বলো তো দেখি, ইতালির টাকাপয়সাকে কী বলে? হ্যাঁ, এখন ইউরো বলে ঠিকই, ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই ইউরো চালু আছে। কিন্তু এটা জানো কি যে, ইউরোর আগে ইতালিতে লিরা চালু ছিল? আমাদের টাকাপয়সার নাম যেমন রুপি, ইতালির তেমনি লিরা। সেই লিরাতে এমন একজনের ছবি ছাপা আছে (না, সব লিরাতে না, শুধু ১০০০ লিরার ব্যাঙ্কনোটে), তোমরা নাম শুনলেই হয়তো লাফিয়ে উঠবে।
মারিয়া মন্তেসরি।
কী, চেনা চেনা লাগছে না? লাগবেই তো, তোমরা অনেকেই যে মন্তেসরি স্কুলে পড়েছ বা না পড়লেও অনেকেরই স্কুলে মন্তেসরি ১, মন্তেসরি ২ এরকম কিছু ক্লাস তো ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু তোমরা হয়তো এটা জানতে না যে এই মন্তেসরি কথাটা এসেছে আসলে মারিয়া মন্তেসরির নাম থেকে। তোমাদের এই মারিয়া মন্তেসরির গল্প বলব এখন, যিনি তোমাদের বয়সি বাচ্চাদের কথা ভেবে, কী করে পড়াশোনাকে খেলার মতো করে শেখা যায়, সেই ভাবনাতেই নিজের গোটা জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন।
ইতালি এখন যেরকম দেখতে লাগে ম্যাপে, আগে কিন্তু সেরকম ছিল না। আমাদের দেশের মতো এতগুলো না হলেও বেশ কয়েকটা ছোট ছোট অংশে ভেঙে ছিল। অনেক পরে নিজেরা এক হয়ে আমাদের দেশের মতোই একটা ঐক্যবদ্ধ দেশ তৈরি করে। এরও বেশ অনেকগুলো বছর পরে মারিয়া মন্তেসরির জন্ম হয়। তাও ধরো, আজ থেকে ১৫০ বছর আগে, ১৮৭০ সালে।
মজার কথা কী জানো, মারিয়া যখন জন্মালেন, তার আগে পর্যন্ত কিন্তু মেয়েদের স্কুলে যেতে দেওয়া হত না। ওই বছরেই সরকার থেকে বলা হল যে মেয়েরা এবার থেকে স্কুলে যেতে পারবে। ভাবো একবার! তার মানে হল, এরকমটা নয় যে শুধু আমাদের দেশেই এমন অন্যায় করা হত, ইতালির মতো দেশেও একই কাজ করা হত। কিন্তু সবাই কি অশিক্ষিত হয়ে থাকত? লেখাপড়া জানত না? না, পড়াশোনা করত ঠিকই, কিন্তু সেটা ঠিক করে দিত চার্চ বা মেয়ের বাড়ির লোকজন। কী পড়বে, কতটা পড়া দরকার… সমস্তটাই। এ তো গেল ছোটবেলার কথা। বড় হলেও কি কিছু পালটাত? না, সেটাও হত না। মেয়েদের নিজেদের সম্পত্তি বলে কিছু ছিল না, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল না, কিছুই ছিল না। আমাদের মা-জেঠিমাদের যে দেখি ভোট দিতে যেতে, ইতালিতে সেটাও ছিল না সেই সময়। এইরকম একটা সময়ে মারিয়ার জন্ম হল। এবার তোমরা ভাবছ যে, এরপরেও মারিয়া মন্তেসরির এত নাম হল কী করে বা এত পড়াশোনাই বা করলেন কী করে? সেটাই বলব এবার।
ছোট থেকেই মারিয়া পড়তে খুব ভালোবাসতেন। বাড়ির বইয়ের তাকে যত ছোটদের বই ছিল, সব পড়া হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বাবা-মা ভেবেছিলেন, মেয়ে হয়তো বড় হয়ে স্কুলে পড়াবে। একটু বড় হলে মারিয়াকে ছোটদের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল। কিন্তু মারিয়ার সেখানে ভালো লাগত না। স্কুলে আবার কারুর ভালো লাগে নাকি? সেই একঘেয়ে পড়া আর টিচারের বকাঝকা। মারিয়া করতেন কী, ক্লাসে বসে ছোট ছোট খেলা তৈরি করতেন, যা দিয়ে ক্লাসের পড়া শেখা যায়। ক্লাসটিচারের বকুনিও খেতেন। তাতে অবশ্য মারিয়া এসব করা বন্ধ করে দেননি।
আরেকটু বড় হলে মারিয়াও গেলেন অন্য আরেকটা স্কুলে। সেই স্কুলে আবার শুধুই ছেলেরা পড়ত। কারণ, মেয়েরা তো আর খুব একটা পড়াশোনা করত না, তাই মেয়েদের স্কুলও ছিল না। মারিয়া কী আর করবেন, ছেলেদের স্কুলেই ভর্তি হলেন বাধ্য হয়ে। বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন, সেটাই পড়লেন। পড়াশোনায় ভালো ছিলেন, ফলে ভালো রেজাল্টও করতেন।
মারিয়ার ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ছিল খুব। তাই স্কুল পাশ করে মেডিকাল কলেজে ভর্তি হলেন। মারিয়াই ইতালির প্রথম মেয়ে যিনি ডাক্তারি পড়তে গেলেন এবং এইখানেই আমাদের কাদম্বিনী গাঙ্গুলির সঙ্গে মারিয়ার দারুণ মিল। তোমরা হয়তো জেনে অবাক হবে যে, মারিয়া মন্তেসরিই হচ্ছেন ইতালির প্রথম মহিলা ডাক্তার, ঠিক যেরকম কাদম্বিনী আমাদের দেশের প্রথম মহিলা ডাক্তার ছিলেন। হ্যাঁ, মারিয়ার আগে ইতালিতে আর কোনও মহিলা কখনও ডাক্তার হননি।
ডাক্তারি তো পড়তে গেলেন, কিন্তু সেখানেও তো একই সমস্যা, মেয়েরা তো যেত না সেখানে পড়তে। মারিয়ার আগে কোনও মেয়ে তো ডাক্তারি পড়তে যাননি ফলে কীভাবে পড়াশোনা হবে তাই নিয়ে আবার একটা সমস্যা হল। ডাক্তারি যারা পড়তে যান, তাদের শরীরের নানা অঙ্গ চেনানোর ক্লাস হয়, তোমরা জানো। কিন্তু সেখানে অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে মারিয়াকে ক্লাস করতে দেওয়া হত না। সবার হয়ে যাওয়ার পর মারিয়া একা একা এইসব ক্লাস করতেন, এছাড়া আর খুব বেশি সমস্যা ছিল না। ভাবো একবার, একটা ঘরে মারিয়া একা আর সামনে একটা মৃতদেহ। মারিয়ার কিন্তু একটুও ভয় করত না। মেডিকাল কলেজে পড়ার সময় মারিয়া অনেক পুরস্কার পেয়েছিলেন এবং তাঁর ক্লাসে তিনি সবচেয়ে ভালো ছাত্রী ছিলেন।
এইভাবে ডাক্তারি পড়াও একদিন শেষ হল। এবার মারিয়া কোথায় যাবেন? দেশের একমাত্র মহিলা ডাক্তার তিনি, নিশ্চয়ই নিজের ডাক্তারখানা খুলে ডাক্তারি শুরু করলেন। না। মারিয়া এরপর একটা মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করলেন। এইখানে গিয়েই মারিয়ার একটা বিরাট উপলব্ধি হল, যার সুফল তোমরা বা তোমাদের বয়সি আরও অনেক বাচ্চারা পাচ্ছে।
মারিয়া দেখলেন, ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের এমনভাবে রাখা হয়েছে যেন তারা অসুস্থ। তারা হয়তো ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না বা ঠিকভাবে পড়াশোনা করতে পারে না বা নিজে নিজে খেতে পারে না, কিন্তু তাই বলে তো তারা অসুস্থ নয়। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনও তো চার বছর বয়স পর্যন্ত কথা বলতে পারতেন না, তাতে কি তাঁর বিজ্ঞানী হওয়া আটকেছে? আটকায়নি, সারা পৃথিবী ওঁকে একডাকে চেনে। তাছাড়াও, মারিয়া দেখলেন যে এখানে বাচ্চাদের খেলার একটা জিনিস নেই। তারা খেলত কী দিয়ে জানো? টেবিলের ওপর পড়ে থাকা খাবার দিয়ে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কেউই তো বাচ্চাদের দিকে সেভাবে নজরও দিত না, যত্নও নিত না। মারিয়ার এসব দেখে ভালো লাগল না।
উনি দেখলেন, এভাবে চলতে পারে না। বাচ্চাদের এভাবে রাখা যাবে না। তাদের আদর ভালোবাসা দিতে হবে, বিশেষভাবে যত্ন করতে হবে, তবেই তারা নতুন কিছু ভাবতে শিখবে। ‘আমরাও পারি’, এই বিশ্বাসটা আনা খুব দরকার।
ব্যস, যেমন ভাবা তেমন কাজ। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বাচ্চাদের বাবা-মা-রা তো তাদের সঙ্গে থাকত না, তাই মারিয়াই নিজে বাচ্চাদের সেই আদরটা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। উনি জানতেন যে আদর ভালোবাসা পেলে এরাও অনেককিছু শিখতে পারবে। মারিয়া ওদের নিজের হাতে খাওয়ানো থেকে শুরু করে, গান শোনানো, বাগানে নিয়ে গিয়ে খেলাধুলা করা… সব করতেন। এবং মজার ব্যাপার কী জানো, মারিয়া যেটা ভেবেছিলেন, সেটা একদম ঠিক ছিল।
বাচ্চারা আস্তে আস্তে ওঁর আদর যত্নে অনেকটাই পালটে গেল। তারা নাচত, গাইত, মারিয়ার তৈরি করা খেলার উপকরণগুলো নিয়ে খেলতে খেলতে শিখতেও থাকল অনেককিছু। আগে সবাই বদ্ধ ঘরে থাকত, মারিয়ার সঙ্গে থেকে তারা তাদের চারপাশের প্রকৃতিকেও চিনতে শিখল। গাছ, ফুল, ফল, পাখি, আকাশ বাচ্চাদের খুব কাছের হয়ে উঠল। মারিয়া বুঝতে পারলেন যে, তিনি যে পদ্ধতিতে পড়াচ্ছেন এই শিশুদের, সেই একই পদ্ধতিতে সমস্ত শিশুদেরই পড়ানো সম্ভব এবং এইভাবে তারাও খুব দ্রুত নিজেদের মতো করেই সমস্ত কিছু জানতে শিখতে পারবে। কিন্তু এইভাবে পড়াতে গেলে তো নিজেকে আলাদা একটা স্কুল করতে হবে, যেটা মারিয়ার নেই। কিন্তু করতে তো হবেই।
সুযোগ একটা হল, ইতালির সরকারই দিলেন। মারিয়াকে একটা স্কুল করার বন্দোবস্ত করে দিলেন। সান লোরেঞ্জোতে রাস্তার পাশে একটা বস্তি ছিল। মারিয়া করলেন কী, এই বস্তি থেকে ১-৬ বছর বয়সি ৬০ জন বাচ্চা নিয়ে রোমে একটা ফ্ল্যাটের মধ্যে ‘কাসা দে বাম্বিনি’ চালু করলেন। ‘কাসা দে বাম্বিনি’ মানে কী, বলো দেখি? এর মানে হল ‘ছোটদের বাড়ি’। তোমাদের মতো বয়সি বাচ্চারা, যাদের বড় স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সামর্থ্য নেই, তাদের জন্য ছিল এই স্কুল। এটা ১৯০৭ সালের ঘটনা। ক্লাসে কী থাকত জানো? টিচারের জন্য একটা টেবিল, একটা ব্ল্যাকবোর্ড, বাচ্চারা যাতে গোল করে বসতে পারে এরকম একটা টেবিল, ছোটদের বসার মতো কয়েকটা চেয়ার, একটা স্টোভ আর একটা আলমারি। এই আলমারির মধ্যে ছিল বাচ্চাদের পড়াশোনা করানোর হরেকরকম জিনিসপত্র, নানারকমের পাজল যা দিয়ে বাচ্চারা খুব তাড়াতাড়ি অনেক কিছু শিখতে পারবে। এর পরের বছর ইতালির মিলান শহরেও এরকম আরেকটি স্কুল চালু করেন।
মারিয়া একটা কাজ করেছিলেন, যেটা তার আগে আর কেউ বাচ্চাদের পড়ানোর ক্ষেত্রে করেননি। কী বলো তো? জানো না? বলছি। তোমরা অ আ ক খ বা A B C D, এইসব অক্ষর দিয়ে শব্দ তৈরি করেছ নিশ্চয়ই ছোটবেলায়… খাতায় বা স্লেটে লিখে নয়, কাঠের বা শক্ত বোর্ডের তৈরি অক্ষর দিয়ে… এই পদ্ধতিতে পড়ানো প্রথম চালু করেন মারিয়া মন্তেসরি।
এই প্রসঙ্গে আরেকজনের কথাও বলতে হবে, তাঁর নাম হেলেন কেলার।
হেলেন কেলারের নাম হয়তো তোমরা শুনেছ, স্কুলের ইংরেজি বইতে পড়েওছ হয়তো ওঁর কথা, উনি খুব ভালো বন্ধু ছিলেন মারিয়া মন্তেসরির। মারিয়াকে তাঁর মন্তেসরি স্কুলের পড়াশোনার জিনিসপত্র তৈরি করতে অনেক সাহায্য করেছিলেন। হেলেন কেলার যেহেতু নিজে দেখতে বা শুনতে পেতেন না, তাই তোমাদের বয়সি সেই সমস্ত শিশু যারা দেখতে বা শুনতে পায় না, তাদের পড়াশোনা করার জন্য অনেক সাহায্য করেছিলেন মারিয়া মন্তেসরিকে। এঁরা দুজনেই বিশ্বাস করতেন যে, যে কোনও জিনিস যদি দ্রুত এবং ভালোভাবে শিখতে হয়, তাহলে সবকটা ইন্দ্রিয়কে ব্যবহার করতে হবে। এবার বলো, ইন্দ্রিয় কী? আমাদের পাঁচটা অঙ্গ, পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের কাজ করে। চোখ দিয়ে দেখি, কান দিয়ে শুনি, নাক দিয়ে গন্ধ পাই, জিভ দিয়ে স্বাদ বুঝতে পারি আর যে কোনও জিনিস স্পর্শ করে বা ধরে বুঝতে সাহায্য করে চামড়া বা ত্বক। যারা চোখে দেখতে পায় না বা কানে শুনতে পায় না, তারা কাঠের বা বোর্ডের তৈরি অক্ষর বা অন্যান্য আকৃতির জিনিস ছুঁয়ে ছুঁয়ে সবকিছু চিনতে শিখত। আবার, যাদের এইসব সমস্যা ছিল না, তারাও এই একই পদ্ধতিতেই পড়ত। সবার জন্য এক নিয়ম। মারিয়া ঈশপের গল্প শুনিয়ে কোনটা ঠিক কোনটা ভুল বোঝাতেন, ঘুরে বেড়ানোর গল্প শুনিয়ে পৃথিবীর নানা দেশ চেনাতেন, রূপকথার গল্প বলতেন, ফুল, পাখি, প্রজাপতির গল্প বলে ছোটদের নানা কিছু শেখানোর চেষ্টা করতেন। ছোটরাও শিখতে খুব আনন্দ পেত, তাদের আর পড়াশোনা করতে বিরক্ত লাগত না। এইভাবেই মারিয়া মন্তেসরির এই স্কুলের কথা আস্তে আস্তে ইউরোপ, আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
১৯১২ সালে মারিয়া মন্তেসরি প্রথমবারের জন্য আমেরিকায় যান। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন, টেলিফোন আবিষ্কার করেছিলেন যিনি সেই আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল, বালবের আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসন, ফোর্ড গাড়ি কোম্পানির মালিক হেনরি ফোর্ডের মতো বিখ্যাত মানুষ সবাই মারিয়ার কাজের প্রচুর প্রশংসা করলেন।
মন্তেসরি স্কুলের কথা আস্তে আস্তে আরও ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বছর তিনেক পর ১৯১৫ সালে আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকো শহরে একটা মেলা হয়, সেখানে মারিয়া একটা মন্তেসরি ক্লাসের ব্যবস্থা করেন যেটার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘গ্লাস হাউস মন্তেসরি ক্লাস’। একটা বিরাট বড় জায়গায় একটা বড় ঘর, যার চারদিকে কাঁচের জানলা যাতে বাইরে থেকে সবাই দেখতে পায় যে ভেতরে কী হচ্ছে আর ভেতরের থাকা ছাত্র-ছাত্রীরাও যেন বাইরের মানুষজনদের দেখতে পায়। বাইরে থেকে সবাই এসে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে থাকল ক্লাসের ভেতরের কাজকর্ম, কিন্তু ক্লাসে বসে থাকা বাচ্চারা তাদের নিজেদের মতো করে পড়াশোনা চালিয়ে গেল।
এরপর কী হল জানো? মারিয়া দু-দুটো সোনার মেডেল পেলেন এই ক্লাসের জন্য। সবার মনে ধরে এইভাবে পড়ানোর ব্যাপারটা। এর পরের দশ বছরের মধ্যে গোটা আমেরিকা জুড়ে হাজারখানেকেরও বেশি মন্তেসরি স্কুল চালু হয়ে গেল।
অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তি আবার নিজেরাই মন্তেসরি স্কুল চালু করে ফেললেন। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল তাঁর নাতি-নাতনিদের জন্য একটা মন্তেসরি স্কুল শুরু করেছিলেন। এমনকী আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের স্ত্রী, এলেনর রুজভেল্টও একটা মন্তেসরি স্কুল চালু করেছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মারিয়া ইতালি ছেড়ে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হন। বেশ কিছুদিন ছিলেন এখানে। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তোমাদের বয়সি বাচ্চাদের কীভাবে পড়াশোনা করানো যায়, তা নিয়ে বহু আলোচনাও করেছেন। তোমরাই তো প্রত্যেক দেশের ভবিষ্যত, তাই তোমাদের শিক্ষা যে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ এবং শান্তির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটা উনি বুঝতেন। সেটা বুঝেই উনি ‘শান্তির জন্য শিক্ষা’ নামে একটা প্রকল্প চালু করেন। আমাদের এখানে যেরকম ‘সর্বশিক্ষা অভিযান’ নামে প্রকল্প চালু আছে যাতে সকলে শিক্ষা পায়, সেরকমই অনেকটা। এবং এই কাজের জন্য মারিয়া মন্তেসরিকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কথাও ভাবা হয়। একবার দু-বার নয়, তিন-তিনবার মারিয়ার নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য ভাবা হলেও পুরস্কার তিনি পাননি। তবে আমাদের সত্যজিৎ রায়ের মতো তিনিও ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছিলেন।
তোমরা ভাবছ, মন্তেসরি স্কুলে শুধু তোমরাই পড়েছ? একদমই না। যদি শোনো কারা কারা এই স্কুলে পড়েছেন, তোমরা অবাক হয়ে যাবে। ব্রিটেনের যুবরাজ প্রিন্স উইলিয়াম, ফ্রান্সের একসময়ের রাষ্ট্রপতি ফ্রাঁসোয়া মিত্তের, আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টন, গুগল তৈরি করেছেন যাঁরা সেই সের্গেই ব্রিন আর ল্যারি পেজ, অ্যামাজন থেকে যে আমরা জিনিস কিনি তার মালিক জেফ বেজোস… এঁরা সবাই সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মন্তেসরি স্কুলগুলোতে পড়াশোনা করেছেন। এমনকী, ‘অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরি’ যারা পড়েছ বা পড়বে, তারা জানতে পারবে যে, হিটলারের অত্যাচারে অ্যানার গোটা পরিবার লুকিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত অ্যানা মন্তেসরি স্কুলেই লেখাপড়া করেছেন।
এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে মন্তেসরি স্কুল কতোগুলো আছে জানো? প্রায় ২৩ হাজারেরও বেশি মন্তেসরি স্কুল পৃথিবীর ১১৫টা দেশে ছড়িয়ে আছে। তাঁর বইয়ের অনুবাদও হয়েছে পৃথিবীর প্রায় ২০টা ভাষায়। ইতালির ১০০০ লিরার নোটে যে মারিয়ার ছবি ছাপা আছে, সেটা তো আগেই তোমাদের বললাম। নোটের সামনের দিকে মারিয়া মন্তেসরির ছবি আর পেছনে ওঁরই তৈরি স্কুলের একটি ক্লাসরুমের ছবি যেখানে শিক্ষক আর বাচ্চারা বসে পড়াশোনা করছে। এটা অবশ্য ফটোগ্রাফ নয়, হাতে আঁকা একটা ছবি যেটা এঁকেছিলেন আর্মান্দো স্পেদিনি। ছবিটার নাম ‘বাম্বিনি আল্লো স্তুদিও’ বা ‘বাচ্চারা পড়াশোনা করছে’।
মারিয়া মন্তেসরি তাঁর জীবনে অনেক সম্মান পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর দেশের টাকায় তাঁর ছবি রেখে ইতালির সরকার যে সম্মান তাঁকে দিয়েছে, সেটাও কি কিছু কম?
Leave a Reply