁছে যাবে ইলিনয়ে। আর তাহলেই সেই যে বদমাশ লোকগুলো তাঁর গবেষণার ফল চুরি করতে চাইছে, তারা এখানে এসে হানা দেবে।

এই জায়গাটা পড়তে পড়তে আমরা বুঝতে পারছিলাম, নিছক পাগলামি। কিন্তু রামনাথবাবুর কাছে এটা ছিল বাস্তব আতঙ্ক। দুর্দান্ত এক উপায়ে উনি এই সমস্যার সমাধান করেছিলেন। ওঁর যন্ত্রপাতিগুলোকে পুরে দিয়েছিলেন একটা রোবটের পেটে। খুব একটা উঁচু দরের রোবট নয়। আজকাল যে কম্পিউটার পরিচালিত হুইল-চেয়ারগুলো পাওয়া যায় তার থেকেও সাধারন টেকনোলজি দিয়ে বানানো একটা মানুষের মতন অবয়ব। উনি নিজেই সেটাকে বানিয়ে নিয়েছিলেন।

এই রোবটই হল বাজবরণ। উনি নিজে অবশ্য একবারও জিনিসটাকে ‘বাজবরণ’ নামে ডাকেননি। ‘আমার প্রিয় রোবট’ বলেই উল্লেখ করেছেন। কখনও আবার আদর করে বলেছেন, ‘মাই সন’। আমার সন্তান।

বাজবরণ চলাফেরা করে আকাশ থেকে ছিনিয়ে আনা বৈদ্যুতিক শক্তির জোরে। গত দুমাস ধরে রামনাথবাবু তাকে নিজের প্রয়োজন মতন বর্ষার বজ্রগর্ভ আকাশের নীচে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাজবরণ তার শরীরের মধ্যে বিদ্যুত নিয়ে ফিরে গেছে ডক্টর দ্বিবেদীর ল্যাবরেটরিতে। সেখানে রোবটের শরীরের ভেতরে বসানো নানান মনিটরের রিডিং দেখে রামনাথবাবু তাঁর গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

এর মধ্যেই কখনও কখনও তিনি ইন্দাসরাইয়ায়ের বাজারেও গিয়েছেন। নিজের খাবারদাবার, জলের বোতল, মশার ধূপ, ওষুধ এইসব কিনতে কিনতে কান পেতে শুনেছেন দধীচিমুনির ফিরে আসার গল্প। শুনে মনে মনে বেদম হেসেছেন। ভাবতে পারেননি সেই হাসি অত তাড়াতাড়ি মুছে যাবে।
ডায়েরির শেষদিকে এসে রামনাথবাবু লিখেছেন এক বিপদের কথা। তাঁর রোবট নাকি গণ্ডগোল শুরু করেছে। যে ছোট্ট মেশিনটার মধ্যে দিয়ে বজ্রের বিপুল শক্তির বেশিরভাগটাকেই তিনি মাটিতে মিশিয়ে দিতেন, সেই মেশিনটাই নাকি ঠিক মতন কাজ করছিল না। ফলে বজ্রের প্রচণ্ড অভিঘাতে এক এক করে রোবটের পেটের ভেতরের অনেক কলকব্জাই খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।

চারদিন আগে ওই ফাইলের শেষ এন্ট্রিতে রামনাথ দ্বিবেদী লিখেছেন, কালকেই আমাকে একবার পাটনায় যেতে হবে। কিছু রেজিস্ট্যান্স আর কয়েল এখনই না কিনলে নয়। রোবটের বডি থেকে ভয়ঙ্কর ইলেকট্রিসিটি ডিসচার্জ হচ্ছে। আজ একটুর জন্যে মরতে মরতে বেঁচে গেছি।

ল্যাপটপটা শাট-ডাউন করে তরুণদা আমাদের মুখের দিকে তাকালেন। বললেন, “বোঝাই যাচ্ছে, রামনাথবাবু শেষ অবধি বাঁচতে পারেননি। সম্ভবত পরের দিনই আবার রোবটকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে জোরালো শক খেয়েছিলেন। ওনাকে বাঁচাবার জন্যে ধারেকাছে কেউ ছিল না।”

মন্মথবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আর রোবটটা? বাজবরণ? তার কী অবস্থা?”

তরুণদা বললেন, “অবস্থা যে ভালো নয় সে তো নিজের চোখেই দেখলাম। হাত তুলতে পারছে না। হাত না তুলতে পারলে লেজার-বিম মেঘের দেশে পৌঁছবে না। তা যদি না পৌঁছয় তাহলে প্লাজমা চ্যানেল তৈরি হবে না। বজ্রপাত ঘটবে না। অতএব এক সময় না এক সময় এনার্জির অভাবে বাজবরণও ওই জঙ্গলের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়বে।”

মন্মথবাবু তাই শুনে কঠিন মুখে উঠে দাঁড়ালেন। টেবিলের ওপর একটা ঘুষি মেরে বললেন, “আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে এখনই ফিরে চলুন। বাজবরণকে তুলে নিয়ে আসি। ও কিন্তু মানবজাতির সম্পদ। ওর মধ্যে অলটারনেটিভ এনার্জির এক বিশাল ভাণ্ডারের চাবিকাঠি লুকনো রয়েছে। ওকে নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। চলুন অনীকবাবু! চলুন তরুণবাবু! ওকে নিয়ে এসে আমরা কোনও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেব। প্রফেসর দ্বিবেদীর বাকি কাজটা তারা নিশ্চয়ই শেষ করতে পারবে।”

আমি বললাম, “ঠিক বলেছেন। তাছাড়া অমন এক কৃতী মানুষের মৃতদেহ কুকুর শেয়ালের পেটে যাচ্ছে, এটা নিজের চোখে দেখে ভীষণ খারাপ লাগছে। ওই মৃতদেহটাও নিয়ে আসব।”

মন্মথবাবু বললেন, “অবশ্যই। এখানকার পুলিশ-টুলিশ সব আমার বন্ধু। ইনকোয়েস্টে বেশি সময় লাগবে না। কাল ভোরবেলাতেই ওনার সৎকার করব।”

তরুণদার চোখ-দুটোও আমাদের কথোপকথন শুনতে শুনতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উনিও উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “আমিও ঠিক এই কথাগুলোই ভাবছিলাম। কিন্তু এরকম বিশ্রী ওয়েদার। ইন্দ্রসরোবরের অমন ভয়ঙ্কর পরিবেশ। ওখানে যাওয়ার পাকা রাস্তাও তো নেই। এত রাতে যাওয়া যাবে?”

মন্মথবাবু বললেন, “ধুর মশাই। আমার নাম মন্মথনাথ সরকার। এই ইন্দাসরাইয়ের তিনপুরুষের বাসিন্দা। আমি চাইলে এক ঘণ্টার মধ্যে রাতকে দিন করে দিতে পারি। আপনি চিন্তা করছেন কেন? দেখুন না কী করি।”

 

 

ছয়

 

পরের এক ঘণ্টায় মন্মথবাবু যা করলেন সেটা সত্যিই দেখবার মতন। ওই তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও সরকারবাড়ির বিশাল উঠোনে একটা বুলডোজার আর একটা ডাম্পার এসে হাজির হল। তাছাড়া হইহই করতে করতে চলে এল অন্তত দশজন লেবার। সবই ওঁর কাঠের ব্যবসার অঙ্গ।

তারপর আমরা সেইদিনের মধ্যে দ্বিতীয়বার ভাঙা মন্দিরের উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আসবার সময় সবার আগে ছিল বুলডোজারটা। গাছপালা, পাথর-টাথর সব সমান করে দিয়ে সে বাকি কনভয়ের জন্যে রাস্তা করে দিচ্ছিল।

ডাম্পার আর বুলডোজারের চারটে হেড-লাইটের আলোয় মন্দিরের দরজাটা দিনের আলোর মতন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এখান থেকে ফিরবার সময় দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছিলাম, যাতে শেয়াল-কুকুর না ঢুকে পড়ে। দরজাটা খুলে দেখলাম রামনাথবাবুর মৃতদেহ একভাবেই পড়ে রয়েছে। কিন্তু বাজবরণের চিহ্নও কোথাও দেখলাম না।

মন্মথবাবু চিন্তিত গলায় বললেন, “গেল কোথায় বলুন তো রোবট-টা? মাঠের মধ্যেই কোথাও মুখ থুবড়ে পড়ে রইল নাকি?”

ওঁর কথার মধ্যেই আমরা শুনতে পেলাম ক্লিং ক্লিং করে একটা ধাতব আওয়াজ। যেন কেউ পায়ের লোহার শেকল টেনে টেনে হাঁটছে। একটু বাদেই মন্দিরের পেছনদিক থেকে বেরিয়ে এল বাজবরণ। এই প্রথম আমরা এত কাছ থেকে ওকে দেখলাম।

কাছ থেকে দেখলাম বলেই বুঝতে পারলাম, ওর পুরো শরীরটাই কালচে রঙের কোনও সেরামিক জাতীয় জিনিস দিয়ে গড়া। চোখের জায়গায় দুটো ফোটো সেন্সর। এছাড়া শরীরের নানান জায়গা থেকে ছোটো ছোটো অ্যান্টেনার মতন জিনিস বেরিয়ে রয়েছে।

বাজবরণকে দেখে মনে হল না আমাদের উপস্থিতি ওর ওপরে কোনও প্রভাব ফেলেছে। তবে ওর প্রভাব আমাদের লেবারদের ওপরে ভালোরকমই পড়ল। অনেক লোকের ভয়ার্ত গলার আওয়াজ পেয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, সবাই দৌড়ে পালিয়েছে।

আবার সামনের দিকে তাকালাম, বাজবরণের দিকে। ভেতরের প্রোগ্রাম অনুযায়ী ও আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেকে বাঁচাতে, মানে আকাশের বাজকে নিজের ভেতরে টেনে আনতে। কিন্তু পারছে না। হাতদুটো ওপরে তুলে ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু তুলতে পারছে না।

তরুণদা কিছুক্ষণ বাজবরণকে ভালো করে দেখে বললেন, “দাঁড়াও, ওকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিই। ওর শরীরে কোথাও একটা সুইচ কিংবা লিভার জাতীয় কিছু নিশ্চয় রয়েছে, যেটা দিয়ে ওকে ডিঅ্যাকটিভেট করা যায়। ডিঅ্যাকটিভেট না করলে ওকে নিয়ে যেতেও অসুবিধে হবে।” এই বলে তরুণদা বাজবরণের দিকে এগিয়ে গেলেন।

আমি পেছন থেকে বললাম, “তরুণদা, খুব সাবধান। শক খাবেন না যেন।”

তরুণদা বললেন, “আরে নাঃ। প্রিকশন নিয়েই যা করার করছি।” তারপর ব্যাগ থেকে একটা হেভি ডিউটি প্লায়ার্স বার করে বাজবরণের পিঠের দিকে ঝুঁকে কোনও একটা অ্যান্টেনায় মোচড় দিলেন।

এরপরেই যেটা ঘটল সেটার জন্যে আমরা কেউই তৈরি ছিলাম না। যে হাতদুটো এতক্ষণ ভালো করে নাড়াতেই পারছিল না, সেই হাতদুটোকেই হঠাৎ বাজবরণ আকাশের দিকে তুলে ধরল। দশ-আঙুলের ডগা থেকে কিড়কিড় শব্দ করে লেজার-বিমের ফলা উঠে গেল আকাশের দিকে। আমি চিৎকার করে উঠলাম – পালাও, পালাও!

আমি, তরুণদা আর মন্মথবাবু মন্দিরের দিকে পেছন ফিরে দৌড়তে শুরু করলাম। বাজবরণ মন্দিরের দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল।

ঠিক তিরিশ সেকেণ্ড পরে যে বজ্রপাতটা ঘটল, সেরকম বজ্রপাতের ঝলসানি আমি অন্তত আগে কখনও দেখিনি। আমরা তিনজনেই মাটির ওপরে ছিটকে পড়লাম। কিছুক্ষণের জন্যে নিশ্চয় জ্ঞান হারিয়েছিলাম। জ্ঞান ফেরার পরে মাটির মধ্যে থেকে মুখ তুলে দেখলাম, দধীচিমুনির মন্দিরের আর কোনও চিহ্ন নেই। এখানে ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে পোড়া ইঁটের টুকরো। বাজবরণ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ছাই হয়ে গেছেন তার কারিগর রামনাথ দ্বিবেদী।

তরুণদা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। মুখ থেকে জলকাদা মুছতে মুছতে বললেন, “নাড়াচাড়া করতে গিয়ে কোন মেশিনে হাত দিয়ে ফেললাম কে জানে। বাজবরণ বাজ নামিয়ে আনল ঠিকই, কিন্তু তাকে আর ধরে রাখতে পারল না।”

মন্মথবাবু মাটি থেকে একটা পোড়া কয়েল কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে রাখতে রাখতে বললেন, “যা হল ভালোই হল, বুঝলেন?”

তরুণদা জিজ্ঞেস করলেন, “কীরকম?”

“রামনাথ দ্বিবেদী সারাজীবন বজ্রবিদ্যুত নিয়েই সাধনা করেছিলেন, বাজের আগুনেই তাঁর দাহ হয়ে গেল। সৎকার করল তার প্রিয় রোবট, যাকে তিনি বলতেন ‘আমার সন্তান’। এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?

“চলুন, ফেরা যাক।”

 

ছবি – সুমিত রায়

গল্পটি টগবগ উৎসব সংখ্যা ১৪২৩-এ প্রকাশিত

Leave a Reply

Your email address will not be published.