ক্ষমতার স্বাদ প্রসেনজিত দাশগুপ্ত Isaac Asimov

[Isaac Asimov-এর ছোটগল্প The Feeling of Power অনুসরণে]

 

 

জেনেরাল উইডার হতভম্ব হয়ে বললেন, “এও কি সম্ভব? আপনি যা বলছেন তা কি ভেবেচিন্তে বলছেন প্রফেসর জেহান?”

কথা হচ্ছিল পেন্টাগনের স্পেশ্যাল লাউঞ্জে, উনত্রিশ তলায়। হ্যাঁ, এই ৫১১৭ সালে সেই পেন্টাগন আর পাঁচতলা বিল্ডিং নেই। আন্তঃগ্রাহিক মহাযুদ্ধ শুরু

হওয়ার পরে এই মুহূর্তে পৃথিবীর প্রধান নিরাপত্তা কার্যালয় যে আড়ে বহরে আরও বাড়বে, সেটাই স্বাভাবিক।

প্রফেসর জেহান খুবই আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দিলেন, “কই হে, এদিকে এসো। স্যার, ইনিই হলেন সেই ব্যক্তি। মেইরন আউব।”

আউব এগিয়ে এসে খুবই কুণ্ঠার সাথে জেনেরাল উইডার এবং স্যার ব্র্যান্টের সাথে করমর্দন করল। উইডার পৃথিবীর সামরিক বিভাগের সর্বাধিনায়ক। স্যার ব্র্যান্ট প্রতিরক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী। আউব এর আগে কখনও এত উচ্চপদস্থ হর্তাকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেনি। সে কিছুটা স্নায়বিক চাপ অনুভব করছিল।
প্রফেসর জেহানের অবশ্য তেমন কোনও হেলদোল নেই। তিনি একজন বৈজ্ঞানিক, অঙ্কবিদ এবং সামরিক বিভাগের সেলফ ডিরেক্টিং যুদ্ধাস্ত্র দপ্তরের কর্মকর্তাও বটে। তাঁকে প্রায়ই এঁদের সাথে মিটিং করতে হয়!

“জেনেরাল উইডার!” জেহান একটু আগে বলা কথাটাই আবার কেটে কেটে উচ্চারণ করলেন, “আউব কোনও যন্ত্রগণকের সাহায্য ছাড়াই গণনা করতে পারে!”

স্যার ব্র্যান্ট এবারে একটু নড়েচড়ে বসলেন। “কম্পিউটারের সাহায্য ছাড়াই কম্পিউটিং? এরকম হয় নাকি?”

জেহান উত্তর না দিয়ে আউবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “নয়-এর সাথে সাত গুণ করলে কত হয় বলো দেখি?”

আউব একটু ইতস্তত করে বলল, “তেষট্টি।”

স্যার ব্র্যান্ট টেবিলের ওপরে রাখা ডিভাইসটা তুলে দ্রুত আঙুল চালালেন। “মাই গড! হি ইজ রাইট! কিন্তু জেহান, এর মধ্যে কি বিশেষত্ব তুমি পেলে? একজন যে প্রায় নিখুঁত আন্দাজ করতে পারে? এই তো?”

“একদমই তা নয় স্যার। বরং তার থেকে অনেকটাই বেশি। আউব এর থেকেও জটিল অঙ্ক করতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে ওর একটা কাগজ লাগবে, হিসেব করার জন্য।”

“মানে তুমি বলতে চাও একটা কাগজের তৈরি কম্পিউটার?” স্যার ব্র্যান্ট ঘাবড়ে গিয়ে বললেন।

“না না, কাগজের কম্পিউটার নয়! সিমপ্লি আ পিস অফ পেপার। আচ্ছা আপনি যে কোনও একটা সংখ্যা বলুন।”

“সতেরো।”

“জেনেরাল, আপনিও বলুন।”

“তেইশ।”

জেহান আউবের দিকে তাকালেন।

আউব ইঙ্গিতটা বুঝে নিয়ে পকেট থেকে একটা নোটপ্যাড আর পেন্সিল বার করল। তার হাত অল্প অল্প কাঁপছিল। সে তেইশ আর সতেরো গুণ করতে শুরু করল। মিনিট পাঁচেক পরে মাথা তুলে বলল, তিনশ একানব্বই!

“একদম ঠিক!” স্যার ব্র্যান্ট প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন। “তুমি কি পদ্ধতিটা ব্যাখ্যা করতে পারবে?”

“নিশ্চয়ই স্যার।” আউব এতক্ষণে কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। এই দেখুন ১৭ লিখলাম, আর তার নিচে তেইশ লিখলাম। এবারে প্রথমে তিন এর সাথে সাত গুণ করছি…”

“কিন্তু তিন-এর সাথে সাত গুণ করলে কী করে হবে? তোমাকে তো ১৭-এর সাথে ২৩ গুণ করতে বলা হয়েছে।”

“হ্যাঁ স্যার, তা জানি। কিন্তু এইভাবেই হিসেব করলে সুবিধা হবে। এখন দেখুন তিন-এর সাথে সাত গুণ করলে হয় একুশ।”

“এটাই বা তুমি কী করে জানলে?” জেনেরাল উইডারও উত্তেজিত হয়ে কখন যেন নিজের চেয়ার থেকে উঠে এসেছেন। তিনি আউবের ছোট্ট নোটপ্যাডটার ওপরে প্রায় ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন।

আউব একটু থমকে গেল। “মানে, সেটা স্যার আমি কম্পিউটার থেকেই শিখেছি। সাত আর তিন গুণ করলে সবসময় একুশই হয়!”

“ওকে, ক্যারি অন।”

“তাহলে সাত আর তিন গুণ করলে হয় ২১, আর ৩-এর সাথে ১ গুণ করলে হয় ৩। এখন এই ২১-এর ২-এর নিচে আমি ৩ লিখলাম।”

“কিন্তু ২-এর নিচেই বা লিখলে কেন? ২১-এর ১-এর নিচেও তো লিখতে পারতে!”

“মানে মানে…” এবারে আউব একটু অসহায় বোধ করল। “এটার কারণ বলা কঠিন, মানে এটা তো এভাবেই…”

প্রফেসর জেহান এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন। এবারে আর হস্তক্ষেপ না করে পারলেন না। “স্যার ব্র্যান্ট, আমার মনে হয় এই পদ্ধতিটা সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ করতে আরও একটু সময় লাগবে। আপনি যদি আগ্রহী হন, তাহলে আমরা কয়েকজন অঙ্কবিদদের নিয়ে একটা টিম বানিয়ে নিতে পারি। কিন্তু আপাতত আউব ওর বক্তব্য শেষ করুক।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। বলো, আউব।” ব্র্যান্ট চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন।

“৩ আর ২ যোগ করলে হয় ৫। তাহলে সব মিলিয়ে হল ৫১। এবারে একইরকমভাবে ২-এর সাথে ৭ গুণ করলে হয় ১৪, আর ২-এর সাথে ১ গুণ করলে হয় ২। তাহলে আমরা পেলাম ৩৪। এখন ৫১ এর বাঁদিকে ৩৪ বসিয়ে যোগ করলেই পেয়ে যাব ৩৯১!”

কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা নেমে এল উনত্রিশ তলার মন্ত্রণাকক্ষে। সবার প্রথমে কথা বলে উঠলেন উইডার, “আমি এটা বিশ্বাস করতে পারলাম না। প্রফেসর জেহান, আউব কিছু সংখ্যা নিয়ে কৌশল দেখাল, ইচ্ছামতো যোগ, বিয়োগ, গুণ করে উত্তর মিলিয়ে দিল ঠিকই। কিন্তু এই পদ্ধতি বিশ্বাসযোগ্য নয়।”

“উইথ ডিউ রেসপেক্ট, জেনেরাল, আমার কিন্তু এই পদ্ধতি সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্যই মনে হয়েছে। আর আউব যে কোনও সংখ্যা নিয়েই এই গণনা করতে পারবে।” প্রফেসর জেহান দৃঢ়স্বরে বললেন।

“আচ্ছা তাই? যে কোনও সংখ্যা? তাহলে আউব, তুমি ৫৭৩৮-এর সাথে ৭২৩৯ গুণ করে দেখাও তো!” জেনেরাল চ্যালেঞ্জের সুরে বললেন।

আউব আরেকটা কাগজ টেনে নিল। পুরো কুড়ি মিনিট পরে জেনেরালের দিকে তাকিয়ে বলল, “৪১৫৩৭৩৮২”।

জেনেরালের মুখে কথা সরল না। ফিসফিস করে কোনওক্রমে বললেন, “মাই গড! হি ইজ রাইট!”

 

 

আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা সদর দপ্তরে বসে প্রেসিডেন্ট সেই প্রশ্নটাই করলেন, যেটা ব্র্যান্ট জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কম্পিউটারের সাহায্য ছাড়াই কম্পিউটিং? এরকম হয় নাকি?”

“কেন নয় মিস্টার প্রেসিডেন্ট? গণনা তো একটা পদ্ধতি মাত্র। যেটা কোনও মেশিন করে থাকে আজকাল। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্কও তো একটা উন্নত মেশিন, নয় কি? আপনাকে কয়েকটা উদাহরণ দিই না হয়।” ব্র্যান্ট কিছু যোগ, গুণ, ভাগ, বিয়োগ ইত্যাদি করে দেখালেন। আউবের থেকে সেদিন পদ্ধতি কিছুটা বুঝে নিয়েছিলেন। সপ্তাহখানেক অভ্যাস করতেই গোটাটা শিখে ফেলেছেন। ব্যাপারটা এমন কিছু কঠিন নয়, প্রথম দেখাতে যা মনে হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট যারপরনাই অবাক হচ্ছিলেন। “এই পদ্ধতি কি সবসময় কাজ করবে?”

“অবশ্যই। এটা ১০০ শতাংশ নিখুঁত। এবং এটা শিখতেও বেশি সময় লাগে না।”

“ওকে। খুবই ভালো কথা।” প্রেসিডেন্ট টেবিলের ড্রয়ার থেকে পাইপ বের করলেন। টোব্যাকোর পাউচ থেকে তাতে টোব্যাকো ভরে অগ্নিসংযোগ করে বললেন, “কিন্তু এটাকে আমার একটা খুবই ইন্টারেস্টিং ম্যাথ গেম বলেই মনে হচ্ছে। আর আপনি চাইছেন আমরা একটা প্রোজেক্ট শুরু করি হিউম্যান কম্পিউটেশন নিয়ে। কিন্তু এর প্রয়োজনীয়তা কোথায়?”

ব্র্যান্ট সামনে রাখা জলের গ্লাস থেকে একটু জল খেলেন। তিনি এই প্রজেক্টের ফলাফল সম্পর্কে যথেষ্ট গবেষণা করেই এসেছেন। সামান্য গুছিয়ে নিয়ে শুরু করলেন।

“মিস্টার প্রেসিডেন্ট, এই মুহূর্তে আমাদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ কী? ডেনেবিয়ান ওয়ার, তাই তো?”
প্রেসিডেন্ট শান্তভাবে ব্র্যান্টের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সামনে সবথেকে বড় পরীক্ষা এই ডেনেবিয়ান যুদ্ধ। আকাশগঙ্গার উত্তরদিকের নক্ষত্রপুঞ্জ সিগনাসের ডেনেব সৌরজগতের সঙ্গে যুদ্ধ বিগত প্রায় পাঁচ দশক ধরে চলছে। প্রথমদিকে পাল্লা পৃথিবীর দিকেই ভারী ছিল। কিন্তু ডেনেবরা শেষ দশ-পনেরো বছরে যন্ত্রগণনা এবং রোবটিক্সে এতটা উন্নতি করে ফেলেছে যে, পৃথিবীর পক্ষে ক্রমে ক্রমে কাজটা কঠিন হয়েই যাচ্ছে।

এইভাবেই চললে…

“মিস্টার প্রেসিডেন্ট!”

প্রেসিডেন্টের ভাবনায় ছেদ পড়ল। “হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন মিস্টার ব্র্যান্ট। অবশ্যই ডেনেবিয়ান ওয়ারই এখন আমাদের প্রধান মাথাব্যথার কারণ।”

“আপনি তো জানেনই, ডেনেবিয়ান ওয়ার এখন কম্পিউটার বনান কম্পিউটার হয়ে দাঁড়িয়েছে।” ব্র্যান্ট আবার বলতে শুরু করলেন। “ডেনেবদের সুপার কম্পিউটার একটা আত্মরক্ষা বর্ম তৈরি করে রেখেছে, যেটা আমাদের গাইডেড মিসাইলগুলোর প্রতিযোগী মিসাইল তৈরি করতে সক্ষম। আমরা যতই আমাদের মিসাইলগুলোর কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে নিতে থাকি, ওরাও পালটা ওদেরটা বাড়িয়ে নেয়। অন্তত আগামী পাঁচ বছরে এই সমস্যার কোনও আশু সমাধান নেই বলেই মনে হয়। আর এইখানেই হিউম্যান কম্পিউটিং আমাদের কাজে আসতে পারে।”

“কীভাবে?”

“আমাদের কাছে এমন একটা টেকনিক আসতে চলছে, যেটা কম্পিউটারের গণনার থেকে আলাদা রকম হবে। আমরা কম্পিউটারের নির্দিষ্ট কিছু থিয়োরির বাইরে বেরিয়ে মানুষকে নিয়োগ করতে চাইছি। আমরা সমস্ত যান্ত্রিক গণনাকে মানুষের চিন্তাভাবনা, কল্পনা দিয়ে পরিমার্জিত করব। এবং আমার ধারণা এইভাবে আমরা যে কোন সুপার কম্পিউটারের সমপরিমাণ বুদ্ধিমত্তা অনায়াসেই পেয়ে যেতে পারব। যদিও এখনই সমস্ত ফলাফল প্রেডিক্ট করা সম্ভব নয়, কিন্তু ডেনেবদের সাথে যুদ্ধে আমরা অবশ্যই এগিয়ে যাব, কারণ ডেনেব শাসনকর্তারা মানুষ নয়, রোবট!”

প্রেসিডেন্টকে দৃশ্যতই হতচকিত লাগছিল। “আপনি আমার থেকে ঠিক কী এক্সপেক্ট করছেন, মিস্টার ব্র্যান্ট?”

“আমি চাই আপনি এই বিষয়ে গোপনে আরও গবেষণা করার জন্য আমাদের অনুমতি দিন। গোপনে, কারণ ফলাফল কতটা সুদূরপ্রসারী হতে পারে, সেই নিয়ে আমাদের এখনও কোনও ধারণা নেই। ফলাফল আশাব্যঞ্জক হলে আমরা এই প্রকল্প সর্বসমক্ষে আনব। আপনার অনুমতি পেলেই আমরা একটা কমিটি তৈরি করে বৈজ্ঞানিকদের নিয়োগ করতে শুরু করব।”

“কিন্তু মানুষের গণনা করার ক্ষমতাই বা কতটা?”

“অসীম! মানুষের গণনা শক্তি বোঝার মতো কোনও কম্পিউটার নেই। অন্তত প্রফেসর জেহানের মতে। যিনি প্রথম এই আবিষ্কার সম্পর্কে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মতে এমন কোনও গণনা নেই যা কম্পিউটার পারে, কিন্তু মানুষ পারে না।”

“হুম, যদি প্রফেসর জেহান বলে থাকেন, তাহলে আমি আর আপত্তির কারণ দেখি না। কিন্তু একটা কম্পিউটার কী পারে না-পারে সেটা একজন মানুষের পক্ষে কি বোঝা সম্ভব?”

ব্র্যান্ট হাসলেন। “মিস্টার প্রেসিডেন্ট, এককালে তো মানুষই কম্পিউটার বানাত। অবশ্য খুবই প্রাথমিক স্তরের কম্পিউটার সেগুলো। দুই-তিন হাজার বছর আগে ওসব ব্যবহার হত। তারপর ধীরে ধীরে কম্পিউটার দিয়েই কম্পিউটার বানানো হতে লাগল।”

প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়ালেন। “ওকে, মিস্টার ব্র্যান্ট। গো অ্যাহেড। আমার দিক থেকে সমস্ত সাহায্য আপনি পাবেন। আর হ্যাঁ, ওই প্রযুক্তিবিদের নামটা কী যেন বলেছিলেন? আউব, না? ওকেও একটা প্রমোশন দিয়ে নতুন টিমে নিয়ে নিন।”

“সিওর মিস্টার প্রেসিডেন্ট। থ্যাঙ্কস আ লট!”

“আর এই প্রকল্পের নাম কিছু ঠিক করেছেন কি?”

“মানব-গণক!” ব্র্যান্ট হেসে বললেন।

 

 

আউব খুবই মনমরা হয়ে ডেস্কে বসেছিল। মানব-গণক প্রজেক্টে প্রায় সাত-আট মাস হয়ে গেল তার। আশাতীত সাফল্য পাওয়া গেছে। কিন্তু তবুও তার মন ভালো না থাকার অনেক কারণ আছে। প্রকল্পের বাকি বৈজ্ঞানিকরা তাকে খুব একটা পাত্তা দেন না। তাকে সেরকম কোনও কাজও দেওয়া হয় না। তার বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাকি বৈজ্ঞানিকরা হাবেভাবে সবসময়ই বুঝিয়ে দেন যে, সে একজন প্রযুক্তিবিদ মাত্র। বরাতজোরে বৈজ্ঞানিকদের সাথে কাজ করার যে সুযোগ পেয়েছে, এতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। অবশ্য প্রফেসর জেহান তাকে খুবই স্নেহ করেন। তাঁর জন্যই সে এখনও এখানে পড়ে আছে। নইলে হয়তো অন্য কোথাও চাকরির চেষ্টা করত। কিন্তু ইদানীং প্রফেসরকেও তার একটু অচেনা মনে হয়। সে তো এই হিউম্যান কম্পিউটিং এমনিই শুরু করেছিল। প্রফেসরও বুঝিয়েছিলেন এটা নিয়ে গবেষণা করলে মনুষ্যজাতিরই লাভ হবে। কিন্তু এখন যেন মনে হয় কোথাও একটা ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। যা হচ্ছে, ঠিক হচ্ছে না। দেখা যাক, আজ প্রেসিডেন্ট এই প্রকল্পকে জনসাধারণের সামনে আনতে চলেছেন। সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। পৃথিবীবাসীকে অবগত করা হবে নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে। হয়তো একটু তাড়াহুড়ো করেই ঘোষণা করা হচ্ছে, কিন্তু সামনেই ভোট! সেটাও তো ভাবতে হবে! আউব নিজের মনেই হেসে উঠল।

“আরে আউব, তুমি এখনও এখানে কী করছ? কনফারেন্স রুমে চলো। প্রেসিডেন্ট এখনই এসে পড়বেন!” প্রফেসর এসে তাড়া দিলেন।

“চলুন স্যার, যাওয়া যাক।”

কনফারেন্স রুম কানায় কানায় ভর্তি। প্রেসিডেন্ট ততক্ষণে চলে এসেছেন। তাঁর বক্তৃতা শুরুও হয়ে গেছে।

“…আমাদের লক্ষ্য খুব পরিষ্কার। কম্পিউটারকে প্রতিস্থাপন করা মানুষ দিয়ে। একটি মনুষ্যচালিত মহাকাশযান আমরা পাঁচভাগের একভাগ সময়ে বানাতে পারব এবং এতে খরচও হবে কম্পিউটারচালিত মহাকাশযানের দশ ভাগের এক ভাগ। আমরা এইভাবে ডেনেবদের থেকে পাঁচগুণ, দশগুণ বেশি মহাকাশযান বানাতে পারব এবং মনুষ্যচালিত বলে ডেনেবরা সেগুলো কীভাবে কাজ করবে, তা আন্দাজ করতেও পারবে না।

“শুধু তাই নয়! আমরা আরও কিছু প্ল্যান করছি, যা আমাদের চূড়ান্ত উৎকর্ষের দিকে নিয়ে যাবে। আমরা মনুষ্যচালিত গাইডেড মিসাইল বানাতে চলেছি!”
কনফারেন্স রুমে একটা হালকা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। আউব অবিশ্বাসভরে তাকিয়ে ছিল প্রেসিডেন্টের দিকে। সে যা শুনছে, তা কি সত্যি!
ওদিকে প্রেসিডেন্ট বলেই চলেছেন।

“হ্যাঁ বন্ধুরা! আমাদের সামরিক কর্মকর্তাদের মতে, কম্পিউটারচালিত মিসাইল সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন। কম্পিউটারের এঁকে দেওয়া পথেই তা পরিচালিত হয়। তাই যে কোনও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টি মিসাইলের পক্ষে তার যাত্রাপথ নির্ণয় করা মোটেই কঠিন হয়ে দাঁড়ায় না। খুব কম সংখ্যক মিসাইলই ডেনেবদের অ্যান্টি মিসাইলকে ফাঁকি দিতে পারে এবং তা এতই নগণ্য যে, যুদ্ধে তার প্রভাবই পড়ে না। অপরদিকে মনুষ্যচালিত মিসাইল যে হালকা হবে তাই নয়, বেশি বুদ্ধিমত্তাসম্পন্নও হবে। যেহেতু চালকই তার গতিপথ নির্ণয় করবে, তাই অ্যান্টি মিসাইলের পক্ষে তার যাত্রাপথের নিখুঁত নির্ণয় করা সম্ভবই হবে না! শুধু তাই নয়, যদিও বা অ্যান্টি মিসাইল সেটা করতে সক্ষমও হয়, তাহলেও আমাদের খুবই নগণ্য পরিমাণ ক্ষতি হবে। কারণ আপনারা জানেনই, একজন বা দুজন মানুষের থেকে একটা সম্পূর্ণ কম্পিউটার চালিত মহাকাশযান বানানোর খরচা কত বেশি! মনুষ্যচালিত মিসাইল আমরা যত খুশি বানাতেও পারব, কারণ মানুষের অভাব কোনওদিনই হবে না…”

প্রেসিডেন্ট আরও বলতে লাগলেন, কিন্তু আউব আর শুনতে পারল না। সে ছুটতে ছুটতে নিজের ডেস্কে এসে কেঁদে ফেলল। যখন সে এই গণনার চর্চা শুরু করেছিল, তখন এটা তার কাছে নিতান্তই খেলা ছিল। যখন এই প্রজেক্ট শুরু হল, তখনও শত অসুবিধা সত্ত্বেও সে নিজেকে এটা বলেই অনুপ্রাণিত করত যে, বহু হাজার বছর আগে তার পূর্বপুরুষরা যেভাবে গণনা করত, সেও সেইভাবেই অগ্রসর হচ্ছে। তখন তো পৃথিবী কত সুন্দর ছিল! সেই দিন হয়তো আবার ফিরে আসবে! কিন্তু আজ প্রেসিডেন্ট কি ইঙ্গিত দিলেন? তার অধীত বিদ্যা মানবজাতির কল্যাণে ব্যয় হচ্ছে না। শুধু মৃত্যু এবং ধ্বংসেই কি এর ব্যবহার হবে? সে পায়ে পায়ে চৌত্রিশ তলার খোলা ব্যালকনিটায় এসে দাঁড়াল।

 

 

মেইরন আউবের কবরের পাশে সবাই দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রেসিডেন্টও এসেছেন তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। সামান্য একজন প্রযুক্তিবিদ হয়েও সে যা আবিষ্কার করেছে তার জন্য এটুকু সম্মান তো তার প্রাপ্য!

অনেকে নিচুস্বরে আউবকে নিয়ে কথা বলছিলেন। তার আত্মহত্যাটা অপ্রত্যাশিত ঠিকই, কিন্তু ইদানীং তাকে একটু অন্যমনস্ক লাগত না? কোনও হতাশায় কি ভুগছিল সে…

প্রফেসর জেহান আউবের সমাধিতে ফুলের তোড়াটা রেখে পিছিয়ে এলেন। লোকটা যা কাজ করে গেল, ইতিহাস ওকে মনে রাখবে! দেখা যাক মনুষ্যচালিত মিসাইল তৈরি করা সম্ভব হয় কিনা! তিনি মনে মনে ৯ এবং ৭ গুণ করলেন। অস্ফুটে বললেন, “তেষট্টি! এই গণনা আমি এখন নিজে নিজেই করতে পারি। আমার কম্পিউটারের দরকার হয় না!”

এই অনাস্বাদিত ক্ষমতার স্বাদটা তিনি উপভোগ করছিলেন। তাঁর চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

 

ছবি – সুমিত রায়

গল্পটি টগবগ কল্পবিজ্ঞান সংখ্যা ১৪২৪-এ প্রকাশিত

Isaac Asimov

Isaac Asimov

Isaac Asimov (২ জানুয়ারি ১৯২০ – ৬ এপ্রিল ১৯৯২) ছিলেন রাশিয়ান বংশোদ্ভুত এবং রাশিয়ায় জন্মগ্রহণকারী প্রখ্যাত মার্কিন লেখক এবং জৈব রসায়নের অধ্যাপক। তিনি মূলত বিজ্ঞান কল্পকাহিনি এবং জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন এবং এক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য গগনচুম্বী। যোগ্যতা বিবেচনায় তাঁকে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির গ্র্যান্ড মাস্টার আখ্যায় ভূষিত করা হয়েছে। তিনি জীবনে ৫০০-রও অধিক গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেছেন, লিখেছেন প্রায় ৯,০০০ চিঠি ও পোস্টকার্ড। আসিমভের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ রচনা হল ‘ফাউন্ডেশন সিরিজ’। তাঁর অন্যান্য প্রধান সিরিজের মধ্যে রয়েছে ‘গ্যালাক্টিক সাম্রাজ্য সিরিজ’ এবং ‘রোবট সিরিজ’। তাঁর অসংখ্য ছোটগল্পের মধ্যে ‘নাইটফল’ গল্পটি ১৯৬৪ সালে সাইন্স ফিকশন রাইটার্স অফ আমেরিকা কর্তৃক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান কল্পকাহিনি শীর্ষক ছোটগল্পের সম্মানে ভূষিত হয়। ৫০২০ আসিমভ নামক গ্রহাণু, আসিমভস্‌ সায়েন্স ফিকশন নামক সাময়িকী এবং আইজাক আসিমভ পুরস্কার নামে একাধিক পুরস্কারের মাধ্যমে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে।

চিত্রসূত্র – উইকিপিডিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published.